ভোর তখন সবে ফুটছে। শীতের পাতলা কুয়াশা তখনও নারায়ণগঞ্জ শ্মশানের পরিবেশকে এক বিষণ্ণ চাদরে ঢেকে রেখেছে। চিতার কাঠগুলো তখনও জলে ভিজে, ছাইয়ের স্তূপ থেকে হালকা ধোঁয়া উঠছে। শ্মশানের কোণায় বসে ছিলেন শ্মশান বন্ধু কোকা, বছর ষাট ছুঁই ছুঁই। তাঁর চুল-দাড়ি সবই শ্মশানের ছাইয়ের মতোই ধূসর, আর তাঁর চোখ দু’টোতে যেন গত কয়েক দশকের সব শোকের প্রতিচ্ছবি। শ্মশান বন্ধু কোকা এই শ্মশানে তাঁরাই এলাকার প্রায় সব মরদেহ নিয়ে আসেন প্রায় পঁচিশ বছর ধরে। এজন্যই তাঁর নাম হয়েছে, নন্দ গোপাল (কোকা) থেকে শ্মশান বন্ধু কোকা। তাঁর কাছে শ্মশান শুধু মৃতদেহ পোড়ানোর জায়গা নয়, এ যেন জীবনের এক বিরাট পাঠশালা।
আজ সকালেই শ্মশান বন্ধু কোকা নিজ হাতে করেছে এলাকায় থাকা এক অসহায় বৃদ্ধার সৎকার শেষ করেন। মরদেহ (শবদেহ) শ্মশান বন্ধু কোকা তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে শ্মশানে এসেছিল রাতেই, কিন্তু শ্মশানের আনুষ্ঠানিকতার খরচাদি মেটানোর জন্যই শবদেহ সৎকার শেষ হতে সকাল হয়েছে। অসহায় বৃদ্ধার দুই মেয়ে তখনও শ্মশানের ভেতরেই নির্বাক বসে, তাদের চোখে জল নেই, যেন সব অশ্রু শুকিয়ে গেছে। শ্মশান বন্ধু কোকা তাদের দিকে তাকিয়ে এক দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তিনি জানেন, এই নীরবতা শোকের গভীরতম রূপ। প্রতিনিয়ত অসংখ্য মানুষের এই নীরব শোকের সাক্ষী শ্মশান বন্ধু কোকা।
তাঁর মনে পড়ে গেল অনেক বছর আগের কথা। যখন তিনি প্রথম এলাকার পরিচিত একজনের মরদেহ শ্মশানে এনে সৎকার শুরু করেন, তখন তাঁর মন সবসময়ই ভারাক্রান্ত থাকতো। প্রতিটি চিতায় যেন নিজেরই কোনো আত্মীয়কে তিনি দেখতেন। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তিনি শিখতে শুরু করেন জীবনের এই অলঙ্ঘনীয় সত্যকে মেনে নিতে। তিনি বুঝতে পারেন, শ্মশান শুধু শেষ যাত্রার স্থান নয়, এটি জীবনের এক নতুন শুরুরও প্রতীক। এখানকার ধোঁয়া কেবল ভস্মীভূত জীবনের স্মারক নয়, তা যেন শোককে উড়িয়ে নিয়ে এক নতুন পথের সূচনা করে।
কিছুক্ষণ পরই শ্মশান থেকে বের হয়ে যাবার পালা। শ্মশান বন্ধু কোকা শ্মশান থেকে বের হবার আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে বৃদ্ধার দুইকে কাছে ডাকেন। দুই মেয়ে-সহ মৃত বৃদ্ধার নাতি-নাতনীরা গুটিগুটি পায়ে হেঁটে সামনে এলেন। তাদের মুখপানে চেয়ে শ্মশান বন্ধু কোকা খেয়াল করলেন, বৃদ্ধ মাকে হারিয়ে তারা যেন পাথর হয়ে গেছে। তারা এমনভাবে ভেঙে পড়েছিলেন যে শ্মশান বন্ধু কোকা দেখে স্থির থাকতে পারেননি। তিনি নিজের হাতে তাদের জন্য জল এনে দেন, পাশে বসে সান্ত্বনা দেন। শ্মশান থেকে বের হবার কিছু নিয়মকানুন শিখিয়ে দিয়ে শ্মশান বন্ধু কোকা তাদের বলেছিলেন, “মৃতদেহ শুধু পঞ্চভূতে বিলীন হয়। কিন্তু ভালোবাসা আর স্মৃতি অমর হয়ে থাকে। সে আপনার মায়ের মতোই আপনাদের সঙ্গেই থাকবে”।
তারপর শ্মশান বন্ধু কোকা আঙুল উঁচিয়ে দেখালেন, গেটে লেখা আছে – “জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ, সব বিধাতার ইচ্ছা”। তিনি আরও বলেন, “এই শ্মশান যেন এক বিশাল শিক্ষালয়, যেখানে প্রতিটি মানুষ আসে এক অনিবার্য সত্যকে উপলব্ধি করতে। এখানে ধর্ম, বর্ণ, ধনী-গরিবের কোনো ভেদাভেদ নেই। সবাই আসে একই পরিণতি বরণ করতে, একইভাবে ছাই হয়ে মিশে যেতে”।
তাদের শান্তনা দিয়ে শ্মশান বন্ধু কোকা অনুভব করেন, প্রতিটি চিতার আগুন এক একটি জীবনের গল্প বলে যায়। কখনো সে গল্প অকালমৃত্যুর বেদনা, কখনো দীর্ঘ জীবনের পরিসমাপ্তি, আবার কখনোবা হঠাৎ করে আসা বিদায়ের শোক। কিন্তু সব গল্পের শেষে একটাই বার্তা – জীবন ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু ভালোবাসার রেশ চিরন্তন।
সূর্য তখন শ্মশানের আকাশে উঁকি দিয়েছে। কুয়াশা কেটে এক নতুন দিনের আলো শ্মশানের পরিবেশকে এক অন্যরকম উজ্জ্বলতা দিচ্ছে। শ্মশান বন্ধু কোকা-সহ শ্মশানের যারা এসেছিল, সবাই “হরি হরি বলা, বল হরি” ধ্বণিতে শ্মশানের গেইটের দিকে এগুতে থাকেন। শ্মশান প্রহরী ডোম সম্প্রদায়ের দুইজন শ্মশানের গেইটে এসে কিছু মন্ত্র পাঠ করে তাদের প্রাপ্য দক্ষিণা বুঝে নিয়ে শ্মশান গেইট পাড় করে দিলেন। শ্মশান বন্ধু কোকা সাথে আসা সবাইকে নিয়ে নিজ এলাকার গন্তব্যে পৌঁছাতে দুটো ছোট বাহনে চেপে বসলেন। একসময় নিজেদের গন্তব্যে এসে পৌঁছালেন।
তাঁর কাছে জানতে চাইলে, তিনি বলেন, “আমি যতদিন এই ধরণীর বুকে বেঁচে থাকি, ততদিন এই এলাকার যেকেউ মৃত্যুবরণ করলে আমি নিঃস্বার্থে সৎকার করে শ্মশানে ছুটে যাবো তাদের প্রিয়জনের শেষ যাত্রায় অংশ নিতে। প্রতিটি শোকের নীরব সাক্ষী হতে নিজেকে নিয়জিত রাখার চেষ্টা করবো। এটাই আমার জীবনের প্রতিজ্ঞা”। শ্মশান বন্ধু কোকা—