ঘুমতালিকার দ্বিতীয় বোতাম
প্রথমটি খসে পড়েছে অনেক আগেই। আমি যখন তৃতীয় বোতামটি
তালাশ করছিলাম, তখনই দুচোখ জুড়ে নেমেছিল বৃষ্টিঘুম। বেশ দীর্ঘ
হয়েছিল রাততালিকা। আর এই গ্রীষ্মাকাশে তারা উড়াবে বলে, ক’টি
পাখি আমার সাথে ধরেছিল বাজি। হারা-জেতার ভয় না করেই।
রাত মানেই ঘুম। ঘুম মানেই রাত। এই বিনম্র শর্তাবলি অস্বীকার
ওরা আমাকে খুব ইচ্ছে মতো পেটালো,
হাত পা বেধে, চোখে কালো পট্টি লাগিয়ে
এতটা প্রহার করলো,
আমি আর কিছুই বলতে পারলাম না।
‘ সমাজ পরিবর্তন চাও শ্লা ‘
এই চেচামেচি পর্যন্তই মনে ছিল আমার।
তারও আগে,
‘সমাজ কি তোর বাপের’ বলে কালো লাঠি
হাতে যে লোকটি আমার চোয়ালে প্রথম
আঘাত করেছিল,
তার মুখছবি মনে
যে দেশে বাঘের খাদ্য চুরি হয়ে যায়
আমাদের চিড়িয়াখানায় আজ যে পশুগুলো আছে,
তাদের সেখানে থাকার কথা ছিল না।
কথা ছিল, সেখানে থাকবে মানুষরূপী কিছু পশু,
যারা দখল করে নিচ্ছে, আমাদের বন-জঙ্গল,বৃক্ষ
নদী,পার্কের সবুজ কিংবা প্রজন্মের উজ্জ্বল পাঁজর।
আমাদের রক্তশূন্যতাপর্ব শেষ হয়েছে বেশ আগেই-
এখন ক্ষয় হচ্ছে হাড়,চোয়াল, দাঁত এমনকি
চোখের জ্যোতি।
মূলত আত্মকাহিনি বলে কিছু নেই
পিতা বলতেন, সব কথার জবাব দিতে নেই। আমি,
তারপরও কালো ছাতা টাঙিয়ে আটকে দিতাম
আষাঢ়ের ঝাপ্টা, হাতের লাল লাঠি দিয়ে, ঠেকাতে
চাইতাম সর্পের উদ্যত ফণা, শৃগালের মৌসুমি উৎপাত।
পিতা বলতেন, এঁকে রাখো সূর্যের ধৈর্যপেশী। এবং
লিখো জ্যোতির্ময় চন্দ্রের সবকটি প্রতিনাম।
তারপরও আমি আঁকাআঁকি ভুলে গিয়ে পাল্লা
অন্যদিন ধূসর পাহাড়ে
এখানে কোনো সবুজই থাকবে না-
এখানে থাকবে না কোনো আগুন,
আগুনের উত্তাপ,
মানুষের প্রেম,
চুমুর দৃশ্য,
সবুজের আলিঙ্গন,
থাকবে না হাত ধরে গারো মেয়েদের মিছিল।
কিছুই থাকবে না অবশেষে। একটি আলখেল্লা
শুধুই হাত বুলাতে বুলাতে দখল করে নেবে সব
হ্যাঁ- সব।
শিশুদের হস্তরেখা, গাভীর ওলানের দুধ,
বনফুলের পরাগ, যাত্রীর বাইসাইকেল
ফেরিঅলা’র হাতের সংবাদপত্র
সাংবাদিকের হাতের
একটি আধুনিক গান।। আপন মনে পৃথিবীর ছবি
আপন মনে পৃথিবীর ছবি আঁকতে হয়তো চাইনি
তাই বলেই মেঘের ছায়ায় নিশীতে হারিয়ে যাইনি।
** হারিয়ে যাওয়ার সাধনা জীবনে
সবাই হয়তো পারে না,
রাগ-সংরাগে ডুবার অসুখ
সকল ওষুধে সারে না,
সেজন্যেই আগুনের দিকে তাকাবার সাহস পাইনি।।
** ছবি আঁকে যারা তারা তো পারে না
নিজের ছবি
আমার আবিষ্কারের তালিকা
একটি ভাঙা বেহালার কয়েক টুকরো তার এবং
কিছু খড়িমাটি দিয়ে একটি গম্বুজ বানাতে
চেয়েছিলাম। তা একান্ত আমার আবিষ্কারের তালিকাভুক্ত
হবে কি না-তা নিয়ে সংশয় ছিল যদিও,
তবু নির্বাসিত ঘুমকে আমি রাখতে চেয়েছিলাম
সকল ঘটনার সাক্ষী।
আর যা যা আমি আবিষ্কার করতে চেয়েছিলাম,
এর মধ্যে ছিল—
পঙ্গু প্রজাপতিদের জন্য কৃত্রিম পাখা,
দুঃখ
আমাকে দেখে যেভাবে কেঁদেছিল বৃষ্টির রাত
দর্শক হতে পারিনি আমি। তাই শ্রোতা হয়ে বসে পড়েছিলাম খোলা আকাশের নীচে।
আর নদীকে বলেছিলাম- তুমি বয়ে যাও, আমি স্থির থেকে যেতে চাই। নদী আমার
দিকে তাকিয়ে কেবল কেঁদেছিল। বলেছিল- তোমার দুইচোখ আমার হোক, কবি!
আমি নদীকে চোখ দুটি ধার দিতে চেয়েছিলাম।
জলস্তম্ভ ও জীবনেরা
আমরা নদীতীরে দাঁড়িয়ে যখন বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করছিলাম,
তখন আমাদের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল একটি শান্ত বাঘ,
তার হলুদ-কালো গায়ের চামড়ায় ডুবেছিল দুপুরের রোদ
কয়েকজন রাখাল, বাঘটিকে চরাতে চেয়েছিল ধূসর মাঠে।
মাঝে মাঝে বন্যপ্রাণীরা তৃষ্ণার্ত হয়ে লোকালয়ে ছুটে আসে,
জীবনের জন্য নির্মিত জলস্তম্ভের ছায়ায় দাঁড়িয়ে ওরা
দেহের দূরভাষ
সবশেষে গৃহীত থেকে যায় দেহের দূরভাষ
দূরত্ব পরখ করে পাখি দেখে– এই বিকেলের গায়ে
লেপ্টে আছে আমাদের দেহধর্ম, আর উষ্ণতার
আলো জমা হতে হতে যে অতীত হয়েছে বিগত,
সেও কাছে এসে দেখায় সম্মোহন, বলে —
হে জীবন চলিষ্ণু হও, পুনরায় আঁকো চুম্বনের গতিরেখা।
এঁকে রাখো এমন কোনও গ্রহের নাম
যেখানে
যে পড়ে স্রোতসংবিধান
রীতিতে সিদ্ধি নেই আমার। বিবিধ বন্দনা গাই। একহাতে
স্রোত, অন্যহাতে সমুদ্র নিয়ে খেলে যাই রচনাখেলা। কখনো
চাঁদ বিষয়ক, কখনো চাষী বিষয়ক। বিষয় নির্বাচনে আমি
সবসময়ই আদিম। যদিও হিংস্র নই, তবু ভাঙতে ভালো লাগে
আমার। কলাতন্ত্র, ঢেউবিদ্যা, আঁচড়ের প্রাণ।
যে পড়ে স্রোতসংবিধান
তার সাথে মিতালী খুঁজে
মাঝে মাঝে বিলবোর্ড বাঁধি।
আর
জল পড়বে, পাতা নড়বে না
রাশিফল দেখতে দেখতে আমরা গোণতে থাকি রাতের তারা। যারা
ভাগ্য বিপর্যস্ত- তাদের কথা না ভেবেই ডুবে থাকি রবীন্দ্রনাথের গানে।
জানি অনেক কিছুই,এমন একটি ভাব দেখিয়ে ভিন্ন ভিন্ন পথে
আমরা দখল করতে থাকি নদীর কিনার।
এই দখলদারিত্ব কবে ঘুচিয়েছে একাকীত্বের সন্ধ্যা— তা এখন আর
খুঁজে পাই
বৃক্ষশুমারি
নগরের গাছগুলো গোণে দেখার জন্য কিছু স্বেচ্ছাসেবক
প্রয়োজন। বিজ্ঞাপন টা চোখে পড়ার পর বিস্তারিত
পড়তে থাকি। ইচ্ছে হয় গোণে দেখি গাছের পাতাগুলো ও।
অক্সিজেনের আলো চেয়ে বাঁচে যে জীবন- করে যাই
তার বাণীবন্দনা।
বিশ্বের এই প্রান্তে বৃক্ষের ও শুমারি হয়, আর অন্যপ্রান্তে
মানব সন্তানের ও হিসেব থাকে না, জন্মসনদহীন
শিশুর হাতে
দূরবর্তী ছায়াদূরবীন
তুমি স্মৃতির দিকে না ফিরলেও পারো
তুমি না তাকালেও পারো- বৃষ্টির দিকে
কিংবা বাঁকোজ্জ্বল নদীর পোশাক পরে এই
বনবাদাড় ছুঁয়ে দেখা থেকেও থাকতে পারো দূূরে।
আমি দূরবর্তী শোকগুচ্ছ অনেক আগেই দেখেছি
ছায়াদূরবীন দিয়ে,
দেখেছি একটি মাকড়শা চলে যাচ্ছে উত্তর থেকে
দক্ষিণে। আমার পকেট থেকে লুটিয়ে পড়ছে
একটি প্রাচীন গোলাপ।
একটি তারা খসে
শপথ বিষয়ক পথদৃশ্য
শপথের শব্দগুলো শুনে হেসে উঠে কুমিরের দল।
”আমি ফকির সালাহউদ্দীন মোহাম্মদ ইলিয়াস এই মর্মে
শপথ করিতেছি যে ”
বলার পর পরই থমকে উঠে আমার কণ্ঠ। কাঁটাবিদ্ধ
হরিণের গলা কিংবা ধনুকবিদ্ধ পাখির ডানা এর আগেও
স্পর্শ করেছে আমার হাড়। আমার দেহের পরাজিত লৌহকণিকা
আমাকে জানিয়েছে, নদীর প্রতিটি