বিভাগের আর্কাইভঃ অণুগল্প

চিকেনিজম ভাবান্দোলন

প্রগতিশীল ও উন্নত রাষ্ট্র বলতে মানসলোকে যে ধারণা পুস্পপত্রে পল্লবিত হয়ে ওঠে ওয়েস্ট শেয়ালপুর রিপাবলিক ঠিক তাই। ফলে শিয়ালপুরের রাজধানীর নাম চিকেনডাঙা শোনার পর বিস্ময় জাগেনি। এই রাজধানীতেই প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয় ‘বিশ্ব মুরগিসুন্দরী প্রতিযোগিতা’।

বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতার কথা শুনলেও বিশ্বমুরগি সুন্দরী প্রতিযোগিতার বিষয়ে পুরোই অজ্ঞ ছিলাম। শেয়ালডাঙার সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী স্যার মোরগালিয়াম কুককুরুক যখন এ তথ্য জানালেন তখন বিস্ময় গোপন করতে পারিনি। অগাধ কৌতূহল নিয়ে তার কাছে জানতে চাইলাম-
: স্যার, এ প্রতিযোগিতা আয়োজনের কারণ কি?
: চিকেনিজম ভাবান্দোলনের ফসল এই প্রতিযোগিতা। মুরগিধিকার প্রতিষ্ঠায় বিশ্বব্যাপী মুরগিবাদীদের চলমান সংগ্রামের প্রতি সংহতি জানাতে শেয়ালপুর রাষ্ট্রীয়ভাবে এ প্রতিযোগিতা আয়োজন করে।

নিজ অজ্ঞানতাকে মনে মনে ধিক্কার জানিয়ে প্রশ্ন করলাম-
: এ প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন কি কি পুরষ্কার পান?

শেয়ালপুর রিপাবলিকের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী বেশকিছুক্ষণ ভাবলেন, তারপর বললেন-
: যে প্রতিযোগী চ্যাম্পিয়ন হন তিনি অনেক পুরষ্কারইই পান। মুরগিধিকার আন্দোলনের ব্রাণ্ড এম্বাসেডর হিসেবে দায়িত্বপালন করেন। তবে সবথেকে বড় পুরষ্কার হলো মুরগি স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় তারা আমৃত্যু শেয়ালদের সাহচর্য পান।

আবার বিস্মিত হবার পালা, সারাজীবন জেনে এসেছি শেয়াল আর মুরগীর সম্পর্ক খাদক ও খাদ্যের, আর মন্ত্রী মশাই বলছেন সাহচার্যের কথা! কৌতূহল চাপতে না পেরে বললাম-
: মন্ত্রী মশাই, শেয়ালদের সাহচর্য বিষয়ে যদি একটু খোলাসা করে বলতেন-
: ভেরী সিম্পল। চ্যাম্পিয়নসহ ফার্স্ট ও সেকেন্ড রানার্স আপ বিশ্ব মুরগিসুন্দরী শেয়ালদের সাথে রাত কাটিয়ে জানিয়ে দেন- মুরগিস্বাধীনতা হরণ করা যাবেনা।

যত জানছি ততই কৌতূহল বাড়ছে, জানতে চাইলাম-
: এতে শেয়ালদের লাভ কি?

মন্ত্রীমশাই ক্ষুব্ধ কণ্ঠে জানালেন-
: সবকিছুতেই লাভ থাকতে হবে! শেয়ালদের মনে মুরগিদের প্রতি দরদ ও ভালোবাসা নেই- এ ধারণা সম্পূর্ণ অবান্তর। শেয়ালদের মত এতো বেশী করে কে আর মুরগিদের ভালোবাসে!

মন্ত্রী মশায়ের কাছে ক্ষমা চাইলাম। কিন্তু তার রাগ কমেছে বলে মনে হোলো না। কিছুটা ভয় নিয়েই প্রশ্ন করলাম-
: বাকী প্রতিযোগিরা কি সুযোগ পান?

মন্ত্রীমশাই ঝাঁঝালো স্বরে বললেন-
: আপনার কি মনে হয়?

বিনয়ের সাথে উত্তর দিলাম-
: স্যার, আমার কোনো ধারণা নেই। তাই আপনার কাছে প্রকৃত তথ্যটা জানতে চাইছি-

স্যার মোরগালিয়াম ক্ষোভে ফেটে পড়লেন-
: শেয়ালপুর রিপাবলিকের মোরগরা কি মরে গেছে! বাকী প্রতিযোগীরা এই মোরগদের সাহচর্য পায়। তারপরেও দু:খজনক সত্য হোলো মুরগিধিকার প্রতিষ্ঠায় মোরগদের ভূমিকা সবসময়েই ফোকাসের বাইরে থেকে গেছে। মুরগী আগে না ডিম আগে প্রশ্ন থেকেই এই অবহেলার শুরু, যেনো ডিমোৎপাদনে মোরগের কোনো ভূমিকা নেই।

আর কোনো প্রশ্ন করার সাহস হলো না। মন্ত্রী মশায়ের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময় তিনি কানে কানে বললেন- ‘মুরগির প্রয়োজন হলে বলবেন, সংকোচ করবেন না। মুরগিধিকার প্রতিষ্ঠায় চিকেনিজম বিশেষজ্ঞ ৩৪-২৬- ইনফিনিটি মুরগি পাঠিয়ে দেবো, জাস্ট রুম নাম্বারটা জানাবেন।’

.
#খসড়া অণুগল্প
১৩১০২০১৮

বাঙালি সেকুলারের মনের পশু সঙ্কট

abu

১.
কোরবানি ঈদের পরদিন, রাত ৮টা। সুনসান পাড়া, নিরবতা বিদীর্ণ করে কেউ একজন তীব্র গতিতে বাড়ির কলাপসিবল দরজা ঝাঁকাচ্ছে। কল বেল থাকার পরও এভাবে দরজা ঝাঁকানো ভীতিকর, ভয় পেতে শুরু করেছি।

আতঙ্ক আর কৌতূহল মিশ্রিত মন নিয়ে দ্রুত দরজার সামনে গেলাম, মহল্লার এক ভায়ের ভয়ার্ত চেহারা, দু’হাতে সজোরে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছেন, ভেঙে ফেলতে চাইছেন। আমাকে দেখে কিছুটা সম্বিৎ ফিরে পেলেন, কাতর স্বরে বললেন,
– জলদি দরজার তালা খুলো, আমারে বাঁচাও.. প্লিজ বাঁচাও।

তাকে ঘরে এনে বসালাম। পরপর দুই গ্লাস পানি খেলেন। বোঝা গেলো খুব বিপজ্জনক কিছু ঘটেছে। জিজ্ঞেস করলাম,
– কি হইছে ভাই!
– তুমি তো জানো আমি দুইটা কোরবানি দেই। একটা পারিবারিকভাবে ঈদের দিন, আরেকটা একা দেই, ঈদের পরদিন।
– আমি তো জানতাম একটা দেন।

গত এক যুগ ধরে এই ভাইদের বাসায় একটা গরু কোরবানি দিতে দেখে আসছি, তিনি দুইটা পশু কোরবানি দেবার কথা বলায় কিছুটা বিস্মিত হলাম। সেই বিস্ময় ভাঙাতে তিনি জানালেন,
– না, একটা না। ঈদের দিন পারিবারিকভাবে কোরবানি দেই বনের পশু, আর ফেসবুকে সিরিয়াস হবার পর থেকে ঈদের পরদিন একা একা কোরবানি দেই মনের পশু।

একটা ঢোক গিলে জানতে চাইলাম,
– তা সমস্যাটা কি, ভাই?
– বিশাল সমস্যা। আজ দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর মনের পশুটারে জবাই দিবার জন্য পায়ে বাইন্ধা একটানে মাটিতে ফেলছি, মুহুর্তের মধ্যে ঝাড়া দিয়া খাড়ায়া গেলো, ফ্র‍্যাকশন অব সেকেন্ড খাড়ায়া রইলো, তারপর দিলো ঝাইররা দৌড়।
– বলেন কি! তারপর?
– আমিও পশুর পিছনে দিলাম দৌড়, টের পায়া ওই পশু গিয়া ঢুকলো সেলিনাদের বাসায়।
– সেলিনা? কোন সেলিনা! আপনাদের বাড়ির পাঁচ ছ’টা বাড়ির পর যে থাকে! মানে আপনার এক্স মানে প্রাক্তন..

কথা শেষ করতে না দিয়ে মহল্লার ভাই চেঁচিয়ে উঠলেন-
– চুপ। একদম চুপ। বিশ্বাসঘাতিনী, আইয়ূব বাচ্চু তাই বলেছেন ‘সেলিনা এখন অন্য কারো/আমার কেউ নয়..’
– ওহ! আচ্ছা। তবে সেলিনার কথা থাক, আপনার মনের পশুর কথা বলেন-
– বিকাল সাড়ে তিনটা থেকে সেলিনাদের গেটে দাঁড়ায়ে আছিলাম, কিন্তু মনের পশুটা ঢুকছে তো ঢুকছেই। বের আর হয়না। একটু আগে বের হইলো সেলিনার বড় ভাই, সাথে তার মনের পশু, তার মনের পশু আবার দুইটা- যমজ এলসেশিয়ান কুত্তা।
– বলেন কি!
– হ রে ভাই! সেলিনার বড় ভাইরে দেইখা সালাম দিলাম, তিনি সালামের জবাব নিয়া জিগাইলেন, ‘এইখানে কি করতাছো, বিলাল?’
– তারপর!
– আমি জবাব দিবার আগেই সেলিনার ভায়ের মনের পশু দিলো ধাওয়া, আমার পাছায় কামড়ায়া কিচ্ছু বাকী রাখে নাই, ধাওয়া খাইতে খাইতে এইখানে আয়া পরছি।

মহল্লার ভায়ের মনের পশু গেছে পালিয়ে, তার ওপর প্রাক্তনের বড় ভায়ের মনের পশু এক জোড়া এলসেশিয়ানের ধাওয়া খাওয়ার ভয়ে চুপচাপ আমার বাসায় বসে আছেন, দেখে মায়া লাগছে, কষ্টও হচ্ছে।

২.
মাঝরাতে তুমুল বৃষ্টি শুরু হলো। এমন বৃষ্টিতেই চার পাঁচজন বন্ধু মিলে পাহারা দিয়ে মহল্লার বড় ভাইকে বাসায় পৌছে দিলাম। সকালে ঘুম ভাঙলো ভায়ের ডাকে, বৃষ্টি নেই কিন্তু বারান্দায় গোড়ালি পর্যন্ত পানি। রাস্তায় পানি বেশী, ময়লাও। ওই পানি পেরিয়ে মহল্লার ভাই চলে এসেছেন। বিস্ময় গোপন করে জানতে চাইলাম,
– এতো সকালে! কোনো সমস্যা, ভাই?
– সমস্যা মানে বিশাল সমস্যা।

একটা মাত্র জীবনে মানুষকে বহু বিশাল বিশাল সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়! ভোরের আলোয় মনটা বিষন্ন হয়ে উঠলো, বিষাদভরা কণ্ঠে বললাম,
– চলেন, ছাদে বসি। চা খেতে খেতে কথা বলি..

দু’জনে ছাদে উঠেছি। ক’টা চড়াই, বাবুই আর দোয়েল খাবার খাচ্ছে। প্রতিদিন এদের খাবার দেওয়া হয়, না দিলে ভোরে এসে চেঁচামেচি শুরু করে। পাখিগুলো আমাদের দেখে উড়ে গেলো না, ভাই বললেন,
– এগুলির দেখি অনেক সাহস!
– উড়ে যাবার পাখা আছে, ভয় কেনো পাবে?
– তা ঠিক! তা ঠিক!

চায়ে চুমুক দিচ্ছি, ভাই উশখুশ করছেন কিন্তু কথা শুরু করতে পারছেন না। অগত্যা আমিই প্রশ্ন করলাম-
– কি সেই বিশাল সমস্যা!
– প্রথম সমস্যা হলো, সেলিনার ভায়ের মনের জোড়া কুত্তা যে আমারে কামড়াইলো, এর জন্য কি নাভির গোড়ায় ইনজেকশন নিতে হইবো!

দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বললাম,
– না, ভাই। মনের ইনজেকশনই বড় ইনজেকশন। দ্বিতীয় সমস্যাটা কি?

ভাই একটু কেশে নিয়ে শুরু করলেন,
– কোরবানি ঈদের পরদিন মানে গতকাল তো মনের পশুরে কোরবানি দিতে পারিনি, দৌড়ায়া সেলিনাদের বাড়িতে পালাইলো।
– হুম।
– কিন্তু কেলেঙ্কারি কাণ্ড ঘইটা গেছে-
– ছি: ছি: বলেন কি!
– হ, আমার মনের পশু তো সেলিনার মনের পশুরে নিয়া জঙ্গলে ভাগছে..
– ওহ! এতে আর সমস্যা কি?
– এইটাই তো সমস্যা! মনের পশু এখন তো আর মনের পশু নাই, পুরাই বনের পশু হয়া গেলো।
– এইভাবে তো ভাবি নাই! তবে আগামী ঈদের পরদিন কোরবানি দিবেন কি!

ভাই স্বস্তির স্বরে জানালেন,
– ওইটা নিয়া চিন্তা নাই। মনের পশু পালানোর আগে তিনটা বাচ্চা দিয়া গেছে, নাদুস নুদুস, মনের মাঠে নাপাম ঘাস খায়া খায়া বড় হইতাছে–

খুব কৌতূহল নিয়েই জানতে চাইলাম-
– বলেন কি! আচ্ছা ভাই, বছরে বছরে মনের পশু কুরবানি না দিয়া, মনের পশুর খামারটারে এক্কেবারে উচ্ছেদ করলে হয়না!

আমার বোকামিতে ভাই মৃদু হাসলেন,
– এইটা একটা কথা হইলো! মনের পশু কুরবানি দিতে কইছে, খামার উচ্ছেদ করতে তো কয়নি। তাছাড়া খামার বন্ধ করলে প্রতি ঈদে ফেসবুকের পাকপবিত্র ময়দানে মনের পশু কোরবানি দিমু কেম্নে!

‘কে এমনটা বলেছে’ এই প্রশ্নের উত্তর জানার সাহস হলো না, তাই চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম,
– সমস্যা কি আরও কিছু আছে?
– হুম
– কি সেটা?
– আমার গফরে বুঝাইতে পারিনা আমি শুধু তারেই ভালবাসি, আমার ১২টা গফের একটা গফও আমার এই কথাটা বিশ্বাস করে না।

মুরগির ডিম ফুটে ছাগলের বাচ্চা বের হলেও এতটা তাজ্জব হতাম না, তাজ্জবতা কাটিয়ে বললাম,
– দু:খজনক, মর্মান্তিক, বেদনাদায়ক–, এ তো অনেক বড় প্রব্লেমেটিক সমস্যা।
– এটা বড় সমস্যা না, সমস্যা হইলো আমার মনের পশুর লগে ওদের মনের পশুও যদি ভাইগা যায় তবে তো বিশৃঙ্খলা হয়া যাইবো।
– ভাগতে চাইলে ভাগতে দেন, বিশৃঙ্খলা হইবো ক্যান!
– বিশৃঙ্খলা হইবো না! ওগো ১২জনের মনে ১২টা পশু, আর আমার মনে পশু মাত্র ৩টা। অবস্থাটা বোঝা একবার, এক্কেবারে পরকীয়া হয়া যায় না!

সাহস নিয়ে বললাম,
– আপনার গফদের মনে আর বনে আসলে একটাই পশু, মানে ১২জন মিলে ১টা পশুরেই শেয়ারে পালতাছে, চিন্তা কইরেন না।
– এইটা হইলে তো ভালোই। কিন্তু একটারে নিয়া যদি বারো পশু পালায়! কিয়েক্টা অরাজকতা! এর থেকে পরিত্রাণের কি কোনো উপায় নাই!!

এই বিশাল সমস্যার সমাধান খুব কঠিন নয়, ভায়ের মনে হাইব্রিড পশু চাষ করলেই হবে। কিন্তু বলার ইচ্ছে হলো না, বাঙালি সেক্যুলারের মন বুঝা খুব কঠিন, তাদের মনের পশুরে বুঝা কঠিনতর, তাই ভায়ের চেহারার সাথে মিলিয়ে নিজের চেহারায় চিন্তার ভাব ধরে রাখি, যেনো কোরাসে চিন্তা করছি।

.
পুরানো লেখা।

নীলমাছি

gty

পায়ের কাছে জানলা খোলা। বাইরে ঝাঝা রোদ। গ্রীষ্ম দুপুরের তালুফাটা গরম। জানালার গ্রীলে তিন চড়ুই শলাপরামর্শ করছে। ধীর গতিতে পাখা ঘুরছে।

কাথা মুড়ে শুয়ে আছি। তিন দিন ধরে ভীষণ জ্বর। আবার কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছে। তৃষ্ণা পাচ্ছে, বরফ চিবিয়ে খেতে ইচ্ছে করছে। জ্বর বাড়ছে আর বিছানাটা কেমন সবুজ মাঠ হয়ে যাচ্ছে। দূর্বা ঘাসের ঘ্রাণ, মাথার কাছে ফুটে আছে ঘাসফুল। ফড়িংয়ের ঝাক উড়ে গেলো- এলোমেলো। একটা চকচকে নীল ডুমো মাছি নাকের কাছে অনেকক্ষণ ভনভনালো। কোথায় উড়ে গিয়ে ফিরে এলো। কাথার উপরে বসলো,
— আবার জ্বর বাঁধিয়েছ?
— জ্বর কি ছবির ফ্রেম না পুকুরের ঘাট যে বাঁধাবো?

আমার বিরক্তিকে পাত্তা দেয় না মাছি,
— হাহাহাহাহা… ভনভনানিতে রাগ করছ?

কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করে মাছি কথা শুরু করল,
— ভনভনিয়ে কি খুঁজছিলাম জানো?
— কি!
— পাকা ল্যাংড়া আমের রসের ঘ্রাণ।

বিরক্তির মাত্রা অসহ্যের সীমা অতিক্রম করল,
— আমি কি ল্যাংড়া আম! তোমার তাই মনে হয়! যুক্তিসহ ব্যাখ্যা কর..

মাছির স্বর কিছুটা বিব্রত,
— ধ্যাত, তুমি ল্যাংড়া আম হবে কেন! সেই জ্বর জ্বর দুপুরের কথা একটুও মনে নেই তোমার!
— কোন দুপুরের কথা?
— সেই যে চারদিন আগে তোমার দাদিজান মারা গেছেন। উনার চেহলাম। দুপুরে ক’জনকে খাওয়ানো হবে। মা কুঁচো চিংড়ি দিয়ে করলাভাজি, পুঁইশাক দিয়ে বড় চিংড়ি, লাউ দিয়ে ইলিশ মাছ, আলু-বেগুন দিয়ে রুই মাছ রান্না করেছেন। রুইমাছের তরকারীতে জিরা ভেজে গুড়ো করে দিয়েছেন। সজনের ডাল থেকে ধোঁয়া উড়ছে। শোক আর ঘ্রাণে উথলে ওঠা দুপুর। নামাজ শেষে মিলাদ, তারপরে খাওয়ানোর পর্ব শুরু হবে। যাদের পাতে দু’বেলা সাদামাটা ভাত জোটে কি জোটে না, এমন ক’জন খাবেন। কি মনে আছে?

বিরক্তি কিছুটা কমে, স্মৃতির ঘায়ে কণ্ঠ কিছুটা কোমল হয়ে আসে,
— হ্যা, মনে আছে। সেসব বহু যুগ আগের স্মৃতি। তুমি এসব জানো?
— জানবো না কেনো! আমিও যে ছিলাম।

বিস্মিত হই,
— নীলমাছি, তুমিও ছিলে?
— হুম। সেদিন তোমার বেশ জ্বর। রান্নার ফাঁকে ফাঁকে মা মাথায় পানি দিচ্ছেন। জ্বর কমছে বাড়ছে, কিন্তু এক্কেবারে ছেড়ে যাচ্ছে না। ঘরের এক কোণে শুয়ে আছো- গুটিশুটি ছোট্ট মানুষ।
— হুম, গায়ে লেপ। দাদিজানের কাফনের মত শাদা কভার। ন্যাপথলিনের কড়া গন্ধ।

নীলমাছি মাথা দোলায়,
— তোমার স্মৃতি দেখছি খুব টনটনে। মেহমানদের জন্য ফল আনা হয়েছে— ল্যাংড়া আম, শক্ত কোষের কাঁঠাল আর তরমুজ। বাবা একটুকুরো আম কেটে তোমার মুখে দিলেন। সেই আমের রস টুপ করে শাদা কাভারে পড়লো।

মনের ভেতর উৎলে উঠে বিষাদ,
— বাবা মারা গেছেন বাইশ বছর হয়ে এলো। সে কথা থাক, তোমার কথাই বলো…

স্মৃতিকাতর মাছি বলে চলে,
— সেদিন গরম আর ক্ষিধের জ্বালায় অস্থির ছিলাম। চিন্তা না করেই লেপের কভারে পড়া দু’তিন ফোঁটা রস খেতে শুরু করলাম। তুমি অবাক হয়ে খাওয়া দেখছিলে।

মাছির ভুল ভাঙাই,
— তোমার খাবার দেখছিলাম না। তোমার নীল শরীরে আলোর ঝিলিমিলি দেখছিলাম।
— খাওয়া শেষে ভাবলাম একটু জিরোই। তুমি অসুস্থ শিশু এক— আমায় কি আর ধরতে পারবে!
— হিসেবে খুব বড় ভুল করেছিলে..

মাছির অকপট স্বীকারোক্তি,
— হ্যা, আত্মঘাতী ভুল করেছিলাম। হঠাৎ মুঠোর ভেতরে ধরে ফেললে। সে কি ভয়! জীবন হারানোর আশঙ্কা ও আতঙ্ক! পায়ে সুতো বেঁধে আমৃত্যু উড়াবে— ভাবতেই বুক ফেঁটে কান্না এলো।
— আহারে! হাহাহাহাহাহাহা…
— হাসছো কেনো! তখন কি জানতাম যে কয়েক মুহূর্ত দেখে ছেড়ে দিবে!

মাথা ব্যথা আর গায়ের তাপ দুইই বাড়ছে, ক্লান্ত স্বরে জানতে চাই,
— আজ সেসব কথা ভনভনাতে এসেছো!

মাছি শোনায় অদ্ভুত কথা,
— রূপকথার অভিশাপে অমরত্ব পেয়েছি। মরে যাই— ফের একজীবনের স্মৃতি নিয়ে জন্মাই। আজ দুপুরে সেই দুপুরের কথা মনে হতেই ছুটে এলাম।

জ্বরের ঘোরে রসিকতা করি,
— নীল মাছির আগমন, শুভেচ্ছায় স্বাগতম। তা কি দেখলে!
— তোমার মুখে এখনো আমের রসের ঘ্রাণ লেগে আছে।
— এখনো ঘ্রাণ লেগে আছে! কত বছর আগের কথা! সময় চলে গেছে কত!
— ধ্যাত! সময় যাবে কোথায়! সময় তার প্রতিটা বিন্দুতে স্থির।

রূপকথার অভিশাপে অভিশপ্ত মাছির কাছে কৌতূহল গোপন করি না,
— ও নীলমাছি, সময় তবে কোথাও যায় না?
— না, যায় না। সময় তার প্রতি বিন্দুতে স্মৃতি সঞ্চয় করে রাখে।
— তবে আমাদের যে বয়স বাড়ে? দিন ফুরোয়?
— বয়স বাড়বে না কেনো বলো! তোমাদের মানুষ হবার কত তাড়া। পায়ের তলায় সর্ষে। বিরাম নেই, বিশ্রাম নেই, শুধু যাওয়া আর যাওয়া।
— সবাই তো যায়, কি যায় না!

নীল মাছির কণ্ঠে বিষাদ ভর করে,
— যেয়ে লাভ কি! সময়বিন্দুকে অতিক্রম করে যেতে যেতে একদিন একেবারে থেমে যাওয়া। থেমে যাবার আগে মনে হওয়া- এই ইঁদুর দৌড়, এই দিনযাপন অর্থহীন… সব অর্থহীন! শুনতে পাওয়া কে যেনো ডাকনাম ধরে ডেকে বলছে, “তোমার না মনসুখিয়া যাবার কথা ছিলো!”

কথা খুঁজে পাই না। নীল মাছি বিজ্ঞের মত বলে,
— এসব কথা থাক। এত ঘনঘন তীব্র মাথাব্যাথা আর গাঢ় জ্বর আসার লক্ষণ মোটেও ভালো নয়। তুমি কি পুষছো?
— জ্বরের লক্ষণ বিচার পরে করো। ও নীল মাছি, মনসুখিয়ায় কবে যেতে পারবো! ছুঁতে পারবো অভ্রজোনাকের পাখা!

নীল মাছি কোনো উত্তর দেয় না। জ্বর বাড়ছে, তৃষ্ণা তীব্রতর হচ্ছে। ঘরের সিলিং কখন নীলাকাশ হয়ে গেছে। মেঘে মেঘে কত প্রিয়মুখ। সবুজ ঘাসে দাঁড়িয়ে আম কাটছেন বাবা, ধবেধবে শাদা পাঞ্জাবী হাওয়ায় উড়ছে যেন মনসুখিয়ার নিশান।

.
নীলমাছি | ২০১৬ | বর্তমানে ‘মনসুখিয়া‘ বইটি আউট অব স্টক।

মনসুখিয়া

abu

১.
মাঝরাত হতে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। মাঝে মাঝে কমে আসছে, কিন্তু থামছে না। অন্ধকার কিছুটা ফিকে হয়ে এসেছে। বৃষ্টির তালের সাথে আজানের সুর মিশে এক মোহনীয় সিম্ফনি ভেসে আসছে– আসসালাতু খায়রুম মিনান নাউম… আসসালাতু খায়রুম মিনান নাউম…।

আড়মোড়া ভেঙ্গে বারান্দায় যাই। সারারাত আন্ধকার দূর করা ক্লান্ত বাতিটাকে নেভাই। গ্রীলের পাশে দাঁড়াই। একটা সিগারেট ধরাতেই ধমকে ওঠে খাঁচায় পোষা ঘুঘু দম্পতির বউটি,
— সক্কাল সক্কাল সিগারেট! খুব খারাপ। খুউউব খারাপ।

বউটির কথার প্রতিবাদ করে স্বামী ঘুঘুটি বলে, ‘খাক না একটা সিগারেট। হয়তো টেনশনে আছে, দেখলে না সারারাত ঘুমোয়নি।’

কথা শেষ হতে না হতেই ঘুঘুবউটি চোখ পাকিয়ে এমনভাবে স্বামীর দিকে তাকাল যে বেচারা করুণ সুরে ডাকতে লাগলো। আমি হেসে উঠলাম, ঘুঘুবউ ফের ধমক লাগাল-
— হাসছো যে খুব! এখখনি সিগারেট ফেলো। আজ বারান্দায় কোনো সিগারেট খাওয়া চলবে না। ইট ইজ এন অর্ডার, পুরো ৫৭ ধারা।

মেঘের নরম ভোরে তর্কে যেতে ইচ্ছে করল না। সিগারেট নিভিয়ে ঘুঘুবউকে জিজ্ঞেস করলাম,
— বারান্দায় ৫৭ধারা জারী হলো কবে?
— আজ, এবং এখন।
— বাহ! জারী করলেন কে?
— কে আবার জারী করবে! আমিই করেছি।

চলচ্চিত্রে দেখা উকিলের ঢংয়ে জানতে চাইলাম,
— মহামান্য আদালত, কতদিনের জন্য বারান্দায় ৫৭ ধারা জারী থাকবে?
— ২৪ঘণ্টার জন্য।
— মাত্র ২৪ ঘণ্টার জন্য! কেন?
— কারণ, আজ আমাদের বাবুর প্রথম জন্মদিন। ওর জন্মের দিনে বারান্দায় কাউকে বাজে কাজ করতে দিব না।

দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বললাম,
— বেশ! আজ বারান্দায় কোনো বাজে কাজ হবেনা। যাই, একটু ছাদ থেকে ঘুরে আসি।

২.
বারান্দা হতে ঘরে ফিরি। খুব সাবধানে শব্দ না করে দরজা খুলি। সিড়ি ভেঙে একতলার চিলেকোঠায় দাঁড়াই। এলোমেলোভাবে কাকের কা কা শব্দ ভেসে আসছে। প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে সিগারেট ধরিয়ে টান দিতেই টিকটিক করে ওঠে এক টিকটিকি,
— ধুত্তোরি! সারা রাত সিগারেট খেয়েছ। ভোরেও শুরু করেছো!
— হুম, আজ বড়ো সিগারেটের তৃষ্ণা পেয়েছে। তৃষ্ণা মিটছে না।

টিকটিকের স্বরে দার্শনিকতা ভর করে,
— মানুষ! তোমার যে কি হয় এক একটা দিন! কিসের কিসের যে তৃষ্ণা পায়! সিগারেটের তৃষ্ণা, চায়ের তৃষ্ণা, গানের তৃষ্ণা, স্মৃতির তৃষ্ণা, শিমুল তুলো ওড়ানোর তৃষ্ণা, তারা গোনার তৃষ্ণা, গজলের তৃষ্ণা, কবিতার তৃষ্ণা, অভ্রবকুলের তৃষ্ণা, হারালো যে জন অন্ধকা….

কথা শেষ হবার আগেই থামিয়ে দিয়ে বলি-
— সব মুখস্থ করে রেখেছো দেখছি! আর কোনো কাজ টাজ নেই তোমার!
— দেখে দেখে মুখস্থ হয়ে গেছে।
— বাহ! বাহ। তুমি দেখছি এক্কেবারে জিপিএ ফাইভ।
— জিপিএ ফাইভ না ছাই! তবে আজ বেশ কষ্ট পেয়েছি। তাই বারান্দা থেকে তোমার পিছুপিছু এলাম।

নরম স্বরে জিজ্ঞেস করি,
— কে তোমাকে কষ্ট দিল টিকটিমনি!
— কে আবার দিবে! তুমিই দিয়েছ, মানুষ।
— কখন! কখন কষ্ট দিলাম!

টিকটিকি একটু লেজ নাড়ে, সদা নীতি শিক্ষায় নিয়োজিত মুরুব্বীর স্বরে বলে,
— ঘুঘুবউটি বললো আজ তাদের বাবুর প্রথম জন্মদিন। তুমি একটু উইশও করলে না! আমার ভীষণ কষ্ট লেগেছে। মানুষ, তুমি এমন কেনো!
— এজন্য এতো কষ্ট!
— হু
— কিন্তু এ কষ্ট যে অর্থহীন।

টিকটিকির স্বরে দ্বিধা,
— অর্থহীন! কেনো বলো তো!
— শোনো টিকটিমনি, উইশের ফিতায় কি মাপা যায় জন্মের পরিধি!
— কি যে বলো! কিছুই বুঝি না।
— কিছু বুঝার দরকার নেই। মনে রেখো প্রতিটা দিনই জন্মদিন। প্রতিটা দিনই নতুন করে জন্মায় তার আগের দিনের স্মৃতি ও বিস্মৃতি নিয়ে, সাথে সাথে আমরাও জন্মাই প্রতিদিন। একদিন এমন একটা দিন আসে, আমরা আর জেগে উঠি না, সেখানে জম্মের শেষ।

টিকটিমনি একটা লম্বা হাই তুলে,
— তাই না কি, মানুষ! তোমার প্যাঁচাল শুনে ঘুম পাচ্ছে।

টিকটিকিকে আর কিছু বলা হয় না। নিজের অজান্তেই ক’টা দীর্ঘতম দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে, ছড়িয়ে পরে ভেজা হাওয়ায়। তুমুল বৃষ্টির একটানা শব্দ ছাপিয়ে তারস্বরে করুণ শিস দিয়ে যাচ্ছে দু’টা দোয়েল। কে জানে এই সকালে কোন কারণে এমনতর বিষাদ তাদের!

৩.
আজ বৃষ্টি আর থামবে না। অপাকস্থালীর জীবন আকুতি জানায়- ‘আজ নিজের ভেতরে সাঁতার কাটা হোক, তালদুপুরে মনপুকুরে দাও ডুব।’ কিন্তু খেঁকিয়ে ওঠে পাকস্থলীর জীবন, ‘সকাল সকালই আকাজের উস্কানি দিচ্ছো যে! কাজ না করলে খাবে কি! পেটে ক্ষিধে থাকলে তখন দেখা যাবে কোথায় থাকে তালদুপুর আর খালপুকুর, হু।’ যে জীবন পাকস্থলীর সে জীবন বোঝেনা পাখির ভাষা, পতঙ্গের আহ্লাদ, বৃষ্টির রোদন। সে জীবন জানে শুধু কামলার ব্যকরণে দীর্ঘশ্বাস গোপনের সকল কৌশল।

রাস্তায় জমে আছে ছিপছিপে পানি। হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার মোড়ে যাই। সব রিকশা এখনো বের হয়নি। তাদেরও হয়তো উস্কানি দিচ্ছে অপাকস্থলীর জীবন। স্বল্প পরিচিত এক রিকশাওয়ালা এগিয়ে আসেন-
— ভাই, ওঠেন।
— কোথায় যাব জানেন?
— হ, জানি।

রিকশায় উঠে বসি। বৃষ্টির বেগ আবার বেড়েছে। তিনি প্লাস্টিকের পর্দাটা ভালো করে খুলে দেন, দু’পাশের হুডে গুজে দেন কিছু অংশ। রিকশা চালাতে শুরু করেন। রিকশা চলছে। পথে পথে অলস সকালের ঘুম ভাঙছে। পাকস্থলীর টানে কামলা ছুটেছে কামলাগিরির জেলে। রিকশাওয়ালা নীরবতা ভাঙেন,
— কুনুদিন এমুন আকাইল্যা বাদলা দেখছেন!
— এখন সব কালই আকাল। এই যে অপনি রিকশা চালাইতাছেন, আমি অফিসে যাইতাছি তার কারণও আকাল।
— কন কি ভাই! আকাল হইব ক্যান!
— অকাল না হইলে তো ঘরে বইসা গপসপ করতাম। পেঁয়াজ কাঁচামরিচ আর চাইল ভাজা সরষা ত্যালে মাখায়া কুচুরমুচুর কইরা চাবাইতাম। দুপুরে বেগুন ভাজা, ইলশা ভাজা, মিষ্টি কুমড়া দিয়া গোশতের ঝাল তরকারি মাখায়া খিচুরী খাইতাম। আকাল বইলাই এই বাদলার মধ্যে আপনে প্যাডেল মারেন আর আমি কলম মারতে যাইতাছি।

রিকশাওয়ালা হেসে ওঠেন। হাসতে হাসতে বলেন-
— আইজ মাসের ২১তারিক, বাড়ির ভাড়া দিতে দেরী হইতাছে। জ্বরের লেগা ৭দিন গাড়ি চালাই নাই। আইজ ভাড়া না দিলে বাড়িওয়ালা পিডাইবো কইছে হাহাহাহাহাহাহা…. আকাইল্যাই তো..

মাথার ভিতর ঘুরতে থাকে আজ ২১তারিখ… আজ ২১মে… আজ ২১মে… আজ ২১মে। মাত্র চারটা ২১মে, ছোটো ছোটো কত যে স্মৃতি, আহ ২১শে মে…।

৪.
তুমুল রোদের দিন ছিল সেদিন। বেইলি রোডের ফাস্টফুড শপে কলেজ ফাঁকি দিয়ে মুখোমুখি দুজন। ভিকারুননিসার আহ্লাদি স্বর,
— নটরডেম, আজ আমার জন্মদিন। খুব সুন্দর একটা উইশ করো, তা না হলে ঠিক ঠিক মরে যাবো।
— একটা উইশ না পেয়ে জন্মদিনের দিন ঠিক ঠিক মরে যাওয়া কাজের কথা না।
— এহহহ! অবশ্যই কাজের কথা। তোমার সুন্দর উইশ না পেলে ঠিক ঠিক মরে যাবো, তখন দেখো, হু।

ভিকারুননিসার মুখে অভিমানের মেঘ জমতে শুরু করে। বাইরে ঝাঁঝাল রোদ। নটরডেম কাঁপা হাতে ভিকারুননিসার কপালে নেমে আসা অবাধ্য এক গোছা চুল কানের পাশে সরিয়ে দেয়,
— শুভ জন্মদিন, প্রিয় ভিকারুননিসা। মানুষ হয়ে ওঠো প্রতিদিন।
ভিকারুননিসার কণ্ঠে তীব্র ক্ষোভ,
— আমি কি মানুষ নই! তোমার সাথে আজ আমার প্রথম জন্মদিন, আর তুমি এভাবে বলতে পারলে! নটরডেম, তুমি এভাবে বললে!
ভিকারুননিসার চোখ ছলছলিয়ে ওঠে, নটরডেমের বুকে কেনো যে ব্যাথা লাগে! ব্যাথা চেপে বলে,
— প্রিয় ভিকারুননিসা, উইশে ‘মানুষ হয়ে ওঠো’ থেকে গভীর কিছু আর খুঁজে পাই না যে। এর চেয়ে দামী উইশ আর কি আছে!
— এটা দামী উইশ!
— অবশ্যই অমূল্য উইশ। কেন অমূল্য তা কি শুনতে চাও?
— হ্যা, চাই। শোনার পরে যদি দামী মনে না হয় তবে কিন্তু ঠিকঠিক মরে যাবো, জেনে রাখো, নটর ডেম।

নটর ডেম বলতে শুরু করে-
— প্রতিজন মানুষ জন্মায় মানুষ হয়ে। তারপর একদিন মানুষ হতে না পেরে মরে যায়।
— যাহ! মানুষ তো মানুষ হয়েই মরে।
— না, ভিকারুননিসা। প্রতিজন মৃত মানুষই আসলে মানুষ হতে না পারা একজন মানুষ।
— কি যে বলো না, নটরডেম!
— জন্মানোর পর মানুষকে মানুষ করে তুলতে শুরু করে পরিবার। তাকে শুধু মানুষ হলেই চলবে না- তাকে হতে হবে সভ্য মানুষ, সফল মানুষ, শিক্ষিত মানুষ।
— তা তো হতে হবেই।
— ভিকারুননিসা, সেখানেই তো সমস্যা, মানুষের আর মানুষ হয়ে ওঠা হয় না।
— ধ্যাত! এ কথার অর্থ কি!

নটর ডেম প্রথমে কথা গুছিয়ে নেয়, তারপর ধীর লয়ে বলে চলে,
— জন্মানোর পরই বাবা-মা মানুষ করে তোলার অভিযানে নামেন। এই অভিযানে পরম উৎসাহে যোগ দেয় আত্মীয়স্বজন আর পাড়া প্রতিবেশী। স্কুল-কলেজের স্যাররাও নামেন মানুষ গড়ার কাজে। সবাই মিলে সে’ই মানুষ গড়ে তুলতে চান যে মানুষ তারা হতে চেয়েছিলেন কিন্তু হতে পারেন নাই। কবি সাহিত্যিক ডাক্তার মোক্তার সবাই মানুষকে মানুষ বানাতে চায়। নিজের নিজের ছায়ার মাপের মানুষ, নিজের নিজের এইম ইন লাইফের মানুষ, নিজের নিজের বৃত্তভাঙার মানুষ।
— একটু থামো, নটরডেম। দম নাও। কিছুটা বুঝতে পারছি।
— গুড। তারপর কি হয় বুঝতে পারছো!
— কি হয়!
— অন্যদের মাপে মানুষ হতে হতে একটা সময় মানুষ নিজের মুখোমুখি দাঁড়ায়। সে বুঝতে পারে যে মানুষটি সে হতে হয়েছিলো সে মানুষটি সে হতে পারে নাই। তার দিন কেটে গেছে অকারণ অর্থহীন এক মানুষ হবার মোহে। তার আর মানুষ হয়ে ওঠা হয় না, বেলা ফুরোয়, খেলা ফুরোয়, মানুষ হতে না পারার আক্ষেপ নিয়ে জীবনও ফুরোয়।

গভীর বিস্ময় নিয়ে নটরডেমের চোখে তাকায় ভিকারুননিসা, টেবিলের ওপরে রাখা হাতটা শক্ত করে ধরে জানতে চায়-
— আমি কেমন মানুষ হব- বলে দাও।
— ভিকারুননিসা, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পৌছানোর যাত্রাটাই হলো মানুষ হবার জার্নি। প্রতিদিন নিজের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন কোরো ‘কতটা মানুষ হবার পথে এগোলাম, কতটা পিছিয়ে পড়লাম।’ প্রতিদিন একটু একটু মানুষ হয়ে ওঠো, নিজের মতো মানুষ, যে মানুষটি তুমি হতে চাও অবিকল সে মানুষ।
— থ্যাংক ইউ নটর ডেম।

কিছুটা বিরতি দিয়ে ভিকারুননিসা আবেগঘন স্বরে বলে-
— যতই মানুষ হয়ে উঠি না কেন, তোমাকে না পেলে ঠিকঠিক মরে যাবো, হু।
— কথায় কথায় মরতে হবে না, মনে রেখ– জীবন অনেক বড়। এক একটা জীবন জীবন থেকেও বড়, দীর্ঘতর এবং দীর্ঘতম।
— এত্ত কিছু জানি না নটরডেম। মানুষ হবার জার্নিতে যেন কখনোই তোমাকে না হারাই।

হাসতে হাসতে নটর ডেম বলে-
— ভিকারুননিসা, এই একটা মাত্র জীবনে তুমি আমার বামপাশে থেক, হারিয়ে যেও না।

পৃথিবীতে আর কোন শব্দ নেই, দুজন মুখোমুখি বসে আছে, দুজনের দৃষ্টি মিনতি করে যায়- হারিয়ে যেও না… হারিয়ে যেও না… হারিয়ে যেও না…

৫.
বৃষ্টির আজ কি যে হলো! বৃষ্টি বাড়ছে তো বাড়ছেই। ভাবনা হয়- বৃষ্টির ছাটে কি ভিজে যাচ্ছে ঘুঘুদম্পতির খাঁচা! ভিজুক, আজ তাদের কষ্টের দিন। ঠিক আজকের দিনেই ডিমফুটে বের হওয়া তাদের প্রথম বাবুকে পিপড়ার দল কামড়ে কামড়ে খুন করেছিল, তার আর ঘুঘু হয়ে ওঠা হয় নাই। মানুষ হবার জার্নিতে আজ কতটা এগিয়েছে ভিকারুননিসা জানা নেই, সে থাকেনি বামপাশে।

রিকশা ছুটেছে তাই ছপছপ শব্দ হচ্ছে পথে, কামলা ছুটেছে রিকশার পিঠে চেপে। জানি, এ রিকশা মনসুখিয়ায় যাবে না, সে চিনে না মনসুখিয়ার পথ। হঠাৎ, বাতাসে কাঁঠালচাঁপার ঘ্রাণ ভেসে আসে, তাকে ফিসফিসিয়ে বলি, ‘প্রতিদিন মনসুখিয়ার দিকে ছুটে চলেছি আমি। অভ্রবকুল নিবে তো আমায়! আমার যে আর কোথায় যাওয়ার নেই!’

কোনো উত্তর পাই না, শুধু কাঁঠালচাঁপার ঘ্রাণ তীব্রতর হয়ে ওঠে, বাতাসে বিষাদ ছড়িয়ে একটা দোয়েল মাথার ভিতরে গেয়ে চলে-
‘চল মন মনসুখিয়ার কাছে
তার গভীরে জোছনা রঙা রৌদ্রনদী আছে…’

.
মনসুখিয়া। বর্তমানে বইটি অউট অব স্টক।

সেই সব বনজ দিন

“সেদিন অনেক রাত অব্দি বাঁশী বেজেছিল নবীনা’দিদের পুকুরঘাটে। আমি তো নির্বাক শ্রোতা বা দর্শক। ঝুমুরের চোখ দু’টো করমচার মতো লাল দেখেছি, বুঝেছি অনেক কিছুই। বলতে কি পেরেছি কিছু?”- বলতে বলতে বড়’মা কাঁদছিলেন। বড়মা’র ছোট ফুফু ছিলেন এই ঝুমুর, সমবয়সী। অমন রূপবতী মেয়ে বুঝি আর হয় না, বড়’মার ভাষ্য। একানব্বুই বছর বয়েসী অশীতিপর এই বৃদ্ধা আমার মায়ের নানু, আমার বড়’মা। তিনি বলছিলেন আর আমি দেখতে পাচ্ছিলাম সবকিছুই, দেখছিলাম বড়’মার চোখ দিয়ে—চলে যাচ্ছিলাম অনেক, অনেক যুগ আগে।

লাল ঢাকাই শাড়ী পরনে এগারো বছরের কিশোরী ছুটে যাচ্ছে কলাই ক্ষেতের ভেতর দিয়ে আমি দেখতে পাচ্ছি- কিশোরীর গলায় হাঁসুলী, পায়ে রূপার খাড়ু আর কোমর ছাড়ানো ঢেউ খেলানো চুল। ফর্সা, ঝকঝকে গায়ের রঙ। মেয়েটি দৌঁড়াচ্ছে আর কেউ পিছু ডাকছে, ওরে ঝুমুর, ঝুমুরি রে—দাঁড়া-

আমি সব দেখতে পাচ্ছি—-
মাত্র দু’দিন আগে ঝুমুরের বিয়ে হয়েছে। যদিও মেয়ে শ্বশুরবাড়ী যাবে আরো দু’বছর পর তবু এখনো বাড়িতে বিয়েবাড়ীর আমেজ। আর এই মেয়ে ছুটছে সইয়ের বাড়ী। সাথে আমার বড়’মা আলতা, ঝুমুরের সমবয়েসী ভাইঝি।
—-শোন আলতা আমি শ্বশুরবাড়ী গেলেও ফিরে আসবো, আর যাব না—বলছে ঝুমুর
—ধ্যাৎ তাই কি হয়? দেখো না ঝর্ণা খালা কত্তো কাঁদলো বিয়ের সময়। আর এখন বলে যাই রে, বাপের বাড়ীতে বেশীদিন থাকলেই আমার ছেলের শরীর খারাপ করে। তুমিও অমনই করবে—আলতাও হেসে উত্তর দেয়।
—বলেছে তোকে!
—বলেনি আবার? বলেই খুব হাসছে আলতা
—দেখবো তুই কি করিস?
—এমা আমি তো বিয়েই করবো না, বাবাকে বলেছি—আর বাবাও বলেছে সে-ই ভাল করিস না বিয়ে।

দূরে উড়ে যাওয়া বকের সারি দেখে দু’জনেই থমকে দাঁড়ায়। এমন অসময়ে বকগুলো ওড়ার কারন হঠাৎ বেজে ওঠা বাঁশীর সুর। দু’জনে কি এক টানে পায়ে পায়ে ঝোঁপটার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। দেবদূতের মতো দেখতে, একমাথা ঝাঁকড়া চুল উড়িয়ে যে ছেলেটি বসে বসে বাঁশী বাজাচ্ছে ওরা দু’জনেই চেনে তাকে। শ্যামল দাদা, নাবীনাদি’র ছোট ভাই।

—কি রে ঝুমরি তোর নাকি সেদিন বিয়ে হয়ে গেল? এখন তবে কেন এত বন বাদাড় ঘুরে মরছিস। যা, যা ঘরে যা—বললো শ্যামল দা।
—বিয়ে হলেই কি! ও কি এখনই চলে যাচ্ছে না-কি শ্বশুরঘরে?
—এখন যাবে না? বাহ ভালই—

শ্যামলের ঠোঁটের কোনে এক টুকরো বাঁকা হাসি আর ঝুমুরের চোখ ছলছল। সে কেবল পায়ের বুড়ো আঙ্গুলে মাটি খুঁড়ছে। ভঙ্গিটা কেমন অপরাধীর। একটা নিঃশ্বাস ফেলে শ্যামল’দা আবার বাঁশী বাজাতে লাগলো। পাশেই ঝালিঙ্গী নদীর শীর্ণ এক ধারা কুলকুল করে বয়ে যাচ্ছে। নদীর জলে তীরবর্তী কোন গাছের ছোট ছোট হলদে ফুল ঢেউয়ের তালে দুলতে দুলতে কোত্থেকে যে কোথায় চলে যাচ্ছে। আলতা কেবল দূরের সরিষা ক্ষেতের ভেতর দিয়ে এগিয়ে আসা পড়ন্ত বিকেলের দিকে চেয়ে থাকে। হঠাৎ লক্ষ্য করে ঝুমুর যেন কেমন মগ্ন হয়ে তাকিয়ে আছে শ্যামলদা’র দিকে। বাতাসে শীতের গন্ধ।

তারপরের ঘটনা সুখের না মর্মান্তিক কে জানে! যে আলতা দর্পিত ভঙ্গিতে বলেছিল, “এমা আমি তো বিয়েই করবো না, বাবাকে বলেছি আর বাবাও বলেছে সে-ই ভাল করিস না বিয়ে।“ সে-ই আলতারও বিয়ে হয়ে গেল হুট করেই। আর বাইরে যেতে পারে না আলতা বা ঝুমুর কেউই। তবু কোন কোন উদাস দুপুরে মা-খালারা ঘুমে থাকতে দুই জনে চষে আসে মাঠ-ঘাট। নবীনা’দিদের বাড়ী। শ্যামলদাদার বাঁশী এখনো তেমনি বাজে করুণ থেকে করুণ সুরে। মাঝে মাঝে কেবল ওরা চুপি চুপি পায়ে গিয়ে দাঁড়ায় শ্যামলদা’র সামনে। কি যে হয়েছে ঝুমরিটার ওকে দেখলেই কাঁদে। চোখের জলে ভেসে যায় ওর নাক চোখ মুখ। শ্যামলদা’র চোখটাও কি একটু ভেজে? কি জানি, এ হয়তো আলতার চোখের ভুল!

কথা ছিল দুই ফুফু ভাইঝি শ্বশুর ঘরে যাবে দুই বছর পর যখন ওরা তেরোয় পড়বে। সে-ই দিনও ঘনিয়ে এসেছে। সামনের অঘ্রানের দুই তারিখেই দুই সই পাড়ি জমাবে ভিন গাঁয়ে। বাড়ীতে হাসি-আনন্দ। মা চিড়ে কোটে, দাদী বানায় নাড়ু, শিকায় উঠছে ভাঁড়ের পর ভাঁড় দই। অন্য ফুফুরাও নাইয়র এসেছে। কলকাতা থেকে মেয়েদের জন্যে এসেছে শাড়ী, চুড়ি, ছেলেদের জন্যে জরিপাড়ের লুঙ্গি, কুর্তা। বাড়ীর পরিবেশ জমজমাট। কাজের লোকজনের হাঁক ডাকে বাসায় তিষ্ঠানো দায়। বড় বড় রুই,পাঙ্গাস কুটছে পাড়ার বৌ-ঝি’রা উঠানে বসে। ধামা ভর্তি খই, মুড়কি নিমেষে শেষ হচ্ছে। আর পানের বরজ তো খালি হবার যোগাড়। এমন এক উৎসবমুখর দিনে আলতা আর ঝুমুর কোন ফাঁকে বেরিয়ে পড়েছে কে জানে! আজ কার্তিকের শেষ দিন।

নদীর ঘাটে যে জংলা মাচাং সেও ছাড়িয়ে দু’জনে চলে গেছে নীরব থেকে নির্জনে। অবেলার কুয়াশায় ঢেকে আছে জায়গাটা। কেমন নিঃস্তব্ধ, শুনশান চারিদিক। পাখিদের ঘরে ফেরার কিচিরমিচির শুধু। এরই মধ্যে গলাগলি করে দু’জনের সে কি কান্না। কে শুনবে তাদের এই হাহাকার? কে আসবে মোছাতে চোখের জল? ঘোচাতে বিচ্ছেদ জ্বালা? আলতা বলছে,
—মনে থাকবে ঝুমরি, আমরা কিন্তু ও বাড়ী থেকে ফেরত এসেই বিষ খাব।
—কোত্থেকে যোগাড় হবে রে বিষ?
—সে আমি যোগাড় করে আনব, ভাবিস না।

ঝোঁপের ভেতর থেকে মচমচ আওয়াজে ওরা উঠে দাঁড়ালো। অবাক হয়ে দেখছে এই বিজন বনে আবার কে এলো! বাঘ নয়তো! মা বলেছে আলতাকে, ‘দেখিস যেন ওদিকে কক্ষনো যাবি না। ওখানে বাঘ বেরোয়।‘ তা ওরা তো এখানে আসছে সেই ছেলেবেলা থেকেই। বাঘ কেন বেড়ালও দেখেনি কখনো। তবে ওদের দেশে বাঘের উপদ্রব অনেক। এই তো সেদিনও বাপ-মা মরা এতিম ছেলে শহীদুল্লাহ কে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল বাঘে। ওর বড়ভাই আসাদুল্লাহ পাশেই মাঠের ঘাস কেটে আঁটি বাঁধছিল। কি সাহস ছেলেটার! এক্কেবারে ঘাসকাটার কাঁচি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাঘের উপর। আসাদুল্লাহ’র চীৎকার, চেঁচামেচিতে লোক জড়ো হয়েছিল বিস্তর। কিনতু ঐ একলা ছেলেই ভাইকে উদ্ধার করেছিল আর কেঁদে কেঁদে বলেছিল, ‘খোদা হামার মা-বাপ কাইড়্যে নিয়েছ তবু হাউস যায় না, ভাই টাকও নিবার চাও। তুমি এংকা ক্যা খোদা? গরীব দুঃকীর দুক্ক বোঝোনা!’ এসব অবিশ্যি আলতা শুনেছে বাড়ীর ঝি রাসুর মায়ের কাছে। তবে এখন এই সাঁঝলাগা বিকেলে ওর শরীরটাও বাঘের ভয়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে। ভয়ে ভয়ে চারপাশে তাকিয়ে দেখছে।
যাহ বাঘ কোথায়! কোত্থেকে শ্যামল দাদা এসে দাঁড়ালো ওদের পাশে।

ওরা কিছু বুঝে উঠবার আগেই হঠাৎ করে সে ঝুমুরের ডান হাতটা চেপে ধরে আকুল হয়ে বললো, —শ্বশুরঘরে যাসনা ঝুমুর। প্রথমে দু’জনেই হতচকিত হয়ে মৃদু একটা চীৎকার করে উঠেছিল, শ্যামল’দাকে দেখে আলতার যেন বুকে পানি ফিরে এল। তবে সামলে উঠেই সেও অবাক হয়ে দেখে শ্যামলদা’র হাতের মুঠোয় ঝুমুরের হাত। এতক্ষনে সম্বিৎ ফেরে ঝুমুরের। হালকা ভাবে হাতটা ছাড়িয়ে নিল আর ঘুরে দাঁড়িয়ে মাথায় ঘোমটাটা আরেকটু টেনে নামিয়ে নিয়ে দৃঢ় অথচ অস্ফুট স্বরে কেবল বললো—ছিঃ
তারপরে দু’জনেই ছুট। দু’জনেরই বুক ঢিবঢিব। পেছনে পড়ে গেল কলাই ক্ষেত, সর্ষে ক্ষেত আর শ্যামল দাদা।
ঘরে ফিরেই ঝুমুর বললো,—আলতা ও কথা যেন কাউকে বলিসনা ভাই।

—যাহ ও কি বলবার কথা! হ্যাঁ রে তুই ও কি ওকে—?
— না না কি যে বলিস!
—তা’ও ঠিক। আর ওরা হলো গিয়ে হিন্দু। এ কি সম্ভব?
এবার ঝুমুর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ম্লানকণ্ঠে কেমন আনমনে বলে, সে-ই তো।

এই রাত্তিরটাই শেষ। কালই আলতা চলে যাবে শ্বশুরবাড়ি গাইবান্ধা জেলা শহরে আর ঝুমুর পলাশবাড়ীর বাঁশকাটায়। জানীপুর গ্রামের দু’টি মেয়ে কি নিমেষে পর হয়ে যাবে স্বজনদের জন্যে! আর ওরা হাসি তামশায় মেতে উঠবে না। ভাইয়ের কাছে পাখি ধরে দিতে বায়না করবে না। মেয়ে দু’টো এটা মানতেই পারছে না। অথচ দেখো ভাই আর মায়েদের খুশীর অন্ত নেই। যেন ওদের জন্মের পর থেকেই চলছিল ওদেরকে পর করে দেবার এই দূরাভিসন্ধি। সত্যি কি নিষ্ঠুর এই জগত! কেমন করে একটা মেয়ের শেকড় উপড়ে টেনে নিয়ে ফেলে অন্য ঘরে! কেউ এতটুকু উহ করে না, কেউ দেয় না বাঁধা। আলতার বুকে অভিমানের বিশাল পাহাড়। সে ভাবে, আর কক্ষনো ফিরবে না এই বাড়ী, এই নিষ্ঠুর লোকগুলোর মাঝে। ওরা তো কেউ ওকে ভালই বাসে না। থেকে থেকেই ওদের বুক ফেটে একটা করে দীর্ঘশ্বাস বাতাসে ভেসে ভেসে উড়ে যায়। কেউ তা শোনে না। শুধু বাতাস হয়ে রয় সাক্ষী।

আজ সারাদিন ধরে দুই শ্বশুরবাড়ীর লোকজন এসেছে গরুগাড়ী বোঝাই করে। এখন অনেক রাত। তা’সত্ত্বেও বাসন কোসনের ঝনঝন আর খাওয়া দাওয়ার হুল্লোড় লেগেই আছে। শুধু কোনার এক ঘরে কাঠের মতো শুয়ে আছে আলতা আর ঝুমুর। এত হৈ চৈ ওদের কানে যাচ্ছে না। বাইরে করুণ সুরে বাজছে বাঁশী। থেকে থেকেই ফুঁপিয়ে উঠছে ঝুমুর। ঝুমুরের চোখ করমচার মতো লাল। আলতার বুক ভেঙ্গে যাচ্ছে শ্বশুরবাড়ী যাওয়ার কষ্টের চেয়েও অন্য এক বেদনায়।

সেই অন্ধকার থাকতেই বাড়ীর মেয়েরা টেনে তুলেছে ঝুমুর আর আলতাকে। আজ দু’জনে যাবে দুই পথে। এ নিয়ে অবশ্য আপত্তি তুলেছিল মুরুব্বিরা। একই দিনে বাড়ীর দুই মেয়ে তা’ও আবার ফুফু ভাইঝি’র একত্রিত বিদায়! এ তো শুভ লক্ষণ নয়। আলতার দাদাজান মানে ঝুমুরের বাপজান এসব মানেন না বলে সব আপত্তি উড়ে গেছে আগেই। ওই অন্ধকারেই দু’জন কে গোসল করানো হলো সন্দা-মেথি আর হলুদ বাটা মেখে। সে কি শীত! কাঁপছে দু’জন ঠকঠক করে। বেলা উঠবার আগেই সবাইকে খাইয়ে দাইয়ে বিদায় দিতে হবে। নইলে দূর পথে ওদের ফিরতে সমস্যা হবে। বেলা বেলা বৌ নিয়ে ঘরে না ফিরতে পারলে শ্বশুরবাড়ীর ওরাই বা নিজেদের লোকজনকে কি করে দেখাবে কেমন বৌ এনেছে! তাই এত দ্রুত সব আয়োজন, তাড়াতাড়ি যাত্রার তোড়জোর। ভেজা চুলেই তেল দিয়ে টেনে বাঁধা হয়েছে বিড়া খোঁপা। এমন শক্ত করে বাঁধা যে দু’জনের কপালের পাশের শিরায় চিনচিন করছে ব্যাথা। অবিশ্যি এ বোধটাও এখন ওদের কাছে নস্যি। কখন মা, দাদী, খালা, ফুফুদের সাথে কান্নার পাট চুকিয়ে ওরা গরুর গাড়িতে গিয়ে বসেছে ওদেরই মনে নেই। দু’জনেই ছইয়ের ভেতর থেকে যতটুকু দেখা যায় দেখলো, দুই গাড়ী চলে যাচ্ছে উঁচু নীচু রাস্তা ভেঙ্গে দুই দিকে।

দশদিন পরেই অঘ্রানের তের তারিখে আবার একই জায়গায় পরপর এসে দাঁড়ালো দু’জনের গরুর গাড়ী। সেদিন গিয়েছিল ছইয়ের ভেতর একা বসে। আজ দু’জনেই ফিরেছে পাশে বর নিয়ে। আজ বাড়ীতে আনন্দের ঢেউ তেমনি, সেদিন যেমন ছিল। তবে আজ কিনতু ঝুমুর বা আলতা কাঁদছে না। দু’জনের চোখে-মুখেই চাপা খুশী, লাজুক মুখে ঘুরছে। বারেবারে চাপা হাসিতে মুখ চেপে দেখছে দু’জন দু’জনকে। শুধু মন খুলে কথা বলতে পারছে না নানা আনুষ্ঠানিকতার ব্যাস্ততায়। তা হোক সকাল তো পরেই আছে। কত্তো গল্প জমে আছে দু’জনার অন্তরে!

সকালে কুয়োতলায় দাঁড়িয়ে ঝুমুর। মুখোমুখি আলতা—
—কি রে এনেছিস বিষ?
—কোত্থেকে আনব?
—ও মা তুইই না বলেছিলি যোগাড় করবি!
—না রে এখন আর পারবো না। মানুষটা খুব ভাল।
—কোন মানুষ ভাল রে?
—যাহ জানিনা
হিহিহি করে হেসে ওঠে ঝুমুর। বলে
—আমারটাও জানিস। আমি বাবা এই জীবনে আর মরতে চাই না।
—আমিও
—দ্যাখ আলতা এই শাড়িটা সে আমায় দিয়েছে লুকিয়ে
—বাপরে! এরই মধ্যে ঘুষ দেয়াও সারা? আর কি কি দিয়েছে শুনি?
—সর পাজী কোথাকার!

এবার আলতাও হেসে উঠলো খুব জোরে। কোথায় যেন বাঁশী বেজে উঠলো, কি করুণ সেই সুর! সকালের কাঁচাসোনা রোদ ধুয়ে দিচ্ছে ওদের শরীর। তবু বাঁশীর সুর শুনে দু’জনেই একটু কেঁপে উঠলো যেন।

হঠাৎ একটা হলদে ঝিলিক। রোদের এত তেজ? এমন ঝিলিক? মূহুর্তের জন্যে আলতা টের পায় শরীরে একটা লোমশ ছোঁয়া, গরম। ওরই ভারে আলতা পা ভেঙ্গে পড়ে গেল মাটিতে। কুয়োর পাড়ে ধুপধাপ ক’য়েকটা শব্দ। এত দ্রুত, এত দ্রুত যে আলতা কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি একবার শুধু চোখ বড় বড় করে দেখলো ওর সামনে ঝুমুর নেই। আর ওর বাসার মানুষজনসহ গ্রামের অনেক লোকের হৈ চৈ চীৎকার—
—বাঘ, বাঘ, ওরে ঝুমুরোক বাঘে নিয়া গেল—ওরেএএএ—–কেটা কুন্ঠে আছ, আউগাও বাহে—বাহে—-

ঝুমুরের আধখাওয়া শরীরটা পাওয়া গিয়েছিল সেই জংলা মাচার পাশের ঐ জঙ্গলে। শ্যামল’দাদাই দেখেছিল প্রথম।

অনেক আগেই গল্প শেষ, শুয়ে পড়েছি আমরা। আমি আর বড়’মা। বড়’মা পাশ ফিরে শুয়ে কাঁদছেন। ফুলে উঠছে শরীর। টের পাই সবই। কিছুই বলি না, কাঁদুক। সারা জীবন যে দুঃখ তিনি বুকে বয়ে বেড়িয়েছেন এটুকু শোক তো এই বৃদ্ধা কেঁদে ঝরাতেই পারেন। আচ্ছা শোক কি কাঁদলে ঝরে যায়? নাকি আটকে থাকে বুকে? খুব ভাবছি, শোক আসলে কি? শোক কি এমনই? একহাজার বছর পরেও একই জায়গায় দাঁড়িয়েই থাকে!

(একটি সত্যি ঘটনা অবলম্বনে)

হারপিক

০১
বাজিতপুর রেলস্টেশন থেকে কয়েক কিলোমিটার পূর্বদিকে গেলেই ভাগলপুর গ্রাম। অবশ্য এখন আর গ্রাম নয়। আধা শহর। কিছুটা গ্রাম আর কিছুটা শহর। বিশেষ করে মেডিকেল কলেজের আশেপাশের এলাকায় ঢুকলে যে কেউ আর ভাগলপুরকে এখন গ্রাম বলবে না। একটা কমপ্লিট আধুনিক শহরের মেজাজ নিয়ে সে যেনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সুরম্য পরিকল্পিত বিল্ডিং এর সাথে আছে সুদৃশ্য কারুকাজ মণ্ডিত মসজিদ, ক্যাফেটরিয়া, লন, পাওয়ার হাউজ, নয়নাভিরাম বাগানের পর বাগান। শহরের কী নেই এখানে! মেডিকেলের সামনের রাস্তাটির দুই পাশেই দোকানের সারি। অসংখ্য ফার্মেসি। খাবার হোটেল। বেশ চওড়া দাম। আর হবেই বা না কেনো – এসব হোটেলে যারা খেতে আসেন তাদের প্রায় সবাই রোগীদের আত্নীয় স্বজন। আজ আছে কাল নেই। বিপদে পড়ে হোটেলে খেতে আসেন। সবাই জানে এসব খাবারে জমিতে সার দেওয়ার মতো করে গ্যাস্ট্রিক বাড়ে। তবুও কোনো উপায়ান্তর নেই। আর সেই সুযোগে হোটেল মালিকেরা কাঁচা ঘাস কাটার মতো বেশ নগদ কামাই করে নেন। শহর আর গ্রামের পার্থক্যটা বুঝি এখানেই! শহরে বিভিন্ন প্রজাতির ধান্ধা করা যায়। গ্রামে এতোটা যায় না।

মেডিকেল কলেজের অদূরেই আঃ রশিদ শিকদার সাহেবের বাসা। অবশ্য কেউ কেউ বাড়িও বলে থাকেন। আমাদের দেশের একসময় প্রচলিত রেওয়াজ ছিলো শহরে হলে বাসা। আর গ্রামে হলেই বাড়ি। এখন অবশ্য এই সংজ্ঞাটা কিছুটা পাল্টে গেছে। এখন টিনের ঘর, খড়ের ঘর, ছনের ঘর এসব কে লোকে বাড়ি বলে। আর যে বাড়ি গুলো শহরের বাড়ির মতো পাকা, আধাপাকা সে সব কে বাসা বলে। সে দৃষ্টিকোণ থেকে এখন গ্রামেও বাড়ি খুঁজে পাওয়া ভার। আঃ রশিদ শিকদার সাহেবের বাড়িটি বনেদি গোছের। পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ মিলিয়ে চারপাশে চারটি ঘর। পূর্ব এবং পশ্চিমের ঘর দুটি আধা পাকা। উত্তরে-দক্ষিণে কাঁচা। অবশ্য এই দুটি ঘর প্রায় সব সময় খালি পড়ে থাকে। কেবল ঈদের সময় ছেলেরা, মেয়েরা সবাই বাড়িতে আসলে ব্যবহৃত হয়। বাড়ির চারপাশে পাকা দেয়াল। সুউচ্চ। পূর্বদিকের ঘরের সামনেই বিশাল আঙ্গিনা। পাড়ার ছেলে-ছোকরাদের জন্য খুব পয়মন্ত। খেলার মাঠ হিসাবে সারাদিনই জমজমাট থাকে। এরপরেই একটি বিশাল দীঘি। লোকে বলে কুমির দীঘি। জনশ্রুতি আছে, এই দীঘিতে একবার একটি ছেলেকে কুমিরে ধরে। কুমিরটি ছেলেটিকে না খেয়ে মুখের উপর নিয়ে সারা দীঘিতে চক্কর দিচ্ছিলো। ছেলেটির চিৎকারে হাজার হাজার লোক দীঘির পাড়ে জমায়েত হয়। কেউ তাকে বাঁচানোর জন্য দীঘির জলে ঝাপ দিতে সাহস পায়নি। এরপর লাঠিতে ভর দিয়ে হঠাৎ কোথা থেকে এক বৃদ্ধা আসলেন। তিনি জলদ গম্ভীর স্বরে বললেন, দীঘির পানিতে দুই মণ দুধ, পাঁচটি মুরগি এবং একটি ছাগল দিলে ছেলেটিকে বাঁচানো সম্ভব। বুড়ির এই কথা কেউ বিশ্বাস করলো। কেউ করলো না।

শিকদার সাহেবের জান্নাতবাসী বাবা বললেন, আর কোনো রাস্তা নেই বুড়ি মা? বুড়ি খট খট করে জানালেন, আছে বাপু। আর একটি রাস্তা আছে। এই ছেলের বদলে অন্য একজন লোককে পুকুরে বিসর্জন দিতে হবে। উপস্থিত সবাই হতভম্ব হয়ে গেলেন। তা কি করে সম্ভব? অবশেষে অনেক জোগাড় যন্ত্র করে দুই মণ দুধ, পাঁচটি মুরগি এবং একটি ছাগল দিয়ে ছেলেটিকে বাঁচানো হয়।যাওয়ার সময় বুড়িমা বলে গিয়েছিলেন, একটা শানবাঁধানো ঘাট বানিয়ে দাও বড়ে মিয়া। এই ঘাটই আমার সীমানা। গোসল করার সময় কেউ যেনো ভুলেও এই সীমানা লঙ্ঘন না করে। সেই থেকে দীঘির ঘাট শানবাঁধানো। অবশ্য বাড়ির পেছনেও একটি পুকুর আছে। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ এই দুইটিতে গোসল করে। মেয়েরা পশ্চিমের পুকুরে আর পুরুষেরা পূর্ব পাশের দীঘিতে। এটা আঃ রশিদ শিকদার সাহেবের বাবার করা নিয়ম। তিনি খুব কড়া মানুষ ছিলেন। এখনও গ্রামের বয়স্করা উনার বিষয়ে বিভিন্ন কিংবদন্তি বলেন।

সেই বাবার একমাত্র সন্তান আঃ রশিদ শিকদার। তিনিও নম্র, ভদ্র অমায়িক মানুষ। পেশায় একজন অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক। একজন সাদা মনের সফল মানুষ। পাঁচ সন্তানের জনক। দুই মেয়ে এবং তিন ছেলে। সবাই বড় হয়ে গেছেন। সবাই উচ্চ শিক্ষিত। ভালো চাকুরী করেন। হাই সেলারী পান। এতো কিছু সফলতার মাঝেও একটা বিষয় শিকদার সাহেবের মনের মধ্যে মাঝে খচ খচ করে। গ্রামের কিছু উঠতি পরিবারের লোকজন তাদেরকে প্রতিহিংসার চোখে দেখেন। সুযোগ পেলেই নানাভাবে হেনস্থা করেন। ক্ষতি করার চেষ্টা করেন। শিকদার সাহেব এই সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে মনে মনে যুদ্ধ ঘোষণা করে রেখেছেন। তিনি তাদের প্রতি কোনো দুর্ব্যবহার করেন না। আপদে-বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সামাজিক কর্মকাণ্ডে তাদের যথেষ্ট গুরুত্ব দেন। তবুও তিনি প্রতিহিংসার এই অনল পুরোপুরি নিভাতে পারছেন না।

০২
এই শিকদার বাড়িতে বিগত কয়েকদিন যাবৎ একের পর এক অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। বাড়ির সব মানুষের মুখের দিকে চাওয়া যায় না। আতংকের পর আতংক। কেউ জানে না কখন কী ঘটে যায়! এই জন্য সবার মুখের মানচিত্রে এক গভীর চিন্তার রেখাপাত। বাড়ির গৃহকর্ত্রী আয়েশা বেগম রান্নাঘরে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। আজ বড় ছেলে নাফিস শিকদার বউ, ছেলেমেয়েসহ বাড়িতে আসার কথা। সকলেই তাদের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। আয়েশা বেগম তরকারিতে লবণ দিবেন এমন সময় ছোট মেয়ে তাজমুন নাহার দীনা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলো। মা, মা—- ওমা । কি হয়েছে রে? একটু বিরক্ত হয়েই বললেন আয়েশা বেগম বললেন। আজকাল তরকারি রান্না করার সময় কেউ ডিস্টার্ব করলে উনি খুব ক্ষেপে যান। বয়স হয়েছে। অনেক কিছুই মনে রাখতে পারেন না। তেল দিলেন না পানি দিলেন! হলুদ দিলেন না মরিচ দিলেন ইত্যাদি ইত্যাদি। মা, আমার মোবাইলটা খুঁজে পাচ্ছি না। দীনা বললো।কী বলছিস? কোথায় রেখেছিলি? কেনো? খাটের উপর।তুই আসার আগের দিন মানে পরশু আমার মোবাইলটাও খাটের উপর থেকে হারিয়ে যায়। কতো খুঁজাখুঁজি করলাম। পেলাম না। আজ আবার তোরটা গেলো। দেখ্‌ তো মা বাথরুমে হারপিকটা ঠিক আছে কিনা? মায়ের আদেশ পালন করার জন্য দীনা দৌড়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। এই দীনা মেয়েটি খুবই লক্ষ্মী। খুব সুন্দর দেখতে। ছিমছাম গড়ন ।এতো বড় হয়েছে। বি সি এস পাশ করে এখন একটি স্বনাম ধন্য সরকারি কলেজের প্রভাষক। তবুও এতোটুকু অহংকার নেই। শিশুর মতো সহজ-সরল। শিকদার সাহেবের পরিবারে দীনাই একমাত্র অবিবাহিত। বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রতিদিনই সম্বন্ধ আসে। ভালো ভালো ঘর। সুপাত্র। তবুও শিকদার সাহেব রাজি হন না। সবাইকে বলেন, মেয়ে মাত্র চাকুরী পেয়েছে। আর কিছুদিন যেতে দিন।

একটু পরে দীনা আবার রান্নাঘরে ছুটে এসে প্রায় চেঁচাতে চেঁচাতে বললো, মা হারপিকের কৌটা আছে; কিন্তু ভেতরে এক ফোঁটা হারপিকও নেই। কি বলিস মা! গতকালই তো আনা হয়েছে। এর আগেও আরও তিনটি হারপিকের একই পরিণতি হয়েছে। আয়েশা বেগম বললেন। দীনা কী বলবে কিছুই ভেবে পেলো না। শেষে বললো, মা ইলা কোথায় গেছে? ইলাকে দেখছি না কেনো? আয়েশা বেগম বললেন, কোথায় আর যাবে? হয়ত দীঘির পাড়ে খেলছে! দীনা আর কথা না বাড়িয়ে দীঘির দিকে হাঁটা দিলো।

এই ইলা দীনার ভাগ্নি। আপন বড় বোনের একমাত্র মেয়ে। খুব আদরের। পুরো বাড়িতে ছোট মানুষ বলতে ওই একজনই। ইলা তার মা-বাবার সাথে নানু বাড়িতেই থাকে। তার মা-বাবা দু’জনেই চাকুরী করে। মা সরকারি প্রাইমারী স্কুলে এবং বাবা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। দুজনই সারাদিন অফিসে থাকেন। প্রায় সন্ধ্যায় ফিরেন। নানা-নানীর সাথে তার সারাদিন কাটে। কখনও একলা। জন্মের পর থেকে এভাবেই চলছে ইলার জীবন। গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। খুব মেধাবী। ওর ক্লাসে বরাবরই প্রথম হয়। দুষ্টুমিতেও একদম পিছিয়ে নেই। সকলের সেরা। অবশ্য গুণীজনেরা হামেশাই বলে থাকেন, মেধাবিরা একটু- আধটু দুষ্টু হবেই। মেধা ছাড়া দুষ্টুমিরা করা যায় না।

দীনা দীঘির পাড়ে এসেই ইলাকে পেয়ে গেলো। ডাকসই চলছে। দীনাও মুহূর্তেই শৈশব ফিরে পেয়েছে। তারও খেলতে ইচ্ছে করছে। অনেকদিন ডাকসই খেলা হয়নি। অনেকদিন—।। ইলাকে বললো, আমাকে খেলতে নিবি? ইলা হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ল। বললো, তুমি খেলবে মানে? তুমি কি আমাদের মতো শিশু নাকি? দীনাও মজা করে বললো, হুম শিশু ইতো। দেখিস, আমি কোনোদিন বুড়ি হবো না। ইলা আর কিছু বললো না। দীনার হাত ধরে টানতে টানতে বাড়ির দিকে হাঁটা দিলো। দুজনের মনেই আনন্দ আর ধরে না। একটু পরে ইলার ছোট মামা আসবে।। শহর থেকে। আরশি আসবে। ঐশী আসবে। ইউশা আসবে। কতো গল্প হবে বস্তা বস্তা। খেলা হবে। কবিতা আবৃত্তির আসর হবে। চাঁদনী রাতে কানামাছি হবে। লুকোচুরি খেলা হবে। মজার উপর মজা। আনন্দের উপর আনন্দ। এতো আনন্দ— ইলা রাখবে কোথায়?

০৩
গত কয়েকদিন ধরে ইলা বমি করছে। কিছুক্ষণ পর পর। কেবল বিকেল হলে একটু ভালো থাকে। কিছুদিন ধরে ইলার খাবারের প্রতি খুব অরূচি। কোনো কিছুই খেতে চায় না। এর সাথে যোগ দিয়েছে বমির ভয়। ওর এখন বদ্ধমূল ধারনা জন্মে গেছে কোনোকিছু খেলেই বুঝি বমি হয়ে যাবে। ইলার বাবা জায়েদ করিম নিজেই একজন মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট। তিনি ঔষধ দিয়েছেন। কোনো কাজ হয়নি। সাথেই ভাগলপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। সেখানেও ডাক্তার দেখানো হয়েছে। কিন্তু ইলা ভালো হচ্ছে না। ইলার বাবা এখন ঠিক করেছেন ইলাকে একটা ফুল চেকআপ করাতে হবে। মেয়েটি দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে।

পরের দিন আরও কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। ইলার ছোট মামা এবং মামীর মোবাইল দুটিও পাওয়া যাচ্ছে না। নতুন আরেকটি হারপিক কেনা হয়েছিলো। সেটির পূর্বের দশা হয়েছে। হারপিকের কৌটা আছে; ভেতরে কোনো লিকুইড নেই। এসবের সাথে যোগ দিয়েছে একটি অভিপ্রেত খস খস শব্দ। শব্দটি একেকবার একেক জায়গা থেকে আসে। মাঝে মাঝে আসে না। শব্দ লক্ষ করে গেলেও সেখানে শব্দের উৎসের কোনো কূল-কিনারা পাওয়া যায় না। ইলার ছোট মামি শহুরে মেয়ে। তিনি ঠিক করেছেন এই বাড়িতে আর থাকবেন। মোটামুটি সবারই একটা ধারনা পাকা হয়েছে যে, এই বাড়িতে কোনো দুষ্টু ভূতের আছর পড়েছে। সে-ই এই সব কর্মকাণ্ড গোপনে করে বেড়াচ্ছে। আঃ রশিদ শিকাদার সাহেব প্রবীণ হলেও চিন্তা-চেতনায় একজন কমপ্লিট আধুনিক মানুষ। তিনি কোনো ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করেন। কিন্তু তিনিও এসব ঘটনায় উদ্বিগ্ন। গ্রামে দু’একজন যারা চুরি-ছ্যাঁচড়ামি করে তাদেরকে উনি অনেক প্রেসার দিয়েছেন কেউ মানুষ চুরি করেছে কিনা। কিন্তু তাদের কাছ থেকে তিনি কোনো তথ্যই উদ্ধার করতে পারেননি।

আর ইলার নানীও বসে নেই। তাঁর বদ্ধমূল ধারণা এইসব কর্মকাণ্ড ভুত-প্রেত ছাড়া সম্ভব নয়। তাই তিনি তাঁর ছোট ভাইকে দিয়ে ভিন গাঁ থেকে একজন ডাকসাইটে ভূত তাড়ানোর ওঝা কাম কবিরাজ নিয়ে আসলেন। বাড়ি জুড়ে হুলস্থূল কাণ্ড। ওঝা তাঁর সাগরেদদের দিয়ে পুরো বাড়ির চারপাশে তাঁর হাতের আশা দিয়ে রেখা টেনে দিলেন। সবাইকে বাড়ির বাইরে যেতে নিষেধ করে দিলেন। কেউ যদি তাঁর অনুমতি ছাড়া বাড়ির বাইরে যান, তাহলে তাঁর রক্ত বমি হবে। সাথে মারা পড়বে। অতঃপর ভেতর বাড়ির উঠানে আগুন জ্বালানো হলো। বেশ বড় আগুনের কুণ্ড। কয়লা আর কাঠ পুড়ানো হচ্ছে। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। সবাই চারপাশে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছেন। ওঝা ঘোষণা করে দিয়েছেন কিছুক্ষণের মধ্যেই এই বাড়িতে থাকা সমস্ত ভূত-প্রেত কে এই জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে পুড়িয়ে মারা হবে। সেই দৃশ্য সবাই সচক্ষে প্রত্যক্ষ করতে পারবেন। উত্তেজনার পর উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছে। কেবল আঃ রশিদ শিকদার সাহেবের এসব ভণ্ডামি ভালো লাগছে না। তিনি বারবার গিন্নীকে নিষেধ করেছেন। কিন্তু গিন্নী তাঁর কথা শোনেনি। দীনাও বাবার সাথে সহমত। কিন্তু মা –কে কিছু বলতে সাহস পায়নি।

ওঝা মন্ত্র পড়া শুরু করে দিয়েছেন। আগুনের মধ্যে ধূপ ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। ধূপের গন্ধে সমস্ত বাড়ি মৌ মৌ করছে। সবার চোখে-মুখে আনন্দ, উত্তেজনা, ভয়, আতংক। ইলা দীনার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আরশি, ঐশী এবং ইউশাও। তিথি, নাবিলা, সিয়াম, সিফাত ওদেরও আজকে বাড়িতে বেড়াতে আসার কথা। বিভিন্ন ধরনের বাদ্য যন্ত্র বাজছে। ওঝাকে এখন অতিমাত্রায় উত্তেজিত দেখা যাচ্ছে। তিনি ক্ষণে ক্ষণে উত্তেজনা বশে আকাশের দিকে লাফ দিচ্ছেন। খামচি দিয়ে একটা একটা করে ভূত ধরে আনছেন। আর চোখের পলক ফেলার পূর্বেই আগুনে নিক্ষেপ করছেন। আগুনে পোড়ার পর ভূতের আত্মা সাঁই সাঁই করে পালিয়ে যাচ্ছিলো। সেই পালিয়ে যাওয়ার শব্দ সবাই স্বকর্ণে শুনতে পেলেন। এভাবে সমস্ত ভূত মারা যাওয়ার পর ওঝা বাড়ির প্রত্যেক ঘরে, ঘরের সামনে পেছনে, আনাচে কানাচে ধূপের ধোঁয়া ছড়িয়ে দিলেন। সবশেষে তিনি ঘোষণা করলেন, আপনাদের বাড়ি আজ থেকে সর্ব প্রকার জিন, ভূত-প্রেত মুক্ত হলো। সবাইকে মেরে ফেলা হয়েছে। তাছাড়া আমি বাড়ি এমন ভাবে বন্ধন করে দিয়েছি যে, ভূত কেনো, ভূতের বাপ-দাদার সাধ্য নেই এই বাড়ির ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে পারে।। অবশেষে তিনি ইলাকে বিশেষ ভাবে ঝাড়ফুঁক দিলেন। বললেন, আর কোনোদিন এই মেয়ের বমি হবে না।

ইলার নানী মনে মনে খুব স্বস্তি পেলেন। দুঃশ্চিন্তা মুক্ত হলেন। দীনা কিছুটা বিভ্রান্তিতে পড়ে গেলো। বিশ্বাসও করতে পারছে না। আবার অবিশ্বাসও করতে পারছে না। শেষ পর্যন্ত মনকে এই বলে প্রবোধ দিলো যে, আচ্ছা দেখাই যাক না কি হয়! সবকিছু ভালো হলেই তো ভালো!!

০৪
কিন্তু ওঝা চলে যাওয়ার ঘণ্টা দুই পড়েই যখন ইলা বমি করতে লাগলো, তখন দীনার সমস্ত বিশ্বাস কর্পূরের মতো উড়ে গেলো। এদিকে দীনার ছুটি শেষ হয়ে গেছে। আগামীকালই সে ময়মনসিংহ ফিরবে। ইলাও দীনার সাথে ময়মনসিংহ আসার জন্য মনে মনে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। শুধু অপেক্ষা করছে কখন, কিভাবে কায়দা করে আন্টিকে প্রস্তাবটি দেওয়া যায়। ইলার দৃঢ় বিশ্বাস আন্টি নিশ্চয় না বলতে পারবেন না। ইলার ছোট মামারাও আগামীকাল ঢাকা চলে যাবেন। যাওয়ার আগে ইলার ছোট মামা তাঁর নানীর জন্য একটি সুন্দর মোবাইল হ্যান্ড সেট, কিছু খাবার-দাবার, সাবান-হারপিক সহ সংসারের নিত্য প্রয়োজনীয় প্রত্যেকটি জিনিস কিনে এনেছেন।
পরদিন সকাল বেলা দীনা বাথরুমে গিয়ে দেখতে পায়, হারপিকের বোতল শেষ। অথচ গতকালই কিনে আনা হয়েছে। মুহূর্তের মধ্যে খবরটি পরিবারের প্রায় সবার কাছে পৌঁছে যায়। এক ধরনের আতংক এমনিতেই সবার মাঝে বিরাজ করছে। তাঁর উপর এসব ঘটনায় সবাই এখন রীতিমত বিব্রত। চেষ্টা তো আর কম করা হয়নি। কিছুতেই কিছু হলো না। দীনা বাজিতপুর রেলস্টেশন থেকে চট্টগ্রাম হতে ছেড়ে আসা বিজয় এক্সপ্রেসে ময়মনসিংহ আসবে। ইতোমধ্যে টিকেট সংগ্রহ করা হয়েছে। ইলাও দীনার সাথে আসছে। ইলার আম্মু আসতে দিতে চায়নি। আব্বুও। তবুও ইলার জিদের কাছে তারা পেরে উঠেনি। সে আসবেই। তাছাড়া ডাক্তারও বলেছেন ওর বায়ু পরিবর্তন খুব জরুরি। আরও একটি কারণ আছে, অফিস ফেরত দীনা বাসায় একা একা থাকে, সময় কাটতে চায় না। ইলা থাকলে বেশ হয়।

ট্রেনে উঠার আগমুহূর্তে ইলা একবার স্টেশনে বমি করে দিলো। দীনার জন্য এটা খুবই বিব্রতকর পরিস্থিতি। তবুও তাঁর চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। আশার কথা বমি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। তারা ট্রেন ছাড়ার পূর্বেই উঠতে পেরেছে। পাশের সিটে বসা ভদ্রলোক দীনার সুপরিচিত। সিনিয়র কলিগ। নাম জনাব কছিম উদ্দিন। দীনার কলেজেরই সহকারি অধ্যাপক। জনপ্রিয় কবি এবং কথা সাহিত্যিক। হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ, চট্টগ্রাম থেকে মাস্টার্স ১ম পর্বের ভাইভা নিয়ে ফিরছেন। সদালাপী মানুষ। সহজ, সরল প্রকৃতির। দীনাকে দেখে খুব খুশি হলেন। দীনাও খুব খুশি। একটু পরেই ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। আস্তে আস্তে গতি বাড়তে লাগলো। পরিষ্কার আকাশ। কোথাও একরত্তি মেঘও নেই। চমৎকার প্রাকৃতিক আবাহন। সবে বসন্ত উকি দিয়েছে। রেললাইনের দুই পাশে প্রায়ই শিমুলের ফুল দেখা যাচ্ছে। গাছে গাছে নতুন পাতা, ফুল ও কুঁড়ি। বমি করতে করতে ক্লান্ত ইলা একটু পরেই আন্টির শরীরে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কছিম উদ্দিন স্যার দীনাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার সাথের মেয়েটি কে?স্যার ও আমার ভাগ্নি। একমাত্র বড় বোনের একমাত্র মেয়ে। মেয়েটি বুঝি ট্রেনে উঠার আগে বমি করছিলো? জী স্যার। কিছুদিন ধরে আমাদের বাড়িতে অনেক অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। কী রকম? দীনা সবিস্তারে প্রত্যেকটি ঘটনা বর্ণনা করলেন। ইলার বমি করা, মোবাইল হারিয়ে যাওয়া, খসখস, শব্দ করা, ওঝার ভোজবাজি কোনোকিছু বাদ দেয়নি। ট্রেন ইতোমধ্যে কিশোরগঞ্জ স্টেশনে এসে থেমেছে। কছিম উদ্দিন স্যার প্রত্যেকটি ঘটনা অত্যন্ত মনোযোগের সহিত শ্রবণ করলেন।

ইলা এখনও ঘুমুচ্ছে। দীনা একটু পর পর ইলার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। কছিম উদ্দিন স্যার কী যেনো ভাবছেন। উনি কবি-সাহিত্যিক মানুষ। ভাবাভাবিই উনার কাজ। তাই দীনা উনাকে বেশি ঘাঁটালেন না। বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা। অবশেষে দীনাই নীরবতা ভেঙ্গে জিজ্ঞেস করলো, স্যার কি ভাবছেন? কছিম উদ্দিন স্যার সম্বিৎ ফিরে পেলেন। বললেন, ও তোমার ঘটনাটাই ভাবছিলাম দীনা। কিছু পেয়েছেন স্যার? দীনা সাগ্রহে জিজ্ঞেস করলো। হুম, ঘটনাটির এক ব্যাখ্যা আমি দাঁড় করিয়েছি। তুমি হয়ত মানতে চাইবে না। কারণ তুমি ইলাকে খুব ভালোবাসো। আমি মানবো না কেনো স্যার? আপনি বলুন। যুক্তিসংগত হলে আমি অবশ্যই মানবো। কছিম উদ্দিন স্যার বলা শুরু করলেন, তোমাদের বাড়ির এই সমস্ত ঘটনার জন্য দায়ী হলো এই মেয়েটি। প্রত্যেকটি হারপিক ইলাই খেয়েছে। দীনার মোটেই সহ্য হলো না। সে শুরুতেই প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠলো। কী বলেন স্যার। আপনার কথা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। অসম্ভবের উপর অসম্ভব। এ হতেই পারে না। দীনার সুতীব্র প্রতিবাদ দেখে কছিম উদ্দিন স্যার হাসতে লাগলেন। প্রাণ খোলা হাসি। হাসতে হাসতে শেষে বললেন, আমার কথা যে ১০০% ঠিক আমি সেটা দাবী করছি না। আমি যা বলছি, সেটা আমার একটা হাইপোথিসিস। সাধারণতঃ ভুল হওয়ার কথা নয়। ঠিক আছে তুমি যেহেতু শোনতে প্রস্তুত নও, তাহলে আর আমি বলছি নে। দীনা সাথে সাথে তাঁর অবস্থান থেকে সরে এসে বললো, না স্যার। আপনি বলুন। আমি ধৈর্য ধরে শুনবো।

০৫
কছিম উদ্দিন সাহেব বললেন, প্রথমতঃ ইলা কোনো একদিন কৌতূহল বশত সামান্য পরিমাণ হারপিক ছেঁকে দেখেছে। মুখে নিয়েই ও বুঝতে পারে হারপিকের স্বাদটি তেতো নয়। কিছুটা টক টক। তবে সব মিলিয়ে স্বাদ মন্দ নয়। সেই থেকে শুরু। ও একটু একটু করে হারপিক খেতে শুরু করে দেয়। পরিমাণ সামান্য হওয়ায় এটা ওর শরীরে আস্তে আস্তে মানিয়ে যায়। একটা সময় এটা ওর নেশায় পরিণত হয়। ও হারপিকে আসক্ত হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে খাওয়ার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু যখনই পরিমাণ বেশি হয়ে যাচ্ছে, তখনই ওর লিভার সেটা কাভার করতে পারছে না। ফলে বমি দেখা দেয়। লিভারের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো, সে তার ধারণ ক্ষমতার বাইরে এবং অযোগ্য কোনোকিছু রাখবে না। বমির মাধ্যমে সেটা বের করে দেবে। অবশ্য এখানে মূল অনুঘটক হলো মস্তিষ্ক। সে-ই প্রথম সংকেত দেয়। এজন্য বমি মানুষের জন্য অনেক সময় বিরাট উপকারী হয়ে থাকে। বমি না হলে পাকস্থলী ফুলে যাবে। প্রসাব, পায়খানার নানা জটিলতা দেখা দিবে। এমন কি মৃত্যুও হতে পারে।

আমি কি একটি প্রশ্ন করতে পারি স্যার? দীনা বললো।
হুম। কেনো নয়। অবশ্যই করতে পারো।
হারপিক খেলে তো স্যার ওর মারা যাওয়ার কথা?
একদম খারাপ বলোনি তুমি। কিন্তু হয়েছে কি তুমি যদি পরিমাণের কম বিষও খাও; তোমার শরীরে সামান্য উপসর্গ দেখা দিতে পারে। কিন্তু তুমি মারা যাবে না। তারপর আস্তে আস্তে বিষের পরিমাণ নির্দিষ্ট মাত্রায় বাড়িয়ে দাও। একটা সময় দেখবে তোমার শরীর এই মারাত্বক বিষকেই কনজিউম করে নিচ্ছে। কিছুদিন আগের একটি ঘটনা, তুমি হয়ত শোনে থাকবে একটি লোককে কিং কোবরা কামড় দেয়। সবাই অস্থির। চিৎকার, চেঁচামেচি, ডাক্তার এসব চলছিলো। কিন্তু যাকে কামড় দিয়েছে তাঁর কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। সে হাসছিলো। পরে দেখা গেলো লোকটির কিছুই হয়নি। আসলে কথায় বলে না, শরীরের নাম মহাশয়। যাহা সহাবে সে তাহাই সয়।
দীনা আর কোনো প্রশ্ন করলো না। স্যার বলতেই থাকলেন, দ্বিতীয়তঃ মোবাইল চুরির বিষয়টি। দীনা তোমাকে বলতে ভয়ই পাচ্ছি। কারণ তুমি খুব রিয়েক্ট করো।

না স্যার। আমি আর রিয়েক্ট করবো না। আপনি বলুন।
স্যার আবার বলা শুরু করলেন। ধন্যবাদ তোমাকে। তুমিই বলেছো ইলার মা-বাবা দুজনেই চাকুরী করেন। উনারা ইলাকে সময় দিতে পারেন না। তোমার মা-বাবাই উনার একমাত্র সঙ্গী। তুমি খেয়াল করলেই দেখবে স্কুলের সময়টা ওর খুব ভালো লাগে। কিন্তু বাসায় আসলেই ও একদম বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। কারণ তোমার মা-বাবা ওকে পর্যাপ্ত দিতে পারছেন না। উনারাও নানা কাজে ব্যস্ত থাকেন। উনাদের দিয়ে ইলার বা-বাবার অভাব পূরণ হচ্ছে না। ইলা অনেক সময় তোমার আম্মুর মোবাইল অথবা তোমার আব্বুর মোবাইল দিয়ে ওর মা বাবাকে কল দিতে চেয়েছে। কিন্তু নানা কারণে দিতে পারেনি। হয়ত মোবাইলে ব্যালেন্স নেই। কিছু মনে করো না দীনা হয়ত ওর নানা-নানী ওকে মোবাইল ব্যবহার করতে দেয়নি। অথবা ওর বাবা-মা কল রিসিভ করেনি ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক কারণে মোবাইল নামক এই যন্ত্রটির প্রতি ইলার মন বিষিয়ে উঠেছে। আসলে বিষণ্ণতার চেয়ে বড় ঘাতক আর নেই। যে বয়সে তার মা-বাবার আদর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন; সেটা সে পাচ্ছে না। তাই ও এখন দিন দিন ক্ষেপে যাচ্ছে এবং একরকম মানসিক সমস্যার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তুমি একটু খেয়াল করলেই দেখতে ইলা অনেকদিনই তার মাকে চাকুরী ছাড়তে বলেছে। এই কথা শোনে দীনা বললো, স্যার আপনি জানলেন কিভাবে? আমার সামনেই ও অনেকদিন এই কথা বলেছে। স্যার আর একটি প্রশ্ন করি। হুম একটি নয়। তোমার যতো জিজ্ঞাস্য আছে সব বলো।

স্যার মোবাইল গুলো ও কী করেছে? খুব কঠিন প্রশ্ন দীনা। উত্তর দেওয়া মুশকিল। তবে আমার ধারণা, মোবাইল গুলো সে পুকুরের পানিতে ফেলে দিয়েছে। ওর জিদ একটাই, সে যেহেতু এই মোবাইল দিয়ে কথা বলতে পারবে না। সুতরাং অন্য কাউকেও কথা বলতে দিবে না। হতে পারে স্যার। এখন আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি।
কছিম উদ্দিন স্যার বললেন, তুমি ওকে হাতে নাতে ধরতে চাও দীনা?
জী স্যার। কিন্তু কিভাবে?
এখন তুমি বাসায় ফেরার সময় ওর সামনেই একটি হারপিক কিনবে। সেটা নিয়ে তোমার টয়লেটে রাখবে। তারপর দেখো কী হয়! এই বলে স্যার হা হা হা হেসে উঠলেন। সেই সুউচ্চ হাসির শব্দে ইলার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ট্রেনও ময়মনসিংহ রেলস্টেশনের কাছাকাছি এসে পড়েছে। সবুজ বাতি দেখা যাচ্ছে।

০৬
দিন দুই পরে একদিন সারারাত বৃষ্টি হয়েছে। কলেজ রোড পানিতে সয়লাব। কলেজ রোডের বেশ কিছু সমস্যার মধ্যে এটিও অন্যতম। অবশ্য আশার কথা হলো এই সময়টাতে রিকশার কোনো অভাব হয় না। অসময়ে দুধের মাছের মতো। যেমন খুশি দাম হাঁকানো যায়। ইচ্ছা হলে যাও, না হলে না যাও। দীনা রিকশার ভাড়া ঠিক করছিলো। এমন সময় কছিম উদ্দিন স্যার। তিনি অফিসে যাবেন। কাকতালীয় ভাবে দুজনেরই সকাল নয় টায় ক্লাস। দীনা সালাম দিলো। স্যার জিজ্ঞেস করলেন, কি খবর দীনা?

স্যার বিশ্বাস করবেন না, আপনার কথাই মনে ভাবছিলাম। সেদিন আপনার কথা মতো আমি একটি হারপিক কিনে তবেই বাসায় গিয়েছিলাম। তারপর স্যার আপনার কথাই ঠিক স্যার। আমি হাতেনাতে ধরেছি। ও খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু আমি ওকে তেমন কিছু বলিনি স্যার।
তুমি ঠিক করেছো। ওকে এখন তুমি সঙ্গ দাও। সব সময় অব্জারভেশনে রাখবে। ওর পছন্দ মতো চকলেট, চুয়িংগাম, চকলেটবার মাঝে মাঝে ওকে খেতে দেবে। মনে রাখবে ও এখন এক প্রকার নেশায় আসক্ত। তুমি ওকে এখানে এনে খুব ভালো করেছো। আমার সাথে একবার আলাপ করিয়ে দিও।
অবশ্যই আলাপ করিয়ে দেবো। স্যার আরও একটি কথা, সবগুলো মোবাইল কুমির দীঘিতে পাওয়া গেছে। কিন্তু স্যার একটি বিষয় বুঝতে পারলাম না।
কছিম উদ্দিন স্যার বললেন, কোন্‌টা?
এই যে স্যার একটা খসখস শব্দ প্রায়ই হতো!!

ওটা কিছু নয়। ইঁদুর, বিড়াল, চিকা ওরা এমন শব্দ করে থাকে। বিশেষ করে ওই সময়টাতে তোমার কেউ স্বাভাবিক চিন্তা করোনি। তাই যে কোনো স্বাভাবিক শব্দ তোমাদের কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়েছে। এই কছিম উদ্দিন স্যার স্বভাব সুলভ হা হা হা করে হেসে উঠলেন। দীনাও সেই হাসিতে যোগ দিলো।।

আসলে গল্পটি এখানেই শেষ হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু শেষ হয়েও হইল না শেষ! ইলার হারপিক খাওয়ার এই ঘটনা এক কান, দুই কান করতে করতে সারা গ্রামে সাড়া তুললো। কিছু মানুষ খুব সহজেই বিশ্বাস করে নিলো এই মেয়েটির মধ্যে একটি সহজাত ঐশ্বরিক ক্ষমতা আছে। সেই ক্ষমতা বলেই সে হারপিকের মতো বিষ খেয়ে হজম করতে পেরেছে। বেশ আর যায় কোথায়? সরল বিশ্বাসে অনেকেই ইলার কাছে পানি পড়া সহ বিভিন্ন কাজে আসতে লাগলো। ঐশ্বরিক ক্ষমতা বলে কথা!!
——————-

মরা ব্যাঙের নাচ

মাঝে মাঝে আমায় বোবায় পায় বলে বাক্যি হরে যায়। মুখে তখন একটা অদৃশ্য ‘কালা হাতে’র মতো সেলোটেপের অস্তিত্ব টের পাই, আর বুকের উপর দিয়ে গোদা পায়ে কেউ নির্ঘাত হেঁটে চলে যায়। কারো কোনো প্রশ্নের উত্তরে একখানা অক্ষর পর্যন্ত মুখের পেট থেকে খসাতে যন্ত্রণা ও চরম অনিচ্ছা। ফলত অন্তর্জলি যাত্রায় বসা লোককে গঙ্গোদক দেবার সময় যেমন নূন্যতম ঠোঁট ফাঁক করে ঢেলে দেওয়া হয়, আমিও তেমনি আধমরা ঠৌঁট ফাঁক করে উত্তর দেব দেব করতে করতেই টাইম আপ! মাঝে মাঝে মনে হয়, এই আমি আসলে মুখ ভেটকে গেলাস ভর্তি নিমপাতার রস গেলার মতো একটা এক্সিসট্যান্স। সুতরাং কথা খরচ করতে হলে আমি একেবারেই নাচার।

একই অবস্থা হয় লেখার বেলাতেও। একখানা অক্ষর লিখতেও আঙুল চলে না। খাতায় কলমে লেখা তো কবেই বিগত শতাব্দীর গোলাপফুল আঁকা মরচে ধরা তোরঙের মতো গতায়ু হয়ে চিলেকোঠার ঝুল ধুলোয় কিছুটা কেতড়ে পড়ে আছে। তার উপর ঠাকুমার গায়েহলুদে পাওয়া মাদুরখানা কাঠি ও সুতোর বাঁধন আলগা হয়ে গুটনো আছে মণখানেক ধুলো মেখে। তাকে দেখে মনে হবে একদা অষ্টাদশী বিয়ের কনেটি রূপ-যৌবন ও তৎসহ পেশিটেশি হারিয়ে ঝুল, মানে ঝুলঝুলে চেহারাপ্রাপ্ত। খাতা-কলম জিনিস দুটোর এখন অনেকটা সেই দশা। কেবল মাঝে মাঝে সরকারী ফাইলের অন্তবিহীন গতিহীন লাইনে লাইন লাগানোর জন্য দরখাস্ত-টরখাস্ত লিখতে দরকার লাগে। তো লিখতে ইচ্ছে করে না যেমন তেমন বিষয়, তার থেকেও বড়ো কথা হলো মনে হয় যেন লিখতেই পারব না। – আমি লিখতে জানিই না – কোনো দিন লিখিইনি! এসব ভাবনার পাশাপাশি প্রচন্ড একটা ভয় জেঁকে বসে।

ধরুন, আমার পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোবে। বড়দি ক্লাসে ঢুকছেন, এক্ষুণি রেজাল্ট ঘোষণা হবে। আর ভয়ে আমার হাত-পা কাঁপছে। মানে চোখ মাথায় উঠে গিয়ে মাথা লাট্টুর মতো ঘুরছে আর থেকে থেকে দ্যাখ বাবাজী দেখবি নাকি করে চোখের সামনে অন্ধকারের ভেতর বিদ্যুত ঝিলিক মারছে। কারণ আমি তো জানি, কী হতে চলেছে! ক্লাস ফাইভে অঙ্কে ছিলাম গ্যালিলিওর জ্যাঠাইমা। অঙ্ক পরীক্ষা দিয়ে ঘন্টা পড়ার দশ মিনিট আগে হল থেকে বেরিয়ে এসেছি এবং অনেক হিসেব করে আমার ধারণা দৃঢ় হলো অঙ্কে চব্বিশ পাবো। কিন্তু সবথেকে বড়ো ট্রাজেডিটা হলো, অঙ্কে মেরেকেটে তিরিশ পেলেও আমি প্রথম বা দ্বিতীয় স্থানে গেঁটিয়ে বসতে পারতাম। কেন, কীকরে সে অন্য গপ্প। তো বারফাট্টাই থাক। বড়দি তো রেজাল্ট বলছেন, – বলছেন – ভালো ভালো রেজাল্ট বলা হয়ে গেল, নিজের নামটা কানে শুনলাম না। নাকি নিজের নামটাই ভুলে গেছি রে, বাবা! তাহলে কি আমার ধারণাই ঠিক? টেনশনে নন-সেন্স হবার মুখে প্রায় সব শেষে একটা বিষয়ে ফেল মেরে উত্তীর্ণ হবার ঘোষণায় আমার নাম এক্কেবারে পেত্থমে! হুঁ হুঁ বাবা! এরপরের ঘটনা ইতিহাস। অঙ্ক শিখি যে কাকুর কাছে তাঁর কাছে যথেষ্ট পরিমাণে উত্তমমধ্যম খেয়ে মুখের ভূগোল পাল্টে গেল বটে, ক্লাস সিক্সে কিন্তু এ শম্মাই অঙ্কে হায়েস্ট নম্বর পেল এটাও মনে রাখবেন! তবে জীবনে ওই একটিবার। তারপর মাধ্যমিক পর্যন্ত ঘষটে ঘষটে মাজা ব্যথা নিয়ে অঙ্ক টপকেছি।

কিছু মনে করবেন না, এক কথা বলতে বসে অন্য কথায় কিস্যা বহুদূর চলে এলো। একেবারে “শিবেরগীত” শেষ করে বাঁকের মুখ থেকে ফেরৎ আসছি। যা বলছিলাম, লেখার ভয়ে তো হার্টবিট মাথায় ফিল করি আমি। নানা জায়গাতেই ফিল করি, এমনকি যেখানে হার্ট আছে তার ঠিক উল্টো দিকেও ঢিপ ঢিপ করে। মানে বাম দিকের বুকের পাঁজর পার করে পিঠের দিকে হার্টবিট চলে।

দূর ছাই! আবার ফালতু বকছি! বলছিলাম লেখা ও কথা মাঝে মাঝে মনের ভেতর হুুড়কো লাগিয়ে অন্ধকারে চুপ করে বসে থাকে। সন্দেহ হয়, অ্যালঝাইমার হলো নাকি! একটা শব্দ, একটা ইনিয়ে বিনিয়ে বাক্য – কিচ্ছু মনে পড়ে না মাইরি! অথচ বিদ্যাসাগর মশাই বর্ণপরিচয় দ্বিতীয় ভাগে লিখেছিলেন – ঐক্য বাক্য মাণিক্য। কিন্তু আমার তো সব ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। হার্ট ফুসফুস কিডনি মগজ – সব ছতিচ্ছন্ন। সুতরাং ঐক্য ও বাক্যের হাত ধরাধরি প্রেমের মাণিক্য আসবে কোত্থেকে?

অথচ কথার চাষ চলছে দুনিয়াময়। কত ধরনের কথা। রূঢ়, প্রেমময়, স্নেহময়, তৈল নিষিক্ত ইত্যাদি ইত্যাদি। সামাজিক মাধ্যমগুলোতে খুব ভালো উপলব্ধি হয় উক্ত ধরনগুলি। আর দরকারী কথা বাদ দিয়ে ফালতু কথায় তীরের মুখ ঘুরিয়ে দিতে পারে, না-কে হ্যাঁ, আর হ্যাঁ-কে না, দিনকে রাত, রাতকে দিন করতে পারে এমন এলেমদার কি কম পড়েছে? রাজনীতির লোকেরা আছেন তো! পড় পড় পড় পড়বি পাখি ধপ! – চোখ সরু করে মনে মনে বীজমন্ত্র আওড়ালেও, পাবলিক প্লেসে কথা বলার সময় সাধারণত কপালের চামড়ায় ইস্ত্রি মারা থাকে।

আর যারা কথা বেচে খান, সে সেক্টরটাও নেহাৎ কম যায় না। কাউকে একটুও ছোট করার নটখটামি না করেই হাত তুলছি, ছাড়ুন তো – কথা বেচতেও “এলেম” লাগে আগেই বলেছি! সংবাদমাধ্যম এ ক্ষেত্রে এক নম্বরে। কত সূক্ষ্ম হিসেব কষতে হয় বলুন তো? দল, অর্থ, টিআরপি, কাকে চটাবে, কাকে রাখবে – তেমন তেমন ঘটনা ঘটে গেলে অচানক চানক্যবাজি সহজ নয়। আরও আছে, শুধু ওরাই যে নন সে যে বাপু আর বলে দিতে হবে না, তা আপনারা খুব ভালো করেই জানেন।

দুঃখ হচ্ছে, “কথা বেচে খাওয়া” লোকজনের কথা বাদ দিলে কথার চাষ অধিকাংশ সময় শব্দদূষণ ছাড়া কিছুই করে না। কারণ ঠিক কথাটা ঠিক সময়ে আমরা সম্মিলিতভাবে বলতে পারি না। হয়তো বা বলতে চাইও না। ছা-পোষা মানুষ আমরা, বাঁশ খেতে চাই না, বড়ো ভয় পাই কার লেজে কখন পা পড়ে যাবে ঠিক কী! হতে পারে সে কোনো গনহত্যা বা এককের উপর অবিচার। হতে পারে কোনো কোটি কোটির ঘাপলা কেস। আমরা ফুটানি করি, ট্রোল করি, ফাজলামি করি – এই পর্যন্ত। আবার ধরুন, হয়তো আপনাকে কেউ বেশ দু-কথা বলল, আপনি ঠিকই বুঝলেন, সে লোক যতই দাঁত কেলিয়ে বলুক না কেন, কথাখানা অপমানেরই। অথচ আপনিও দাঁতটাই কেলালেন, কিন্তু উপযুক্ত যে কথা দিয়ে তাকেও আচ্ছা করে কেলানো যেত, সেটা পরে মনে করে নিজের মনেই ফুঁসবেন। তখন গালাগালটা যে অ্যাকচ্যুয়েলিই কেবল নয়, বরং “দুইচ্যুয়ালি”ই নিজেকেই দেওয়া উচিত সেই মুহূর্তে ফিল করে নিজের গালেই চড় কসাবেন।

কথা না বলেও যথেচ্ছ প্রতিবাদ করা যায় বটে! ভেরকরের বই পড়েছিলাম, সাইলেন্স অফ দ্য সি। অনেকদিন আগে পড়া। স্মৃতি ল্যাং দিতে পারে, তবু যদ্দূর মনে হচ্ছে ঘটনাটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে। ফ্রান্সের এক গ্রামে জার্মানীর সৈনিকদের সঙ্গে কেউ একটি কথাও না বলে নিরুচ্চার ঘৃণা দিয়ে তাদের ইগো দুরমুশ করে দিয়েছিল গ্রামবাসী। তাই কথার সঙ্গে সঙ্গে নৈঃশব্দও হাতিয়ার হতে পারে ক্ষেত্রবিশেষে। আমরাও যদি পারতাম, অসৎ রাজনীতির লোকেদের নিঃশব্দে উপেক্ষা করতে!

সংসার রাজনীতিতে কথার চাষাবাদ, সার-চাপান, ল্যাং মারামারি হামেশাই চলে। কুরুক্ষেত্র রণাঙ্গনের কিংবা রামায়ণের যুদ্ধুর ব্রহ্মাস্ত্র, দিব্যাস্ত্র, ব্রহ্মানন্দ অস্ত্র, শিলীমুখ, ঐশিক, অশ্বমুখ ইত্যাদি হরবখতই কথার ধনুকে পরিয়ে বেমক্কা ছোঁড়াছুড়ি চলছে। তাতে ঘায়েল হয়ে অসার জীবনসহ দিল দরিয়ায় ভেসে যেতে চায় বটে, তবে অচিরাৎ মৃতসঞ্জীবনী আমাদের দিব্যি বাঁচিয়ে তোলে। বেড়ালের নটা জীবন তো সংসার রণাঙ্গনে বাঁচার ফিরিস্তির তুলনায় নস্যি।

তবু এক একসময় দুম করে আঁতে লেগে যায় বইকি! তখন মনে হয় কে আমি, আমি কার। দারা পুত্র, থুড়ি পতি কন্যা কে কার!

সবমিলিয়ে জীবনের সারসত্য আবিষ্কার হয়েছে ধীরে ধীরে। আমাজনের জঙ্গলে খিদে তেষ্টায় কাতর পথহারা আবিষ্কারকের থেকে কম অভিজ্ঞতা লাভ হয়নি সেজন্য। এই অভিজ্ঞতা থেকে অর্জিত প্রত্যেকেরই প্রায় নিজস্ব পাদটীকাটি হলোঃ এযাবৎ ভুবনে ভ্রমে ভ্রমণ করেছি।

যে চুলোর পাড়ে গেলে সত্যি সত্যি মানবজনমের সোনা ফলে তেমন কোনো চুলোর পাড় তো জোটে না। তাই সমাজ ও সংসারের চুলোয় দিবারাত্র পুড়ে কয়লা হতে হতে কখনও কখনও বোবায় ভর করে। অথচ শেষ পর্যন্ত কোথাও যাই না আমরা। অশ্বডিম্ব প্রসব করে কাঁটার মুকুট পরে জীয়ন্তে আমরা জলে ডোবা মৃতদেহ। ফুলে ঢোল উপুড় হয়ে ভাসছি চারদিকে নাচতে নাচতে। পুব থেকে হাওয়া বয় নাচতে নাচতে ঘুরে যাই পশ্চিমে। পশ্চিম থেকে হাওয়ার তালে পুবে। এইভাবে চারদিকে ঘুরে ঘুরে মরা ব্যাঙের নাচন নাচছি – যে মরা ব্যাঙের ভেতর একদা বিদ্যুৎ ছিল।

মরা ব্যাঙকে নাচিয়েছিলেন বিজ্ঞানী লুইজি গ্যালভানি জীবদেহে বিদ্যুতের অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে গিয়ে। কোনো গ্যালভানি কোনো একদিন কি আমাদের আগাপাশতলা এমনই বিদ্যুৎ ফুঁড়তে পারেন না, যাতে আমরা নড়ে উঠতে পারি চরমভাবে বিদ্যুৎবাহিত হয়ে? কে জানে, কখনও হবে কিনা! তা যদি হয় কোনোদিন, তবে হয়তো কথার উৎসমুখ খুলে গিয়ে আমাদের অসহ্য এই নোনাধরা জীবনে আর কখনও তাকে বোবায় পাবে না।

(প্রকাশিত)

ছায়াসঙ্গী

০১
তখনো পাখি ডাকা শুরু করেনি। ভাঙেনি রাতের গোঙানি। তবুও প্রতিদিনের অভ্যাস মতো আজকেও ঘুম ছুটে যায় ছায়ার। দিনের আগে দিন শুরু হওয়ার আনন্দটা একেবারেই আলাদা। যে রোজ ভোরের পাখি হয়, সে ছাড়া অন্যকারো পক্ষে এর স্বাদ বুঝতে পারা শুধু কঠিনই নয়; একেবারে দুঃসাধ্য। এই আমেজের কেবল একটি উপমা-ই দেওয়া যায়, যেমনঃ লবণ, কাঁচামরিচ, আদা, খাঁটি সরিষার তেল পরিমাণ মতো চিড়ামুড়ির সাথে মাখিয়ে মচমচে করে খাওয়া। ছায়া জানলার ছিটকিনি খুলে বাইরে একবার চোখ ঘুরিয়ে নেয়। সেই চোখ কী যেন খোঁজে.. কাকে যেন খুঁজছে…! এখনও ঘুটঘুটে আঁধার। এমন আধাঁর… যে আঁধার বাসি, পঁচা জলের মতোন আসক্তিহীন। তবুও এর একটা ভিন্ন ঘরানার জৌলুশ আছে। আদিমকালের মতো আটকোরা রুপ-যৌবন আছে। এখানেই বোধ করি মানুষের সাথে সৃষ্টিকর্তার সবচেয়ে বড় পার্থক্যটি খুঁজে পাওয়া যায়। তাঁর সবকিছুই এমনি নিখুঁত, এমনি অকৃত্রিম।

ব্রাশ হাতে নিয়ে বারান্দায় চলে আসে ছায়া। বারান্দা তো নয়, যেনো ইনডোর ক্রিকেট খেলার পিচ। যেমন ইচ্ছে ব্যাটিং, বোলিং করার মতো জায়গা আছে। বল কুঁড়ানোর জন্য ৩/৪ জন ফিল্ডারও দাঁড় করিয়ে দেয়া যাবে অনায়াসেই। যদিও বল বাইরে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। গ্রিলের বাঁধা ডিঙিয়ে বাইরে যাবে এমন সাহস কার? ছায়া বারকয়েক পায়চারি দিয়ে মর্নিংওয়াক সেরে নিলো। শরীরটা এখন আগের চেয়ে বেশ হালকা লাগছে। বারান্দার ঠিক মাঝ বরাবর চমতকার ফ্রেমে বাঁধানো একটি আয়না ঝুলছে৷ ছায়ার অনেককিছু না হলেও চলে কিন্তু আয়না ছাড়া চলে না। এজন্য মেয়েবেলায় তাকে মজা করে আয়নামতি বলে খেপানো হতো।
ছায়া আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে আর দেখছে৷ এ দেখা যেনো কিছুতেই শেষ হচ্ছে না৷ নিজেই বুঝতে পারছে না সে কি যুবতী, না কিশোরী৷ দুই তৃতীয়াংশ ফোঁটা একটা গোলাপ যেনো ছায়ার রুপের কাছে কিছুই না৷ নাক, মুখ, চোখ সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার পর ছায়া কিছু একটা ভাবতে ভাবতে নিচের দিকে নামতে লাগলো।

অবশেষে স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হলো, তার মতো সুডৌল বক্ষ পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় কোনো মেয়ের নেই। জান্নাতের হুরদের থাকলেও থাকতে পারে। ছায়া বেশ কিছুক্ষণ নিজের চোখে, মুখে, গালে, থুতনিতে, বাঁশির মতো খাড়া নাকে হাত বুলিয়ে আদর করে। আয়নার সামনে নিজেকে আদর করতে ছায়ার বেশ লাগে। একটা সময় ছায়ার অবাধ্য হাত দুটি নিচে নামতে চায়। ছায়া সাথে সাথে হাত দুটিকে শাসন করে। সরিয়ে নেয়। এসব করতে করতে হঠাৎ ছায়া খেয়াল করে আজও তার অবাধ্য চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। ছায়া ওড়নার একপ্রান্ত দিয়ে জল মুছে নেয়। বুঝতে পারে তার মনটা এখন মোটেই ভালো নেই। একে যে করেই হোক ভালো করে তুলতেই হবে।

ছায়া আবার বাইরের দিকে তাকায়। কয়েকটা শেয়াল আর কুকুর একসাথে খেলা করছে। একটা আরেকটার মুখে মুখ ঘষে দিচ্ছে। নাকে নাক ঘাষ দিচ্ছে। লেজের দিকে আলতো কামড় দিচ্ছে। প্রকৃতির এই বিরুপ দৃশ্য দেখে ছায়া রোজকার মতো আজ আবারও আশা বেঁধে রাখে। ছায়া নিজেকে খুব ভালোবাসে। প্রত্যেক মানুষই তাই করে। ছায়া জানে মানুষের স্বভাবের, আচার আচরণের পরিবর্তন হয়। শিয়াল কুকুরের হয় না।
ছায়া বিশ্বাস করে যে মানুষটিকে একদিন সে সুতীব্র ঘৃণা করতো, সেই মানুষটিকে সে এখন সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। এমনকি তার নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসে।

বড়লোক জামাই পেয়ে মা-বাবা একপ্রকার জোর জবরদস্তি করেই মানুষটার সাথে ছায়ার বিয়ে দিয়েছিল। তারপর ছায়ার জীবনেও আসে সেই বাসর ঘর! যে বাসর ঘরে সে তার প্রেমে পাগল পারা স্বামী বেচারাকে এতটুকু শরীর স্পর্শ করতে দেয়নি। লোকটি তাকে কত যে অনুনয় করেছে, কতবার যে তার বিনয়ের বাহু প্রসারিত করেছে, কতবার যে তার নিখাদ ভালোবাসার কসম করেছে… কিন্তু একটিবারের জন্যও জোর করেনি। তবে এতকিছুর পরও ছায়ার মন গলেনি। কেন গলেনি সেই ইতিহাস ছায়া আজও জানে না। অপমানে, ক্ষোভে সেই নিরপরাধ মানুষ টি ভোর ফুটার একটু আগে তার প্রাসাদের মতো বাড়িটি ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। সেই যে গেল… তো গেল… আর ফিরে এলো না!

তারপর থেকেই শুরু হয় ছায়ার নতুন এক জীবন। যে জীবনে ছায়া নিজেই নিজের সঙ্গী। বলা যায়, ছায়াসঙ্গী। রোজ রোজ ভোরের বিছানা ছেড়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে আর তার হারিয়ে যাওয়া মানুষটির পথের বাঁকে তাকিয়ে থেকে নিজেকে খোঁজে!!
—————

কানের ভেতরে আঙুল

আরশি কদম আলীর ছোট মেয়ে। তিনজনের মধ্যে তৃতীয়। বয়স মাত্র পাঁচ বছর। বলা চলে একটি সুবাসিত ফুলের কুঁড়ি। মুখে গুটিকয়েক দাঁত উঁকি দিয়েছে। সেই দাঁত মেলে যখন হাসে তখন কদমের ঘর আলোকিত হয়ে উঠে। আর যখন কাঁদে তখন আষাঢ়ে বৃষ্টির মতো আঁধার নেমে আসে। আরশির মুখে কাবুলিওয়ালার মিনির মতোন অনর্গল কথার খৈ ফুটে। সে ভুতেদের জ্যান্ত ছবি আঁকতে পারে। পুতুলের বিয়েতে কান্নাকাটিও করতে পারে। এভাবেই কদমের কুঁড়েঘরে রোদ-বৃষ্টির খেলা চলে। ওর হাসি, অভিমানী কান্না, হাঁটা-চলা, কথা বলা সবকিছুতে এতো আলো যে, কদম মেঝেতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আকাশ দিয়ে উড়তে থাকে। মেঘের সাথে কিছুক্ষণ ভাসার পর আরশির আকস্মিক ডাকে মাটিতে ফিরে আসে।

রোজকার মতো আজও আরশি আর কদম একসাথে ঘুমিয়েছে। এই ঘুম যেমন-তেমন ঘুম নয়। রীতিমতো বারো-তেরো হাত লম্বা ঘুম। এই ঘুমের আবার কয়েকটি বিশেষ স্টাইল আছে। এই যেমনঃ প্রথমেই আরশি কদমের বুকের উপর বুক রেখে শুইতে হবে। অতঃপর যতক্ষণ না আরশি ঘুমের রাজ্যে বেড়াতে না যায়, ততক্ষণ চলতে থাকবে কদমের গল্প বলা। অবশ্য এখানেই শেষ নয়, গল্পের বাঁকে বাঁকে চলতে থাকে প্রশ্নের উপর প্রশ্ন। আর এসব প্রশ্নও যেন-তেন প্রশ্ন নয়। ধারালো তলোয়ারের মতো সুতীক্ষ্ম সেসব প্রশ্ন। কোনোরকম গড়-পরতা উত্তর দেওয়ার জো নেই। তাহলে জরিমানাসহ এর মাসুল গোনতে হয়।

ঘুম ভাঙতেই কদম বুঝতে পারে, সে স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। একটি বিশেষ অবস্থা নিজের অজান্তেই অতিক্রম করে চলেছে। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই রহস্যের জাল ছিঁড়ে যায়। কদম বুঝতে পারে, তার দুই কানের ভেতর দুটি মিহি আঙুল ঢুকানো আছে। চোখ না মেলেই বুঝতে পারল এ এ নিশ্চয়ই আরশি কাজ। আরও বুঝতে পারল নিশ্চয়ই এর কোনো জবরদস্ত কারণ আছে। কারণ আরশি উদ্দেশ্যহীন কোনো কিছু করে না। কদম কিছুক্ষণ চুপচাপ অপেক্ষা করল। আরশি একইভাবে দুই কানে দুই আঙুল ঢুকিয়ে কদমের মাথার পাশে বসে আছে। অবশেষে আরশির ধৈর্যের কছে কদম আলী পরাজিত হল। জিজ্ঞেস করল, আমার কানে আঙুল ঢুকিয়েছ কেন মা?

আরশি বলল, মাম্মা সেলাই মেশিন চালাচ্ছে তো। তাই অনেক শব্দ হচ্ছে। তোমার যাতে ঘুৃৃম ভেঙে না যায়, এজন্য আমি তোমার কানে আঙুল ঢুকিয়ে অনেকক্ষণ যাবৎ বসে আছি বাবা। বাবা, আমি কি ভালো কাজ করিনি?
আরশির কথা শুনে কদম খুব খুশি হল। এইটুকু মেয়ের এতোটা সুতীক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টি! দেখে তার বুক সাত আকাশের সমান বড় হয়ে গেলো আর কেবলই হযরত বায়েজিদ বোস্তামীর নাম মনে হতে লাগল। কদম আলী আরশির প্রশ্নের কোন জবাব দিল না আরশিকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো।

বিশ্রাম

ক’দিন ধরেই মা’র জ্বর। সারাদিন জ্বরকে সামাল দেন, রাতে হেরে যান। শরীরের তাপ বাড়ে। বিছনায় নির্জীব হয়ে পড়ে থাকেন। চোখ সামান্য খোলা, চোখের মণি মাঝে মাঝে চঞ্চল হয়ে ওঠে। কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমোন। না, ঘুমোন না। মা ঘুম আর জাগরণের মাঝে পেণ্ডুলামের মত দোল খান। দোল খেতে খেতে মাঝে মাঝে কুঁকড়ে ওঠেন, অস্ফুট স্বরে বলেন,
– মাহমুদা, পা’টা একটু টিপে দেরে মা..

মাহমুদা নেই। জ্বরের ঘোরে মা ভুলে যান। অভাবের সংসারে কেইবা থাকে! যতদিন সে ছিল মেয়ের মত হয়েই ছিল। মায়ের ভুল ভাঙাই না। মাহমুদা হয়ে পা টিপে দেই। মাথায় বিলি কাটি। ফিডিং কাপে করে পানি খাওয়াই। ওষুধ খাওয়াই। জ্বরের ঘোরেই তিনি জানতে চান,
– রোকন ফিরেছে! খেয়েছিস তোরা!

মাহমুদা হয়েই ছোট করে উত্তর দেই,
– হু।

ভোর হয়। মা জেগে ওঠেন, কিছুটা অপরাধীর মত করে বলেন,
– আজও জেগে ছিলি!
– হ্যা, তুমি আরেকটু ঘুমাও না হয়।

ঘুমের প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে মা বলেন,
– রোকন, মাহমুদাকে কোনোভাবে ফিরিয়ে আনা যায় না!

কোনো উত্তর দেই না। মা জেগে উঠেন, আমার চোখে ঘুম নেমে আসে। রাতজাগার কারণে ঘুম গাঢ় হয়ে আসার কথা, আসেনা। ঘোর ঘোর ঘুমে শুধু চোখের পাতা ভারি হয়ে আসে, মন জেগে থাকে। ওই ঘুমের মাঝেই ক’দিন ধরে একটা গল্প আসছে। লাইনের পর লাইন লিখছি, কাটাছেড়া করছি প্যারাগ্রাফ ঠিক করছি। কিন্তু ঘুম ভাঙার পর গল্পটা আর মনে থাকে না।

দুপুরে মায়ের সাথে খেতে বসি। মা জিজ্ঞেস করেন,
– ছুটি শেষ হতে আর ক’দিন বাকী?
– ১১ দিনের মত।
– ও।

আমার পাতে একটুকরো তেলেপিয়া মাছ তুলে দিতে দিতে অনুনয়ের স্বরে বলেন,
– আমাকে ক’দিনের জন্য গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাবি! ক’টা দিন থাকবো, বিশ্রাম নিবো। মনটা খুব টানছে।
– এই বর্ষায় যাবে? চারদিকে পানি আর পানি…

মা কিছু বলেন না। হঠাৎ করেই মাথায় বিদ্যুৎ খেলে যায়, স্বপ্নে লেখা গল্পটার প্রথম লাইন ছিলো ‘চারদিকে পানি আর পানি..।’ প্রতিটা লাইন এখন একের পর এক মনে পড়ছে। দ্রুত খেয়ে উঠে পরি। টেবিলে বসে লিখতে শুরু করি, ‘চারদিকে পানি আর পানি। অথৈ স্রোতের ঘূর্ণি…।’ লেখা চলছে তরতরিয়ে।

মা টেবিলে চা রেখে গিয়েছিলেন। খেয়াল করিনি। চা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। মাথার ভেতর গল্পের অলিখিত অংশটা ভরে নিয়ে রান্নাঘরে যাই। নতুন করে চা রান্না করি। দুটো কাপে ঢালি। মা’র ঘরে যাই। মা ঘুমোচ্ছেন। শেষ বিকেলের নরম আলোর আভায় মা’র চেহারায় কোমল জ্যোতি, মায়ামায়া। চা খাওয়ার জন্য মা’র ঘুম ভাঙাতে ইচ্ছে করেনা।

কোনো শব্দ না করেই কিছুক্ষণ পা টিপি। এরপর চুলে বিলি কাটতে কাটতে বুঝতে পারি গল্পটা আর লেখা হবেনা। মাকে নিয়ে গ্রামে যেতে হবে। চারদিকে পানি আর পানি, এর মাঝে একখণ্ড শুকনো জমিতে মা’কে রেখে আসতে হবে, মা থাকবেন, মায়ের এখন অথৈ বিশ্রাম।

.
#বিশ্রাম
১০০৮২০২০

অণুগল্পঃ মায়াবী কোমল আদর

নিজের টাইমলাইন একান্ত নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করার একটা শক্তিশালী প্ল্যাটফরম। কিন্তু গল্প লিখতে লিখতে নিজের কথাই বলা হয়ে ওঠে না।

আমি মিস করি আমার ছোট ভাইকে। ‘ইমিডিয়েট’ ছোট ভাই। আমার জীবনের অধিকাংশ সময় ওর সাথে কেটেছে। সেই ছেলেবেলা থেকে একসাথে স্কুলে যাওয়া, এক সাথে বেড়ে উঠা, কলেজ-ভার্সিটির সময়গুলোতেও কাছাকাছি ছিলাম। মুসা ভাই চবিতে যখন গুলিবিদ্ধ হলেন, আমি তখন সেই দোকানটির সামনে বসে চা পান করছিলাম। হঠাৎ সিনেমা স্টাইলে ক্রলিং করে ফায়ারিং শুরু হলো। দেখছিলাম সব চুপচাপ। দৌঁড়াতে বা পালাতে তখন লজ্জা লাগতো। আমার সাথের সবাই হাওয়া। ভাই ছিল পাশে তখনো। পাশে ফিরে ছোট ভাইকে দেখে এবং আমাকে ছেড়ে তার না যাওয়াটা দেখে বড্ড ভালো লেগেছিল সেদিন।

এরকম অনেক ভালোলাগা রয়েছে আমার চিন্তার গোপন আলমিরায় এই ভাইটিকে ঘিরে।

সে আমার দেখা দুর্দান্ত মটরবাইক চালক। আমাদের আব্বাও ছিলেন তাই। আমার ভাই আর আমি চট্টগ্রাম থেকে মটরবাইকে করে খুলনায় নিজেদের বাড়িতে এসেছিলাম একবার। ওর সাথে এবং আরো কয়েকজন ভাই-বন্ধুদের সাথে বাইক বহর নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি যশোহর, ঝিনাইদহ, সাতক্ষীরা, কালিগঞ্জ, বাগেরহাট, পিরোজপুর, গোপালগঞ্জ, মঠবাড়িয়া, পাথরঘাটা, বরগুনা, পটুয়াখালী।

নিজেকে একজন রাজপুত্র মনে হতো তখন। আব্বার সাথে ছিলাম যে তখন!

এখন কি মনে হয় নিজেকে?
কিছুই না।
‘নাথিং এট অল।’

জীবনের খারাপ এবং ভালো সময়গুলো আমরা দুই ভাই আরো ভাইদেরকে নিয়ে একত্রে কাটিয়েছি। যদিও তৃপ্ত সময়গুলো কিছু অতৃপ্তিও বুকে নিয়ে চলেছিল তখন।

সারা রাত জার্ণি করে ঢাকা থেকে ফজরের আজানের একটু আগে বাড়ি পৌঁছে মেইন গেটের সামনে একটুও অপেক্ষা করতে হয়নি আমাকে। চাবি হাতে ভাইকে দাঁড়ানো পেয়েছি! যতবার গেছি ঠিক ততোবারই এভাবেই পেয়েছি। বউয়েরা সবাই তখন ঘুমে বিভোর।

আর ঘুরে ঢুকে পেয়েছি আম্মাকে। সোজা তাঁর বিছানায় আমার জন্য রাখা খালি জায়গাটায় গিয়ে শুয়ে পড়েছি। মা আরো অনেকক্ষণ জেগে থাকতেন। আমি তখন ঘুমে বিভোর।

সেই শুণ্য জায়গাটি আজো শুণ্য আছে। কেবল আমি নেই। মায়ের আঁচলের আদর এখনো শীতের নরম রোদের মত বড্ড মায়াবী কোমল! কিন্তু অনুভব করার জন্য সেখানে আমি নেই। আমি আছি এই কংক্রিট নগরে। ইউনিটে আবদ্ধ বাসা পরিবারে।

আমার মাটি নেই। মাটি মায়ের কাছে। মা নেই এই কংক্রিট নগরে।

ভাই মায়ের কাছে। আমার আদরের অংশটুকু বড্ড যত্ন করে পাহারা দিচ্ছে।

সব পাখি একসময় নীড়ে ফিরে। মানুষ ও বাড়ি ফেরে। কিন্তু আমি বাড়ি ফিরবো কখন?

হে ক্ষণিকের অতিথি … পর্ব: ১

324

আমি যখন অনুভব করা শিখলাম, তখন থেকেই ওকে ভালো লাগতো। এই ভালো লাগা অন্যসব ভালো লাগার থেকে আলাদা। বাবা-মা কিংবা ভাই-বোনের জন্য যে ভালো লাগা সেরকম না। লতায় পাতায় জড়ানো আত্মীয়কূলদের জন্যও তো আলাদা এক ‘ফিলিংস’ থাকে, তেমনও না। আবার ওই ভালো লাগাকে ভালোবাসা ও বলা যাবে না।

তাহলে ওর প্রতি আমার ভালো লাগাটা কেমন ছিলো?
ওটা যেন গন্তব্যহীন কোনো পথের শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে থাকা ‘ল্যান্ডমার্ক’ এর দেখা পাওয়ার উদগ্র বাসনায় তাড়িত হওয়া। অন্ধকার টানেলে দিকভ্রান্ত ছুটে চলে এক কোটি বছর পর বহুদূরে শেষ মাথায় আলোর আভাস পাওয়া। কিংবা পাতা ঝড়ার দিনে- দুইপাশে সারি সারি গাছের মাঝ দিয়ে কালো পিচের পথ ধরে পাগলা হাওয়ায় নিঃশব্দে হেঁটে চলা। অথবা শীতের দুপুরে ভরপেট ঘুম চোখে প্রিয় কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ ঝাপসা করে দেয়া বিস্মৃতির অতল গভীরে ডুব দেওয়ার আগ মুহুর্ত!

ওকে যেদিন প্রথম দেখি, জীবনের প্রথম সমুদ্র দর্শনের চেয়ে সেটা কোনো অংশে কম ছিলো না। কিংবা প্রথম বিমান ভ্রমণ। অথবা মায়ের আঁচল ছেড়ে প্রথম একা বান্ধবীদের সাথে বাইরে যাওয়া। অক্ষরে সেই অনুভব প্রকাশ করা দায়।

ওর ঘামে ভেজা লেপ্টানো কোঁকড়া চুল যখন বাতাসে ভেসে বেড়ায়, আমি তখন আর জন্মে বাতাস হতে চাই! ওর কপালে জমে থাকা মুক্তোর মত শ্বেদবিন্দু শীতের নরম রোদে যখন চকচক করে, পরের জন্মে আমার নরম রোদ হতে ইচ্ছে করে। ও যে পথ ধরে বন্ধুদের আড্ডায় যায়, সেই পথে ওর শরীরের ঘ্রাণ পেতে আমি পৌণঃপুণিক হেঁটে চলি!

বাবা মারা গেলেন। মায়ের আবার বিয়ে হলো। ওদের বাড়িতে আশ্রিতা হলাম। বাবার বড় বোনের ছেলে সে। সে দিক থেকে সম্পর্কে আমরা ভাই-বোন। কিন্তু আমি চাইলাম- যতবার জন্মাবো, আমি ওর হবো! এভাবেই বেড়ে উঠলাম আমরা। আনন্দ-হাসি-কান্নার মাঝে শৈশব পেরিয়ে কৈশোর ছাড়িয়ে আলগোছে একদিন হৃদয়বতী হয়ে উঠলাম।

যখন হৃদয়বতী হলাম, ভালো লাগা প্রেমের আগুনে পুড়ে পুড়ে ভালোবাসায় রুপ নিলো। আমি পুইঁয়ের লতার মতো আমার হৃদয়বানকে ঘিরে নেতিয়ে পড়লাম। মোমের মতো গলে গেলাম। আবার ধীরে ধীরে শক্ত মোম হলাম। কিন্তু ওকে ভালোবাসি তা কী বুঝাতে পারলাম?

এক ভরা সাঁঝে সে চলে গেলো। ওর আর আমার গল্পের শুরুটা এখান থেকেই।

#হে_ক্ষণিকের_অতিথি_পর্ব_১

(ক্রমশঃ)

মশা ঘনুবাবু ও ছটা বিয়াল্লিশ

চটাস করে এক চড় নিজেরই ডান পায়ের গুলফের ওপর কষালেন ঘনুবাবু। চলন্ত ট্রেনে যে এত মশা কি করে থাকে! আশ্চর্য! হালকা সাদা আলোয় হাতটা চোখের সামনে তুলে এনে দেখলেন নাহ মরেনি ব্যাটা। মশা মারায় ঘনু একেবারেই অপদার্থ। গিন্নীও হামেশাই বলেন সেকথা। অবশ্য এই একটাই কথা বলেন না। বলতে গেলে সারাদিনই অসহ্য নাকচাবি পরা বোয়াল মাছের মত জাবদা মুখখানা চলছে তো চলছেই। সেই সাতসকালে শুরু হয়ে এই কথার চর্বিতচর্বণ চলতেই থাকে অবিরাম। তাকে থামায় কার বাপের সাধ্যি। আর সব কথার সার হল, ঘনুবাবু অতি অকর্মণ্য। ভাগ্যিস বহু তপস্যা করে তাঁর মত একপিস বউ পেয়েছিলেন তাই বর্তে গেছেন। নইলে যে ঘনুর কি হতো, ভাবলেও তিনি শিউরে ওঠেন। পাড়ার আর পাঁচটা বউকে দেখুক ঘনু, তাহলেই বুঝবে সে কি রত্ন পেয়েছে। শুধু পাড়ার বউদেরই নয়, তার সাথে নিজের অকালকুষ্মান্ড পরিবারের অন্য মেয়ে বউ দেরও দেখুক। তাহলেই হাড়ে হাড়ে বুঝবে তার নিজের বউ কত্তো গুনী। এটসেট্রা…এটসেট্রা…

পাড়ার বউদের যে দেখেন না ঘনু, তা নয়। বরং কাছেপিঠে বউ নেই দেখলেই বেশ ভালো করেই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেন। চব্ব্যচোষ্য করেই চেটেপুটে দেখেন। আর শুধু দেখাই নয়, অনেককিছু কল্পনাও করেন। মাঝেমধ্যে অবশ্য বউএর অবস্থানটা দেখে নিতে হয়। এখন এই মাঝবয়সে পাড়া কেন দুনিয়ার তাবৎ অন্যলোকের বউ কেই দেখার কি যে সুখ! আহা! চলতি ট্রেনেই মুচকি হাসি ভেসে ওঠে তাঁর দুঠোঁটের মাঝে। পাশের লোকটার এক ঠেলা খেয়ে একটু কাত হয়ে পড়তেই সংবিত ফিরে এল তাঁর।

-“আস্তে রে ভাই! আস্তে আস্তে”।
এই ছটা বিয়াল্লিশের লক্ষীকান্তপুর লোকালের আশি পার্সেন্ট প্যাসেঞ্জারই ডেইলি। তাই মোটামুটি সবাইই মুখ চেনা। বীভৎস ভীড় হয় এসময়টায়। শেয়ালদা থেকে ছাড়ার সময়েই ভীড় কামরা ছাড়িয়ে রড ধরে ঝুলতে থাকে। সবই ছোটখাট চাকরীজীবী কিম্বা হকার, ছোট দোকানদার। সারাদিনের পেটের বন্দোবস্ত করে ফিরে চললো নিজের গ্রামের বাড়ীতে। এই ভীড় ঠেলে ওঠা বা নামা দুইই বেশ কসরতের কাজ। বছরের পর বছর রীতিমত ঠোক্কর খেয়ে তাঁকে শিখতে হয়েছে ওঠা-নামা- দাঁড়িয়ে থাকার কায়দা কানুন। যদিও খুব বেশিদূর যাতায়াত নয় তাঁর। শেয়ালদা থেকে মাত্র খান চারেক স্টপেজ পরেই বাঘাযতীন। বাসেও যেতে পারেন, কিন্তু সিগন্যালে ঠেক খেতে খেতে বাসের প্রায় ঘন্টা দেড়েক লাগে। তাছাড়া শেয়ালদা থেকে এদিকের বাস পাওয়াও সমস্যা। অনেকক্ষণ দাঁড়ালে তবে একটা ভীড়ঠাসা বাস আসে। অনেক ভেবেচিন্তে এই ট্রেনলাইনই বেছে নিয়েছেন তিনি। হোক ভীড় তবু মিনিট পনেরোর মধ্যেই পৌঁছে যাওয়া যায়। আর বছর সাতেক চাকরী আছে। চালিয়ে নেবেন এভাবেই। একটা স্টেশন এল। উঁকি মেরে দেখলেন পার্কসার্কাস।

-“দাদারা, বোনেরা, মিস্টার এন্ড মিসেসেরা, এই চলন্ত ট্রেনে অনেক হকারই আপনাদের কাছে আসে। রোজই তাদের দেখেন। অনেকেই খুব পরিচিত হয়ে গেছে আপনাদের”।

এই ঠাসা ভীড়ের মধ্যে কিভাবে যে এই হকাররা যায়, সেটা একটা ম্যাজিক। শুধু যাতায়াত করাই নয়, কাউকে বিরক্ত না করেই দিব্যি নিজের প্রোডাক্ট নিয়ে বকবক করে গছিয়ে টাকা পয়সা নিয়ে চলেও যায় ফের। আর কি না বিক্রী করে ওরা! সেফটিপিন থেকে জলের বোতল, গামছা থেকে ডাব। ভাবা যায় না। ওই ভারী জিনিসগুলো বয়ে অনায়াসে এ কামরা সে কামরা করে বেড়ায় ওরা। ঠিকই বলেছে এই নতুন হকার, বহু হকারই ডেলি প্যাসেঞ্জারদের পরিচিত হয়ে গেছে।

একটু স্বস্তি পেয়ে, ভালো করে হকারের দিকে তাকালেন ঘনুবাবু। বাপরে! এই লোকালে রীতিমত সাদা শার্ট, প্যান্ট, টাই পরে সেজেগুজে উঠেছে লোকটা। টাই দেখলেই ঘনুবাবু বেশ সম্ভ্রমের চোখে তাকান। তিনি জীবনে কখনো ওই জিনিসটা ছুঁয়েও দেখেন নি। আসলে টাই এর কোনো দরকারই পরেনি তাঁর। টাই বাঁধতে গেলে যে জিনিস টা দরকার, সেই স্যুটও নেই তাঁর। থাকতোও যদি তাহলেও ওই অফিস-বাড়ী-বাজারের পরিক্রমায় তিনি কিছুতেই সেটা পরতেন না প্যাঁক খাবার জন্যে। অথচ এই হকার তো দিব্যি পুরোদস্তুর অফিসার মার্কা চেহারা আর সাজগোজ নিয়েও চলে এসেছে। এঁকে তো আগে কোনোদিন দেখেননি তিনি। অন্য ডেইলিদের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন তারাও কেমন হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছে ওই হকারের দিকে।

এ নিশ্চয়ই খুব শিক্ষিত কেউ। অবস্থার চাপে পড়ে আজ হকারি করতে এসেছে। মনে মনে ভাবলেন ঘনু। এবার মন দিলেন ওর কথায়।

-“ দাদারা- বৌদিরা! আপনারা রোজই হরেক সমস্যায় বিব্রত। সারাদিন হাড়ভাঙা খটুনির পরে সন্ধেয় বাড়ী ফিরে চলেছেন একটু শান্তির আশায়। নিঝুম সন্ধ্যায় ক্লান্ত পাখীরা কুলায় ফিরছে সারাদিনের শেষ হয়ে যাওয়া এনার্জি লেভেল বাড়ীর শান্তিতে একটু ঘুমিয়ে বাড়িয়ে নিয়ে আগামীকাল ফের ঝাঁপিয়ে পড়বেন জীবন যুদ্ধে।

কিন্তু ভাবুন তো দাদারা-বৌদিরা, বাড়ী ফিরে সেখানে শান্তি পাবেন কি? বাড়ীতে ঢুকে হাত মুখ ধুয়ে যেই একটু বিশ্রামের জন্যে জলখাবারের প্লেট হাতে মাদুরে কিম্বা চেয়ারে কিম্বা টুলে কিম্বা বিছানায় বসবেন, ওমনি প্যাঁক… ইয়াব্বড় ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ হাতে আপনার জন্যে অপেক্ষা করছে কয়েক লক্ষ মশা। কোথায় পালাবেন? রান্নাঘরে- মশা, বাথরুমে- মশা, ক্লাবে- মশা, রাত্তিরে বিছানায় থইথই করছে মশাবাহিনী। আর কি না রোগ বয়ে আপনার শরীরে ঢুকিয়ে দিতে ওঁত পেতে বসে আছে ওরা। ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, এনকেফেলাইটিস, এনসেফেলাইটিস, ফাইলেরিয়া আরো কত হাজার রোগ। একটা মশা কামড়ানো মানে আপনার কাজ বন্ধ, ডাক্তারের কাছে বা হাসপাতালে ছোটাছুটি। টাকার শ্রাদ্ধ”।

এত রোগের ফিরিস্তি শুনে যেন ঘনুর শরীর টা খারাপ লাগতে শুরু করলো। আজ সকালেই বাজারে শুনে এসেছেন আজাদগড়ে একজন ডেঙ্গুতে মারা গেছে। ডেঙ্গু না কি ডেঙ্গি তাও জানেন না তিনি। কেমন জঙ্গি জঙ্গি মনে হয় শব্দটা। ডেঙ্গু হলে কি করে লোকে মরে যায় পটাস করে তাও তাঁর অজানা। কিন্তু শব্দটা শুনলেই গায়ে কাঁটা দেয়।

-“আপনারা এতদিন বহু কোম্পানির অনেক নামী দামী প্রোডাক্ট ব্যবহার করেছেন। কিন্তু একবারও ভেবেছেন কি, সেইসব কয়েল বা লিকুইড বা ম্যাটের সাইড এফেক্ট কি? জানেন কি এগুলো দিনের পর দিন ব্যবহার করলে হাঁপানি, চর্মরোগ, এমন কি ক্যান্সারও হতে পারে!”

ঘনুর অবস্থা এখন রীতিমত করুণ। ক্যান্সার! ওরেবাবা! অফিসের এক পিওন সদ্য পটল তুললো ওই রোগে। শুনেছেন ভয়ংকর যন্ত্রণা পেয়ে দগ্ধে দগ্ধে মরতে হয়। গরমে নাকি ভীড়ের চাপেই দরদর করে ঘামতে থাকেন ঘনু।

-“ আমি আজ আপনাদের কাছে হকারি করে জিনিস বিক্রী করতে আসিনি দাদারা-বৌদিরা। আমি এসেছি বিখ্যাত বিজ্ঞানী নিধিরাম নস্করের তৈরী এক অনবদ্য ওষুধ এই প্রথম পরীক্ষামূলক ভাবে আপনাদের কাছে পৌঁছে দিতে। কিছুদিনের মধ্যেই পেটেন্ট এসে যাচ্ছে। এরমধ্যেই হামলে পড়েছে দেশ বিদেশের বড় বড় নামী দামী কোম্পানী। ওদের হাতে এর স্বত্ত্ব চলে গেলেই আকাশছোঁয়া দামে বিক্রী করে বিপুল লাভ করবে ওরা”।
পেটেন্ট টা কি ব্যাপার! কাল অফিসে জানতে হবে অম্লানের কাছে। ভাবলেন ঘনু।

-“এই জগতবিখ্যাত ওষুধের কোনো সাইড এফেক্ট নেই। একটা ওষুধ সুতোয় বেঁধে ঘরে ঝুলিয়ে দিলেই মশারা পিলপিল করে পাড়া ছেড়ে পগাড়পার। কোনো রোগ নেই, কোনো অস্বস্তি নেই, আর দামও আপনার হাতের নাগালেই”।

-“পরে এই ওষুধের কি দাম হবে জানিনা। কিন্তু এখন প্রথম আমার দেশকে প্রনাম জানাতে বিজ্ঞানী নস্কর এই ওষুধের দাম রেখেছেন প্যাকেট প্রতি মাত্র পাঁচ টাকা – পাঁচ টাকা – পাঁচ টাকা। প্রায় জলের দরে কিম্বা ফ্রী বলতে পারেন। আর শুধুমাত্র আপনাদের জন্যেই আছে একটা স্পেশাল অফার। তিনটে একসাথে যেকোন বড় দোকানে পরে কিনতে গেলে আপনার পড়বে প্রায় একশো টাকা। কিন্তু আপনাদের জন্যে, শুধুই আপনাদের জন্যে আজ একসাথে এই তিন প্যাকেট নিলে দাম পড়বে মাত্র দশ টাকা – দশ টাকা – দশ টাকা। আমার কাছে আজ বেশি প্যাকেট নেই। পরীক্ষামূলকভাবে মাত্র কয়েক পিস এনেছি। যদি কারো দরকার লাগে তাহলে দয়া করে হাত বাড়ান”।

দেখতে দেখতে লোকটার ব্যাগ খালি হয়ে গেল। ঘনু শুধু নেবার সময় আস্তে জিজ্ঞেস করেছিলেন-“দাদা কাজ হবে তো?” লোকটা ভুবনমোহন হাসি হেসে বললে-“ বহু টাকাই তো জলে যায় দাদা, এটা একবার ব্যবহার করে দেখুন। তারপরে আবার আমাকে খুঁজে বেড়াবেন”। বেশ গর্বিত হাসি হেসে ঘনু প্যাকেট তিনটে তাঁর ছেঁড়া রঙচটা ক্যাম্বিস ব্যাগে ঢোকালেন।

#
অন্যদিন মশা তাঁকে খোঁজে, আজ বিছানায় বসে তিনি মশা খুঁজছেন। এখনো পর্যন্ত দেখতে পাননি। সদ্য রাতের বরাদ্দ রুটি আর আলু বিহীন পেঁপের তরকারি খেয়ে বিছানায় বসে মেজাজে একটা বিড়ি ধরিয়েছেন। গিন্নী এখন রান্নাঘরে ব্যস্ত থালাবাসন ধোবার কাজে। রাতের বাসন ধুয়ে না রাখলে সকালে ফের রান্না করতে অসুবিধা হয় তাঁর। সন্ধেয় বাড়ীতে ফিরে বেশ মেজাজে ব্যাগ থেকে প্যাকেট তিনটে বার করে তার গুণাগুণ বোঝাতে শুরু করেছেন, অমনি এক ঝামটা দিয়ে তাঁকে থামিয়ে দিয়েছিলেন গিন্নী।

-“দয়া করে ওসব কেরামতি না দেখিয়ে এখন হাত মুখ ধুয়ে খেয়ে আমাকে উদ্ধার কর। আবার রাতের রান্না আছে”।

বেজার মুখে পড়তে বসে উৎসুক তাকিয়ে থাকা মেয়েকেই চুপিচুপি বুঝিয়ে উঠে পড়েছিলেন ঘনু। গিন্নীর যে তাঁর ওপর এতটুকু আস্থা কেন নেই কে জানে!

মেয়ে আগেই পাশের ঘরে শুয়ে পড়েছে। কাল ওর ক্লাসটেস্ট আছে। তিনটে প্যাকেট ওই খুলে সুতো দিয়ে টাঙিয়েছিল খেতে যাবার আগে। হাসি হাসি মুখে বেশ প্রশ্রয়ের ভঙ্গীতেই দেখছিলেন ঘনু। গিন্নী এলেন হাতের কাজ চুকিয়ে।

-“কি গো মশারী না টাঙিয়েই শুয়ে পড়েছ যে? বাঘাযতীনের বাঘা মশা কি তোমাকে ছেড়ে দেবে ওই পুরিয়াগুলো দেখে?”
-“হে হে, দেখ, এখনো পর্যন্ত একটাও মশা নেই”।
আর কথা না বাড়িয়ে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়েছিলেন ঘনুজায়া।

এপাশ ওপাশ করতে করতে সবে ঘুম আসছিল, তখন মনে হল পায়ে একটা কিছু কামড়ালো। পা টা চুলকে নিলেন ঘনু। মনের ভুল হয়তো। ভাবতে না ভাবতেই চারদিক থেকে সাঁড়াশী আক্রমন। এদিকে কামড়ায়, ওদিকে কামড়ায়। উঠে আলো জ্বালাতেই দেখেন গৃহিণী আগেই উঠে বিছানায় বসে আছেন।

-“রইলো তোমার এই পাগলের সংসার। কাল সকালে উঠেই আমি বাপের বাড়ী চলে যাব। আর সহ্য হচ্ছে না। থাক তুমি এ ঘরে তোমার পুরিয়া আর মশাদের নিয়ে, আমি মেয়ের ঘরে চললাম”।

রেগে গজগজ করতে করতে পাশের ঘরে চলে গেলেন তিনি।
আলোয় ঘরটা দেখে ঘনুর চোখ কপালে। গিজগিজ করছে মশা। ঘরের মশা বাইরে যাওয়া তো দূরের কথা, মনে হচ্ছে বাইরের যত মশা ঘরের মধ্যে চলে এসেছে। উঠে পাশের ঘরে উঁকি দিলেন তিনি। অন্ধকারে আবছা আলোয় দেখলেন মেয়ে আগেই মশারী টাঙিয়ে নিয়েছে। ভীষণ রেগে ঘরে ফিরে এলেন ঘনু। একটানে সুতো ছিঁড়ে নামিয়ে আনলেন প্যাকেট টা। আজ হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বেন তিনি। দেখবেন কি মহামহৌষধ আছে ওতে।
প্যাকেট মানে ফুটো ফুটো প্লাস্টিকে মোড়া একটা পুরিয়া। সেটা ছিঁড়তেই ভেতরে আরেকটা কাগজের পুরিয়া। সেটা খুলতে বেরোল আরেকটা ছোট কাগজের পুরিয়া। উত্তরোত্তর রাগ বাড়ছে। এটাও খুললেন ঘনু। ভেতরে মোড়া একটা সাদা কাগজ। তাতে লেখা-

“মশারী টাঙান। এর কোনো সাইড এফেক্ট নেই।– ইতি বিজ্ঞানী নিধিরাম নস্কর”।

মকাইশা মোকাম্মিল

মোকাম্মিলকে আমি ডাকি ‘মকাইশা’, আমরা যখন ছোট তখন মকাইশা নামে এক অদ্ভুত, অলৌকিক মানুষ আমাদের পাড়ায় আসতেন। তিনি আমাদের খুব পছন্দের মানুষ ছিলেন; তাঁর বিচিত্র আচার-আচরণের জন্য। আমাদের পাড়ায় যতগুলো টিউবওয়েল ছিল প্রত্যেক টিউবওয়েলে তাঁর একছত্র রাজত্ব। টিউবওয়েলের পানি তাঁর কথা শুনতো তিনি যা চাইতেন টিউবয়েলের পানি তাই করতো, ঘন্টার পর ঘন্টা তাঁর মাথায় পানি ঝরতেই থাকতো, ঝরতেই থাকতো।

টিউবওয়েলের পানি যেভাবে তাঁর অনুগত ছিল, আমরাও ঠিক সেভাবে তাঁর অনুগত, ভক্ত ছিলাম। তিনি যা বলতেন আমরা তাই করতাম। আমাদের যে ছোটখাটো রাজত্ব ছিল, আমরা তাঁকে সেই রাজত্বের রাজা হিসাবে স্বীকার করেছিলাম। তিনি ছিলেন আমাদের জন্য হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা, তাঁর বাঁশির ডাকে আমরা ছুটে বেরিয়ে আসতাম। তিনি বললে আমরা সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়তাম।

আমরা বড় হতে শুরু করলে তিনি তিরোহিত হলেন, কিন্তু তাঁর চিহ্ন থেকে গেল আমাদের হৃদয়ে। বন্ধুবান্ধব যখনই একত্র হই মকাইশাকে খুঁজতে থাকি, ইচ্ছে করে পুনরায় শৈশবে ফিরে যাই, ইচ্ছে করে টিউবওয়েলে ঘন্টার পর ঘন্টা মাথায় পানি ঢালি।

মোকাম্মিলের মাঝে মকাইশার কিছু চিহ্ন আছে। সেও অদ্ভুত স্বভাবের, তার সম্মোহনের ক্ষমতা অসাধারণ! একদিন লক্ষ্য করলাম আমরা তাকে অনুসরণ করছি। একদিন সে আমাদের দলনেতা হিসেবে দেখা দিল।

দেশে গেলে মোকাম্মিল ছাড়া আমার জীবন অচল। বিশ্বাস করুন এক বিন্দুও বাড়িয়ে বলছি না, মোকাম্মিল ছাড়া দেশের কোন আকর্ষণ নেই। আমি যদি বাসা থেকে এক ফুট দূরত্বে যাই, মোকাম্মিলকে সাথে থাকতে হয়। যদিও আমি দেশ থেকে বড় হয়ে এসেছি তবুও কেন জানি মনে হয় মোকাম্মিল সঙ্গে না থাকলে আমি হারিয়ে যাব। অথবা কেউ আমাকে চুরি করে নিয়ে যাবে। যতদিন দেশে থাকি নিজের চেয়ে মোকাম্মিলের উপর ভরসা করতে হয় বেশি।

ব্যক্তিগতভাবে মোকাম্মিল আমার ওস্তাদ। আমার জীবনের ‘প্রথম’ অনেক কিছু তার কাছে শিখেছি। দু একটা উদাহরণ দেই: সিগারেট খাওয়া ক্ষতিকর সবাই জানি, আমাদের পারিবারিক শৃঙ্খলার মাঝে সিগারেটের কোন স্থান নেই। এটা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের অতিরিক্ত আকর্ষণ থাকে। আমাদেরও ছিল; কিন্তু নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ করে স্বর্গচ্যুত না হওয়া কীভাবে সম্ভব মোকাম্মিল সেটা শিখিয়েছিল। সিগারেট খেয়ে কচি লেবুর পাতা কতক্ষণ চিবুলে সিগারেটের দুর্গন্ধ দূর হয়ে যায়, হাতের আঙ্গুলেও যাতে নাসির বিড়ির দুর্গন্ধ না থাকে সেজন্য কচি লেবুর পাতার রস বানিয়ে হাতে মাখতে হয়।

দুই টাকার বিনিময়ে কুসুমবাগে সিনেমা দেখা যায় সেটাও তার কাছে শেখা। কুসুমবাগের তখনকার যে টিকেট কন্ট্রোলার ছিলেন, তাকে দুই টাকার ঘুষ দিলে তিনি আমাদের থার্ড ক্লাসে বসিয়ে দিতেন, বিরতির পূর্বে শুধুমাত্র ১৫ মিনিটের জন্য বাইরে আসতে হতো তখন হল মালিকের নির্বাচিত লোক পরিদর্শনে আসতো, পরিদর্শন শেষ হওয়া মাত্র পুনরায় সিনেমা দেখার সুযোগ পেতাম।

শবেবরাতের নফল নামাজের জন্য মসজিদের প্রতিটি কোনা যে কভার করা লাগে সেটাও মোকাম্মিলের কাজ থেকে শেখা। আল্লাহ তাঁর রহমত মসজিদের কোন কোনায় বর্ষণ করছেন সেটা আমরা জানি না, সব কোনা কাভার হয়ে গেলে আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হলাম না পরীক্ষা পাশও সহজ হয়ে গেল।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক যে শেখ মুজিবুর রহমান এই সত্য সে-ই আমাকে প্রথম জানিয়েছিল। তখন খাল কাটার জমানা, বাজারে সাধারণ জ্ঞানের অসংখ্য বই বেরিয়েছে। আমাদের জায়গীর মাস্টার চাকরির ধান্দায় এসব বই গোগ্রাসে গিলছে। সাধারণ জ্ঞানের এক বইয়ে স্বাধীনতার ঘোষক হিসাবে দেখেছিলাম সানগ্লাস মেজরের নাম।

মোকাম্মিল বলেছিল এসব মিথ্যা; মেজর কোনভাবেই স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে পারে না তার সেই অধিকার নেই। স্বাধীনতা ঘোষণার অধিকার একমাত্র বঙ্গবন্ধুর, তখন গুগল জামানা ছিল না তাই দলিল, দস্তাবেজ দেখিয়ে প্রমাণ করার সুযোগ ছিল না কিন্তু যাকে সাক্ষী মেনে ছিল তাঁর সত্যবাদীতার কাছে হাজারটা গুগল পৌঁছাতে পারবে না। সাক্ষী ছিলেন সৈয়দ আমজাদ আলী, মোকাম্মিলের পিতা। সত্যবাদিতা এবং সৈয়দ আমজাদ আলী সমার্থক ছিলেন। আমাদের শহরে তাঁর সত্যের সামনে দাঁড়াতে পারে এমন কেউ ছিল না। সত্যের মূর্তপ্রতিক যখন বললেন শেখ মুজিবুর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষক; সন্দেহ করার তিল পরিমাণ অবকাশ থাকল না।

মোকাম্মিল সম্পর্কে আমার চাচা, কিন্তু আমাদের সম্পর্ক কোনদিনই চাচা ভাতিজায় রূপ নেয়নি। সেরকম সম্ভাবনা ছিল না। আমাদের জন্ম প্রায় একসাথে দু-চার দিনের কম বেশি হতে পারে, বাসা পাশাপাশি। আমরা যখন বড় হই তখন কে কোন বাসার সে চিন্তা মাথায় আসেনি আমি যেমন অনায়াসে তাদের পাক ঘরে ঢুকে খাবার খেতে পারতাম, সে ঠিক তেমনি আমার সাথে এক পাতে খেতে বসে যেত। মোকাম্মিল আমার বন্ধু, সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। যে গোপন কথা বিবাহিত বউকে বলা যায় না; সে গোপন কথা মোকাম্মিলের সিন্দুকে আজীবন নিরাপদ থাকে।

আমার গায়ের রং কৃষ্ণ অর্থাৎ কালো মোকাম্মিল ফর্সা, মহাভারতের জমানা হলে সব গোপিনী আমার জন্য পাগল হতো কিন্তু এটা কলিকাল। এটা বুক ফেটে যাওয়ার জমানা; আমার ভাগ্যে কোনদিনই কোন গোপিনী জোটেনি, যাকে পছন্দ করি সেও আমার সামনে দিয়ে মোকাম্মিলের হাত ধরে চলে যায়। তবে ভাতিজার জন্য, প্রাণের বন্ধুর জন্য মোকাম্মিল চেষ্টা করেছে অনেক, তাকে পছন্দ করা গোপিনীদের আমার কাছে ভিড়াতে চেয়েছে, কিন্তু কলিকালের কারণে কেউ রাধা হতে রাজী হয়নি।

আমার দুঃখের এক বয়ান দিয়ে এই লেখার সমাপ্তি করি। মোকাম্মিলের সাথে ঢাকায় যাচ্ছি, ট্রেনে শ্রীমঙ্গল থেকে। ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে এমন সময় এক তরুণী আমাদের কামরায় উঠে এলো তরুণীর আলোয় ঝলমল করে উঠলো কামরা। মোকাম্মিল এবং আমি সামনাসামনি বসেছি। আমার পাশের সিট খালি, মোকাম্মিলেরও। তরুণী একবার আমার দিকে তাকিয়ে মোকাম্মিলের দিকে তাকাল, তারপর বলল ‘ভাইয়া আপনার পাশে কী একটু বসতে পারি’। মোকাম্মিল সায় দিলে বসে পড়ল, একটু ধাতস্থ হওয়ার পরে আমার দিকে চেয়ে বলল ‘চাচা কী ঢাকা পর্যন্ত যাচ্ছেন…’

আমার তখন মরমে মরে যাওয়ার অবস্থা…

গল্পঃ প্রকৌশল

‘গল্প লেখা মোটেও কঠিন নয়, পুরস্কারের জন্য গল্প লেখা আরও সহজ। কলম আর এ ফোর সাইজের দুটো কাগজ নাও, ফরমুলা শিখিয়ে দিচ্ছি’ বলে নোমান থামে, প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরায়, লম্বা একটা টান দিয়ে মাছের খাবি খাওয়ার মত করে ধোঁয়া ছেড়ে হাওয়ায় রিং বানানোর চেষ্টা করে। টেবিলের অপর পাশে বসে আছে নবীন লেখিকা হেনা মুস্তারি, সন্দেহপূর্ণ দৃষ্টিতে নোমানকে দেখছে, মনে মনে বলছে — ‘গল্প লেখা যদি এতই সহজ তবে আপনি লিখেন না কেনো!’

হেনার মনের ভাব টের পায় নোমান, নিজেই একটা কাগজ সামনে টেনে নেয়, কলম দিয়ে দাগ কাটতে কাটতে বলে,
— এ গল্পটা রেজাউলের পরিবারের গল্প। পরিবারের কর্তা রেজাউল দরিদ্র হলে নামের শেষে মিয়া এবং ডাক নাম রেউজ্জা’ করে দিলেই হত। কিন্তু গল্পের প্রয়োজনে রেজাউল দরিদ্র নয়, উচ্চবিত্ত শ্রেণির শহুরে মানুষ। তাই তার নাম হবে ‘রেজাউল করিম’। এদেশে বিত্তবান মানেই প্রভাবশালী, প্রভাবের ভাব ফুটাতে নামের শেষে পদবী ‘চৌধুরী’ বা ‘খান’ যোগ করা প্রয়োজন। রেজাউল করিমের সাথে চৌধুরী পদবীটা মানায়, ওটাই থাক। অবশ্য রেজাউলকে আরও বিশেষ করে তুলতে চাইলে নামের আগে ‘খান মোহম্মদ’ যোগ করা যায়।

হেনা মুস্তারি গল্প লেখার ফরমুলা শুনছে। এ ফরমুলা জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকার তরুণ সাহিত্য সম্পাদক নোমানের রসিকতা কি না বুঝতে না পারলেও শুনতে ভালোই লাগছে। হেনা জানতে চায়,
— তবে কি গল্পের পরিবারের কর্তার নাম খান মোহম্মদ রেজাউল করিম চৌধুরী?
— না, না, তা নয়। গল্পে রেজাউল করিমকে দিয়ে কিছু অনৈতিক কাজ করানো হবে। তাই নামের আগে মোহম্মদ যোগ করা ঠিক হবে না।
— সে কি! কেনো! আমাদের দেশে অধিকাংশ পুরুষের নাম শুরু হয় মোহম্মদ দিয়ে, এ প্রথা যতটা না ধর্মীয় তার চাইতে বেশী কালচার। রেজাউলের নামের আগে মোহম্মদ থাকলে সমস্যা কি!

নোমানের মুখে হাসির রেখা, এলোমেলো চুলে আঙুল চালায়, তর্জনী দিয়ে চাঁদি চুলকায়, হাসিটাকে সামান্য বিস্তৃত করে বলে,
— কালচারের অংশ! কিন্তু কালচারের পাহারাদার আমাদের ক’জন প্রধান বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতি কর্মী আর সাহিত্যিকদের নামের আগে মোহম্মদ আছে! নামের আগে সৈয়দ বা আল ব্যবহারে আপত্তি নেই, নামের শেষে আহমেদ, ওসমান, রহমান ব্যবহারেও আপত্তি নেই, প্রথা মেনে নামের শুরুতে মোহম্মদ শব্দের ব্যবহার তেমন কই! সবাই তো আর প্রথাবিরোধী লেখক নন। এদের গল্প উপন্যাসের চরিত্রগুলোর অবস্থা অনেকাংশে একই রকম। রাজনীতিকদের নামের শুরুতেও মোহম্মদের ব্যবহার খুব কম।
— এটা উনাদের ইচ্ছাকৃত নয়, উনাদের নাম যেমন রাখা হয়েছে, তেমনই তো থাকবে।
— হেনা, উনাদের এসএসসি পরীক্ষার সনদপত্র দেখার ইচ্ছে হয়, সাহিত্য করতে এসে রইসুদ্দীনও এদেশে রইসু হয়ে যায়।

হেনা প্রতিবাদ করে ওঠে,
— ভাইয়া, কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করবেন না, উনি আমার খুউউউব প্রিয় লেখক ও বুদ্ধজীবী।
— আমিও উনার বিশেষ ভক্ত। কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করছি না, সমষ্টিগত প্রবণতাকে বুঝাচ্ছি।

হেনা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকায়, বুঝতে চেষ্টা করে নোমান সত্য বলছে কি না। যুক্তি দিয়ে নোমানকে পরাভূত করতে চায়,
— আশ্চর্যকথা! গল্পের কোনো চরিত্র অনৈতিক কাজ করলে তার নামের শুরুতে ‘মোহম্মদ’ ব্যবহার করা যাবে না!
— যাবে না কেনো, অবশ্যই যাবে। তবে পুরস্কারের জন্য লেখা গল্পতে ব্যবহার না করাই ভালো। ব্যবহার করলে উগ্র ইসলামিস্টদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগবে, তাদের বক্তব্য হবে মুসলমানদের নেতিবাচকভাবে উপস্থাপনের জন্য রেজাউলের নামের আগে মোহম্মদ যোগ করা হয়েছে। ইসলামফোবিকরা বলবে, নায়ক মুসলিম বলেই অনৈতিক কাজ করছে, মুসলমান মানেই দুষ্টু। দুই পক্ষের কোনো পক্ষকেই প্রশ্ন তোলার সুযোগ দেওয়া যাবে না, এমন বিতর্কে পরিচিতি বাড়বে কিন্তু পুরস্কার সুদূরপরাহত।

হেনার কণ্ঠে দ্বিধা,
— এমনিতে তো গল্পের তেমন পাঠক নেই। এ গল্প কি অনেকে পড়বে?

নোমানের স্বরে দৃঢ়তা,
— প্রথমে এ গল্প খুব বেশী পাঠক পড়বে না, সাহিত্য পুরস্কার পেলে অনেকেই পড়বে। গল্প পড়ে তোমার ভক্তরা বলবে ‘অসাধারণ, বাংলা সাহিত্যে এমন গল্প লেখা হয়নি’, প্রতিদ্বন্দ্বীরা বলবে ‘অতি দুর্বল গল্প, এ গল্প পুরস্কার পায় কি করে?’ আর একদল সমালোচক এক জীবনে সঞ্চিত সমস্ত বিরক্তি চেহারায় ফুটিয়ে তুলে প্রশ্ন করবে, ‘এ গল্পে গল্পটা কই?’
— আচ্ছা, বুঝলাম।
— মন দিয়ে ফরমুলার বাকী অংশটা শোনো, গল্পটা রেজাউল করিম চৌধুরীর পরিবারকে ঘিরে। রেজাউলের বয়স সাকুল্যে পঞ্চাশ বছর। এ বয়সেও বলশালী শরীর। নাকের নিচে কলপ দেওয়া পুরু গোঁফ, তার ব্যক্তিত্ব ফোঁটাতে গল্পে গোঁফের ডিটেইলস জরুরী, সাথে মোটা ভ্রু’র ডিটেলস। স্ত্রী আর দুই ছেলেকে নিয়ে বিত্তবান ও প্রভাবশালী রেজাউলের সংসার। স্ত্রী চির রুগ্ন এবং প্রায়ই শয্যাশায়ী থাকে, তবে স্বামীর সুকর্ম ও অপকর্ম সবকিছু তার কানে আসে। স্বামীর সুকর্মে আনন্দিত হয়, অপকর্মে ভয়াবহ সব অভিশাপ দেয়।

হেনার নারীবাদী মন বুঝতে চেষ্টা করে রেজাউল করিমের স্ত্রীকেই কেনো রুগ্ন হতে হবে! বলশালী স্বামীর চির রুগ্ন স্ত্রী কি আধিপত্যবাদী সবলের সাথে নিরুপায় দুর্বলের সহাবস্থানের প্রতীক! অথবা স্ত্রীকে রুগ্ন দেখানো কি প্রকৃতপক্ষে নারীকে দুর্বল হিসেবে প্রতিষ্ঠার পুরুষতান্ত্রিক আচরণ! হেনা প্রশ্ন করে,
— স্ত্রীকেই কেনো রুগ্ন দেখাতে হবে?
— এ প্রশ্নের উত্তর তো খুবই সহজ, রুগ্ন স্ত্রীর কাছে ক্ষমতাবান সবল স্বামীর অপকর্ম গোপন থাকছে না। সে সবসময় স্বামীর অপকর্মের প্রতিবাদ করছে, বিদ্রোহ করছে। কিন্তু স্বামী মোটেও পাত্তা দিচ্ছে না। এ যে আমাদের সোসাইটির প্রতীক, রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনদের সাথে সাধারণ নাগরিকের সম্পর্কের ঘরোয়া সংস্করণ।
— বুঝতে পারছি।
— ইজমের দায় মেটাতে গল্পে যৌনতা আর নীতিহীনতা মানে মানব চরিত্রের অন্ধকার দিকের কিছু ছিটেফোঁটা মেশাতে হবে, তা না হলে বোদ্ধারা নাক কুঁচকে বলবে গল্পের মধ্যে পোস্ট মর্ডানিজম বা উত্তর আধুনিকতার ছোঁয়া নেই। গল্পে যৌনতার প্রয়োজনে রেজাউলের সংসারে দূর সম্পর্কের এক শালীকে আশ্রয় দাও, ধরা যাক তার নাম ফারজানা। ২৫ বছরের চোখ ধাঁধানো সুন্দরী শালীকে দেখলে রেজাউলের শরীর জেগে ওঠে। স্ত্রীর তীক্ষ্ম নজরদারির জন্য জাগ্রত শরীর বেশীদূর অগ্রসর হতে পারে না। গল্পের এ পর্যায়টাতে একটু ইয়োইয়ো খেলবে, রেজাউল এই বুঝি ঝাপিয়ে পড়ে, এই বুঝি ঝাঁপিয়ে পড়ে পরিস্থিতি তৈরী করবে।

হেনা শব্দ করে হেসে ওঠে। পত্রিকা অফিসে দুপুরের ব্যস্ততায় সুর তুলে যায় হাসি। আশপাশের ডেস্ক থেকে দুই তিনজন চোখ তুলে তাকায়। অফিস বয় টেবিলে দুই কাপ রঙ চা আর প্লেটে চারটা বিস্কিট রেখে যায়, হেনা নিজেকে সামলে নিয়ে হাসি থামায়,
— শেষ পর্যন্ত ঝাঁপিয়ে পড়বে না!
— পড়বে তো অবশ্যই। তবে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত পাঠককে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্থ অস্থিরতার মধ্যে রাখতে হবে। গল্পে কমপক্ষে একটা দরিদ্র চরিত্র থাকতে হয়, আপাতত আশ্রিত ফারজানা ওই দরিদ্র চরিত্র। এক রাতে রেজাউল পেছন থেকে তাকে ঝাপটে ধরবে বা শাড়ির আঁচল ধরে টান দিবে — এ দু’টো আচরণেই বুনো দস্যুতা আছে, পাঠকের অবদমিত যৌন আকাঙ্ক্ষা দোলায়িত করার স্পন্দন আছে। আর সুরিয়ালিস্টিক করে উপস্থাপন করতে চাইলে এভাবে লিখতে পারো— ফারজানার বুকের ওপর কিছু একটা চেপে বসেছে, শ্বাস নিতে কষ্ট প্রচণ্ড হচ্ছে, বুঝতে পারছে না ও স্বপ্ন দেখছে না জেগে আছে। ঠোঁটে কামড়ের চাপ বাড়তেই তীব্র ব্যথা আর সিগারেটের উৎকট গন্ধটা একসাথে পায়, হাঁসফাঁস করতে করতে ঘরের হালকা আলোয় চোখ মেলে তাকাতেই দেখে ক’সেন্টিমিটার দূরে রেজাউল, না রেজাউল নয়, মাকড়সার বড় বড় চোখ। ওর বুকে লোমশ বিশাল মাকড়সাটা চেপে বসছে, বড় বড় লোমশ পা গুলো শরীরে কিলবিল করছে। মাকড়সার বিষাক্ত লালায় ভরে যাচ্ছে শরীর। ফারজানা হিস্টিরিয়ার রোগীর মত কাঁপছে।

নোমানের বর্ণনায় হেনার শরীর শিরশিরিয়ে ওঠে। ও মাকড়সা খুব ভয় পায়। ওর মনে হচ্ছে চেয়ার বা টেবিলের নিচে একটা মাকড়সা ওত পেতে আছে। সুযোগ পেলেই শরীর বেয়ে উঠতে শুরু করবে। চারদিকের দেয়ালে মাকড়সা আছে কি না দেখে নোমানের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়, এক মুহুর্তেরও কম সময়ের মধ্যে নোমান চোখ ফিরিয়ে নিলেও হেনা বুঝতে পারে নোমান ওর বুকের দিকে তাকিয়ে ছিলো। ওর কাছে নোমানের চোখ দু’টোকে ক’মুহুর্ত মৃত মাছের চোখের মত লাগে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে নোমান বলে,
— গল্পের মধ্যে একটু মুক্তিযুদ্ধ মেশাতে হবে। আমাদের দেশে ওটাই ভালো গল্প যার মধ্যে প্রাসঙ্গিক বা অপ্রাসঙ্গিকভাবে দারিদ্র অথবা মুক্তিযুদ্ধ রয়েছে। তুমি রেজাউল করিম খানকে শান্তি কমিটির সদস্য বানিয়ে দাও, স্বাধীনতার পর রঙ বদলে সে আরও ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী হয়েছে।

নোমান সাদা কাগজে আঁকিবুঁকি আঁকছে আর বলে যাচ্ছে,
— কিছু বিষয় মনে রাখতে হবে হেনা। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছে অল্প সংখ্যক মানুষ। তাদের শক্তির উৎস ছিলো পাকবাহিনী। স্বাধীনতা অর্জনের পর পর এদের একটা অংশ রাতারাতি সিক্সটিনথ ডিভিশনের মুক্তিযোদ্ধা বনে যায়। বড় অংশটা পরাজয় মেনে সাধারণ মানুষের স্রোতে মিশে যায়। আকারে ছোট আরেকটা অংশ যে রাজনৈতিক স্ট্যান্ড থেকে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছিলো, ওই স্ট্যান্ড থেকে প্রকাশ্যে গোপনে রাজনীতিটা চালু রাখলো। স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরও তাদের প্রকট উপস্থিতি দেখানো হলে মোটেও প্রশ্ন তোলা যাবে না — তাদের রাজনৈতিক অবস্থান কেনো উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের কাছে গ্রহনযোগ্য হয়ে উঠেছে? এ প্রশ্নও তোলা যাবে না, স্বাধীনতা অর্জনের পর দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, শিল্প সংস্কৃতিসহ সব কিছুর বিকাশ ও নিয়ন্ত্রণ তো মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তির হাতেই ছিলো, তারা কেনো এদের প্রতিরোধে ব্যর্থ হলো।

হেনা বিষ্ময় গোপন করে না,
— সত্যি, এ প্রশ্নগুলো মনে আসছিলো। তবে দুটো বিষয় একটু পরিস্কার করেন- সিক্সটিন্থ ডিভিশনের মুক্তিযোদ্ধা কি? রেজাউলের বয়স পঞ্চাশ বছর, স্বাধীনতার বয়স পঞ্চাশ বছর, রেজাউল শান্তি কমিটির সদস্য হয় কিভাবে?

নোমান নতুন একটা সিগারেট ধরায়, বয়কে আরেক কাপ চা দিতে বলে। মন দিয়ে হেনাকে দেখে— হেনার বয়স কত আর হবে চব্বিশ বা পঁচিশ বছর। অথচ চোখে কিশোরীর উচ্ছসিত সরলতা। কাঁধ ছোঁয়া কুচকুচে কালো কোকড়া চুল, গোল মুখে চাপা নাক আর ফোলা গালের জন্য চোখের সরলতা পুরো মুখাবয়বে সংক্রমিত হয়েছে। কলাপাতা পাড়ের মাখন রঙা মনিপুরী শাড়িতে শ্যামলা হেনাকে উজ্জ্বল দেখাচ্ছে, বহু রঙা পালকে আবৃত কৌতূহলী এক ফিঞ্চ পাখি বসে আছে মুখোমুখি। নোমান নরম স্বরে বলে,
— একদল মানুষ যারা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে ছিলো বা সম্মুখ সমরে অংশ নেয়নি বা কোনো পক্ষেই ছিলো না, ১৬ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় ধারণ করে, এরাই সিক্সটিনথ ডিভিশনের মুক্তিযোদ্ধা। তোমার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর খুব সহজ, মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশ বছর বয়সে সম্মুখ সমরে যুদ্ধ করা সার্টিফিকেটধারী চল্লিশ বছর বয়সী মুক্তিযোদ্ধা পাওয়া গেলে পঞ্চাশ বছর বয়সী শান্তি কমিটির সদস্য থাকবে না কেনো!
নোমানের তীর্যক বক্তব্যে হেনা আমোদ বোধ করে,
— মানলাম রেজাউল শান্তি কমিটির সদস্য ছিলো। গল্প কি এখানেই শেষ! মানে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর বয়স, কিন্তু এখনও সব অপকর্ম স্বাধীনতা বিরোধীরাই করে যাচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধারা সর্বশক্তি দিয়ে অল্প কিছু স্বাধীনতা বিরোধীকে সামলাতে পারছে না, যুদ্ধ করেই যাচ্ছে যুদ্ধ করেই যাচ্ছে যুদ্ধ করেই যাচ্ছে। মানে মুক্তিযুদ্ধ চলছেই।
— মুক্তিযুদ্ধ একটা চলমান বিষয়, মুক্তিযুদ্ধ চলতেই থাকবে। কিন্তু এখানে গল্প থামালে বিদগ্ধ পাঠকরা বলবে, টুইস্ট কই! গল্পে টুইস্ট নেই কেনো!
— সত্যিই তো, এ গল্পে টুইস্ট কই?

নোমান মুচকি হাসি দিয়ে বলে,
— গল্পে টুইস্টের যোগান দিবে রেজাউলের দুই ছেলে। রেজাউল অতি বদ লোক, সে অপরাধের শাস্তি পায়নি, কিন্তু প্রকৃতি চরম প্রতিশোধ নিবে। তুমি তার সবচে প্রিয় সন্তানটাকে হঠাৎ পাগল বানিয়ে দিবে, বদ্ধ পাগল।
— কি বলছেন এসব! প্রকৃতি কি এভাবে প্রতিশোধ নেয়, নোমান ভাই?
— না, নেয় না। প্রকৃতি বা আমাদের সৃষ্টিকর্তা কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগা সদা বিরক্ত এবং প্রতিশোধ পরায়ণ রগচটা সাইকো নন। পরম মমতায় যে বা যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, সে বা তিনি এতটা উন্মাদ নন যে একের অপরাধে অন্যকে শাস্তি দিবেন।

হেনা চমকে ওঠে,
— এমন করে বলবেন না, বিপদে পড়ে যাবেন। টুইস্ট’টা বলেন?
— প্রথম টুইস্ট রেজাউলের এক সন্তানের পাগল হয়ে যাওয়া। তবে বড় টুইস্টটা দ্বিতীয় ছেলেকে দিয়ে দেখাবে। রেজাউলের দূর সম্পর্কের আশ্রিত শালী ফারজানা এবং দ্বিতীয় ছেলে সমবয়সী, দু’জনের গভীর প্রেম।
— বলেন কি! এ তো মারাত্মক টুইস্ট।
— শুধু টুইস্ট’ই দেখলে, হেনা! এর মধ্যে ট্যাবু ভাঙা আছে, মানব মানবীর দুর্নিবার প্রেম আছে। গল্পের এ পর্যায়ে তুমি রেজাউলের প্রতি ঘৃণাটা গাঢ় করে দিতে পারো— রেজাউল যখন জেনে যায় ছেলের সাথে ফারজানার প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে, তখনই ফারজানার শরীরের প্রতি তার লোভ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে।

গল্পের ফরমুলা হেনার পছন্দ হয়েছে, নিখিলবঙ্গ প্রগতিশীল সাহিত্য পুরস্কারের জন্য গল্প পাঠানোর শেষ তারিখ আগামী মাসের ২২তারিখ, হাতে প্রায় মাস খানেক সময় রয়েছে। গল্পটা নামিয়ে ফেলা যাবে। হেনা জানতে চায়,
— গল্পের শেষটা কি হবে?
— ফারজানা, রেজাউল বা রেজাউলের দ্বিতীয় ছেলে— এদের যে কোনো একজনকে খুন করে গল্পটা শেষ করা যায়, কিন্তু আরও কিছু অতি জরুরী উপাদান বাকী রয়ে গেছে।
— কি উপাদান?
— সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, দারিদ্রের কষাঘাত, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ এবং অপ্রতিরোধ্য উন্নয়ন।

আকাশ থেকে পড়ার দশা হেনার,
— এক গল্পে এতকিছু! কিভাবে সম্ভব!
— খুব সহজেই সম্ভব। বাবার কু-কর্মের কথা জেনে ফারজানাকে নিয়ে রেজাউলের ছেলে পালাবে। বাস ছুটছে। রেজাউলের ছেলের মনে হবে গত সরকারের আমলে একবার এ রাস্তা দিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলো। ভাঙা রাস্তায় অনবরত ঝাঁকির কারনে পেট ব্যথা হয়ে গিয়েছিলো। এখন কোনো ঝাঁকি নেই, রাস্তাগুলো যেনো মাখন দিয়ে তৈরী। আর কিছুক্ষণের মধ্যে বাস পদ্মা সেতুতে উঠবে। এই সেতুটার বিরুদ্ধে কত আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র যে হলো, সব ষড়যন্ত্র নস্যাত করে প্রধানমন্ত্রী সেতুটা তৈরী করে দিলেন। রেজাউলের ছেলে ফারজানার ঘুমন্ত মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বাসের জানালা দিয়ে তারা ভরা আকাশ দেখবে, সে জানে তারার ভিড়ে জেগে আছে স্যাটেলাইট, সে স্যাটেলাইট কি জানে পৃথিবীর সবচে রূপবতী মেয়েটা তার পাশে বসে আছে। বাস পদ্মা সেতু পাড়ি দিচ্ছে, পদ্মার স্রোতে আলোর নান্দনিক খেলা। কাঁধে মাথা রেখে ঘুমের গভীর সমুদ্রে সাবমেরিনের মত ডুব সাতার দিচ্ছে ফারজানা, বাসের স্পিকারে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা গাইছেন ‘এমনি করে যায় যদি দিন যাক না।’

হেনার মনে প্রশ্ন জাগে — নোমান কি রসিকতা করছে! কিন্তু চেহারা দেখে আর কণ্ঠস্বর শুনে তা মনে হচ্ছে না। নোমান এশট্রেতে ঘষে সিগারেটের আগুন নেভায়, ফিল্টারটা ভিতরে ফেলে বলে,
— অসাম্প্রদায়িক চেতনার অংশ হিসেবে রেজাউলের ছেলে এক হিন্দু বন্ধুর বাড়িতে আশ্রয় নিবে। বন্ধুটি ওদের সেবাযত্মের চূড়ান্ত করবে। কাজী ডেকে বিয়ে পড়াবে। বিয়ের পর স্বামী স্ত্রী মিলে নফল নামাজ আদায় করবে, হিন্দু বন্ধুটি ওই সময় ঘরে দেব-দেবীর মূর্তি ও ছবিগুলো কাপড় দিয়ে ঢেকে দিবে, যাতে নামাজ আদায়ে সমস্যা না হয়।

— বাহ! বাহ! বেশ বলেছেন। পরের অংশটা মনে হয় ধরতে পারছি। এ সংবাদ রেজাউলের কানে পৌছাবে, রেজাউল ছেলেকে শায়েস্তা করতে হিন্দু পাড়ায় আক্রমণ চালাবে। ঘটনা গড়াবে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায়। এই তো?
— ঠিক তাই। হামলার পাশাপাশি অভাবগ্রস্ত হিন্দু মুসলমানদের ফোকাস করে গল্পে দারিদ্রের কষ্টের ছবি আঁকবে। তবে দারিদ্রের কারণ বা রেজাউলের ক্ষমতার উৎস সম্পর্কে কিছু বলা যাবে না। রেজাউল এমনি এমনি ক্ষমতাবান, ক্ষমতাসীন কারো মমতার ছায়া তার ওপর নেই, থাকলেও তা বিরোধী দলের।
— নোমান ভাই, তাই হবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭মার্চের ভাষণ কি সত্যিই এই গল্পে প্রাসঙ্গিক? গল্পের প্রয়োজনে ব্যবহার হবে!

নোমান হাই তুলে, মোবাইল অন করে সময় দেখে, সাদা কাগজে আঁকিবুঁকি করতে করতে বলে,
— পুরস্কারের জন্য গল্প লেখা হচ্ছে— এ গল্পে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থাকবে না! গল্পের প্রয়োজনেই তো সবকিছু আসছে, ভাষণও আসবে। হিন্দু পাড়ায় হামলার পর হিন্দু এবং মুসলিম প্রতিবেশীরা মিলে হামলাকারীদের প্রতিরোধ করবে। প্রতিরোধের নেতৃত্ব দিবে রেজাউলের ছেলে, তার মনে বেজে চলবে বঙ্গবন্ধুর উদাত্ত কণ্ঠের ভাষণ, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
— গল্পের শেষটা কি হবে?
— গল্পটা বেশ ক’ভাবে শেষ করা যেতে পারে, যেমন রেজাউলের ইন্ধনে সংঘটিত হামলায় ছেলে মারা যাবে, ফারজানাকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবেনা। অথবা, রেজাউলকে বিষ খাইয়ে হত্যা করে আত্মঘাতী হবে স্ত্রী। আরও ভয়াবহও শেষ হতে পারে, রেজাউলের ছেলে মারা যাবে, ফারজানার গর্ভে বেড়ে উঠবে রেজাউলের সন্তান।

হেনা বলার মত কোনো কথা খুঁজে পায় না, নোমান তাকে উদ্ধার করে,
— গল্পের ঝোপ বুঝে সীমিত পরিমাণে কাফকা, মারকেজ আর চমেস্কির কোপ মারতে হবে। তুমি আগে গল্পটা লিখে ফেলো, তারপর ঝোপ বুঝে বুঝে লাগসই কোপ মারা যাবে।

হেনা হ্যা সূচক মাথা নাড়ে, আগ্রহ ভরে জানতে চায়,
— আচ্ছা, রেজাউলের ছেলে মানে দ্বিতীয় ছেলের নাম কি দিবো? আর, নোমান ভাই, গল্পটা আপনি লিখছেন না কেনো?

কিছুক্ষণ কি যেনো ভাবে নোমান, চোখ থেকে চশমা খুলে টেবিলে রাখে, হেনার চোখে তাকিয়ে বলে,
— দ্বিতীয় ছেলের নাম দিও নোমান, নোমান করিম। আর রেজাউলের ছেলেদের এমন গল্প লিখতে নেই।

নোমানের এ কথা কি শুধুই টুইস্ট! ইংগিতপূর্ণ রসিকতা! অথবা নিরেট বাস্তবতা— হেনা একই সাথে বিভ্রান্ত, বিস্মিত এবং আশ্চর্যান্বিত। টেবিলের অপরপাশে এ ফোর সাইজের সাদা কাগজের এক পিঠে আঁকিবুঁকি শেষে অপর পিঠে আঁকিবুঁকি কাটছে জনপ্রিয় দৈনিকের তরুণ সাহিত্য সম্পাদক নোমান করিম।