বিভাগের আর্কাইভঃ গল্প

চিকেনিজম ভাবান্দোলন

প্রগতিশীল ও উন্নত রাষ্ট্র বলতে মানসলোকে যে ধারণা পুস্পপত্রে পল্লবিত হয়ে ওঠে ওয়েস্ট শেয়ালপুর রিপাবলিক ঠিক তাই। ফলে শিয়ালপুরের রাজধানীর নাম চিকেনডাঙা শোনার পর বিস্ময় জাগেনি। এই রাজধানীতেই প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয় ‘বিশ্ব মুরগিসুন্দরী প্রতিযোগিতা’।

বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতার কথা শুনলেও বিশ্বমুরগি সুন্দরী প্রতিযোগিতার বিষয়ে পুরোই অজ্ঞ ছিলাম। শেয়ালডাঙার সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী স্যার মোরগালিয়াম কুককুরুক যখন এ তথ্য জানালেন তখন বিস্ময় গোপন করতে পারিনি। অগাধ কৌতূহল নিয়ে তার কাছে জানতে চাইলাম-
: স্যার, এ প্রতিযোগিতা আয়োজনের কারণ কি?
: চিকেনিজম ভাবান্দোলনের ফসল এই প্রতিযোগিতা। মুরগিধিকার প্রতিষ্ঠায় বিশ্বব্যাপী মুরগিবাদীদের চলমান সংগ্রামের প্রতি সংহতি জানাতে শেয়ালপুর রাষ্ট্রীয়ভাবে এ প্রতিযোগিতা আয়োজন করে।

নিজ অজ্ঞানতাকে মনে মনে ধিক্কার জানিয়ে প্রশ্ন করলাম-
: এ প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন কি কি পুরষ্কার পান?

শেয়ালপুর রিপাবলিকের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী বেশকিছুক্ষণ ভাবলেন, তারপর বললেন-
: যে প্রতিযোগী চ্যাম্পিয়ন হন তিনি অনেক পুরষ্কারইই পান। মুরগিধিকার আন্দোলনের ব্রাণ্ড এম্বাসেডর হিসেবে দায়িত্বপালন করেন। তবে সবথেকে বড় পুরষ্কার হলো মুরগি স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় তারা আমৃত্যু শেয়ালদের সাহচর্য পান।

আবার বিস্মিত হবার পালা, সারাজীবন জেনে এসেছি শেয়াল আর মুরগীর সম্পর্ক খাদক ও খাদ্যের, আর মন্ত্রী মশাই বলছেন সাহচার্যের কথা! কৌতূহল চাপতে না পেরে বললাম-
: মন্ত্রী মশাই, শেয়ালদের সাহচর্য বিষয়ে যদি একটু খোলাসা করে বলতেন-
: ভেরী সিম্পল। চ্যাম্পিয়নসহ ফার্স্ট ও সেকেন্ড রানার্স আপ বিশ্ব মুরগিসুন্দরী শেয়ালদের সাথে রাত কাটিয়ে জানিয়ে দেন- মুরগিস্বাধীনতা হরণ করা যাবেনা।

যত জানছি ততই কৌতূহল বাড়ছে, জানতে চাইলাম-
: এতে শেয়ালদের লাভ কি?

মন্ত্রীমশাই ক্ষুব্ধ কণ্ঠে জানালেন-
: সবকিছুতেই লাভ থাকতে হবে! শেয়ালদের মনে মুরগিদের প্রতি দরদ ও ভালোবাসা নেই- এ ধারণা সম্পূর্ণ অবান্তর। শেয়ালদের মত এতো বেশী করে কে আর মুরগিদের ভালোবাসে!

মন্ত্রী মশায়ের কাছে ক্ষমা চাইলাম। কিন্তু তার রাগ কমেছে বলে মনে হোলো না। কিছুটা ভয় নিয়েই প্রশ্ন করলাম-
: বাকী প্রতিযোগিরা কি সুযোগ পান?

মন্ত্রীমশাই ঝাঁঝালো স্বরে বললেন-
: আপনার কি মনে হয়?

বিনয়ের সাথে উত্তর দিলাম-
: স্যার, আমার কোনো ধারণা নেই। তাই আপনার কাছে প্রকৃত তথ্যটা জানতে চাইছি-

স্যার মোরগালিয়াম ক্ষোভে ফেটে পড়লেন-
: শেয়ালপুর রিপাবলিকের মোরগরা কি মরে গেছে! বাকী প্রতিযোগীরা এই মোরগদের সাহচর্য পায়। তারপরেও দু:খজনক সত্য হোলো মুরগিধিকার প্রতিষ্ঠায় মোরগদের ভূমিকা সবসময়েই ফোকাসের বাইরে থেকে গেছে। মুরগী আগে না ডিম আগে প্রশ্ন থেকেই এই অবহেলার শুরু, যেনো ডিমোৎপাদনে মোরগের কোনো ভূমিকা নেই।

আর কোনো প্রশ্ন করার সাহস হলো না। মন্ত্রী মশায়ের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময় তিনি কানে কানে বললেন- ‘মুরগির প্রয়োজন হলে বলবেন, সংকোচ করবেন না। মুরগিধিকার প্রতিষ্ঠায় চিকেনিজম বিশেষজ্ঞ ৩৪-২৬- ইনফিনিটি মুরগি পাঠিয়ে দেবো, জাস্ট রুম নাম্বারটা জানাবেন।’

.
#খসড়া অণুগল্প
১৩১০২০১৮

বাঙালি সেকুলারের মনের পশু সঙ্কট

abu

১.
কোরবানি ঈদের পরদিন, রাত ৮টা। সুনসান পাড়া, নিরবতা বিদীর্ণ করে কেউ একজন তীব্র গতিতে বাড়ির কলাপসিবল দরজা ঝাঁকাচ্ছে। কল বেল থাকার পরও এভাবে দরজা ঝাঁকানো ভীতিকর, ভয় পেতে শুরু করেছি।

আতঙ্ক আর কৌতূহল মিশ্রিত মন নিয়ে দ্রুত দরজার সামনে গেলাম, মহল্লার এক ভায়ের ভয়ার্ত চেহারা, দু’হাতে সজোরে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছেন, ভেঙে ফেলতে চাইছেন। আমাকে দেখে কিছুটা সম্বিৎ ফিরে পেলেন, কাতর স্বরে বললেন,
– জলদি দরজার তালা খুলো, আমারে বাঁচাও.. প্লিজ বাঁচাও।

তাকে ঘরে এনে বসালাম। পরপর দুই গ্লাস পানি খেলেন। বোঝা গেলো খুব বিপজ্জনক কিছু ঘটেছে। জিজ্ঞেস করলাম,
– কি হইছে ভাই!
– তুমি তো জানো আমি দুইটা কোরবানি দেই। একটা পারিবারিকভাবে ঈদের দিন, আরেকটা একা দেই, ঈদের পরদিন।
– আমি তো জানতাম একটা দেন।

গত এক যুগ ধরে এই ভাইদের বাসায় একটা গরু কোরবানি দিতে দেখে আসছি, তিনি দুইটা পশু কোরবানি দেবার কথা বলায় কিছুটা বিস্মিত হলাম। সেই বিস্ময় ভাঙাতে তিনি জানালেন,
– না, একটা না। ঈদের দিন পারিবারিকভাবে কোরবানি দেই বনের পশু, আর ফেসবুকে সিরিয়াস হবার পর থেকে ঈদের পরদিন একা একা কোরবানি দেই মনের পশু।

একটা ঢোক গিলে জানতে চাইলাম,
– তা সমস্যাটা কি, ভাই?
– বিশাল সমস্যা। আজ দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর মনের পশুটারে জবাই দিবার জন্য পায়ে বাইন্ধা একটানে মাটিতে ফেলছি, মুহুর্তের মধ্যে ঝাড়া দিয়া খাড়ায়া গেলো, ফ্র‍্যাকশন অব সেকেন্ড খাড়ায়া রইলো, তারপর দিলো ঝাইররা দৌড়।
– বলেন কি! তারপর?
– আমিও পশুর পিছনে দিলাম দৌড়, টের পায়া ওই পশু গিয়া ঢুকলো সেলিনাদের বাসায়।
– সেলিনা? কোন সেলিনা! আপনাদের বাড়ির পাঁচ ছ’টা বাড়ির পর যে থাকে! মানে আপনার এক্স মানে প্রাক্তন..

কথা শেষ করতে না দিয়ে মহল্লার ভাই চেঁচিয়ে উঠলেন-
– চুপ। একদম চুপ। বিশ্বাসঘাতিনী, আইয়ূব বাচ্চু তাই বলেছেন ‘সেলিনা এখন অন্য কারো/আমার কেউ নয়..’
– ওহ! আচ্ছা। তবে সেলিনার কথা থাক, আপনার মনের পশুর কথা বলেন-
– বিকাল সাড়ে তিনটা থেকে সেলিনাদের গেটে দাঁড়ায়ে আছিলাম, কিন্তু মনের পশুটা ঢুকছে তো ঢুকছেই। বের আর হয়না। একটু আগে বের হইলো সেলিনার বড় ভাই, সাথে তার মনের পশু, তার মনের পশু আবার দুইটা- যমজ এলসেশিয়ান কুত্তা।
– বলেন কি!
– হ রে ভাই! সেলিনার বড় ভাইরে দেইখা সালাম দিলাম, তিনি সালামের জবাব নিয়া জিগাইলেন, ‘এইখানে কি করতাছো, বিলাল?’
– তারপর!
– আমি জবাব দিবার আগেই সেলিনার ভায়ের মনের পশু দিলো ধাওয়া, আমার পাছায় কামড়ায়া কিচ্ছু বাকী রাখে নাই, ধাওয়া খাইতে খাইতে এইখানে আয়া পরছি।

মহল্লার ভায়ের মনের পশু গেছে পালিয়ে, তার ওপর প্রাক্তনের বড় ভায়ের মনের পশু এক জোড়া এলসেশিয়ানের ধাওয়া খাওয়ার ভয়ে চুপচাপ আমার বাসায় বসে আছেন, দেখে মায়া লাগছে, কষ্টও হচ্ছে।

২.
মাঝরাতে তুমুল বৃষ্টি শুরু হলো। এমন বৃষ্টিতেই চার পাঁচজন বন্ধু মিলে পাহারা দিয়ে মহল্লার বড় ভাইকে বাসায় পৌছে দিলাম। সকালে ঘুম ভাঙলো ভায়ের ডাকে, বৃষ্টি নেই কিন্তু বারান্দায় গোড়ালি পর্যন্ত পানি। রাস্তায় পানি বেশী, ময়লাও। ওই পানি পেরিয়ে মহল্লার ভাই চলে এসেছেন। বিস্ময় গোপন করে জানতে চাইলাম,
– এতো সকালে! কোনো সমস্যা, ভাই?
– সমস্যা মানে বিশাল সমস্যা।

একটা মাত্র জীবনে মানুষকে বহু বিশাল বিশাল সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়! ভোরের আলোয় মনটা বিষন্ন হয়ে উঠলো, বিষাদভরা কণ্ঠে বললাম,
– চলেন, ছাদে বসি। চা খেতে খেতে কথা বলি..

দু’জনে ছাদে উঠেছি। ক’টা চড়াই, বাবুই আর দোয়েল খাবার খাচ্ছে। প্রতিদিন এদের খাবার দেওয়া হয়, না দিলে ভোরে এসে চেঁচামেচি শুরু করে। পাখিগুলো আমাদের দেখে উড়ে গেলো না, ভাই বললেন,
– এগুলির দেখি অনেক সাহস!
– উড়ে যাবার পাখা আছে, ভয় কেনো পাবে?
– তা ঠিক! তা ঠিক!

চায়ে চুমুক দিচ্ছি, ভাই উশখুশ করছেন কিন্তু কথা শুরু করতে পারছেন না। অগত্যা আমিই প্রশ্ন করলাম-
– কি সেই বিশাল সমস্যা!
– প্রথম সমস্যা হলো, সেলিনার ভায়ের মনের জোড়া কুত্তা যে আমারে কামড়াইলো, এর জন্য কি নাভির গোড়ায় ইনজেকশন নিতে হইবো!

দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বললাম,
– না, ভাই। মনের ইনজেকশনই বড় ইনজেকশন। দ্বিতীয় সমস্যাটা কি?

ভাই একটু কেশে নিয়ে শুরু করলেন,
– কোরবানি ঈদের পরদিন মানে গতকাল তো মনের পশুরে কোরবানি দিতে পারিনি, দৌড়ায়া সেলিনাদের বাড়িতে পালাইলো।
– হুম।
– কিন্তু কেলেঙ্কারি কাণ্ড ঘইটা গেছে-
– ছি: ছি: বলেন কি!
– হ, আমার মনের পশু তো সেলিনার মনের পশুরে নিয়া জঙ্গলে ভাগছে..
– ওহ! এতে আর সমস্যা কি?
– এইটাই তো সমস্যা! মনের পশু এখন তো আর মনের পশু নাই, পুরাই বনের পশু হয়া গেলো।
– এইভাবে তো ভাবি নাই! তবে আগামী ঈদের পরদিন কোরবানি দিবেন কি!

ভাই স্বস্তির স্বরে জানালেন,
– ওইটা নিয়া চিন্তা নাই। মনের পশু পালানোর আগে তিনটা বাচ্চা দিয়া গেছে, নাদুস নুদুস, মনের মাঠে নাপাম ঘাস খায়া খায়া বড় হইতাছে–

খুব কৌতূহল নিয়েই জানতে চাইলাম-
– বলেন কি! আচ্ছা ভাই, বছরে বছরে মনের পশু কুরবানি না দিয়া, মনের পশুর খামারটারে এক্কেবারে উচ্ছেদ করলে হয়না!

আমার বোকামিতে ভাই মৃদু হাসলেন,
– এইটা একটা কথা হইলো! মনের পশু কুরবানি দিতে কইছে, খামার উচ্ছেদ করতে তো কয়নি। তাছাড়া খামার বন্ধ করলে প্রতি ঈদে ফেসবুকের পাকপবিত্র ময়দানে মনের পশু কোরবানি দিমু কেম্নে!

‘কে এমনটা বলেছে’ এই প্রশ্নের উত্তর জানার সাহস হলো না, তাই চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম,
– সমস্যা কি আরও কিছু আছে?
– হুম
– কি সেটা?
– আমার গফরে বুঝাইতে পারিনা আমি শুধু তারেই ভালবাসি, আমার ১২টা গফের একটা গফও আমার এই কথাটা বিশ্বাস করে না।

মুরগির ডিম ফুটে ছাগলের বাচ্চা বের হলেও এতটা তাজ্জব হতাম না, তাজ্জবতা কাটিয়ে বললাম,
– দু:খজনক, মর্মান্তিক, বেদনাদায়ক–, এ তো অনেক বড় প্রব্লেমেটিক সমস্যা।
– এটা বড় সমস্যা না, সমস্যা হইলো আমার মনের পশুর লগে ওদের মনের পশুও যদি ভাইগা যায় তবে তো বিশৃঙ্খলা হয়া যাইবো।
– ভাগতে চাইলে ভাগতে দেন, বিশৃঙ্খলা হইবো ক্যান!
– বিশৃঙ্খলা হইবো না! ওগো ১২জনের মনে ১২টা পশু, আর আমার মনে পশু মাত্র ৩টা। অবস্থাটা বোঝা একবার, এক্কেবারে পরকীয়া হয়া যায় না!

সাহস নিয়ে বললাম,
– আপনার গফদের মনে আর বনে আসলে একটাই পশু, মানে ১২জন মিলে ১টা পশুরেই শেয়ারে পালতাছে, চিন্তা কইরেন না।
– এইটা হইলে তো ভালোই। কিন্তু একটারে নিয়া যদি বারো পশু পালায়! কিয়েক্টা অরাজকতা! এর থেকে পরিত্রাণের কি কোনো উপায় নাই!!

এই বিশাল সমস্যার সমাধান খুব কঠিন নয়, ভায়ের মনে হাইব্রিড পশু চাষ করলেই হবে। কিন্তু বলার ইচ্ছে হলো না, বাঙালি সেক্যুলারের মন বুঝা খুব কঠিন, তাদের মনের পশুরে বুঝা কঠিনতর, তাই ভায়ের চেহারার সাথে মিলিয়ে নিজের চেহারায় চিন্তার ভাব ধরে রাখি, যেনো কোরাসে চিন্তা করছি।

.
পুরানো লেখা।

নীলমাছি

gty

পায়ের কাছে জানলা খোলা। বাইরে ঝাঝা রোদ। গ্রীষ্ম দুপুরের তালুফাটা গরম। জানালার গ্রীলে তিন চড়ুই শলাপরামর্শ করছে। ধীর গতিতে পাখা ঘুরছে।

কাথা মুড়ে শুয়ে আছি। তিন দিন ধরে ভীষণ জ্বর। আবার কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছে। তৃষ্ণা পাচ্ছে, বরফ চিবিয়ে খেতে ইচ্ছে করছে। জ্বর বাড়ছে আর বিছানাটা কেমন সবুজ মাঠ হয়ে যাচ্ছে। দূর্বা ঘাসের ঘ্রাণ, মাথার কাছে ফুটে আছে ঘাসফুল। ফড়িংয়ের ঝাক উড়ে গেলো- এলোমেলো। একটা চকচকে নীল ডুমো মাছি নাকের কাছে অনেকক্ষণ ভনভনালো। কোথায় উড়ে গিয়ে ফিরে এলো। কাথার উপরে বসলো,
— আবার জ্বর বাঁধিয়েছ?
— জ্বর কি ছবির ফ্রেম না পুকুরের ঘাট যে বাঁধাবো?

আমার বিরক্তিকে পাত্তা দেয় না মাছি,
— হাহাহাহাহা… ভনভনানিতে রাগ করছ?

কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করে মাছি কথা শুরু করল,
— ভনভনিয়ে কি খুঁজছিলাম জানো?
— কি!
— পাকা ল্যাংড়া আমের রসের ঘ্রাণ।

বিরক্তির মাত্রা অসহ্যের সীমা অতিক্রম করল,
— আমি কি ল্যাংড়া আম! তোমার তাই মনে হয়! যুক্তিসহ ব্যাখ্যা কর..

মাছির স্বর কিছুটা বিব্রত,
— ধ্যাত, তুমি ল্যাংড়া আম হবে কেন! সেই জ্বর জ্বর দুপুরের কথা একটুও মনে নেই তোমার!
— কোন দুপুরের কথা?
— সেই যে চারদিন আগে তোমার দাদিজান মারা গেছেন। উনার চেহলাম। দুপুরে ক’জনকে খাওয়ানো হবে। মা কুঁচো চিংড়ি দিয়ে করলাভাজি, পুঁইশাক দিয়ে বড় চিংড়ি, লাউ দিয়ে ইলিশ মাছ, আলু-বেগুন দিয়ে রুই মাছ রান্না করেছেন। রুইমাছের তরকারীতে জিরা ভেজে গুড়ো করে দিয়েছেন। সজনের ডাল থেকে ধোঁয়া উড়ছে। শোক আর ঘ্রাণে উথলে ওঠা দুপুর। নামাজ শেষে মিলাদ, তারপরে খাওয়ানোর পর্ব শুরু হবে। যাদের পাতে দু’বেলা সাদামাটা ভাত জোটে কি জোটে না, এমন ক’জন খাবেন। কি মনে আছে?

বিরক্তি কিছুটা কমে, স্মৃতির ঘায়ে কণ্ঠ কিছুটা কোমল হয়ে আসে,
— হ্যা, মনে আছে। সেসব বহু যুগ আগের স্মৃতি। তুমি এসব জানো?
— জানবো না কেনো! আমিও যে ছিলাম।

বিস্মিত হই,
— নীলমাছি, তুমিও ছিলে?
— হুম। সেদিন তোমার বেশ জ্বর। রান্নার ফাঁকে ফাঁকে মা মাথায় পানি দিচ্ছেন। জ্বর কমছে বাড়ছে, কিন্তু এক্কেবারে ছেড়ে যাচ্ছে না। ঘরের এক কোণে শুয়ে আছো- গুটিশুটি ছোট্ট মানুষ।
— হুম, গায়ে লেপ। দাদিজানের কাফনের মত শাদা কভার। ন্যাপথলিনের কড়া গন্ধ।

নীলমাছি মাথা দোলায়,
— তোমার স্মৃতি দেখছি খুব টনটনে। মেহমানদের জন্য ফল আনা হয়েছে— ল্যাংড়া আম, শক্ত কোষের কাঁঠাল আর তরমুজ। বাবা একটুকুরো আম কেটে তোমার মুখে দিলেন। সেই আমের রস টুপ করে শাদা কাভারে পড়লো।

মনের ভেতর উৎলে উঠে বিষাদ,
— বাবা মারা গেছেন বাইশ বছর হয়ে এলো। সে কথা থাক, তোমার কথাই বলো…

স্মৃতিকাতর মাছি বলে চলে,
— সেদিন গরম আর ক্ষিধের জ্বালায় অস্থির ছিলাম। চিন্তা না করেই লেপের কভারে পড়া দু’তিন ফোঁটা রস খেতে শুরু করলাম। তুমি অবাক হয়ে খাওয়া দেখছিলে।

মাছির ভুল ভাঙাই,
— তোমার খাবার দেখছিলাম না। তোমার নীল শরীরে আলোর ঝিলিমিলি দেখছিলাম।
— খাওয়া শেষে ভাবলাম একটু জিরোই। তুমি অসুস্থ শিশু এক— আমায় কি আর ধরতে পারবে!
— হিসেবে খুব বড় ভুল করেছিলে..

মাছির অকপট স্বীকারোক্তি,
— হ্যা, আত্মঘাতী ভুল করেছিলাম। হঠাৎ মুঠোর ভেতরে ধরে ফেললে। সে কি ভয়! জীবন হারানোর আশঙ্কা ও আতঙ্ক! পায়ে সুতো বেঁধে আমৃত্যু উড়াবে— ভাবতেই বুক ফেঁটে কান্না এলো।
— আহারে! হাহাহাহাহাহাহা…
— হাসছো কেনো! তখন কি জানতাম যে কয়েক মুহূর্ত দেখে ছেড়ে দিবে!

মাথা ব্যথা আর গায়ের তাপ দুইই বাড়ছে, ক্লান্ত স্বরে জানতে চাই,
— আজ সেসব কথা ভনভনাতে এসেছো!

মাছি শোনায় অদ্ভুত কথা,
— রূপকথার অভিশাপে অমরত্ব পেয়েছি। মরে যাই— ফের একজীবনের স্মৃতি নিয়ে জন্মাই। আজ দুপুরে সেই দুপুরের কথা মনে হতেই ছুটে এলাম।

জ্বরের ঘোরে রসিকতা করি,
— নীল মাছির আগমন, শুভেচ্ছায় স্বাগতম। তা কি দেখলে!
— তোমার মুখে এখনো আমের রসের ঘ্রাণ লেগে আছে।
— এখনো ঘ্রাণ লেগে আছে! কত বছর আগের কথা! সময় চলে গেছে কত!
— ধ্যাত! সময় যাবে কোথায়! সময় তার প্রতিটা বিন্দুতে স্থির।

রূপকথার অভিশাপে অভিশপ্ত মাছির কাছে কৌতূহল গোপন করি না,
— ও নীলমাছি, সময় তবে কোথাও যায় না?
— না, যায় না। সময় তার প্রতি বিন্দুতে স্মৃতি সঞ্চয় করে রাখে।
— তবে আমাদের যে বয়স বাড়ে? দিন ফুরোয়?
— বয়স বাড়বে না কেনো বলো! তোমাদের মানুষ হবার কত তাড়া। পায়ের তলায় সর্ষে। বিরাম নেই, বিশ্রাম নেই, শুধু যাওয়া আর যাওয়া।
— সবাই তো যায়, কি যায় না!

নীল মাছির কণ্ঠে বিষাদ ভর করে,
— যেয়ে লাভ কি! সময়বিন্দুকে অতিক্রম করে যেতে যেতে একদিন একেবারে থেমে যাওয়া। থেমে যাবার আগে মনে হওয়া- এই ইঁদুর দৌড়, এই দিনযাপন অর্থহীন… সব অর্থহীন! শুনতে পাওয়া কে যেনো ডাকনাম ধরে ডেকে বলছে, “তোমার না মনসুখিয়া যাবার কথা ছিলো!”

কথা খুঁজে পাই না। নীল মাছি বিজ্ঞের মত বলে,
— এসব কথা থাক। এত ঘনঘন তীব্র মাথাব্যাথা আর গাঢ় জ্বর আসার লক্ষণ মোটেও ভালো নয়। তুমি কি পুষছো?
— জ্বরের লক্ষণ বিচার পরে করো। ও নীল মাছি, মনসুখিয়ায় কবে যেতে পারবো! ছুঁতে পারবো অভ্রজোনাকের পাখা!

নীল মাছি কোনো উত্তর দেয় না। জ্বর বাড়ছে, তৃষ্ণা তীব্রতর হচ্ছে। ঘরের সিলিং কখন নীলাকাশ হয়ে গেছে। মেঘে মেঘে কত প্রিয়মুখ। সবুজ ঘাসে দাঁড়িয়ে আম কাটছেন বাবা, ধবেধবে শাদা পাঞ্জাবী হাওয়ায় উড়ছে যেন মনসুখিয়ার নিশান।

.
নীলমাছি | ২০১৬ | বর্তমানে ‘মনসুখিয়া‘ বইটি আউট অব স্টক।

মনসুখিয়া

abu

১.
মাঝরাত হতে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। মাঝে মাঝে কমে আসছে, কিন্তু থামছে না। অন্ধকার কিছুটা ফিকে হয়ে এসেছে। বৃষ্টির তালের সাথে আজানের সুর মিশে এক মোহনীয় সিম্ফনি ভেসে আসছে– আসসালাতু খায়রুম মিনান নাউম… আসসালাতু খায়রুম মিনান নাউম…।

আড়মোড়া ভেঙ্গে বারান্দায় যাই। সারারাত আন্ধকার দূর করা ক্লান্ত বাতিটাকে নেভাই। গ্রীলের পাশে দাঁড়াই। একটা সিগারেট ধরাতেই ধমকে ওঠে খাঁচায় পোষা ঘুঘু দম্পতির বউটি,
— সক্কাল সক্কাল সিগারেট! খুব খারাপ। খুউউব খারাপ।

বউটির কথার প্রতিবাদ করে স্বামী ঘুঘুটি বলে, ‘খাক না একটা সিগারেট। হয়তো টেনশনে আছে, দেখলে না সারারাত ঘুমোয়নি।’

কথা শেষ হতে না হতেই ঘুঘুবউটি চোখ পাকিয়ে এমনভাবে স্বামীর দিকে তাকাল যে বেচারা করুণ সুরে ডাকতে লাগলো। আমি হেসে উঠলাম, ঘুঘুবউ ফের ধমক লাগাল-
— হাসছো যে খুব! এখখনি সিগারেট ফেলো। আজ বারান্দায় কোনো সিগারেট খাওয়া চলবে না। ইট ইজ এন অর্ডার, পুরো ৫৭ ধারা।

মেঘের নরম ভোরে তর্কে যেতে ইচ্ছে করল না। সিগারেট নিভিয়ে ঘুঘুবউকে জিজ্ঞেস করলাম,
— বারান্দায় ৫৭ধারা জারী হলো কবে?
— আজ, এবং এখন।
— বাহ! জারী করলেন কে?
— কে আবার জারী করবে! আমিই করেছি।

চলচ্চিত্রে দেখা উকিলের ঢংয়ে জানতে চাইলাম,
— মহামান্য আদালত, কতদিনের জন্য বারান্দায় ৫৭ ধারা জারী থাকবে?
— ২৪ঘণ্টার জন্য।
— মাত্র ২৪ ঘণ্টার জন্য! কেন?
— কারণ, আজ আমাদের বাবুর প্রথম জন্মদিন। ওর জন্মের দিনে বারান্দায় কাউকে বাজে কাজ করতে দিব না।

দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বললাম,
— বেশ! আজ বারান্দায় কোনো বাজে কাজ হবেনা। যাই, একটু ছাদ থেকে ঘুরে আসি।

২.
বারান্দা হতে ঘরে ফিরি। খুব সাবধানে শব্দ না করে দরজা খুলি। সিড়ি ভেঙে একতলার চিলেকোঠায় দাঁড়াই। এলোমেলোভাবে কাকের কা কা শব্দ ভেসে আসছে। প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে সিগারেট ধরিয়ে টান দিতেই টিকটিক করে ওঠে এক টিকটিকি,
— ধুত্তোরি! সারা রাত সিগারেট খেয়েছ। ভোরেও শুরু করেছো!
— হুম, আজ বড়ো সিগারেটের তৃষ্ণা পেয়েছে। তৃষ্ণা মিটছে না।

টিকটিকের স্বরে দার্শনিকতা ভর করে,
— মানুষ! তোমার যে কি হয় এক একটা দিন! কিসের কিসের যে তৃষ্ণা পায়! সিগারেটের তৃষ্ণা, চায়ের তৃষ্ণা, গানের তৃষ্ণা, স্মৃতির তৃষ্ণা, শিমুল তুলো ওড়ানোর তৃষ্ণা, তারা গোনার তৃষ্ণা, গজলের তৃষ্ণা, কবিতার তৃষ্ণা, অভ্রবকুলের তৃষ্ণা, হারালো যে জন অন্ধকা….

কথা শেষ হবার আগেই থামিয়ে দিয়ে বলি-
— সব মুখস্থ করে রেখেছো দেখছি! আর কোনো কাজ টাজ নেই তোমার!
— দেখে দেখে মুখস্থ হয়ে গেছে।
— বাহ! বাহ। তুমি দেখছি এক্কেবারে জিপিএ ফাইভ।
— জিপিএ ফাইভ না ছাই! তবে আজ বেশ কষ্ট পেয়েছি। তাই বারান্দা থেকে তোমার পিছুপিছু এলাম।

নরম স্বরে জিজ্ঞেস করি,
— কে তোমাকে কষ্ট দিল টিকটিমনি!
— কে আবার দিবে! তুমিই দিয়েছ, মানুষ।
— কখন! কখন কষ্ট দিলাম!

টিকটিকি একটু লেজ নাড়ে, সদা নীতি শিক্ষায় নিয়োজিত মুরুব্বীর স্বরে বলে,
— ঘুঘুবউটি বললো আজ তাদের বাবুর প্রথম জন্মদিন। তুমি একটু উইশও করলে না! আমার ভীষণ কষ্ট লেগেছে। মানুষ, তুমি এমন কেনো!
— এজন্য এতো কষ্ট!
— হু
— কিন্তু এ কষ্ট যে অর্থহীন।

টিকটিকির স্বরে দ্বিধা,
— অর্থহীন! কেনো বলো তো!
— শোনো টিকটিমনি, উইশের ফিতায় কি মাপা যায় জন্মের পরিধি!
— কি যে বলো! কিছুই বুঝি না।
— কিছু বুঝার দরকার নেই। মনে রেখো প্রতিটা দিনই জন্মদিন। প্রতিটা দিনই নতুন করে জন্মায় তার আগের দিনের স্মৃতি ও বিস্মৃতি নিয়ে, সাথে সাথে আমরাও জন্মাই প্রতিদিন। একদিন এমন একটা দিন আসে, আমরা আর জেগে উঠি না, সেখানে জম্মের শেষ।

টিকটিমনি একটা লম্বা হাই তুলে,
— তাই না কি, মানুষ! তোমার প্যাঁচাল শুনে ঘুম পাচ্ছে।

টিকটিকিকে আর কিছু বলা হয় না। নিজের অজান্তেই ক’টা দীর্ঘতম দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে, ছড়িয়ে পরে ভেজা হাওয়ায়। তুমুল বৃষ্টির একটানা শব্দ ছাপিয়ে তারস্বরে করুণ শিস দিয়ে যাচ্ছে দু’টা দোয়েল। কে জানে এই সকালে কোন কারণে এমনতর বিষাদ তাদের!

৩.
আজ বৃষ্টি আর থামবে না। অপাকস্থালীর জীবন আকুতি জানায়- ‘আজ নিজের ভেতরে সাঁতার কাটা হোক, তালদুপুরে মনপুকুরে দাও ডুব।’ কিন্তু খেঁকিয়ে ওঠে পাকস্থলীর জীবন, ‘সকাল সকালই আকাজের উস্কানি দিচ্ছো যে! কাজ না করলে খাবে কি! পেটে ক্ষিধে থাকলে তখন দেখা যাবে কোথায় থাকে তালদুপুর আর খালপুকুর, হু।’ যে জীবন পাকস্থলীর সে জীবন বোঝেনা পাখির ভাষা, পতঙ্গের আহ্লাদ, বৃষ্টির রোদন। সে জীবন জানে শুধু কামলার ব্যকরণে দীর্ঘশ্বাস গোপনের সকল কৌশল।

রাস্তায় জমে আছে ছিপছিপে পানি। হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার মোড়ে যাই। সব রিকশা এখনো বের হয়নি। তাদেরও হয়তো উস্কানি দিচ্ছে অপাকস্থলীর জীবন। স্বল্প পরিচিত এক রিকশাওয়ালা এগিয়ে আসেন-
— ভাই, ওঠেন।
— কোথায় যাব জানেন?
— হ, জানি।

রিকশায় উঠে বসি। বৃষ্টির বেগ আবার বেড়েছে। তিনি প্লাস্টিকের পর্দাটা ভালো করে খুলে দেন, দু’পাশের হুডে গুজে দেন কিছু অংশ। রিকশা চালাতে শুরু করেন। রিকশা চলছে। পথে পথে অলস সকালের ঘুম ভাঙছে। পাকস্থলীর টানে কামলা ছুটেছে কামলাগিরির জেলে। রিকশাওয়ালা নীরবতা ভাঙেন,
— কুনুদিন এমুন আকাইল্যা বাদলা দেখছেন!
— এখন সব কালই আকাল। এই যে অপনি রিকশা চালাইতাছেন, আমি অফিসে যাইতাছি তার কারণও আকাল।
— কন কি ভাই! আকাল হইব ক্যান!
— অকাল না হইলে তো ঘরে বইসা গপসপ করতাম। পেঁয়াজ কাঁচামরিচ আর চাইল ভাজা সরষা ত্যালে মাখায়া কুচুরমুচুর কইরা চাবাইতাম। দুপুরে বেগুন ভাজা, ইলশা ভাজা, মিষ্টি কুমড়া দিয়া গোশতের ঝাল তরকারি মাখায়া খিচুরী খাইতাম। আকাল বইলাই এই বাদলার মধ্যে আপনে প্যাডেল মারেন আর আমি কলম মারতে যাইতাছি।

রিকশাওয়ালা হেসে ওঠেন। হাসতে হাসতে বলেন-
— আইজ মাসের ২১তারিক, বাড়ির ভাড়া দিতে দেরী হইতাছে। জ্বরের লেগা ৭দিন গাড়ি চালাই নাই। আইজ ভাড়া না দিলে বাড়িওয়ালা পিডাইবো কইছে হাহাহাহাহাহাহা…. আকাইল্যাই তো..

মাথার ভিতর ঘুরতে থাকে আজ ২১তারিখ… আজ ২১মে… আজ ২১মে… আজ ২১মে। মাত্র চারটা ২১মে, ছোটো ছোটো কত যে স্মৃতি, আহ ২১শে মে…।

৪.
তুমুল রোদের দিন ছিল সেদিন। বেইলি রোডের ফাস্টফুড শপে কলেজ ফাঁকি দিয়ে মুখোমুখি দুজন। ভিকারুননিসার আহ্লাদি স্বর,
— নটরডেম, আজ আমার জন্মদিন। খুব সুন্দর একটা উইশ করো, তা না হলে ঠিক ঠিক মরে যাবো।
— একটা উইশ না পেয়ে জন্মদিনের দিন ঠিক ঠিক মরে যাওয়া কাজের কথা না।
— এহহহ! অবশ্যই কাজের কথা। তোমার সুন্দর উইশ না পেলে ঠিক ঠিক মরে যাবো, তখন দেখো, হু।

ভিকারুননিসার মুখে অভিমানের মেঘ জমতে শুরু করে। বাইরে ঝাঁঝাল রোদ। নটরডেম কাঁপা হাতে ভিকারুননিসার কপালে নেমে আসা অবাধ্য এক গোছা চুল কানের পাশে সরিয়ে দেয়,
— শুভ জন্মদিন, প্রিয় ভিকারুননিসা। মানুষ হয়ে ওঠো প্রতিদিন।
ভিকারুননিসার কণ্ঠে তীব্র ক্ষোভ,
— আমি কি মানুষ নই! তোমার সাথে আজ আমার প্রথম জন্মদিন, আর তুমি এভাবে বলতে পারলে! নটরডেম, তুমি এভাবে বললে!
ভিকারুননিসার চোখ ছলছলিয়ে ওঠে, নটরডেমের বুকে কেনো যে ব্যাথা লাগে! ব্যাথা চেপে বলে,
— প্রিয় ভিকারুননিসা, উইশে ‘মানুষ হয়ে ওঠো’ থেকে গভীর কিছু আর খুঁজে পাই না যে। এর চেয়ে দামী উইশ আর কি আছে!
— এটা দামী উইশ!
— অবশ্যই অমূল্য উইশ। কেন অমূল্য তা কি শুনতে চাও?
— হ্যা, চাই। শোনার পরে যদি দামী মনে না হয় তবে কিন্তু ঠিকঠিক মরে যাবো, জেনে রাখো, নটর ডেম।

নটর ডেম বলতে শুরু করে-
— প্রতিজন মানুষ জন্মায় মানুষ হয়ে। তারপর একদিন মানুষ হতে না পেরে মরে যায়।
— যাহ! মানুষ তো মানুষ হয়েই মরে।
— না, ভিকারুননিসা। প্রতিজন মৃত মানুষই আসলে মানুষ হতে না পারা একজন মানুষ।
— কি যে বলো না, নটরডেম!
— জন্মানোর পর মানুষকে মানুষ করে তুলতে শুরু করে পরিবার। তাকে শুধু মানুষ হলেই চলবে না- তাকে হতে হবে সভ্য মানুষ, সফল মানুষ, শিক্ষিত মানুষ।
— তা তো হতে হবেই।
— ভিকারুননিসা, সেখানেই তো সমস্যা, মানুষের আর মানুষ হয়ে ওঠা হয় না।
— ধ্যাত! এ কথার অর্থ কি!

নটর ডেম প্রথমে কথা গুছিয়ে নেয়, তারপর ধীর লয়ে বলে চলে,
— জন্মানোর পরই বাবা-মা মানুষ করে তোলার অভিযানে নামেন। এই অভিযানে পরম উৎসাহে যোগ দেয় আত্মীয়স্বজন আর পাড়া প্রতিবেশী। স্কুল-কলেজের স্যাররাও নামেন মানুষ গড়ার কাজে। সবাই মিলে সে’ই মানুষ গড়ে তুলতে চান যে মানুষ তারা হতে চেয়েছিলেন কিন্তু হতে পারেন নাই। কবি সাহিত্যিক ডাক্তার মোক্তার সবাই মানুষকে মানুষ বানাতে চায়। নিজের নিজের ছায়ার মাপের মানুষ, নিজের নিজের এইম ইন লাইফের মানুষ, নিজের নিজের বৃত্তভাঙার মানুষ।
— একটু থামো, নটরডেম। দম নাও। কিছুটা বুঝতে পারছি।
— গুড। তারপর কি হয় বুঝতে পারছো!
— কি হয়!
— অন্যদের মাপে মানুষ হতে হতে একটা সময় মানুষ নিজের মুখোমুখি দাঁড়ায়। সে বুঝতে পারে যে মানুষটি সে হতে হয়েছিলো সে মানুষটি সে হতে পারে নাই। তার দিন কেটে গেছে অকারণ অর্থহীন এক মানুষ হবার মোহে। তার আর মানুষ হয়ে ওঠা হয় না, বেলা ফুরোয়, খেলা ফুরোয়, মানুষ হতে না পারার আক্ষেপ নিয়ে জীবনও ফুরোয়।

গভীর বিস্ময় নিয়ে নটরডেমের চোখে তাকায় ভিকারুননিসা, টেবিলের ওপরে রাখা হাতটা শক্ত করে ধরে জানতে চায়-
— আমি কেমন মানুষ হব- বলে দাও।
— ভিকারুননিসা, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পৌছানোর যাত্রাটাই হলো মানুষ হবার জার্নি। প্রতিদিন নিজের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন কোরো ‘কতটা মানুষ হবার পথে এগোলাম, কতটা পিছিয়ে পড়লাম।’ প্রতিদিন একটু একটু মানুষ হয়ে ওঠো, নিজের মতো মানুষ, যে মানুষটি তুমি হতে চাও অবিকল সে মানুষ।
— থ্যাংক ইউ নটর ডেম।

কিছুটা বিরতি দিয়ে ভিকারুননিসা আবেগঘন স্বরে বলে-
— যতই মানুষ হয়ে উঠি না কেন, তোমাকে না পেলে ঠিকঠিক মরে যাবো, হু।
— কথায় কথায় মরতে হবে না, মনে রেখ– জীবন অনেক বড়। এক একটা জীবন জীবন থেকেও বড়, দীর্ঘতর এবং দীর্ঘতম।
— এত্ত কিছু জানি না নটরডেম। মানুষ হবার জার্নিতে যেন কখনোই তোমাকে না হারাই।

হাসতে হাসতে নটর ডেম বলে-
— ভিকারুননিসা, এই একটা মাত্র জীবনে তুমি আমার বামপাশে থেক, হারিয়ে যেও না।

পৃথিবীতে আর কোন শব্দ নেই, দুজন মুখোমুখি বসে আছে, দুজনের দৃষ্টি মিনতি করে যায়- হারিয়ে যেও না… হারিয়ে যেও না… হারিয়ে যেও না…

৫.
বৃষ্টির আজ কি যে হলো! বৃষ্টি বাড়ছে তো বাড়ছেই। ভাবনা হয়- বৃষ্টির ছাটে কি ভিজে যাচ্ছে ঘুঘুদম্পতির খাঁচা! ভিজুক, আজ তাদের কষ্টের দিন। ঠিক আজকের দিনেই ডিমফুটে বের হওয়া তাদের প্রথম বাবুকে পিপড়ার দল কামড়ে কামড়ে খুন করেছিল, তার আর ঘুঘু হয়ে ওঠা হয় নাই। মানুষ হবার জার্নিতে আজ কতটা এগিয়েছে ভিকারুননিসা জানা নেই, সে থাকেনি বামপাশে।

রিকশা ছুটেছে তাই ছপছপ শব্দ হচ্ছে পথে, কামলা ছুটেছে রিকশার পিঠে চেপে। জানি, এ রিকশা মনসুখিয়ায় যাবে না, সে চিনে না মনসুখিয়ার পথ। হঠাৎ, বাতাসে কাঁঠালচাঁপার ঘ্রাণ ভেসে আসে, তাকে ফিসফিসিয়ে বলি, ‘প্রতিদিন মনসুখিয়ার দিকে ছুটে চলেছি আমি। অভ্রবকুল নিবে তো আমায়! আমার যে আর কোথায় যাওয়ার নেই!’

কোনো উত্তর পাই না, শুধু কাঁঠালচাঁপার ঘ্রাণ তীব্রতর হয়ে ওঠে, বাতাসে বিষাদ ছড়িয়ে একটা দোয়েল মাথার ভিতরে গেয়ে চলে-
‘চল মন মনসুখিয়ার কাছে
তার গভীরে জোছনা রঙা রৌদ্রনদী আছে…’

.
মনসুখিয়া। বর্তমানে বইটি অউট অব স্টক।

সেই সব বনজ দিন

“সেদিন অনেক রাত অব্দি বাঁশী বেজেছিল নবীনা’দিদের পুকুরঘাটে। আমি তো নির্বাক শ্রোতা বা দর্শক। ঝুমুরের চোখ দু’টো করমচার মতো লাল দেখেছি, বুঝেছি অনেক কিছুই। বলতে কি পেরেছি কিছু?”- বলতে বলতে বড়’মা কাঁদছিলেন। বড়মা’র ছোট ফুফু ছিলেন এই ঝুমুর, সমবয়সী। অমন রূপবতী মেয়ে বুঝি আর হয় না, বড়’মার ভাষ্য। একানব্বুই বছর বয়েসী অশীতিপর এই বৃদ্ধা আমার মায়ের নানু, আমার বড়’মা। তিনি বলছিলেন আর আমি দেখতে পাচ্ছিলাম সবকিছুই, দেখছিলাম বড়’মার চোখ দিয়ে—চলে যাচ্ছিলাম অনেক, অনেক যুগ আগে।

লাল ঢাকাই শাড়ী পরনে এগারো বছরের কিশোরী ছুটে যাচ্ছে কলাই ক্ষেতের ভেতর দিয়ে আমি দেখতে পাচ্ছি- কিশোরীর গলায় হাঁসুলী, পায়ে রূপার খাড়ু আর কোমর ছাড়ানো ঢেউ খেলানো চুল। ফর্সা, ঝকঝকে গায়ের রঙ। মেয়েটি দৌঁড়াচ্ছে আর কেউ পিছু ডাকছে, ওরে ঝুমুর, ঝুমুরি রে—দাঁড়া-

আমি সব দেখতে পাচ্ছি—-
মাত্র দু’দিন আগে ঝুমুরের বিয়ে হয়েছে। যদিও মেয়ে শ্বশুরবাড়ী যাবে আরো দু’বছর পর তবু এখনো বাড়িতে বিয়েবাড়ীর আমেজ। আর এই মেয়ে ছুটছে সইয়ের বাড়ী। সাথে আমার বড়’মা আলতা, ঝুমুরের সমবয়েসী ভাইঝি।
—-শোন আলতা আমি শ্বশুরবাড়ী গেলেও ফিরে আসবো, আর যাব না—বলছে ঝুমুর
—ধ্যাৎ তাই কি হয়? দেখো না ঝর্ণা খালা কত্তো কাঁদলো বিয়ের সময়। আর এখন বলে যাই রে, বাপের বাড়ীতে বেশীদিন থাকলেই আমার ছেলের শরীর খারাপ করে। তুমিও অমনই করবে—আলতাও হেসে উত্তর দেয়।
—বলেছে তোকে!
—বলেনি আবার? বলেই খুব হাসছে আলতা
—দেখবো তুই কি করিস?
—এমা আমি তো বিয়েই করবো না, বাবাকে বলেছি—আর বাবাও বলেছে সে-ই ভাল করিস না বিয়ে।

দূরে উড়ে যাওয়া বকের সারি দেখে দু’জনেই থমকে দাঁড়ায়। এমন অসময়ে বকগুলো ওড়ার কারন হঠাৎ বেজে ওঠা বাঁশীর সুর। দু’জনে কি এক টানে পায়ে পায়ে ঝোঁপটার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। দেবদূতের মতো দেখতে, একমাথা ঝাঁকড়া চুল উড়িয়ে যে ছেলেটি বসে বসে বাঁশী বাজাচ্ছে ওরা দু’জনেই চেনে তাকে। শ্যামল দাদা, নাবীনাদি’র ছোট ভাই।

—কি রে ঝুমরি তোর নাকি সেদিন বিয়ে হয়ে গেল? এখন তবে কেন এত বন বাদাড় ঘুরে মরছিস। যা, যা ঘরে যা—বললো শ্যামল দা।
—বিয়ে হলেই কি! ও কি এখনই চলে যাচ্ছে না-কি শ্বশুরঘরে?
—এখন যাবে না? বাহ ভালই—

শ্যামলের ঠোঁটের কোনে এক টুকরো বাঁকা হাসি আর ঝুমুরের চোখ ছলছল। সে কেবল পায়ের বুড়ো আঙ্গুলে মাটি খুঁড়ছে। ভঙ্গিটা কেমন অপরাধীর। একটা নিঃশ্বাস ফেলে শ্যামল’দা আবার বাঁশী বাজাতে লাগলো। পাশেই ঝালিঙ্গী নদীর শীর্ণ এক ধারা কুলকুল করে বয়ে যাচ্ছে। নদীর জলে তীরবর্তী কোন গাছের ছোট ছোট হলদে ফুল ঢেউয়ের তালে দুলতে দুলতে কোত্থেকে যে কোথায় চলে যাচ্ছে। আলতা কেবল দূরের সরিষা ক্ষেতের ভেতর দিয়ে এগিয়ে আসা পড়ন্ত বিকেলের দিকে চেয়ে থাকে। হঠাৎ লক্ষ্য করে ঝুমুর যেন কেমন মগ্ন হয়ে তাকিয়ে আছে শ্যামলদা’র দিকে। বাতাসে শীতের গন্ধ।

তারপরের ঘটনা সুখের না মর্মান্তিক কে জানে! যে আলতা দর্পিত ভঙ্গিতে বলেছিল, “এমা আমি তো বিয়েই করবো না, বাবাকে বলেছি আর বাবাও বলেছে সে-ই ভাল করিস না বিয়ে।“ সে-ই আলতারও বিয়ে হয়ে গেল হুট করেই। আর বাইরে যেতে পারে না আলতা বা ঝুমুর কেউই। তবু কোন কোন উদাস দুপুরে মা-খালারা ঘুমে থাকতে দুই জনে চষে আসে মাঠ-ঘাট। নবীনা’দিদের বাড়ী। শ্যামলদাদার বাঁশী এখনো তেমনি বাজে করুণ থেকে করুণ সুরে। মাঝে মাঝে কেবল ওরা চুপি চুপি পায়ে গিয়ে দাঁড়ায় শ্যামলদা’র সামনে। কি যে হয়েছে ঝুমরিটার ওকে দেখলেই কাঁদে। চোখের জলে ভেসে যায় ওর নাক চোখ মুখ। শ্যামলদা’র চোখটাও কি একটু ভেজে? কি জানি, এ হয়তো আলতার চোখের ভুল!

কথা ছিল দুই ফুফু ভাইঝি শ্বশুর ঘরে যাবে দুই বছর পর যখন ওরা তেরোয় পড়বে। সে-ই দিনও ঘনিয়ে এসেছে। সামনের অঘ্রানের দুই তারিখেই দুই সই পাড়ি জমাবে ভিন গাঁয়ে। বাড়ীতে হাসি-আনন্দ। মা চিড়ে কোটে, দাদী বানায় নাড়ু, শিকায় উঠছে ভাঁড়ের পর ভাঁড় দই। অন্য ফুফুরাও নাইয়র এসেছে। কলকাতা থেকে মেয়েদের জন্যে এসেছে শাড়ী, চুড়ি, ছেলেদের জন্যে জরিপাড়ের লুঙ্গি, কুর্তা। বাড়ীর পরিবেশ জমজমাট। কাজের লোকজনের হাঁক ডাকে বাসায় তিষ্ঠানো দায়। বড় বড় রুই,পাঙ্গাস কুটছে পাড়ার বৌ-ঝি’রা উঠানে বসে। ধামা ভর্তি খই, মুড়কি নিমেষে শেষ হচ্ছে। আর পানের বরজ তো খালি হবার যোগাড়। এমন এক উৎসবমুখর দিনে আলতা আর ঝুমুর কোন ফাঁকে বেরিয়ে পড়েছে কে জানে! আজ কার্তিকের শেষ দিন।

নদীর ঘাটে যে জংলা মাচাং সেও ছাড়িয়ে দু’জনে চলে গেছে নীরব থেকে নির্জনে। অবেলার কুয়াশায় ঢেকে আছে জায়গাটা। কেমন নিঃস্তব্ধ, শুনশান চারিদিক। পাখিদের ঘরে ফেরার কিচিরমিচির শুধু। এরই মধ্যে গলাগলি করে দু’জনের সে কি কান্না। কে শুনবে তাদের এই হাহাকার? কে আসবে মোছাতে চোখের জল? ঘোচাতে বিচ্ছেদ জ্বালা? আলতা বলছে,
—মনে থাকবে ঝুমরি, আমরা কিন্তু ও বাড়ী থেকে ফেরত এসেই বিষ খাব।
—কোত্থেকে যোগাড় হবে রে বিষ?
—সে আমি যোগাড় করে আনব, ভাবিস না।

ঝোঁপের ভেতর থেকে মচমচ আওয়াজে ওরা উঠে দাঁড়ালো। অবাক হয়ে দেখছে এই বিজন বনে আবার কে এলো! বাঘ নয়তো! মা বলেছে আলতাকে, ‘দেখিস যেন ওদিকে কক্ষনো যাবি না। ওখানে বাঘ বেরোয়।‘ তা ওরা তো এখানে আসছে সেই ছেলেবেলা থেকেই। বাঘ কেন বেড়ালও দেখেনি কখনো। তবে ওদের দেশে বাঘের উপদ্রব অনেক। এই তো সেদিনও বাপ-মা মরা এতিম ছেলে শহীদুল্লাহ কে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল বাঘে। ওর বড়ভাই আসাদুল্লাহ পাশেই মাঠের ঘাস কেটে আঁটি বাঁধছিল। কি সাহস ছেলেটার! এক্কেবারে ঘাসকাটার কাঁচি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাঘের উপর। আসাদুল্লাহ’র চীৎকার, চেঁচামেচিতে লোক জড়ো হয়েছিল বিস্তর। কিনতু ঐ একলা ছেলেই ভাইকে উদ্ধার করেছিল আর কেঁদে কেঁদে বলেছিল, ‘খোদা হামার মা-বাপ কাইড়্যে নিয়েছ তবু হাউস যায় না, ভাই টাকও নিবার চাও। তুমি এংকা ক্যা খোদা? গরীব দুঃকীর দুক্ক বোঝোনা!’ এসব অবিশ্যি আলতা শুনেছে বাড়ীর ঝি রাসুর মায়ের কাছে। তবে এখন এই সাঁঝলাগা বিকেলে ওর শরীরটাও বাঘের ভয়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে। ভয়ে ভয়ে চারপাশে তাকিয়ে দেখছে।
যাহ বাঘ কোথায়! কোত্থেকে শ্যামল দাদা এসে দাঁড়ালো ওদের পাশে।

ওরা কিছু বুঝে উঠবার আগেই হঠাৎ করে সে ঝুমুরের ডান হাতটা চেপে ধরে আকুল হয়ে বললো, —শ্বশুরঘরে যাসনা ঝুমুর। প্রথমে দু’জনেই হতচকিত হয়ে মৃদু একটা চীৎকার করে উঠেছিল, শ্যামল’দাকে দেখে আলতার যেন বুকে পানি ফিরে এল। তবে সামলে উঠেই সেও অবাক হয়ে দেখে শ্যামলদা’র হাতের মুঠোয় ঝুমুরের হাত। এতক্ষনে সম্বিৎ ফেরে ঝুমুরের। হালকা ভাবে হাতটা ছাড়িয়ে নিল আর ঘুরে দাঁড়িয়ে মাথায় ঘোমটাটা আরেকটু টেনে নামিয়ে নিয়ে দৃঢ় অথচ অস্ফুট স্বরে কেবল বললো—ছিঃ
তারপরে দু’জনেই ছুট। দু’জনেরই বুক ঢিবঢিব। পেছনে পড়ে গেল কলাই ক্ষেত, সর্ষে ক্ষেত আর শ্যামল দাদা।
ঘরে ফিরেই ঝুমুর বললো,—আলতা ও কথা যেন কাউকে বলিসনা ভাই।

—যাহ ও কি বলবার কথা! হ্যাঁ রে তুই ও কি ওকে—?
— না না কি যে বলিস!
—তা’ও ঠিক। আর ওরা হলো গিয়ে হিন্দু। এ কি সম্ভব?
এবার ঝুমুর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ম্লানকণ্ঠে কেমন আনমনে বলে, সে-ই তো।

এই রাত্তিরটাই শেষ। কালই আলতা চলে যাবে শ্বশুরবাড়ি গাইবান্ধা জেলা শহরে আর ঝুমুর পলাশবাড়ীর বাঁশকাটায়। জানীপুর গ্রামের দু’টি মেয়ে কি নিমেষে পর হয়ে যাবে স্বজনদের জন্যে! আর ওরা হাসি তামশায় মেতে উঠবে না। ভাইয়ের কাছে পাখি ধরে দিতে বায়না করবে না। মেয়ে দু’টো এটা মানতেই পারছে না। অথচ দেখো ভাই আর মায়েদের খুশীর অন্ত নেই। যেন ওদের জন্মের পর থেকেই চলছিল ওদেরকে পর করে দেবার এই দূরাভিসন্ধি। সত্যি কি নিষ্ঠুর এই জগত! কেমন করে একটা মেয়ের শেকড় উপড়ে টেনে নিয়ে ফেলে অন্য ঘরে! কেউ এতটুকু উহ করে না, কেউ দেয় না বাঁধা। আলতার বুকে অভিমানের বিশাল পাহাড়। সে ভাবে, আর কক্ষনো ফিরবে না এই বাড়ী, এই নিষ্ঠুর লোকগুলোর মাঝে। ওরা তো কেউ ওকে ভালই বাসে না। থেকে থেকেই ওদের বুক ফেটে একটা করে দীর্ঘশ্বাস বাতাসে ভেসে ভেসে উড়ে যায়। কেউ তা শোনে না। শুধু বাতাস হয়ে রয় সাক্ষী।

আজ সারাদিন ধরে দুই শ্বশুরবাড়ীর লোকজন এসেছে গরুগাড়ী বোঝাই করে। এখন অনেক রাত। তা’সত্ত্বেও বাসন কোসনের ঝনঝন আর খাওয়া দাওয়ার হুল্লোড় লেগেই আছে। শুধু কোনার এক ঘরে কাঠের মতো শুয়ে আছে আলতা আর ঝুমুর। এত হৈ চৈ ওদের কানে যাচ্ছে না। বাইরে করুণ সুরে বাজছে বাঁশী। থেকে থেকেই ফুঁপিয়ে উঠছে ঝুমুর। ঝুমুরের চোখ করমচার মতো লাল। আলতার বুক ভেঙ্গে যাচ্ছে শ্বশুরবাড়ী যাওয়ার কষ্টের চেয়েও অন্য এক বেদনায়।

সেই অন্ধকার থাকতেই বাড়ীর মেয়েরা টেনে তুলেছে ঝুমুর আর আলতাকে। আজ দু’জনে যাবে দুই পথে। এ নিয়ে অবশ্য আপত্তি তুলেছিল মুরুব্বিরা। একই দিনে বাড়ীর দুই মেয়ে তা’ও আবার ফুফু ভাইঝি’র একত্রিত বিদায়! এ তো শুভ লক্ষণ নয়। আলতার দাদাজান মানে ঝুমুরের বাপজান এসব মানেন না বলে সব আপত্তি উড়ে গেছে আগেই। ওই অন্ধকারেই দু’জন কে গোসল করানো হলো সন্দা-মেথি আর হলুদ বাটা মেখে। সে কি শীত! কাঁপছে দু’জন ঠকঠক করে। বেলা উঠবার আগেই সবাইকে খাইয়ে দাইয়ে বিদায় দিতে হবে। নইলে দূর পথে ওদের ফিরতে সমস্যা হবে। বেলা বেলা বৌ নিয়ে ঘরে না ফিরতে পারলে শ্বশুরবাড়ীর ওরাই বা নিজেদের লোকজনকে কি করে দেখাবে কেমন বৌ এনেছে! তাই এত দ্রুত সব আয়োজন, তাড়াতাড়ি যাত্রার তোড়জোর। ভেজা চুলেই তেল দিয়ে টেনে বাঁধা হয়েছে বিড়া খোঁপা। এমন শক্ত করে বাঁধা যে দু’জনের কপালের পাশের শিরায় চিনচিন করছে ব্যাথা। অবিশ্যি এ বোধটাও এখন ওদের কাছে নস্যি। কখন মা, দাদী, খালা, ফুফুদের সাথে কান্নার পাট চুকিয়ে ওরা গরুর গাড়িতে গিয়ে বসেছে ওদেরই মনে নেই। দু’জনেই ছইয়ের ভেতর থেকে যতটুকু দেখা যায় দেখলো, দুই গাড়ী চলে যাচ্ছে উঁচু নীচু রাস্তা ভেঙ্গে দুই দিকে।

দশদিন পরেই অঘ্রানের তের তারিখে আবার একই জায়গায় পরপর এসে দাঁড়ালো দু’জনের গরুর গাড়ী। সেদিন গিয়েছিল ছইয়ের ভেতর একা বসে। আজ দু’জনেই ফিরেছে পাশে বর নিয়ে। আজ বাড়ীতে আনন্দের ঢেউ তেমনি, সেদিন যেমন ছিল। তবে আজ কিনতু ঝুমুর বা আলতা কাঁদছে না। দু’জনের চোখে-মুখেই চাপা খুশী, লাজুক মুখে ঘুরছে। বারেবারে চাপা হাসিতে মুখ চেপে দেখছে দু’জন দু’জনকে। শুধু মন খুলে কথা বলতে পারছে না নানা আনুষ্ঠানিকতার ব্যাস্ততায়। তা হোক সকাল তো পরেই আছে। কত্তো গল্প জমে আছে দু’জনার অন্তরে!

সকালে কুয়োতলায় দাঁড়িয়ে ঝুমুর। মুখোমুখি আলতা—
—কি রে এনেছিস বিষ?
—কোত্থেকে আনব?
—ও মা তুইই না বলেছিলি যোগাড় করবি!
—না রে এখন আর পারবো না। মানুষটা খুব ভাল।
—কোন মানুষ ভাল রে?
—যাহ জানিনা
হিহিহি করে হেসে ওঠে ঝুমুর। বলে
—আমারটাও জানিস। আমি বাবা এই জীবনে আর মরতে চাই না।
—আমিও
—দ্যাখ আলতা এই শাড়িটা সে আমায় দিয়েছে লুকিয়ে
—বাপরে! এরই মধ্যে ঘুষ দেয়াও সারা? আর কি কি দিয়েছে শুনি?
—সর পাজী কোথাকার!

এবার আলতাও হেসে উঠলো খুব জোরে। কোথায় যেন বাঁশী বেজে উঠলো, কি করুণ সেই সুর! সকালের কাঁচাসোনা রোদ ধুয়ে দিচ্ছে ওদের শরীর। তবু বাঁশীর সুর শুনে দু’জনেই একটু কেঁপে উঠলো যেন।

হঠাৎ একটা হলদে ঝিলিক। রোদের এত তেজ? এমন ঝিলিক? মূহুর্তের জন্যে আলতা টের পায় শরীরে একটা লোমশ ছোঁয়া, গরম। ওরই ভারে আলতা পা ভেঙ্গে পড়ে গেল মাটিতে। কুয়োর পাড়ে ধুপধাপ ক’য়েকটা শব্দ। এত দ্রুত, এত দ্রুত যে আলতা কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি একবার শুধু চোখ বড় বড় করে দেখলো ওর সামনে ঝুমুর নেই। আর ওর বাসার মানুষজনসহ গ্রামের অনেক লোকের হৈ চৈ চীৎকার—
—বাঘ, বাঘ, ওরে ঝুমুরোক বাঘে নিয়া গেল—ওরেএএএ—–কেটা কুন্ঠে আছ, আউগাও বাহে—বাহে—-

ঝুমুরের আধখাওয়া শরীরটা পাওয়া গিয়েছিল সেই জংলা মাচার পাশের ঐ জঙ্গলে। শ্যামল’দাদাই দেখেছিল প্রথম।

অনেক আগেই গল্প শেষ, শুয়ে পড়েছি আমরা। আমি আর বড়’মা। বড়’মা পাশ ফিরে শুয়ে কাঁদছেন। ফুলে উঠছে শরীর। টের পাই সবই। কিছুই বলি না, কাঁদুক। সারা জীবন যে দুঃখ তিনি বুকে বয়ে বেড়িয়েছেন এটুকু শোক তো এই বৃদ্ধা কেঁদে ঝরাতেই পারেন। আচ্ছা শোক কি কাঁদলে ঝরে যায়? নাকি আটকে থাকে বুকে? খুব ভাবছি, শোক আসলে কি? শোক কি এমনই? একহাজার বছর পরেও একই জায়গায় দাঁড়িয়েই থাকে!

(একটি সত্যি ঘটনা অবলম্বনে)

ছোটগল্প “এ শহর প্রান্ত”

0-18

তক্তাপোষের ওপর এক হাঁটু মুড়ে অন্য পা টা সামনে ছড়িয়ে বসেছিল রনি। আনমনে পায়ের বুড়ো আঙুলের নখের কোনের চামড়া খুঁটে খুঁটে ছাড়ানোর চেষ্টা করে চলেছিল, যদিও অত মোটা চামড়া একটু খোঁচা হয়ে উঠে আর ছাড়ছিল না। বেশি জোরে টানলে লাগছিল, আর তখনই চমকে হাত সরিয়ে আনছিল ও। কিন্তু আবার একটু পরেই হাতটা সেখানে চলে যাচ্ছিল অজান্তেই।

সামনে উঁচু একটা পড়ার টেবিলের ওপর রাখা টিভি তে ইস্টবেঙ্গলের খেলা হচ্ছে টালিগঞ্জ অগ্রগামীর সঙ্গে। বেশ বেগ দিচ্ছে দলটা। রনি আবার ইস্টবেঙ্গলের কট্টর সাপোর্টার। সুযোগ পেলেই ক্লাবহাউসের টেন্টে ঢুকে পড়ে। ভাবও জমিয়ে নিয়েছে কয়েকজনের সঙ্গে। এখন সবই তেলের যুগ। খিক খিক করে আপনমনেই হেসে উঠল ও।

পুরনো সাবেকী ঢঙের দোতলা বাড়ী। তৈরী করেছিল রনির ঠাকুরদা। জায়গায় জায়গায় পলেস্তারা চটে গিয়ে ইট দাঁত বার করেছে। কোথাও নোনার স্পষ্ট ছোপ। ছাদের বেশিরভাগ অংশই শ্যাওলার মোটা আস্তরণের দখলে। কতদিন যে রঙ হয়নি ঠিক মনেও করতে পারে না কেউ। কালিঘাটের এই অঞ্চলটা এখনো পড়ে আছে সেই মান্ধাতার আমলের ভাবনা চিন্তায়। ওপরে ওপরে বড় রাস্তার ধারে অনেক চকচকে দোকান, শোরুম, শপিংমল, রেস্টুরেন্ট হলে কি হবে, গলির মধ্যে কিম্বা মন্দিরের সামনের জগতের মানুষগুলো এখনো সাবেক ঘি এর গন্ধ শুঁকেই দিন কাটায়। এখানে মার্জিত সুরে কেউ কারো সঙ্গে কথা বলেনা। চিৎকার করে হামেশাই একে অপরের সঙ্গে ঝগড়া করা আর সেই কুৎসিত কোলাহল উঁকিঝুকি মেরে উপভোগ করা এখানকার স্বাভাবিক দস্তুর। এখানে সম্প্রতি যারা বাড়ী করেছে, তাদের এই পুরনো বাসিন্দারা বহিরাগত উপদ্রব মনে করে তাচ্ছিল্য করে।
রনি নিজেও ওই ভাবধারার শরিক। সেখানে সে বড় বেশি আত্মকেন্দ্রিক। নিজেরটুকু গুছিয়ে নিতে পারলেই হল। এত বড় বাড়ীর দেখভাল করার মত কেউই আর নেই। শরিকদের মধ্যে যাদের সামর্থ্য আছে, তারা অন্য জায়গায় ফ্ল্যাট কিনে চলে গেছে। পড়ে রয়েছে রনি আর তার জ্যাঠতুতো ভাই অনীক। সে এখনো বিয়ে থা করেনি। আর করবেও না মনে হয়। প্রায় পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই অনীক সল্টলেকে একটা সরকারী অফিসের কেরানি। বাড়ী বা সংসার সম্পর্কে তার কোনো আগ্রহই নেই। সন্ধের অনেকপরে বাড়ী ফিরে সোজা একখানা বোতল খুলে বসে। সাথে অফিসফেরতা আনা টুকটাক খাবার আর একটা বই কিম্বা নতুন কেনা ট্যাব। এ বাড়ীর ঐতিহ্য যদিও সেরকম কিছুই নেই কিন্তু সেসম্পর্কে তৈরী করা কিছুটা টনটনে অহংকার তার মধ্যেও আছে।

গোওওল… যাহ! টালিগঞ্জ গোল দিয়ে দিল ইস্টবেঙ্গলকে। নড়েচড়ে বসল রনি। বিড়বিড় করে গাল দিল কাউকে। এই পুচকে দলগুলোর কাছে গোল খাওয়ার আগে এরা আত্মহত্যা করে না কেন? চোখদুটো ঈগলের মত তীক্ষ্ণ করে তক্তাপোষ থেকে ঝুঁকে পড়ে দেখতে থাকল সে। পারলে হয়তো টিভির মধ্যে ঢুকেই পড়ত।

উফ! অনেক দেরী হয়ে গেল। আরো জোরে পা চালাল সম্পাতি। এই কলকাতার ফুটপাতে তাড়াতাড়ি হাঁটাও যায়না। এখানে গর্ত, সেখানে নোংরা আর হকারের দৌরাত্য … ধুস শালা…এখানে কেউ থাকে! বিড়বিড় করল আপনমনেই। টালিগঞ্জ ট্রামডিপোর মোড়ে এসে রাস্তা পেরোনোর জন্যে দাঁড়িয়ে গেল। হুশ হুশ করে গাড়িগুলো প্রায় গায়ের ওপর দিয়েই চলে যাচ্ছে। এই হতভাগা দেশে কোনো সিস্টেম তৈরী হলোনা এখনো। আর হবেও না কোনোদিন। এদিক ওদিক তাকিয়ে কোথাও কোনো ট্র্যাফিক পুলিশের চিহ্নও দেখতে পেলনা সে।

থেমেছে। চটপট পা চালিয়ে রাস্তা পেরিয়ে এপাড়ে মেট্রোর সাইডে এল। ঘড়িটা দেখল একবার, বিকেল চারটে বাজে প্রায়। সাড়ে পাঁচটার ট্রেন ধরা যাবে কি? সামনে একটা বাস থেকে কন্ডাকটর চিৎকার করে যাচ্ছে- হাওড়া…হাওড়া…হাওড়া…! আর না ভেবে পাদানিতে পা রাখল ও, আর আশ্চর্য উঠেই সিট পেয়ে গেল। কলকাতার পুরনো আমলের এই বাসের সিটগুলোও একেবারেই পছন্দ নয় তার। সেই মান্ধাতার আমলের দুদিকে লম্বা লাইন করে বসার সিট। অন্যদেশের কথা ছেড়েই দেওয়া যাক, এই পশ্চিমবঙ্গের অন্য শহরে কিম্বা গ্রামাঞ্চলেও এই বাসগুলো আর দেখা যায়না। বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে উঠলো সম্পাতির।

আসলে এখন যা দেখছে তাতেই বিরক্ত লাগছে। দুপুরে ভাত খেয়ে ঘুমনো উচিৎই হয়নি তার। মোবাইলে একটা অ্যালার্ম দিয়ে রাখতে হত। সিগন্যালে আটকেছে বাসটা। অধৈর্য হয়ে জানলা দিয়ে বাইরে দেখল সে। কাতারে কাতারে গাড়ি দাঁড়িয়ে সামনে।

কাল দেশপ্রিয় পার্কে অনেকক্ষণ বসেছিল শাখার সঙ্গে। সেই একই টুকটাক কথা হতে হতেই শাখা অনর্গল হয়ে গেল। নিজের কথা, ছেলেবেলার কথা, ওর বাবার কথা, মায়ের কথা, জেঠুমনি, পাশের বাড়ির তাতাই এর কথা গড়গড় করে বলে যাচ্ছিল। ঘটিগরমের ঠোঙা থেকে একটু একটু খেতে খেতে মন দিয়ে শুনছিল সম্পাতি। খুব মন দিয়ে কিছু শুনলেই তার চোখের সামনে ছবিগুলো পরিস্কার ফুটে ওঠে। সিনেমার মত সব ঘটে যাওয়া অতীত সরে সরে যায়, পিছলে যায়। একাত্ম হয়ে যায় তখন সে।

শাখার হাতের তালুটা বেশ শক্ত। ওর শ্বশুরবাড়ির প্রায় সব কাজই তাকে করতে হয়। আসলে ও বাড়িতে শাখার জায়গা কাজের লোকের প্যারালাল। ওর স্বামীটা একেবারেই অপদার্থ। মোটামুটি সবকিছুই শোনা হয়ে গেছে সম্পাতির।

হাত তুলে কুলফি ডাকলো ও। দুটো দিতে বলে একটা সিগারেট ধরালো। ঘাসের সামান্য রেখার ওপরে বসে আছে ওরা দুজন। পার্কের বাইরের রাস্তার একটা অংশ দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। এদিক ওদিক গাড়ি চলে যাচ্ছে। আচ্ছা এখানে পাখি আছে?

এবারে মাত্র দুদিনের জন্যে এসেছিল সে। চাকরীসূত্রে সম্পাতি থাকে বীরভূমের রামপুরহাটে। লালমাটির দেশে প্রচুর খোলামেলা জায়গা, পাখপাখালি তাকে অভিভূত করে দেয়। আজন্ম এই কলকাতার মানুষ সে। পড়া কমপ্লিট করে প্রথম চাকরী পেয়ে বাইরে গেছিল, তাও প্রায় বছর দশেক হয়ে গেল। কিন্তু সেও কাঠখোট্টা গুজরাতের এক শহর, মেহসানা। বাংলার প্রাম যে একেবারেই দেখেনি তা নয়। দু একবার বন্ধুদের সঙ্গে আশেপাশের গ্রামের কোনো ট্যুরিস্টস্পটে গেছে পিকনিক করতে কিম্বা বেড়াতে।কিন্তু আপাদমস্তক গ্রাম কে এভাবে উপভোগ করা, শরীরে মনে মেখে নেওয়া আগে কখনো হয়নি।

রামপুরহাটে সে যেতেও চায়নি। কিন্তু নতুন এই চাকরীটা বেশ বড় কোম্পানীতে, আর অফারটাও বেশ শাঁসালো। কলকাতা থেকে প্রায় আড়াইশো কিলোমিটার দূরে শুনে কি হয় দেখি একবার গোছের মনোভাব নিয়েই গেছিল সে। আর গিয়েই জাস্ট প্রেমে পড়ে গেছে জায়গাটার।

শাখার সঙ্গে ওর আলাপ ফেসবুকে। সন্ধের পরে ওখানে বিশেষ কিছুই করার থাকেনা। ওখানে খুব একটা বন্ধুও নেই তার। কাজের সূত্রে যা কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ। তার বেশি কখনোই এগোয়নি কোনো সম্পর্ক। তাই সময় কাটাতে সন্ধের পরে ফেসবুক খুলতে শুরু করেছিল সে। প্রথম প্রথম শুধু পড়ত, দেখত। তারপর গুড ইভনিং, গুড নাইট। আর এভাবেই কিভাবে কখন যেন আলাপ হয়ে গেল শাখার সঙ্গে এখন আর ঠিক মনেও করতে পারবে না সে। সেখানেই ঘন্টার পর ঘন্টা চ্যাটে কেটে যেত। কখনো মেয়েদের সাথে সেভাবে না মেশার জন্যে ওদের মন, চাহিদা, কল্পনা সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না সম্পাতির। কথায় কথায় জল গড়িয়ে সম্পর্ক কখন যেন গাঢ় হয়ে গেল। শাখার হাতের আঙুল নিয়ে নাড়াচাড়া করে সম্পাতি।

পঁয়তাল্লিশ ছুঁল সে এই লাস্ট জুনে। বাড়িতে দাদা আর বউদি। দাদার মেয়েরা বিয়ে হয়ে বিদেশে। এখানে আর ফিরে আসার চান্স খুবই কম। দাদাও রিটায়ারমেন্টের পরে ক্লাব নিয়েই মেতে থাকে। আগে আত্মীয়রা বিয়ের কথা বলত ওকে। ঠাট্টা তামাশাও করত। এখন ওরাও ফেডআপ হয়ে ছেড়ে দিয়েছে ওসব বলা। ধরেই নিয়েছে এরকমই অবিবাহিত হয়েই থেকে যাবে সম্পাতি। আসলে এতদিন মেয়েদের সম্পর্কে খুব একটা উৎসাহ ছিল না ওর। মেয়ে মানেই বাধা এই ধারণাটা ওর বদ্ধমূল ছিল। আস্তে আস্তে শাখার সঙ্গে আলাপের পরে সব কেমন যেন পাল্টে গেল। সাদাকালো স্কেচের ওপরে রঙের আলতো টান লাগতে শুরু হল।

শাখার জীবনটা ওর খুব অদ্ভুত মনে হয়। ওর বাপের বাড়িও কেমন যেন উদাসীন। দুই বাড়িই প্রাচীন মানসিকতার কূপমন্ডুকতায় পড়ে আছে এখনো এই একুশ শতকেও। কলকাতা শহরটাকে সম্পাতির মাঝেমাঝে গ্রাম মনে হয়। যতই ঝাঁ চকচকে হোক ওপরটা, ভেতরে ভেতরে মানসিকতা পড়ে আছে সেই মধ্যযুগেই। শাখার বাপের বাড়িতে যেমন মনে করে মেয়ের বিয়ে দিয়ে আপদ নেমে যায় ঘাড় থেকে। তেমনি শ্বশুরবাড়িও মনে করে বাড়ির বউএর কদর কাজের লোকের বেশি নয়। আশ্চর্য, এদিকে লোকটা কিন্তু শাখার রোজগারেই বসে বসে খায়।

-“উঠবে না? অনেক রাত্রি হলো তো! না ফিরলে আবার চিৎকার …”
শাখার কথায় হুঁশ ফিরলো সম্পাতির।
-“হ্যাঁ চল”।
টেনিস কোরটের পাশ দিয়ে যেতে যেতে শাখার ডানহাতের তালুটা বাঁ হাত দিয়ে মুঠো করে ধরলো সে। শাখাও আঁকড়ে ধরলো ওর হাত। কালিঘাটের গলিতে পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে শাখাকে।
নভেম্বরের মাঝামাঝি এখন, অথচ হিমের কোনো রেশ নেই এই মহানগরে।

একটা মানুষের আইডেনটিটি কি? একটা ভোটার আইডি? একটা আধার কার্ড কিম্বা প্যান কার্ড, পাসপোর্ট? কয়েকটা কাগজের টুকরো বা কয়েকজন সাক্ষী কি একজন মানুষকে মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে? আইডির ফটো থেকে চেনা যায় মানুষটা কেমন?

সে বা তার বাবা, মা কেউই তো রনি কে চিনতে পারেনি কখনো। বিয়ের আগে প্রায় বছর তিনেক একটানা ওদের সিথির বাড়িতে যেত রনি। ভুরিভুরি মিথ্যে বলতো সেসময়। সে নাকি বিশাল আর্টিস্ট। প্রেসিডেন্সির ছাত্র, প্যারিসের ডিপ্লোমা আছে। বড় বড় এক্সিবিশন করে সে, যেগুলো উদ্বোধন করেন বিশাল মাপের বিশিষ্ট মানুষেরা। অবাক হয়ে সেসব শুনত ওদের বাড়ির সবাই। ওর বোন তো রীতিমত ফ্যান ছিল রনির। তারপর যেদিন রনি বিয়ের প্রস্তাব দিল ওদের বাড়ির সবাই যেন হাতে চাঁদ পেল। ও নিজেও বিভোর হয়ে গেছিল এক বিশাল আর্টিস্ট কে নিজের করে পাবে ভেবে। আগুপিছু কোনো খবর না নিয়েই এক অশুভক্ষণে বিয়েটা হয়ে গেল তার।

হ্যাঁ, তার বিয়েই বলবে সে। কারন রনি কোনোদিনই নিজেকে বিবাহিত ভাবেনি। বিয়ের কিছুদিন পরেই এটা বুঝতে পেরেছিল শাখা। আসলে রনির দরকার ছিল ওর মা কে দেখাশোনা করার জন্যে একটা বিনে মাইনের আয়া আর রান্নার, বাসন মাজার কাজের লোক। বিনেমাইনের, কারন রনির কোনো রোজগার ছিলনা। সব মিথ্যে কথা বলেছিল। সে আদৌ শিল্পী নয়, বলতে গেলে কিছুই নয়। পড়াশোনাও মাধ্যমিকের গন্ডীর এদিকে। আর রীতিমত দুশ্চরিত্র। প্রথম যেদিন একতাড়া চিঠি ঘর পরিস্কার করতে গিয়ে হাতে পেল, সেদিন ছুটে গিয়ে রনিকে জবাবদিহি করেছিল স্ত্রীর অধিকারবোধ নিয়েই। কিন্তু রনি চিঠিগুলো হাত থেকে কেড়ে নিয়ে যখন সপাটে গালে চড় মারলো, যেন বাজ পড়েছিল ওর মাথার কোষের মধ্যেই। রনির বাকী চিৎকার আর ওর মাথায় ঢোকেনি। পরে যতবারই ফোনে মা বাবাকে এসব কথা বলেছে, তাঁরা গম্ভীর হয়ে অ্যাডজাস্ট করতে বলেছেন ওকে।

কতভাবে অ্যাডজাস্ট করতে পারে একটা মেয়ে? রাত্রির এই নির্জন সময়ে একা ছাদে হাঁটতে হাঁটতে ভাবল শাখা। এই ছাদ আর এই রাত্রি ওর বন্ধু, ওর আশ্রয়। যখনই কোনো মানসিক বিচ্যুতি ঘটে ওর, পালিয়ে আসে এই ছাদে। এখনো পর্যন্ত কোনো ইস্যু হয়নি ওর। রনি ওকে যেমন আজ পর্যন্ত হাতে তুলে কোনো উপহার দেয়নি, তেমনি দিতে পারেনি স্বামী-স্ত্রীর সেরা উপহার। আসলে বহুগামিতায় নানারকম রোগের শিকার হয়ে পড়েছে সে। যে কয়েকবার সে রনির কামনার শিকার হয়েছে, লক্ষ্য করেছে তার আগে রনিকে ওষুধ খেতে হয়েছে। তবুও কখনোই শেষরক্ষা করতে পারেনি সে। নিজের কামনাটুকু চরিতার্থ কোনোরকমে করেই ওপাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়েছে নিজের তক্তাপোষের ওপরে। ওপরে সেই বিছানায় শোবার অধিকার ছিলনা শাখার। এখন অবশ্য সেই ঘর ছেড়ে দোতলায় একচিলতে চিলেকুঠুরিই তার জায়গা। ছোট্ট, তাহলেও অন্তত একা নিজের মুখোমুখি হতে পারে এখানে সে। আর খুব বিচলিত হলে, কিম্বা নির্ঘুম এইসব রাতে চলে আসে ছাদে। তাকিয়ে থাকে আকাশের তারাদের দিকে। কথা বলে ওদের সঙ্গে, নিজের সঙ্গেও। আজও গায়ে হাত তুলেছিল জানোয়ারটা। আঁকছিল শাখা। ছোট থেকেই আঁকার শখ তার। কিন্তু এখানে এসে সব জলাঞ্জলি দিতে হয়েছে। রনি তো কিছু রোজগার করেনা। অথচ তার চাহিদা আকাশ ছোঁয়া। প্রথম প্রথম বাবার কাছে হাত পাততে হত। কিন্তু তারপর বাবার বিমুখতা আঁচ করে এখন নিজেই টিউশন শুরু করেছে। পড়ানোর আর আঁকার। মোটামুটি চলে যায় এতেই। কিন্তু যা পায় তার বেশিরভাগটাই রনি কেড়েকুড়ে নিয়ে চলে যায়। কোনোরকমে কিছু বাঁচিয়ে সংসার চালাতে হয় তাকে। অথচ সেই আঁকাটাই সহ্য করতে পারেনা জন্তুটা। হয়তো তার নিজের বলা মিথ্যেগুলো মনে পড়ে যায়। আজ যখন একমনে আঁকছিল, কখন যে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল রনি, বুঝতে পারেনি। সাধারণত ওকে লুকিয়েই ছবি আঁকে সে। হঠাৎ কাগজটা ছিনিয়ে নিয়ে কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ফেলে হাতে জোরে একটা ঘুষি মেরে বসলো রনি। যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠেছিল সে। এখনো হাতের কব্জির ওপরটা ফুলে আছে। দুচোখ ভরে জল এল শাখার। ওপরে তাকিয়ে বলল, আর কত?

নিজের শৈশব, যৌবন সব যখন প্রৌঢ়ত্বের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছিল ঠিক সেই সময়েই সম্পাতির সঙ্গে ওর পরিচয়। আশ্চর্য ক্ষমতা মানুষটার, ওর সঙ্গে কথা বললে সব ভুলে যায় সে। তার নিত্যকার ক্লেদ, গ্লানি, ক্ষোভ কিছুই লুকায়নি সে সম্পাতির কাছে। প্রায় একবছরে আস্তে আস্তে কখন যেন সে তার আশ্রয় হয়ে উঠেছে। রোজ ফোনে কথা হয় দুজনের। কিন্তু একটাই মুস্কিল বড় অবুঝ আর অভিমানী সম্পাতি। ওকে বোঝাতে হয় সবকিছু। আর এই বোঝানোতে এই এতদিন পরে তৃপ্তি পায় শাখা। এতদিনে সে পূর্ণ নারী হয়ে উঠছে।

ওয়ালেটটা খুলে দেখল রনি।মাত্র পঞ্চাশ টাকা পড়ে আছে। মাগীটা এখন কিছুতেই হাত উপুড় করতে চাইছে না। কি ব্যাপার কিছুই আঁচ করতে পারছে না সে। কোনো চক্কর চালাচ্ছে নাকি? কয়েকবার বন্ধ দরজায় আড়ি পেতে মনে হয়েছে কারো সাথে কথা বলছে ফোনে। এইসব বুদ্ধি নিশ্চয় সেই নাগরই দিচ্ছে। রাগে গা কিসকিস করে উঠলো রনির।

শালীকে বিয়ে করে আনার পরে বেশ বাধ্য ছিল। বাপরে! অনেক ভুজুং ভাজাং দিতে হয়েছে ওর বাপ মা দুটোকে। হেব্বি মালকড়ির টোপ দিয়ে তবে কাজ হাসিল হয়েছিল। মাগীটাকে প্রথম দেখেছিল ওদের পাড়ায় একটা ছবির একজিবিশনে। ওখানেই মাথায় বুদ্ধিটা আসে। তারপর আর্টিস্ট সাজতে ওর বেশিক্ষণ লাগেনি। আর টুপি পরানো ওর কাছে জলভাত। কিন্তু সেই বাধ্য মেয়েটা কি করে যে গত একবছরে পাল্টে যেতে শুরু করল, তার থই খুঁজে পায়না সে। যে মালটা এইসব বুদ্ধি দিচ্ছে হাতের কাছে পেলে সেটাকেও ঠ্যাঙাত সে। নিজের পিপের মত পেটটা সামনে বিছিয়ে ভাবতে বসলো রনি। কিভাবে এখন কিছু হাতানো যায়। সন্ধেয় মনিকার সঙ্গে মোলাকাতের টাইম দেওয়া আছে। খালি হাতে তো যাওয়া যায়না। অলরেডি যা গয়না ছিল চুরি করে ঝেড়ে দিয়েছে সে। আলমারীতে দামী শাড়ীগুলোরও একই অবস্থা। এখন…!

এখন চারদিকেই খারাপ সময় চলছে তার। ক্লাবে ওর ব্যাকিং সতুদাটা পট করে অ্যারেস্ট হয়ে গেল একটা কুকর্মতে ফেঁসে গিয়ে। মনিকাকে ইমপ্রেস করার জন্যে যে পঞ্চাশ কপি বই নিজের নামে ছাপিয়েছিল এর তার বই থেকে ঝেড়ে, সেই প্রেসের মালিক রন্তু আজ রীতিমত শাসিয়ে গেছে টাকা পেমেন্টের জন্যে। দুপুরে টাকা চাইতে গিয়ে দেখে ছোটোলোকের মেয়েটা আবার ছবি আঁকতে বসেছে। দেখেই ধাঁ করে মাথা গরম হয়ে গেছিল ওর। কতবার বলেছে, বারন করেছে সে, তবুও আবার! এই ছবি আঁকলেই মনে হয় মেয়েটা তাকে বিদ্রূপ করছে। ছবিটা কেড়ে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলেছিল আর মেরে বসেছিল এক ঘুষি।

আফশোষে হাত কামড়াল রনি। ইস। তখন মাথা গরম না করে কোনোরকমে কাজ হাসিল করে নিলে এখন আর এই চিন্তায় থাকতে হত না তাকে। এতটা বোকামি তো কখনো করেনা সে। এখন কি করা যায়? পাড়ায় সবাই ওকে চেনে। সবাই মোটামুটি জেনে গেছে ওর কীর্তিকলাপ। এখন আর কেউই ধার দিতে চায় না ওকে। নানান অজুহাতে এড়িয়ে যায়। সতুদা থাকলে এইসময় কিছু পাওয়া যেত। কিন্তু…
ডিওর ক্যান থেকে স্প্রে করল অকারণ। তারপর মেসেজ করল মনিকাকে, “শরীরটা হঠাৎ খুব খারাপ লাগছে। আজ যেতে পারব না। প্লিজ কিছু মনে কোরোনা সোনা”।

মাথা গরম হয়ে আছে। ট্রেনে আসতে আসতেই সব শুনেছে সে। আরো মাথা গরম হয়েছে দুপুরে মেরেছে জানোয়ারটা, হাত ফুলে আছে এখনো, কিন্তু শাখা ডাক্তার দেখায়নি শুনে। ফোনেই প্রচন্ড রাগারাগি করেছে সে। শাখা কথা দিয়েছে কাল সকালেই ডাক্তার দেখাবে।

আরেকটা কথা বলেছে সম্পাতি। একটা এফআইআর করতে থানাতে। প্রথমে কিছুতেই রাজী হচ্ছিল না শাখা। কিন্তু এভাবে মার খাওয়া বন্ধ করার যে আর অন্য কোনো রাস্তাই নেই সেটা বুঝিয়ে বলার পরে নিমরাজি হয়েছে, কিন্তু ড্রাফট টা এখন করে দিতে হবে সম্পাতিকে এই শর্তে।

মেসের ঠাকুর চন্দন খাবার দিয়ে গেল। প্লেট টা খুলে দেখল ও, রুটি, বেগুনের তরকারি আর একটা ওমলেট। খাওয়ার ব্যাপারে কোনো খুঁতখুঁতে ভাব নেই সম্পাতির। যা পায় তাই খায়। হাত ধুয়ে বসে পড়ল সে। এমনিতে জীবনে খুব বাস্তববাদী সে। কখনো আবেগের বশে কোনো কাজ করেনা। যোগ বিয়োগ গুন ভাগের চাকরী করতে করতে তার মধ্যে আসেনা কাশফুলের রোমান্টিকতা। সব আত্মীয়দের সঙ্গে সম্পর্কও একেবারে নিখুঁত দেনাপাওনার হিসেবমত। তাহলে শাখার মধ্যে কি এমন খুঁজে পেল সে, যাতে এত কাছাকাছি চলে গেল সে স্বভাববিরুদ্ধ হয়ে? শাখার ক্ষেত্রেও ঠিক একই প্রশ্ন কাজ করে। স্বভাবগত ভাবেই শাখা খুব রোমান্টিক, ঠিক তার উলটো। সর্বদা একা থাকতে থাকতে নিজের সঙ্গেই কথা বলে মেয়েটা। ছবি আঁকে, কবিতাও লেখে। যদিও দু একটা ওর কবিতা শাখার ফেসবুকের ওয়ালে দেখেছে সম্পাতি, লাইকও করেছে, কিন্তু বোঝেনি কিছুই। আসলে ওসব কবিতা বা ছবি টবি বোঝার মত অত সূক্ষ্ম বোধ নেই তার। তার শুধু শাখাকে ভালো লাগে। সারাক্ষণ শাখাকে ছুঁয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। আচ্ছা, এটাই কি প্রেম? আপনমনেই মুচকি হাসলো সে। খাওয়া শেষ করে একটা সিগারেট ধরিয়ে ল্যাপটপ টা খুলে বসল ও। ওয়ার্ডে লিখতে শুরু করল, “ টু দ্য অফিসার ইন চার্জ, কালিঘাট পোলিশ স্টেশন…”

জীবনে এই প্রথম নিজেকে মুক্ত মনে হচ্ছে। আজকের সকালটার রঙ অন্যদিনের থেকে একেবারেই আলাদা। দেওয়ালে, আশেপাশের আসবাবগুলোতে হাত বোলাচ্ছিল ও। কতদিন! কতদিন হলো এই পুরনো হয়ে যাওয়া জিনিসগুলো, এই দাগ ধরা রঙ চটা দেওয়াল ওর সঙ্গী। প্রায় বারোটা বছর একটানা এদের সঙ্গেই কাটিয়ে দিল সে। নিজেই আশ্চর্য হয় শাখা। একযুগ! এতদিন সে এই অন্ধকূপে কাটিয়েছে!

আজ ঘুম থেকে ঊঠেই ছাদে গেছিল সে। কাল রাতে ভালো ঘুমও হয়নি। হাতের যন্ত্রণা তো ছিলই, আর ছিল দুশ্চিন্তা। কখনো একা বাড়ির বাইরে যায়নি সে। স্টুডেন্ট লাইফেও যখন ইউনিভার্সিটি তে যেত তখন সঙ্গে থাকত বোন। এখানে টুকটাক কোথাও বেরোতে হলে পাড়ার কোনো মেয়েকে ডেকে নেয় সে। অথচ সম্পাতির জেদে সকাল হলেই যেতে হবে থানায়। একটু একটু রাগও হচ্ছিল সম্পাতির ওপরে। একদিন থেকে যেতে পারত না সে? এরকম ভাবে তাকে বাঘের গুহায় ঠেলে দিয়ে উনি কোন চুলোয় বসে বসে পা নাচাচ্ছেন!

ওর খুব প্রিয় টবগুলোর গায়ে, টবে এতদিন যত্ন করে লাগানো ছোট্ট গাছ গুলোর গায়ে আলতো করে ভালোবাসার হাত বুলিয়ে যাচ্ছিল সে। গাছেরা ভালোবাসা বুঝতে পারে। পরিস্কার বোঝে শাখা, সে আদর করলেই গাছেরা তার দিকে ঝুঁকে পড়ে। তার হাতের আঙুলে ওরাও আদর করে। আজ ওদের আদর করতে করতে চোখ দিয়ে টপটপ করে কয়েকফোঁটা ঈষদুষ্ণ জল ঝরে পড়ল।

সকালে যখন বাড়ী থেকে বেরোল, রনি তখনো নাক ডাকছে। এই নাকডাকাও আগে একেবারেই সহ্য করতে পারত না সে। কিন্তু পরিস্থিতির চাপে মানুষকে কত কিছুই সহ্য করতে হয়। এই পঁয়ত্রিশ বছরের জীবনে সহ্য করা কাকে বলে, তা প্রতিদিনই একটু একটু করে জেনেছে ও। রোজ সকাল হলেই একটা ভয়ংকর আতঙ্ক চেপে ধরত তাকে। কোন দিক থেকে কি বিপদ আসবে তা আঁচ করার মত প্যাঁচালো বুদ্ধিবৃত্তি নেই তার। ছিলনা কোনোদিনই। একবার কথায় কথায় কাঁদতে কাঁদতে বাবাকে বলে ফেলেছিল এ বাড়ী ছেড়ে চলে যাবার কথা। শুনেই রেগে আগুন হয়ে বাবা বলেছিলেন, এ বাড়ী থেকে বেরিয়ে গেলে যেন সে গঙ্গায় ডুবে মরে। বাবার ঠুনকো আভিজাত্যের মোহ যে তার চেয়েও দামী এটা বুঝতে পেরে সেদিন থেকেই সে আরো কঠিন হয়ে গেছিল। বুঝে গেছিল সব সহ্য করতে হবে তাকে এভাবেই যতদিন না মৃত্যু এসে তাকে আদর করে নিয়ে যায়। হঠাৎই কোথা থেকে তার এই শপ্ত জীবনে টুপ করে ঝরে পড়ল সম্পাতি।

ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের চার্জে একটু আগেই পাড়ার সকলের চোখের সামনে রনি কে অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেছে পুলিশ। ফাঁকা বাড়ির দরজায় তালা দিল শাখা, চাবিটা ওপাশে ঘুরে অনীকের হাতে দিয়ে এল। সে এখনো ঘুমের দেশেই ছিল। কাল রাতে একটু বেশিই খাওয়া হয়ে গেছিল। ঘুমঘুম চোখে কিছু না বুঝেই চাবি হাতে নিয়ে ফের বিছানায় লম্বা হল। বাড়ির এদিকটায় যে এতকিছু ঘটে গেল তার কিছুই জানেনা ও। জানতে পারলে হয়তো বাড়ির প্রেস্টিজ চলে গেল বলে কিছুক্ষণ লাফালাফি করে নিত। এই অপদার্থ পরজীবীদের সম্মানবোধের আড়ম্বর যে কোন ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, তাই বুঝে উঠল না সে এতদিনেও।

বুক ভরে একটা পূর্ণ শ্বাস টানল শাখা। স্যুটকেস টা হাতে তুলে নিল। আর এখানে নয়। জীবনটা এবার অন্যভাবে নতুনকরে শুরু করতে হবে।

রোজা আফজা

index-1

এমন বৈশাখ কে দেখেছে আগে! দুপুরে গরম প্রকট, রাতে বিপরীত। মফস্বল শহরের নদী সংলগ্ন এক পাড়ায় নির্জন দোতলার ছাদে দাঁড়াই, মাঝরাত, চারদিকে গাছের ফাঁকে ফাঁকে ঘুমন্ত বাড়িঘর। অল্প ক’টা বাড়ির বাইরে লাগানো বাল্ব থেকে আলোর বিচ্ছুরণ- নিস্তেজ, দুর্বল। জলরঙের কম্পোজিশনের মত আলো মিশে যাচ্ছে বৃহত্তর অন্ধকারে। চারদিকে নিভু নিভু সিগারেটের ধোঁয়ার মত ছোপ ছোপ কুয়াশা। নদীর সকল বিষাদ বাষ্পীভূত হয়ে মিশছে হাওয়ায়, তাই হাওয়া নৈরাশ্যের মত শীতল।

হঠাৎ একরাশ ঝড়ো হাওয়া বয়ে যায়, ছাদের টবে টবে লাগানো গাছের পাতারা খসখসিয়ে ওঠে। নিরাপদ খাঁচা হতে পোষা কবুতরগুলো ডেকে উঠে, দু’মিনিট পরই থেমে যায়। কে যেনো ক্যানকেনে স্বরে প্রশ্ন করলো,
– ওই লোকটাকে মনে আছে, মানুষ?
চোখ গেলো কিছুদিন আগে টিনের ড্রামে লাগানো পেঁপে গাছের পিছনে। ওখানে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে ঢাকনাটা, ওই আবার জানতে চাইলো,
– ও মানুষ, ওই লোকটার কথা তোমার মনে আছে?
কৌতূহল গোপন করে খুব স্বাভাবিক স্বরে প্রশ্ন করলাম,
– কোন লোকটা?
– ওই যে পুরান ঢাকায়, বহু দিন আগে, তখন তোমার বয়স অনেক কম, তখন যে লোকটা আসতো ওই লোকটাকে মনে আছে?
অর্থহীন কথায় বেশ রাগ হয়, রাগটা ধীরে ধীরে কমেও যায়। কথা প্যাঁচালে রাগের সাথে যোগ হয় বিরক্তি, রাগ কমলেও বিরক্তি কমে না। বিরক্তি গোপন করলাম না,
– হয় স্পষ্ট করে বলো নয়তো এক্কেবারে চুপ থাকো। বিরক্ত করো না তো।
– বিরক্ত করছি না তো। ওই যে লোকটা মাঝরাতে আসতো, তার এক হাতে আমার মত টিনের ঢাকনা আর অন্য হাতে চিকন লাটি। লাটি দিয়ে হালকা করে ঢাকনায় ক’টা টোকা দিত, টিনের শব্দ থামলে সুর করে বলতো, “ওঠঠোওওও… জাগগোওওও.. রোজদারো.. ইনসানো ওঠঠোওওও। সেহরি খানেওয়ালা.. রোজা রাখনে ওয়ালা… নামাজ পড়নেওয়ালা.. যাকাত দেনেওয়ালাআআআ ওঠঠোওওও… জাগগোওওও…।”

২.
চোখের পলকে মফস্বলের ছাদটা রূপান্তরিত হয় পুরান ঢাকার এক বাড়ির ছাদে। ছাদের পূর্ব দিকে একটা মাত্র ঘর, মাঝরাতে ঘরের জানলা দিয়ে দক্ষিণ দিকের রাস্তায় তাকিয়ে আছে ক্লাশ এইট, অপেক্ষা করছে কখন আসবে ওই লোকটা। মোড়ে দাঁড়াবে, টিনের ঢাকনায় তিন চারটা বাড়ি দিবে, তাতে বিশ্রী আওয়াজ না হয়ে কেমন সুরেলা আওয়াজ হবে, যেনো বিলম্বিত দাদরা তালে বাজছে বাদ্যযন্ত্র, এরপর সুর করে বলবে, “ওঠঠোওওও.. রোজদারো.. ইনসানো…ওঠঠোওওও। সেহরি খানেওয়ালা.. রোজা রাখনে ওয়ালা… নামাজ পড়নেওয়ালা.. যাকাত দেনেওয়ালাআআআ ওঠঠোওওও… জাগগোওওও…।” এই লোকটা হেটে একটু সামনে যাবে, দাঁড়িয়ে টিন বাজাবে এবং সেহেরি খাওয়ার জন্য জাগার আহ্বান জানাবে, আবার সামনে যাবে। কতদূর সে যাবে জানা নেই।

লোকটার একটা চোখ অন্ধ, অবস্থাও দরিদ্র, অথচ কণ্ঠে হাহাকার নেই। সময় জুড়ে রোজা রাখার আহ্বানের কোমল তৃপ্তি ছড়িয়ে যেতে যেতে তার আওয়াজ ক্ষীণ হয়ে আসবে। আর, তখনই স্পষ্ট শোনা যাবে নিচতলায় মা জেগে রান্নাঘরের দরজা খুলেছেন, ভাত রান্না করছেন। কিছুক্ষণ পর তরকারি গরম করবেন, হাওয়ায় ভাসবে সুবাস। আশপাশের বাড়ি থেকেও আসবে রান্নাঘরের শব্দ। খুব অল্প সময়ের মধ্যে জেগে উঠবে সবাই। বাড়ির ছাদে ছাদে বাচ্চারা রেলিং ধরে দাঁড়াবে, রাস্তায় টিউব লাইটের আলোয় কখন ফুটে উঠবে হ্যাজাকবাতির আলোর আভাসের তার অপেক্ষায়। এরপর হ্যাজাকের আলো সামনে এগিয়ে আসবে, সাথে কাসিদা দলের গান, “নীলাকাশে চাঁদ উঠেছে ওঠো মোমিন মুসলমান/রোজা রাখো নামাজ পড়ো আখেরাতে পাবে দান”, এই গানের শেষে শুরু হবে “হেরা হতে হেলে দুলে নূরানী তনু ও কে আসে হায়/সারা দুনিয়ার হেরেমের পর্দা খুলে খুলে যায় —/সে যে আমার কমলিওয়ালা — কমলিওয়ালা।।”

এরই ফাঁকে মসজিদের মাইকে মুয়াজ্জিন ঘোষণা দিবেন, “প্রিয় রোজদার ভাই ও বোনেরা, সেহেরি খেয়ে নিন। সেহেরির সময় শেষ হতে আর এক ঘণ্টা বাকী।” টিনের ঢাকনায় আওয়াজ, কাসিদার গান, মুয়াজ্জিনের ঘোষণা- এসবে রাতের নির্জনতার ছন্দপতন ঘটবে না, এসব বাঙালির রমজানের মধ্য রাতের চিরায়ত অনুষঙ্গ।

ক্লাশ এইট নিচে নেমে আসতেই মা তরকারির বাটি হাতে দিয়ে বলবেন, “এটা শরফু দাদাকে আর এই বাটিটা ফুপুআম্মাকে দিয়ে আসো।” পাড়াতো দাদা, বয়স্ক মানুষ, অবস্থা স্বচ্ছল নয়। এমন আরও কিছু পরিবারকে মা, চাচী এবং প্রতিবেশীরা মিলে ঠিক করে নিতেন কবে কে তোফা পাঠাবেন। এই তোফাকে যেনো দান মনে না হয়, কেউ যেনো একক কৃতিত্ব দাবি করতে না পারে, তাই ওমন ব্যবস্থা। নীরবে প্রতিযোগিতাও চলতো, তোফা মানে উপহারের খাবারটা যেনো ভালো হয়, মাছ বা মাংসের টুকরোটা যেনো বড় হয়, আর রান্নাটা যেনো খুব স্বাদের হয়। ফুপু আম্মার বাসা থেকে আরেক বাটি তোফা নিয়ে ফিরতে হতো। পাড়াতো দাদাও তোফা দিতেন, দুটো খেজুর বা আম বা কলা জোড় করে ধরিয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলতেন, “খাইতে খাইতে বাড়িতে যাও, ভাই।”

ক্লাশ এইটের মনে পড়ে সুবীরদের কথা। সুবীরের মা মানে মাসিমা একবার মা’কে বলেছিলেন,
– আপা, আপনারা যে রাতে জেগে উঠেন, সেহরি খান, দেখতে খুব ভালো লাগে। খাবারের ঘ্রাণও খুব ভালো লাগে।
এমনিতে মা প্রায়ই খাবার পাঠাতেন, মাসিমা পাঠাতেন নারকেলের নাড়ু আর আনারসের চাটনি। মাঝে মাঝে নিরামিষ আর লুচি। তবু মা জানতে চাইলেন,
– তোমাকে সেহরি পাঠালে খাবে! ধর্মের বাঁধা নেই তো!
– না, আপা।
এরপর প্রায়ই মাসিমা’কে সেহরির সময় খাবার পৌছে দিতে হত। মা দুটো টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার গুছিয়ে দিতেন, অন্তত চারজন মানুষের তিনবেলা যেনো হয়ে যায়। ক্লাশ এইট জানতো তখন সুবীরদের খুব খারাপ দিন চলছে, এজন্যই মা সেহরির নামে তিন বেলার খাবারই পাঠাচ্ছেন। মাসিমা যেনো বিব্রত না হন তাই বলেছেন, সেহরি অল্প করে দেওয়ার রেওয়াজ নেই।

৩.
খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে ড্রামে লাগানো পেঁপে গাছের পাতা, বলে,
– তোমার এত কিছু মনে আছে, মানুষ?
এ কথায় ক্লাশ এইট ফিরে আসে মাঝ বয়সে, বলে,
– অনেক কিছুই মনে নেই।
– যেমন?
– ঘরে ফিরে দেখতাম মা শীতল পাটি বিছিয়েছেন। সবাই মিলে একসাথে সেহরি খেতে বসতাম। খাওয়ার ফাঁকে..
– খাওয়ার ফাঁকে কি?
– বাবা নিজের পাত থেকে মাংস বা মাছের টুকরো ভাইবোনদের পাতে তুলে দিতেন, একেক দিন একেক জনের পাতে।
পেঁপে গাছের পাতা খসখসে স্বরে বলে,
– এই যে মনে আছে!
– স্মৃতিটা মনে আছে সত্য, কিন্তু বহুদিন হয় বাবার গায়ের ঘ্রাণটা ভুলে গেছি।
– ওহ। তোমাকে কষ্ট দিলাম, মানুষ!
হাওয়ায় মিশে যায় দীর্ঘশ্বাস,
– না, কষ্ট নয়, বিষাদ। জানো, বাবা ডানহিল সিগারেট খেতেন।
– সিগারেট খাওয়া মোটেও ভালো কথা নয়, হু।
– ওই সময়ে কি আর এসব বুঝতাম! ডানহিলের গাঢ় লাল রঙের প্যাকেট, তাতে সোনালী বর্ডার- খুব প্রিয় ছিলো। প্যাকেটগুলো জমাতাম। যখন ক্লাশ এইটে, তখন বাবার ছোট্ট কারখানায় আগুন লাগলো। সব পুড়ে গেলো।
– তারপর!
– বাবা কেমন যেনো হয়ে গেলেন! ডানহিলের পরিবর্তে সস্তা স্টার সিগারেট খেতে শুরু করলেন। হাসি গেলো কমে, খেতে আর খাওয়াতে ভালবাসতেন। কষ্ট হলেও খাওয়ানোর রেওয়াজটা ধরে রাখলেন, কিন্তু খাওয়ার অভ্যাস অনেকটাই ত্যাগ করলেন।
হাওয়ায় দোল খায় পেঁপে পাতা, খাঁচার ভেতর বিষাদের মত ডেকে ওঠে এক জোড়া কবুতর,
– জানি… আমরা জানি.. আমাদের আগের জন্মের স্মৃতি.. আমাদের আগের জন্মের সব স্মৃতি..
– মানে?
– খুব সহজ, মানুষ। তোমার বাবা কিছুই বুঝতে দেননি কোথায় পুড়েছে কতটা। কে করেছে বিশ্বাসঘাতকতা আর কে লাগিয়েছে আগুন। নিজে পুড়েছেন প্রত্যহ।
– সত্যিই তাই।
– তিনি সবটাই নীরবে সয়েছেন, সবার চাওয়া পূরণ করেছেন সাধ্যমত। কারো প্রতি ছিলো না অভিযোগ।
– হ্যা।
একটা কবুতর প্রশ্ন করে,
– আমাদের এই জন্মে তুমিও কি ক্রমশ তোমার বাবার মত হয়ে উঠছো, মানুষ?
– কি জানি, জানিনা তো।
– তোমারও দেখি কি নিজের জন্য সময় নেই?

এসব প্রশ্নের উত্তর হয় না, উত্তর জানাও নেই। খোলা ছাদে মাঝ বয়সের মানুষটা আবার ফিরে যায় ক্লাশ এইটে। সেহরি খাওয়ার পর সবাই মিলে চা খাওয়া হচ্ছে। বাবা বহু দিন আগের ওই ছাদে প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে নাড়াচাড়া করছেন, কিন্তু ধরাচ্ছেন না। ক্লাশ এইট জানে চা’য়ে শেষ চুমুক দিয়ে বাবা সিগারেটটা প্যাকেটে ভরে রেখে দিবেন, এই মাসটায় চেন স্মোকার বাবা সিগারেটে একটা টানও দিবেন না।

সেহরির সময় শেষ হয়ে আসে। মুয়াজ্জিন জানান, “আর মাত্র পনেরো মিনিট বাকী, সেহরি খাওয়ার সময় শেষ হতে আর মাত্র পনেরো মিনিট বাকী।” কাসিদার গান আবার ক্ষীণ থেকে স্পষ্ট হয়ে আসে। এবার তারা ফিরতি পথে যাচ্ছে, দলের মধ্যে সবচাইতে সুরেলা কণ্ঠ যার, সে আকুল হয়ে গায়, “এই সুন্দর ফুল সুন্দর ফল/মিঠা নদীর পানি…” বাকীরা পরের লাইনে কোরাস ধরে, “খোদা..তোমার মেহেরবানী/খোদা..তোমার মেহেরবানী।”

সেহরির সময় শেষ হওয়ার পর মসজিদের অল্পবয়সী মুয়াজ্জিন পৃথিবীর সকল প্রেম কণ্ঠে ধারণ করে গাইতে শুরু করে,
“খোদার প্রেমের শরাব পিয়ে বেহুঁশ হয়ে রই প’ড়ে
ছেড়ে’ মস্‌জিদ আমার মুর্শিদ এল যে এই পথ ধ’রে।।
দুনিয়াদারির শেষে আমার নামাজ রোজার বদ্‌লাতে
চাইনে বেহেশ্‌ত্‌ খোদার কাছে নিত্য মোনাজাত ক’রে।।”

মহল্লায় একটা সতেজ আলস্য নেমে আসে, কেউই যেনো নামাজ রোজার পুরস্কার স্বরূপ বেহশত চায় না, পরম করুণাময়ের প্রেমে বেহুশ হয়ে থাকাতেই সবার পরমানন্দ। মুয়াজ্জিনের গান থেমে যায়, আবেশ থাকে অনেকটা সময়, এরপর আজান, খাইরুন মিনান নাউম.. খাইরুন মিনান নাউম…। একটা নতুন দিনের শুরু।

৪.
প্রতিদিন সকালে নিকোলাস স্যারের কাছে ক্লাশ এইটের কোচিং থাকে। পুরান ঢাকার লক্ষ্মী বাজারের এক গলির ভেতর কোচিং সেন্টার। ওই বাড়ির মালিক ছিলেন সংগীত বিশারদ সমর দাস। ক্লাশ এইট সময়ের আগেই কোচিংয়ে পৌছাতো, বাড়ির ভেতর থেকে গ্রান্ড পিয়ানোতে ভেসে আসতো মনভুলানো সুর। প্রায়ই পিয়ানো বাজিয়ে কেউ গাইতো, “আ..নন্দলোওওওকে মঙ্গলালোওকে বিরাজও..ও..ও সত্য সুন্দরও…।”

কোচিংয়ে পালা করে প্রথম ক্লাশ নিতেন হাকিম স্যার আর অর্জুন স্যার। অর্জুন স্যার ক্লাশে ঢুকেই বলতেন,
– কারা কারা রোজা আছো হাত তুলো।
যারা হাত তুলতো তাদের দুই পিরিয়ড পর ছুটি দিয়ে বলতেন,
– সোজা বাসায় চইলা যাইবা। এবাদতের ফাঁকে পড়া শেষ করবা।

হাকিম স্যার বেশী সময় ধরে ক্লাশ নিতেন। কেউ উশখুশ করলে বলতেন, বেশীক্ষণ ক্লাশ করলে তোমাগো ক্ষিধায় ধরবো না। আরামে রোজা করতে পারবা। অর্জুন স্যার আগে ছুটি দিলে ক্লাশ এইট একা একাই ঘুরে বেড়ায়, রাস্তার দুইপাশে দেখার কতকিছু। মাঝে মাঝে সদরঘাটের লিয়াকত এভিনিউর দোকানগুলো থেকে গল্পের বই ভাড়া নিয়ে বাসায় ফিরে। বই পড়ার মাঝেই বাড়ির প্রয়োজনে বাজারে আর মসজিদে নামাজ আদায় করতে যাওয়া হয়। ফিরে আবার বইয়ে ডুব।

আসরের নামাজ আদায় করেই মা ব্যস্ত হন ইফতার তৈরী করতে। রমজান মাসে তার উপর খুব চাপ যায়। প্রতিদিনই দুই তিনজন প্রতিবেশীকে ইফতার পাঠানো হয়। মা’র ক্লান্তি নেই। রোজা রেখেও এ মাসে অন্তত দু’দিন নির্ঘুম কাজ করতে হবে তাকে, একদিন সকল প্রতিবেশীর বাড়িতে ইফতার যাবে, অন্যদিন মসজিদের ইমাম ও মুসুল্লিদের জন্য। এত কাজের পরও মা’র চেহারায় খেলা করে অপার সুখ ও তৃপ্তির আভা। ক্লাশ এইট বইয়ে মগ্ন হয়ে থাকে, মাঝে মাঝে রান্নাঘরে মায়ের আশপাশ দিয়ে ঘুরে আসে। মায়ের ঘ্রাণ নিতে ভালো লাগে, মায়ের ঘ্রাণ মন ভরে নিলেও রোজা ভাঙেনা।

সময় গড়ায়। ক্লাশ এইটের ঘোর ভাঙে আসরের নামাজের বহু পরে, নাসির চাচার সুরেলা চিৎকারে, “এইইইইই পাহাইড়া বরফ…. এইইইইই পাহাইড়া বরফ…এইইইই…।” কাঠের কুড়ো দিয়ে ঢাকা বরফের পাটা, গাঢ় খয়েরি রঙয়ের কাঠের কুড়োর দুই একটা ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এসেছে দুধ সাদা বরফ। কি যে সুন্দর! ঘরে ফ্রিজ আছে, এরপরও পাহাইড়া বরফ কেনা চাই। ক্লাশ এইট জানে এ বরফের জন্ম কোনো এক কারাখানায়, এ বরফ পাহাড় থেকে আসা নয়। তবু ভাবতে ইচ্ছে করে, বহুদূরের কোনো পাহাড় থেকে কেউ একজন বরফগুলো নিয়ে এনেছে, শুধু পানি নয়, গলে যেতে হবে জেনেও পানির সাথে পাহাড়ের সহস্র স্মৃতি জমাট বেঁধে জন্ম নিয়েছে এ বরফ, শীতল শুভ্র বরফ।

মফস্বলে রাত গভীর হয় দ্রুত। খোলা ছাদে স্মৃতিকাতর মাঝবয়সী মানুষের ভাবনায় সুর মিলায় রাতের হাওয়া, ফিসফিসিয়ে বলে,
– আমি সেই পাহাড়ের কথা জানি, মানুষ। আমি সেই পাহাড়টা চিনি।
– তাই! কোথায় সেই পাহাড়?
– বহুদূর। বহু… বহু… দূর।
মানুষ উদগ্রীব হয়ে জানতে চায়,
– আমাকে ওই পাহাড়ের কাছে নিয়ে যাবে, প্রিয় হাওয়া?
হাওয়ার স্বর করুণ হয়ে আসে,
– ওই পাহাড় ডাক পাঠালে তবেই যাওয়া যায়, এর আগে নয়।
– ও তুমি মনসুখিয়ার চিরশুভ্র চিরশীতল পাহাড়ের কথা বলছো!
– হ্যা, মানুষ। আমি ওই পাহাড়ের কথাই বলছি। আমি ওখান থেকেই মাঝে মাঝে আসি, তোমায় দেখি, আবার ফিরে যাই।
মানুষের মুখে হাসি ফুটে ওঠে,
– প্রিয় হাওয়া, তুমি মনসুখিয়ার পাহাড়কে বোলো, সে যেনো ডাকে আমায়। তাকে আরও বোলো জমাটবাধা বরফ যেমন উত্তাপে গলে যায়, আমিও প্রতিনিয়ত গলে যাচ্ছি, দ্রুত.. খুব দ্রুত।
হাওয়া কিছুই বলে না। পেঁপে গাছের পাতা, তেলের ড্রামের ঢাকনা, খাঁচার ভিতর কবুতরগুলো নিরব হয়ে থাকে, শুধু রাতের একটা তারা জিজ্ঞেস করে, “তোমাকে এত দ্রুত গলতেই হবে, এ তোমার কেমন নেশা মানুষ!” উত্তর দিতে ইচ্ছে করে না, যে গলে যাচ্ছে তার কাছে এসব প্রশ্ন ও উত্তরের কোনো অর্থ নেই।

জিততে গেলে হেরে যাব

সাত
— চাঁদ, যা দিদিকে ডেকে আন তো। রুটিক’টা বেলে দিক।
— এই ছোড়দা, দিদিকে ডাক।
— আমার বয়ে গেছে।

শিউলিকে পাচ্ছ না? দ্যাখো গে’ খুকুর কাছে ব’সে। খুকুর খোঁজ নেই? সে নিশ্চিত শিউলিদের ঘরে। চাঁদ তিনটে ফ্যানাভাতের গন্ধ, সাত সুপুরিগাছ আর তেইশটা রোদ্দুর পেরিয়ে সুশীলকাকুর বাড়ি পৌঁছে গলা খাঁখারি দিল। বারান্দায় উপুড় টিনের কৌটো, পাঁচছটা পুরনো পুঁতির মালা থেকে ভালো পুঁতিগুলো ছিঁড়ে শিউলি মাটিতে রাখছে… নাকি নিজেই খ’সে যাচ্ছে টাপুস-টুপুস; আর খুকু, ভালো নাম অশোকা, সেগুলো লাল কারে গেঁথে নিলেই নতুন মুক্তোহার!
— খুকুদি, তোমার বন্ধুকে মা ডাকছে।
— আমার বন্ধু সবাই। তুইও তো।
— আমি তোমার ভাই না? সবুজ রঙের ফ্রক পরা বন্ধুকে ডাকছে।

দুজনে এক-নদী হেসে গড়িয়ে পড়ল।
— এখানে সবুজ ফ্রক পরা কোনও মেয়ে নেই।
— না না সবুজ না, নীল।

এবার ফুঁসে উঠবে দাঁতের ফেনা-ঘেরা হাসির সমুদ্র।
— হোই রঙকানা, মাসিমা যাকে ডাকছে তার নাম বল।

নাম মুখে আনার নিয়ম নেই, খুকুদি ভালো ক’রেই জানে। কিন্তু চাঁদের বুদ্ধি কি কিছু কম?
— তালিবোশ্‌শ’য় রোশ্‌শি, রস্‌সোউ, ল’য় রোশ্‌শি।

আট
শিউলি কদবেলমাখা ক’রে সবাইকে দেওয়ার সময়ে দিদিমা বলেছিল :
—আমার ভাগেরডা তুই নে গে, বুনডি। আমার দাঁত কদবেল খালি ট’কে যায়।
এ-বাবা, ফলস দাঁত আবার টকে কী ক’রে! বাসু অবাক।
— তোমাগো ফলস দাঁত আছে যে জানবা?

তার এই আনজাস্ট এনরিচমেন্ট ঠেকাতে চাঁদ পেছন থেকে ডিঙি পেড়েছে বুঝে শিউলি টপাৎ ক’রে গোটা দলাটা মুখে পুরে দুটো বিশেষণ ছুঁড়ে দেয় : ১/ ছোঁচা ২/ পাতকুড়োনি, আর উড়ে আসা কিলের কথা ভেবে কুঁচকে রাখে পিঠ।

ওসবে না গিয়ে ভাই তার বাঁহাত খুঁজছে… শিউলি হাত মুঠো ক’রে পেছনে লুকোলো। ছেলেটা তখন মগ জলদস্যু, এক চোখে কালো কাপড়ের ঠুলি, দিদির কব্জি কামড়ে ধরেছে। ওর গজদাঁত দিয়ে ঝরঝর ক’রে পানখাওয়া রক্ত পড়ছিল নিশ্চয়ই, নাহলে মুঠো চিৎকার ক’রে খুলে যাবে কেন? ওমনি চাঁদ নিজের বাঁহাতের কড়ে আঙ্গুল শিউলির কনিষ্ঠায় পেঁচিয়ে ছেড়ে দেয় — আড়ি!

আড়ি, বলতে গেলে, ভালো। বাড়িতে যখন ঢের সারে বাচ্চা, তাদের ক্লোজড গ্রুপে দাঙ্গা ঠেকাতে আক্রোশকে খসখসে অভিমানে মুড়ে ফেলার নামই আড়ি। আর অভিমান কিছুদিন পরে বাতাসের জলীয় বাষ্প শুষে খামের ভেতরের রাগটাকে পচিয়ে দেবে। হয়ত তখনও রাস্তায় কারফিউ, কিন্তু বাগানের দুই গাছই মাথা দুলিয়ে ‘রাজি’ বলছে।

বড়দের কি আড়ি হয় না? গত বছর মান্নাপাড়ায় ভাড়াটে-বাড়িওলা তুমুল ক’রে দুজনেই কোর্টে কেস ঠুকে দিয়ে এল। মহকুমা আদালতে ডেট পড়ে; কোনও দিন এনার উকিল গায়েব, কোনওদিন ওনার। একই ট্রেনে কোর্টে হাজির হয়ে ঠনঠনে রোদে শিরিষতলায় দুজন-দুদিকে-মুখ ব’সে থেকে থেকে আবার একই ট্রেনে একই বাড়ি।

তার মধ্যে হঠাৎ বাড়িওলা শসা কিনে কলাপাতা-সমেত বাড়িয়ে দিয়েছে ভাড়াটের দিকে। সে আড়ষ্ট হাতে গ্রহণ ক’রে রোদের তেজ কমলে নিল দুটো চা। পাশাপাশি ভাঁড়ে চুমুক, ছেলের পরীক্ষা বা বাজারদর নিয়ে শৌখিন কথা; ভেতরে ভেতরে তখন ওই কবিতাটা হচ্ছে — কে বলে তোমারে বন্ধু অস্পৃশ্য, অশুচি…।

মায়া ভেবেচিন্তেই চাঁদকে পাঠিয়েছিল দিদিকে ডেকে আনতে, তারপর সে ‘ও গৃহস্থ’ ডাকা লোকটার কাছে গিয়ে বসে :

— আপনার ছোট পুত্র আর বড় কন্যার তো মুখ-দেখাদেখি বন্ধ আজ দুই সপ্তা।
— ও, আড়ি? আড়ি-তে গাইছে দুজন? দুরূহ কাজ কিন্তু, শমের আধ মাত্রা পরে ধরতে হবে। গাইতে পারলে অন্যরকম চার্ম তৈরি হয়! যেমন, ‘আজু বহোত সুগন্ধ পবন সুমন্দ মধুর বসন্ত্‌’, রাগ বাহার। হাতে তালি দিয়ে নির্মল দেখাতে থাকে — ধা দেন্‌ তা, তেটে কতা, গদি ঘেনে, ধা-আজু বহোত…।

আট
রেল স্টেশন থেকে কাঁচা রাস্তায় নামল দুটো পালতোলা নারী-পুরুষনৌকো। দেখে পুকুরঘাটে কাপড়-আছড়ানো ঘোমটা স্থির, বটতলায় বিড়িটানা আঙুল নেমে এল ঠোঁট ছুঁতে গিয়ে — কতটা লম্বা দেখেছ, কী সুন্দর জুতো, কী ভারি-ভারি গয়না, সঙ্গে আবার চাকর, তার কাঁধে কত বড় ব্যাগ! সব পয়সাওলাই রাস্তার চোত্‌রাপাতা-চোরকাঁটা বাঁচিয়ে, কুকুর-মানুষের গু বুঝে পা ফেলে তারপরেও দুটি হোঁচট খেয়ে গ্রামের কুটুমবাড়ি পৌঁছোয়। কিন্তু কলকাতার বড়লোকদের কাঁধের পেছনে আলোর ঝালর থাকে — জাদুকর ম্যানড্রেক! তারা কোথাও হাজির হলে আচমকা বায়ুপ্রবাহ বেড়ে যাবে; শিমূলগাছ দুটো তুলোফল ঝরাতে গিয়েও — থাক বাবা, যদি মাথায় লাগে; শালিখপাখি ঘেঁটি বেঁকিয়ে পাড়ার বেড়ালকে জিগ্যেস করবে — কোন কূলে আজ ভিড়ল তরী, আইডিয়া আছে?

চাঁদ বাড়ি ফিরে দ্যাখে ভবানীপুরের মাসি উঠোনে চৌকিতে ব’সে হ্যাঁচ্চাই এক ব্যাগ খুলে জিনিস বের করছে তো করছেই — বাবার জন্যে সাধনা-র চ্যবনপ্রাশ, দিদিমার জন্যে নতুন থান, চাঁদের কেডস, গোপুর জন্যে বর-বউ পুতুল, শিউলির ফ্রক… মায়ের কিছু নেই? এই যে, দুকেজি সরষের তেল! দেখতে দেখতে উঠোনটাই দোকান, পাড়ার লোকেরা নেড়েচেড়ে দেখছে জিনিসপত্র, মাসি উঁচু গলায় দাম শোনাচ্ছে, তার মধ্যে দিদিমা : সঞ্জুভাই, বালতিতে জল ভরো, অশ্বিণী চান করবে। উঠোনে আর একটা জলচৌকিতে মেসো গা আগ্‌লা ক’রে বসলে চাঁদ আর গোপু ছোট ছোট থাবায় তার আঁচিলখচিত পাহাড়-পিঠে তেল ড’লে দিচ্ছে। বদলে দুজনের চ্যাটচেটে হাতে পাঁচ পাঁচ দশ নয়া।

রানীর রাজপুত্রকন্যা নেই, সেই যন্ত্রণার ওপর সে ধনসম্পদের ডাকটিকিট চিটিয়ে রাখতে চায়। মায়াকে বিদ্রূপ করে বছর-বছর বাচ্চা বিয়োনোর জন্যে, আবার খুব ইচ্ছে দিদির একদুটো সন্তান নিজের পরিচয়ে মানুষ করবে। তারা ঘটাং-ঘটাং কাশবে না, চপর-চপর ভাত চেবাবে না, কুজড়িমুজড়ি জামাকাপড় প’রে বেরোবে না রাস্তায়, কলকাতার সবচেয়ে ভালো স্কুলের ছাত্র হবে।

দিদির ‘হ্যাঁ’ না পেয়ে রানী নিমতিতা কলোনিতে আসা কমিয়েছে, এলে দুকেজি সরষের তেলের হিংসেঝাঁঝ ছড়িয়ে যায়।
শিউলি ভাইয়ের পেছন পেছন বাড়ি ফিরে মাকে ধরল।
— মাসি এই আমাদের বাড়ি এসে আবার এই বারাসাত চলে যাচ্ছে কেন?
— যাচ্ছে পদ্মর সঙ্গে দেখা করতে। দুই বাঁজায় ব’সে পরের সংসারের মুন্ডুপাত করবে না?

নয়
ঋজুদার মতো পদ্মপিসির গল্পটাও অ্যাডাল্ট, শিউলি দিদিমাকে তুইয়ে-তাইয়ে শুনে নিয়েছে :

সাত-আট বছর বয়েসেই পদ্মকুঁড়ির বিয়ে হল পঁচিশ বছরের জোয়ান ছেলের সঙ্গে। রাত্তিরে সে ঘরে ঢুকলেই বউ আপাদমস্তক চেঁচাত। কিছুদিন পরে মা ছেলের দ্বিতীয় বিয়ে দিল; প্রথম জন ফিরল তার মাসির শ্বশুরবাড়ি, সিদ্ধান্তপাড়ায়।

আস্তে আস্তে সে-মেয়ে বড় হয়, অতি নম্র, মাটি দিয়ে হাঁটলে মাটিতে আওয়াজ হবে না; আর এমন রূপসী, পুকুরঘাটে গেলে বৌঝিরা কথা থামিয়ে তাকিয়ে থাকে। তখন খবর পেয়ে তার বর লুকিয়ে লুকিয়ে পদ্মর কাছে আসতে লাগল। এদিকে তোমাদের বাড়িতে অনেক দিনের পুরনো এক কুরির মেয়ে ছিল, সে জন্ম-বোবা।

— কুরি মানে কী, দিদ্‌মা?

কুরি হচ্ছে ময়রা। কাজের মেয়ে হলে কী হবে, জোচ্ছোনার ভীষণ দাপট। বাড়িতে ভিখারি এলে নাদু চাল-আলু দিতে গেছে, সে বারান্দায় ব’সে ইশারা করছে — অত চাল দিয়ো না। শীত হোক বর্ষা হোক, জ্যোৎস্না শুতো বাড়ির বারান্দায়। সে ধরে ফেলল, পদ্মর বর গভীর রাতে তার কাছে আসে, পদ্ম নিঃসাড়ে দরজা খুলে দেয়, আবার শেষ রাতে ঘর থেকে তাকে লুকিয়ে বের করে।

যদি মেয়েটার পেটে বাচ্চা এসে পড়ে, কী হবে! হিন্দুদের মধ্যে দুই বিয়ে তখনও করে কেউ কেউ, কিন্তু এক বউয়ের হাল হয় রক্ষিতার মতো। বাণীনাথ শালীর মেয়েকে বললেন, জামাকাপড় গোছাও। বাগেরহাটে গরীব বাপমা-র কাছে ফিরে গেল পদ্ম, সেখান থেকে দেশভাগের পর দুই ভাই বৈদ্যনাথ আর অজিতের সঙ্গে হিন্দুস্তানে।

কিন্তু দুঃখের কথা কি জানিস? পদ্মপিসির কোনওদিনও সন্তান হতো না। শরীর খারাপই হতো না ওর। তোদের ঠাকুর্দা জানত না, বলার সাহসও কেউ দেখায়নি।

— দিদ্‌মা, পিসি এখনও শাঁখাসিঁদুর পরে ক্যান্‌?
— বরের তো কোনও দিশে-হদিশ নেই, আইনমতোন ছাড়াছাড়িও হয়নি। ওই শাঁখাসিঁদুর নিয়েই চিতেয় উঠতি হবে পদ্মর।

শিউলি কিছুক্ষণ হাঁ হয়ে ব’সে থাকে। তারপর হাসি পায় তার ঠোঁটদুটোর :
— বলো দিদ্‌মা, সারা জীবন মাছ খাতি পারবে পদ্মপিসি!

.
(চলছে)

হারপিক

০১
বাজিতপুর রেলস্টেশন থেকে কয়েক কিলোমিটার পূর্বদিকে গেলেই ভাগলপুর গ্রাম। অবশ্য এখন আর গ্রাম নয়। আধা শহর। কিছুটা গ্রাম আর কিছুটা শহর। বিশেষ করে মেডিকেল কলেজের আশেপাশের এলাকায় ঢুকলে যে কেউ আর ভাগলপুরকে এখন গ্রাম বলবে না। একটা কমপ্লিট আধুনিক শহরের মেজাজ নিয়ে সে যেনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সুরম্য পরিকল্পিত বিল্ডিং এর সাথে আছে সুদৃশ্য কারুকাজ মণ্ডিত মসজিদ, ক্যাফেটরিয়া, লন, পাওয়ার হাউজ, নয়নাভিরাম বাগানের পর বাগান। শহরের কী নেই এখানে! মেডিকেলের সামনের রাস্তাটির দুই পাশেই দোকানের সারি। অসংখ্য ফার্মেসি। খাবার হোটেল। বেশ চওড়া দাম। আর হবেই বা না কেনো – এসব হোটেলে যারা খেতে আসেন তাদের প্রায় সবাই রোগীদের আত্নীয় স্বজন। আজ আছে কাল নেই। বিপদে পড়ে হোটেলে খেতে আসেন। সবাই জানে এসব খাবারে জমিতে সার দেওয়ার মতো করে গ্যাস্ট্রিক বাড়ে। তবুও কোনো উপায়ান্তর নেই। আর সেই সুযোগে হোটেল মালিকেরা কাঁচা ঘাস কাটার মতো বেশ নগদ কামাই করে নেন। শহর আর গ্রামের পার্থক্যটা বুঝি এখানেই! শহরে বিভিন্ন প্রজাতির ধান্ধা করা যায়। গ্রামে এতোটা যায় না।

মেডিকেল কলেজের অদূরেই আঃ রশিদ শিকদার সাহেবের বাসা। অবশ্য কেউ কেউ বাড়িও বলে থাকেন। আমাদের দেশের একসময় প্রচলিত রেওয়াজ ছিলো শহরে হলে বাসা। আর গ্রামে হলেই বাড়ি। এখন অবশ্য এই সংজ্ঞাটা কিছুটা পাল্টে গেছে। এখন টিনের ঘর, খড়ের ঘর, ছনের ঘর এসব কে লোকে বাড়ি বলে। আর যে বাড়ি গুলো শহরের বাড়ির মতো পাকা, আধাপাকা সে সব কে বাসা বলে। সে দৃষ্টিকোণ থেকে এখন গ্রামেও বাড়ি খুঁজে পাওয়া ভার। আঃ রশিদ শিকদার সাহেবের বাড়িটি বনেদি গোছের। পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ মিলিয়ে চারপাশে চারটি ঘর। পূর্ব এবং পশ্চিমের ঘর দুটি আধা পাকা। উত্তরে-দক্ষিণে কাঁচা। অবশ্য এই দুটি ঘর প্রায় সব সময় খালি পড়ে থাকে। কেবল ঈদের সময় ছেলেরা, মেয়েরা সবাই বাড়িতে আসলে ব্যবহৃত হয়। বাড়ির চারপাশে পাকা দেয়াল। সুউচ্চ। পূর্বদিকের ঘরের সামনেই বিশাল আঙ্গিনা। পাড়ার ছেলে-ছোকরাদের জন্য খুব পয়মন্ত। খেলার মাঠ হিসাবে সারাদিনই জমজমাট থাকে। এরপরেই একটি বিশাল দীঘি। লোকে বলে কুমির দীঘি। জনশ্রুতি আছে, এই দীঘিতে একবার একটি ছেলেকে কুমিরে ধরে। কুমিরটি ছেলেটিকে না খেয়ে মুখের উপর নিয়ে সারা দীঘিতে চক্কর দিচ্ছিলো। ছেলেটির চিৎকারে হাজার হাজার লোক দীঘির পাড়ে জমায়েত হয়। কেউ তাকে বাঁচানোর জন্য দীঘির জলে ঝাপ দিতে সাহস পায়নি। এরপর লাঠিতে ভর দিয়ে হঠাৎ কোথা থেকে এক বৃদ্ধা আসলেন। তিনি জলদ গম্ভীর স্বরে বললেন, দীঘির পানিতে দুই মণ দুধ, পাঁচটি মুরগি এবং একটি ছাগল দিলে ছেলেটিকে বাঁচানো সম্ভব। বুড়ির এই কথা কেউ বিশ্বাস করলো। কেউ করলো না।

শিকদার সাহেবের জান্নাতবাসী বাবা বললেন, আর কোনো রাস্তা নেই বুড়ি মা? বুড়ি খট খট করে জানালেন, আছে বাপু। আর একটি রাস্তা আছে। এই ছেলের বদলে অন্য একজন লোককে পুকুরে বিসর্জন দিতে হবে। উপস্থিত সবাই হতভম্ব হয়ে গেলেন। তা কি করে সম্ভব? অবশেষে অনেক জোগাড় যন্ত্র করে দুই মণ দুধ, পাঁচটি মুরগি এবং একটি ছাগল দিয়ে ছেলেটিকে বাঁচানো হয়।যাওয়ার সময় বুড়িমা বলে গিয়েছিলেন, একটা শানবাঁধানো ঘাট বানিয়ে দাও বড়ে মিয়া। এই ঘাটই আমার সীমানা। গোসল করার সময় কেউ যেনো ভুলেও এই সীমানা লঙ্ঘন না করে। সেই থেকে দীঘির ঘাট শানবাঁধানো। অবশ্য বাড়ির পেছনেও একটি পুকুর আছে। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ এই দুইটিতে গোসল করে। মেয়েরা পশ্চিমের পুকুরে আর পুরুষেরা পূর্ব পাশের দীঘিতে। এটা আঃ রশিদ শিকদার সাহেবের বাবার করা নিয়ম। তিনি খুব কড়া মানুষ ছিলেন। এখনও গ্রামের বয়স্করা উনার বিষয়ে বিভিন্ন কিংবদন্তি বলেন।

সেই বাবার একমাত্র সন্তান আঃ রশিদ শিকদার। তিনিও নম্র, ভদ্র অমায়িক মানুষ। পেশায় একজন অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক। একজন সাদা মনের সফল মানুষ। পাঁচ সন্তানের জনক। দুই মেয়ে এবং তিন ছেলে। সবাই বড় হয়ে গেছেন। সবাই উচ্চ শিক্ষিত। ভালো চাকুরী করেন। হাই সেলারী পান। এতো কিছু সফলতার মাঝেও একটা বিষয় শিকদার সাহেবের মনের মধ্যে মাঝে খচ খচ করে। গ্রামের কিছু উঠতি পরিবারের লোকজন তাদেরকে প্রতিহিংসার চোখে দেখেন। সুযোগ পেলেই নানাভাবে হেনস্থা করেন। ক্ষতি করার চেষ্টা করেন। শিকদার সাহেব এই সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে মনে মনে যুদ্ধ ঘোষণা করে রেখেছেন। তিনি তাদের প্রতি কোনো দুর্ব্যবহার করেন না। আপদে-বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সামাজিক কর্মকাণ্ডে তাদের যথেষ্ট গুরুত্ব দেন। তবুও তিনি প্রতিহিংসার এই অনল পুরোপুরি নিভাতে পারছেন না।

০২
এই শিকদার বাড়িতে বিগত কয়েকদিন যাবৎ একের পর এক অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। বাড়ির সব মানুষের মুখের দিকে চাওয়া যায় না। আতংকের পর আতংক। কেউ জানে না কখন কী ঘটে যায়! এই জন্য সবার মুখের মানচিত্রে এক গভীর চিন্তার রেখাপাত। বাড়ির গৃহকর্ত্রী আয়েশা বেগম রান্নাঘরে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। আজ বড় ছেলে নাফিস শিকদার বউ, ছেলেমেয়েসহ বাড়িতে আসার কথা। সকলেই তাদের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। আয়েশা বেগম তরকারিতে লবণ দিবেন এমন সময় ছোট মেয়ে তাজমুন নাহার দীনা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলো। মা, মা—- ওমা । কি হয়েছে রে? একটু বিরক্ত হয়েই বললেন আয়েশা বেগম বললেন। আজকাল তরকারি রান্না করার সময় কেউ ডিস্টার্ব করলে উনি খুব ক্ষেপে যান। বয়স হয়েছে। অনেক কিছুই মনে রাখতে পারেন না। তেল দিলেন না পানি দিলেন! হলুদ দিলেন না মরিচ দিলেন ইত্যাদি ইত্যাদি। মা, আমার মোবাইলটা খুঁজে পাচ্ছি না। দীনা বললো।কী বলছিস? কোথায় রেখেছিলি? কেনো? খাটের উপর।তুই আসার আগের দিন মানে পরশু আমার মোবাইলটাও খাটের উপর থেকে হারিয়ে যায়। কতো খুঁজাখুঁজি করলাম। পেলাম না। আজ আবার তোরটা গেলো। দেখ্‌ তো মা বাথরুমে হারপিকটা ঠিক আছে কিনা? মায়ের আদেশ পালন করার জন্য দীনা দৌড়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। এই দীনা মেয়েটি খুবই লক্ষ্মী। খুব সুন্দর দেখতে। ছিমছাম গড়ন ।এতো বড় হয়েছে। বি সি এস পাশ করে এখন একটি স্বনাম ধন্য সরকারি কলেজের প্রভাষক। তবুও এতোটুকু অহংকার নেই। শিশুর মতো সহজ-সরল। শিকদার সাহেবের পরিবারে দীনাই একমাত্র অবিবাহিত। বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রতিদিনই সম্বন্ধ আসে। ভালো ভালো ঘর। সুপাত্র। তবুও শিকদার সাহেব রাজি হন না। সবাইকে বলেন, মেয়ে মাত্র চাকুরী পেয়েছে। আর কিছুদিন যেতে দিন।

একটু পরে দীনা আবার রান্নাঘরে ছুটে এসে প্রায় চেঁচাতে চেঁচাতে বললো, মা হারপিকের কৌটা আছে; কিন্তু ভেতরে এক ফোঁটা হারপিকও নেই। কি বলিস মা! গতকালই তো আনা হয়েছে। এর আগেও আরও তিনটি হারপিকের একই পরিণতি হয়েছে। আয়েশা বেগম বললেন। দীনা কী বলবে কিছুই ভেবে পেলো না। শেষে বললো, মা ইলা কোথায় গেছে? ইলাকে দেখছি না কেনো? আয়েশা বেগম বললেন, কোথায় আর যাবে? হয়ত দীঘির পাড়ে খেলছে! দীনা আর কথা না বাড়িয়ে দীঘির দিকে হাঁটা দিলো।

এই ইলা দীনার ভাগ্নি। আপন বড় বোনের একমাত্র মেয়ে। খুব আদরের। পুরো বাড়িতে ছোট মানুষ বলতে ওই একজনই। ইলা তার মা-বাবার সাথে নানু বাড়িতেই থাকে। তার মা-বাবা দু’জনেই চাকুরী করে। মা সরকারি প্রাইমারী স্কুলে এবং বাবা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। দুজনই সারাদিন অফিসে থাকেন। প্রায় সন্ধ্যায় ফিরেন। নানা-নানীর সাথে তার সারাদিন কাটে। কখনও একলা। জন্মের পর থেকে এভাবেই চলছে ইলার জীবন। গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। খুব মেধাবী। ওর ক্লাসে বরাবরই প্রথম হয়। দুষ্টুমিতেও একদম পিছিয়ে নেই। সকলের সেরা। অবশ্য গুণীজনেরা হামেশাই বলে থাকেন, মেধাবিরা একটু- আধটু দুষ্টু হবেই। মেধা ছাড়া দুষ্টুমিরা করা যায় না।

দীনা দীঘির পাড়ে এসেই ইলাকে পেয়ে গেলো। ডাকসই চলছে। দীনাও মুহূর্তেই শৈশব ফিরে পেয়েছে। তারও খেলতে ইচ্ছে করছে। অনেকদিন ডাকসই খেলা হয়নি। অনেকদিন—।। ইলাকে বললো, আমাকে খেলতে নিবি? ইলা হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ল। বললো, তুমি খেলবে মানে? তুমি কি আমাদের মতো শিশু নাকি? দীনাও মজা করে বললো, হুম শিশু ইতো। দেখিস, আমি কোনোদিন বুড়ি হবো না। ইলা আর কিছু বললো না। দীনার হাত ধরে টানতে টানতে বাড়ির দিকে হাঁটা দিলো। দুজনের মনেই আনন্দ আর ধরে না। একটু পরে ইলার ছোট মামা আসবে।। শহর থেকে। আরশি আসবে। ঐশী আসবে। ইউশা আসবে। কতো গল্প হবে বস্তা বস্তা। খেলা হবে। কবিতা আবৃত্তির আসর হবে। চাঁদনী রাতে কানামাছি হবে। লুকোচুরি খেলা হবে। মজার উপর মজা। আনন্দের উপর আনন্দ। এতো আনন্দ— ইলা রাখবে কোথায়?

০৩
গত কয়েকদিন ধরে ইলা বমি করছে। কিছুক্ষণ পর পর। কেবল বিকেল হলে একটু ভালো থাকে। কিছুদিন ধরে ইলার খাবারের প্রতি খুব অরূচি। কোনো কিছুই খেতে চায় না। এর সাথে যোগ দিয়েছে বমির ভয়। ওর এখন বদ্ধমূল ধারনা জন্মে গেছে কোনোকিছু খেলেই বুঝি বমি হয়ে যাবে। ইলার বাবা জায়েদ করিম নিজেই একজন মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট। তিনি ঔষধ দিয়েছেন। কোনো কাজ হয়নি। সাথেই ভাগলপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। সেখানেও ডাক্তার দেখানো হয়েছে। কিন্তু ইলা ভালো হচ্ছে না। ইলার বাবা এখন ঠিক করেছেন ইলাকে একটা ফুল চেকআপ করাতে হবে। মেয়েটি দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে।

পরের দিন আরও কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। ইলার ছোট মামা এবং মামীর মোবাইল দুটিও পাওয়া যাচ্ছে না। নতুন আরেকটি হারপিক কেনা হয়েছিলো। সেটির পূর্বের দশা হয়েছে। হারপিকের কৌটা আছে; ভেতরে কোনো লিকুইড নেই। এসবের সাথে যোগ দিয়েছে একটি অভিপ্রেত খস খস শব্দ। শব্দটি একেকবার একেক জায়গা থেকে আসে। মাঝে মাঝে আসে না। শব্দ লক্ষ করে গেলেও সেখানে শব্দের উৎসের কোনো কূল-কিনারা পাওয়া যায় না। ইলার ছোট মামি শহুরে মেয়ে। তিনি ঠিক করেছেন এই বাড়িতে আর থাকবেন। মোটামুটি সবারই একটা ধারনা পাকা হয়েছে যে, এই বাড়িতে কোনো দুষ্টু ভূতের আছর পড়েছে। সে-ই এই সব কর্মকাণ্ড গোপনে করে বেড়াচ্ছে। আঃ রশিদ শিকাদার সাহেব প্রবীণ হলেও চিন্তা-চেতনায় একজন কমপ্লিট আধুনিক মানুষ। তিনি কোনো ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করেন। কিন্তু তিনিও এসব ঘটনায় উদ্বিগ্ন। গ্রামে দু’একজন যারা চুরি-ছ্যাঁচড়ামি করে তাদেরকে উনি অনেক প্রেসার দিয়েছেন কেউ মানুষ চুরি করেছে কিনা। কিন্তু তাদের কাছ থেকে তিনি কোনো তথ্যই উদ্ধার করতে পারেননি।

আর ইলার নানীও বসে নেই। তাঁর বদ্ধমূল ধারণা এইসব কর্মকাণ্ড ভুত-প্রেত ছাড়া সম্ভব নয়। তাই তিনি তাঁর ছোট ভাইকে দিয়ে ভিন গাঁ থেকে একজন ডাকসাইটে ভূত তাড়ানোর ওঝা কাম কবিরাজ নিয়ে আসলেন। বাড়ি জুড়ে হুলস্থূল কাণ্ড। ওঝা তাঁর সাগরেদদের দিয়ে পুরো বাড়ির চারপাশে তাঁর হাতের আশা দিয়ে রেখা টেনে দিলেন। সবাইকে বাড়ির বাইরে যেতে নিষেধ করে দিলেন। কেউ যদি তাঁর অনুমতি ছাড়া বাড়ির বাইরে যান, তাহলে তাঁর রক্ত বমি হবে। সাথে মারা পড়বে। অতঃপর ভেতর বাড়ির উঠানে আগুন জ্বালানো হলো। বেশ বড় আগুনের কুণ্ড। কয়লা আর কাঠ পুড়ানো হচ্ছে। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। সবাই চারপাশে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছেন। ওঝা ঘোষণা করে দিয়েছেন কিছুক্ষণের মধ্যেই এই বাড়িতে থাকা সমস্ত ভূত-প্রেত কে এই জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে পুড়িয়ে মারা হবে। সেই দৃশ্য সবাই সচক্ষে প্রত্যক্ষ করতে পারবেন। উত্তেজনার পর উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছে। কেবল আঃ রশিদ শিকদার সাহেবের এসব ভণ্ডামি ভালো লাগছে না। তিনি বারবার গিন্নীকে নিষেধ করেছেন। কিন্তু গিন্নী তাঁর কথা শোনেনি। দীনাও বাবার সাথে সহমত। কিন্তু মা –কে কিছু বলতে সাহস পায়নি।

ওঝা মন্ত্র পড়া শুরু করে দিয়েছেন। আগুনের মধ্যে ধূপ ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। ধূপের গন্ধে সমস্ত বাড়ি মৌ মৌ করছে। সবার চোখে-মুখে আনন্দ, উত্তেজনা, ভয়, আতংক। ইলা দীনার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আরশি, ঐশী এবং ইউশাও। তিথি, নাবিলা, সিয়াম, সিফাত ওদেরও আজকে বাড়িতে বেড়াতে আসার কথা। বিভিন্ন ধরনের বাদ্য যন্ত্র বাজছে। ওঝাকে এখন অতিমাত্রায় উত্তেজিত দেখা যাচ্ছে। তিনি ক্ষণে ক্ষণে উত্তেজনা বশে আকাশের দিকে লাফ দিচ্ছেন। খামচি দিয়ে একটা একটা করে ভূত ধরে আনছেন। আর চোখের পলক ফেলার পূর্বেই আগুনে নিক্ষেপ করছেন। আগুনে পোড়ার পর ভূতের আত্মা সাঁই সাঁই করে পালিয়ে যাচ্ছিলো। সেই পালিয়ে যাওয়ার শব্দ সবাই স্বকর্ণে শুনতে পেলেন। এভাবে সমস্ত ভূত মারা যাওয়ার পর ওঝা বাড়ির প্রত্যেক ঘরে, ঘরের সামনে পেছনে, আনাচে কানাচে ধূপের ধোঁয়া ছড়িয়ে দিলেন। সবশেষে তিনি ঘোষণা করলেন, আপনাদের বাড়ি আজ থেকে সর্ব প্রকার জিন, ভূত-প্রেত মুক্ত হলো। সবাইকে মেরে ফেলা হয়েছে। তাছাড়া আমি বাড়ি এমন ভাবে বন্ধন করে দিয়েছি যে, ভূত কেনো, ভূতের বাপ-দাদার সাধ্য নেই এই বাড়ির ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে পারে।। অবশেষে তিনি ইলাকে বিশেষ ভাবে ঝাড়ফুঁক দিলেন। বললেন, আর কোনোদিন এই মেয়ের বমি হবে না।

ইলার নানী মনে মনে খুব স্বস্তি পেলেন। দুঃশ্চিন্তা মুক্ত হলেন। দীনা কিছুটা বিভ্রান্তিতে পড়ে গেলো। বিশ্বাসও করতে পারছে না। আবার অবিশ্বাসও করতে পারছে না। শেষ পর্যন্ত মনকে এই বলে প্রবোধ দিলো যে, আচ্ছা দেখাই যাক না কি হয়! সবকিছু ভালো হলেই তো ভালো!!

০৪
কিন্তু ওঝা চলে যাওয়ার ঘণ্টা দুই পড়েই যখন ইলা বমি করতে লাগলো, তখন দীনার সমস্ত বিশ্বাস কর্পূরের মতো উড়ে গেলো। এদিকে দীনার ছুটি শেষ হয়ে গেছে। আগামীকালই সে ময়মনসিংহ ফিরবে। ইলাও দীনার সাথে ময়মনসিংহ আসার জন্য মনে মনে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। শুধু অপেক্ষা করছে কখন, কিভাবে কায়দা করে আন্টিকে প্রস্তাবটি দেওয়া যায়। ইলার দৃঢ় বিশ্বাস আন্টি নিশ্চয় না বলতে পারবেন না। ইলার ছোট মামারাও আগামীকাল ঢাকা চলে যাবেন। যাওয়ার আগে ইলার ছোট মামা তাঁর নানীর জন্য একটি সুন্দর মোবাইল হ্যান্ড সেট, কিছু খাবার-দাবার, সাবান-হারপিক সহ সংসারের নিত্য প্রয়োজনীয় প্রত্যেকটি জিনিস কিনে এনেছেন।
পরদিন সকাল বেলা দীনা বাথরুমে গিয়ে দেখতে পায়, হারপিকের বোতল শেষ। অথচ গতকালই কিনে আনা হয়েছে। মুহূর্তের মধ্যে খবরটি পরিবারের প্রায় সবার কাছে পৌঁছে যায়। এক ধরনের আতংক এমনিতেই সবার মাঝে বিরাজ করছে। তাঁর উপর এসব ঘটনায় সবাই এখন রীতিমত বিব্রত। চেষ্টা তো আর কম করা হয়নি। কিছুতেই কিছু হলো না। দীনা বাজিতপুর রেলস্টেশন থেকে চট্টগ্রাম হতে ছেড়ে আসা বিজয় এক্সপ্রেসে ময়মনসিংহ আসবে। ইতোমধ্যে টিকেট সংগ্রহ করা হয়েছে। ইলাও দীনার সাথে আসছে। ইলার আম্মু আসতে দিতে চায়নি। আব্বুও। তবুও ইলার জিদের কাছে তারা পেরে উঠেনি। সে আসবেই। তাছাড়া ডাক্তারও বলেছেন ওর বায়ু পরিবর্তন খুব জরুরি। আরও একটি কারণ আছে, অফিস ফেরত দীনা বাসায় একা একা থাকে, সময় কাটতে চায় না। ইলা থাকলে বেশ হয়।

ট্রেনে উঠার আগমুহূর্তে ইলা একবার স্টেশনে বমি করে দিলো। দীনার জন্য এটা খুবই বিব্রতকর পরিস্থিতি। তবুও তাঁর চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। আশার কথা বমি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। তারা ট্রেন ছাড়ার পূর্বেই উঠতে পেরেছে। পাশের সিটে বসা ভদ্রলোক দীনার সুপরিচিত। সিনিয়র কলিগ। নাম জনাব কছিম উদ্দিন। দীনার কলেজেরই সহকারি অধ্যাপক। জনপ্রিয় কবি এবং কথা সাহিত্যিক। হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ, চট্টগ্রাম থেকে মাস্টার্স ১ম পর্বের ভাইভা নিয়ে ফিরছেন। সদালাপী মানুষ। সহজ, সরল প্রকৃতির। দীনাকে দেখে খুব খুশি হলেন। দীনাও খুব খুশি। একটু পরেই ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। আস্তে আস্তে গতি বাড়তে লাগলো। পরিষ্কার আকাশ। কোথাও একরত্তি মেঘও নেই। চমৎকার প্রাকৃতিক আবাহন। সবে বসন্ত উকি দিয়েছে। রেললাইনের দুই পাশে প্রায়ই শিমুলের ফুল দেখা যাচ্ছে। গাছে গাছে নতুন পাতা, ফুল ও কুঁড়ি। বমি করতে করতে ক্লান্ত ইলা একটু পরেই আন্টির শরীরে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কছিম উদ্দিন স্যার দীনাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার সাথের মেয়েটি কে?স্যার ও আমার ভাগ্নি। একমাত্র বড় বোনের একমাত্র মেয়ে। মেয়েটি বুঝি ট্রেনে উঠার আগে বমি করছিলো? জী স্যার। কিছুদিন ধরে আমাদের বাড়িতে অনেক অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। কী রকম? দীনা সবিস্তারে প্রত্যেকটি ঘটনা বর্ণনা করলেন। ইলার বমি করা, মোবাইল হারিয়ে যাওয়া, খসখস, শব্দ করা, ওঝার ভোজবাজি কোনোকিছু বাদ দেয়নি। ট্রেন ইতোমধ্যে কিশোরগঞ্জ স্টেশনে এসে থেমেছে। কছিম উদ্দিন স্যার প্রত্যেকটি ঘটনা অত্যন্ত মনোযোগের সহিত শ্রবণ করলেন।

ইলা এখনও ঘুমুচ্ছে। দীনা একটু পর পর ইলার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। কছিম উদ্দিন স্যার কী যেনো ভাবছেন। উনি কবি-সাহিত্যিক মানুষ। ভাবাভাবিই উনার কাজ। তাই দীনা উনাকে বেশি ঘাঁটালেন না। বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা। অবশেষে দীনাই নীরবতা ভেঙ্গে জিজ্ঞেস করলো, স্যার কি ভাবছেন? কছিম উদ্দিন স্যার সম্বিৎ ফিরে পেলেন। বললেন, ও তোমার ঘটনাটাই ভাবছিলাম দীনা। কিছু পেয়েছেন স্যার? দীনা সাগ্রহে জিজ্ঞেস করলো। হুম, ঘটনাটির এক ব্যাখ্যা আমি দাঁড় করিয়েছি। তুমি হয়ত মানতে চাইবে না। কারণ তুমি ইলাকে খুব ভালোবাসো। আমি মানবো না কেনো স্যার? আপনি বলুন। যুক্তিসংগত হলে আমি অবশ্যই মানবো। কছিম উদ্দিন স্যার বলা শুরু করলেন, তোমাদের বাড়ির এই সমস্ত ঘটনার জন্য দায়ী হলো এই মেয়েটি। প্রত্যেকটি হারপিক ইলাই খেয়েছে। দীনার মোটেই সহ্য হলো না। সে শুরুতেই প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠলো। কী বলেন স্যার। আপনার কথা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। অসম্ভবের উপর অসম্ভব। এ হতেই পারে না। দীনার সুতীব্র প্রতিবাদ দেখে কছিম উদ্দিন স্যার হাসতে লাগলেন। প্রাণ খোলা হাসি। হাসতে হাসতে শেষে বললেন, আমার কথা যে ১০০% ঠিক আমি সেটা দাবী করছি না। আমি যা বলছি, সেটা আমার একটা হাইপোথিসিস। সাধারণতঃ ভুল হওয়ার কথা নয়। ঠিক আছে তুমি যেহেতু শোনতে প্রস্তুত নও, তাহলে আর আমি বলছি নে। দীনা সাথে সাথে তাঁর অবস্থান থেকে সরে এসে বললো, না স্যার। আপনি বলুন। আমি ধৈর্য ধরে শুনবো।

০৫
কছিম উদ্দিন সাহেব বললেন, প্রথমতঃ ইলা কোনো একদিন কৌতূহল বশত সামান্য পরিমাণ হারপিক ছেঁকে দেখেছে। মুখে নিয়েই ও বুঝতে পারে হারপিকের স্বাদটি তেতো নয়। কিছুটা টক টক। তবে সব মিলিয়ে স্বাদ মন্দ নয়। সেই থেকে শুরু। ও একটু একটু করে হারপিক খেতে শুরু করে দেয়। পরিমাণ সামান্য হওয়ায় এটা ওর শরীরে আস্তে আস্তে মানিয়ে যায়। একটা সময় এটা ওর নেশায় পরিণত হয়। ও হারপিকে আসক্ত হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে খাওয়ার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু যখনই পরিমাণ বেশি হয়ে যাচ্ছে, তখনই ওর লিভার সেটা কাভার করতে পারছে না। ফলে বমি দেখা দেয়। লিভারের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো, সে তার ধারণ ক্ষমতার বাইরে এবং অযোগ্য কোনোকিছু রাখবে না। বমির মাধ্যমে সেটা বের করে দেবে। অবশ্য এখানে মূল অনুঘটক হলো মস্তিষ্ক। সে-ই প্রথম সংকেত দেয়। এজন্য বমি মানুষের জন্য অনেক সময় বিরাট উপকারী হয়ে থাকে। বমি না হলে পাকস্থলী ফুলে যাবে। প্রসাব, পায়খানার নানা জটিলতা দেখা দিবে। এমন কি মৃত্যুও হতে পারে।

আমি কি একটি প্রশ্ন করতে পারি স্যার? দীনা বললো।
হুম। কেনো নয়। অবশ্যই করতে পারো।
হারপিক খেলে তো স্যার ওর মারা যাওয়ার কথা?
একদম খারাপ বলোনি তুমি। কিন্তু হয়েছে কি তুমি যদি পরিমাণের কম বিষও খাও; তোমার শরীরে সামান্য উপসর্গ দেখা দিতে পারে। কিন্তু তুমি মারা যাবে না। তারপর আস্তে আস্তে বিষের পরিমাণ নির্দিষ্ট মাত্রায় বাড়িয়ে দাও। একটা সময় দেখবে তোমার শরীর এই মারাত্বক বিষকেই কনজিউম করে নিচ্ছে। কিছুদিন আগের একটি ঘটনা, তুমি হয়ত শোনে থাকবে একটি লোককে কিং কোবরা কামড় দেয়। সবাই অস্থির। চিৎকার, চেঁচামেচি, ডাক্তার এসব চলছিলো। কিন্তু যাকে কামড় দিয়েছে তাঁর কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। সে হাসছিলো। পরে দেখা গেলো লোকটির কিছুই হয়নি। আসলে কথায় বলে না, শরীরের নাম মহাশয়। যাহা সহাবে সে তাহাই সয়।
দীনা আর কোনো প্রশ্ন করলো না। স্যার বলতেই থাকলেন, দ্বিতীয়তঃ মোবাইল চুরির বিষয়টি। দীনা তোমাকে বলতে ভয়ই পাচ্ছি। কারণ তুমি খুব রিয়েক্ট করো।

না স্যার। আমি আর রিয়েক্ট করবো না। আপনি বলুন।
স্যার আবার বলা শুরু করলেন। ধন্যবাদ তোমাকে। তুমিই বলেছো ইলার মা-বাবা দুজনেই চাকুরী করেন। উনারা ইলাকে সময় দিতে পারেন না। তোমার মা-বাবাই উনার একমাত্র সঙ্গী। তুমি খেয়াল করলেই দেখবে স্কুলের সময়টা ওর খুব ভালো লাগে। কিন্তু বাসায় আসলেই ও একদম বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। কারণ তোমার মা-বাবা ওকে পর্যাপ্ত দিতে পারছেন না। উনারাও নানা কাজে ব্যস্ত থাকেন। উনাদের দিয়ে ইলার বা-বাবার অভাব পূরণ হচ্ছে না। ইলা অনেক সময় তোমার আম্মুর মোবাইল অথবা তোমার আব্বুর মোবাইল দিয়ে ওর মা বাবাকে কল দিতে চেয়েছে। কিন্তু নানা কারণে দিতে পারেনি। হয়ত মোবাইলে ব্যালেন্স নেই। কিছু মনে করো না দীনা হয়ত ওর নানা-নানী ওকে মোবাইল ব্যবহার করতে দেয়নি। অথবা ওর বাবা-মা কল রিসিভ করেনি ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক কারণে মোবাইল নামক এই যন্ত্রটির প্রতি ইলার মন বিষিয়ে উঠেছে। আসলে বিষণ্ণতার চেয়ে বড় ঘাতক আর নেই। যে বয়সে তার মা-বাবার আদর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন; সেটা সে পাচ্ছে না। তাই ও এখন দিন দিন ক্ষেপে যাচ্ছে এবং একরকম মানসিক সমস্যার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তুমি একটু খেয়াল করলেই দেখতে ইলা অনেকদিনই তার মাকে চাকুরী ছাড়তে বলেছে। এই কথা শোনে দীনা বললো, স্যার আপনি জানলেন কিভাবে? আমার সামনেই ও অনেকদিন এই কথা বলেছে। স্যার আর একটি প্রশ্ন করি। হুম একটি নয়। তোমার যতো জিজ্ঞাস্য আছে সব বলো।

স্যার মোবাইল গুলো ও কী করেছে? খুব কঠিন প্রশ্ন দীনা। উত্তর দেওয়া মুশকিল। তবে আমার ধারণা, মোবাইল গুলো সে পুকুরের পানিতে ফেলে দিয়েছে। ওর জিদ একটাই, সে যেহেতু এই মোবাইল দিয়ে কথা বলতে পারবে না। সুতরাং অন্য কাউকেও কথা বলতে দিবে না। হতে পারে স্যার। এখন আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি।
কছিম উদ্দিন স্যার বললেন, তুমি ওকে হাতে নাতে ধরতে চাও দীনা?
জী স্যার। কিন্তু কিভাবে?
এখন তুমি বাসায় ফেরার সময় ওর সামনেই একটি হারপিক কিনবে। সেটা নিয়ে তোমার টয়লেটে রাখবে। তারপর দেখো কী হয়! এই বলে স্যার হা হা হা হেসে উঠলেন। সেই সুউচ্চ হাসির শব্দে ইলার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ট্রেনও ময়মনসিংহ রেলস্টেশনের কাছাকাছি এসে পড়েছে। সবুজ বাতি দেখা যাচ্ছে।

০৬
দিন দুই পরে একদিন সারারাত বৃষ্টি হয়েছে। কলেজ রোড পানিতে সয়লাব। কলেজ রোডের বেশ কিছু সমস্যার মধ্যে এটিও অন্যতম। অবশ্য আশার কথা হলো এই সময়টাতে রিকশার কোনো অভাব হয় না। অসময়ে দুধের মাছের মতো। যেমন খুশি দাম হাঁকানো যায়। ইচ্ছা হলে যাও, না হলে না যাও। দীনা রিকশার ভাড়া ঠিক করছিলো। এমন সময় কছিম উদ্দিন স্যার। তিনি অফিসে যাবেন। কাকতালীয় ভাবে দুজনেরই সকাল নয় টায় ক্লাস। দীনা সালাম দিলো। স্যার জিজ্ঞেস করলেন, কি খবর দীনা?

স্যার বিশ্বাস করবেন না, আপনার কথাই মনে ভাবছিলাম। সেদিন আপনার কথা মতো আমি একটি হারপিক কিনে তবেই বাসায় গিয়েছিলাম। তারপর স্যার আপনার কথাই ঠিক স্যার। আমি হাতেনাতে ধরেছি। ও খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু আমি ওকে তেমন কিছু বলিনি স্যার।
তুমি ঠিক করেছো। ওকে এখন তুমি সঙ্গ দাও। সব সময় অব্জারভেশনে রাখবে। ওর পছন্দ মতো চকলেট, চুয়িংগাম, চকলেটবার মাঝে মাঝে ওকে খেতে দেবে। মনে রাখবে ও এখন এক প্রকার নেশায় আসক্ত। তুমি ওকে এখানে এনে খুব ভালো করেছো। আমার সাথে একবার আলাপ করিয়ে দিও।
অবশ্যই আলাপ করিয়ে দেবো। স্যার আরও একটি কথা, সবগুলো মোবাইল কুমির দীঘিতে পাওয়া গেছে। কিন্তু স্যার একটি বিষয় বুঝতে পারলাম না।
কছিম উদ্দিন স্যার বললেন, কোন্‌টা?
এই যে স্যার একটা খসখস শব্দ প্রায়ই হতো!!

ওটা কিছু নয়। ইঁদুর, বিড়াল, চিকা ওরা এমন শব্দ করে থাকে। বিশেষ করে ওই সময়টাতে তোমার কেউ স্বাভাবিক চিন্তা করোনি। তাই যে কোনো স্বাভাবিক শব্দ তোমাদের কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়েছে। এই কছিম উদ্দিন স্যার স্বভাব সুলভ হা হা হা করে হেসে উঠলেন। দীনাও সেই হাসিতে যোগ দিলো।।

আসলে গল্পটি এখানেই শেষ হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু শেষ হয়েও হইল না শেষ! ইলার হারপিক খাওয়ার এই ঘটনা এক কান, দুই কান করতে করতে সারা গ্রামে সাড়া তুললো। কিছু মানুষ খুব সহজেই বিশ্বাস করে নিলো এই মেয়েটির মধ্যে একটি সহজাত ঐশ্বরিক ক্ষমতা আছে। সেই ক্ষমতা বলেই সে হারপিকের মতো বিষ খেয়ে হজম করতে পেরেছে। বেশ আর যায় কোথায়? সরল বিশ্বাসে অনেকেই ইলার কাছে পানি পড়া সহ বিভিন্ন কাজে আসতে লাগলো। ঐশ্বরিক ক্ষমতা বলে কথা!!
——————-

মরা ব্যাঙের নাচ

মাঝে মাঝে আমায় বোবায় পায় বলে বাক্যি হরে যায়। মুখে তখন একটা অদৃশ্য ‘কালা হাতে’র মতো সেলোটেপের অস্তিত্ব টের পাই, আর বুকের উপর দিয়ে গোদা পায়ে কেউ নির্ঘাত হেঁটে চলে যায়। কারো কোনো প্রশ্নের উত্তরে একখানা অক্ষর পর্যন্ত মুখের পেট থেকে খসাতে যন্ত্রণা ও চরম অনিচ্ছা। ফলত অন্তর্জলি যাত্রায় বসা লোককে গঙ্গোদক দেবার সময় যেমন নূন্যতম ঠোঁট ফাঁক করে ঢেলে দেওয়া হয়, আমিও তেমনি আধমরা ঠৌঁট ফাঁক করে উত্তর দেব দেব করতে করতেই টাইম আপ! মাঝে মাঝে মনে হয়, এই আমি আসলে মুখ ভেটকে গেলাস ভর্তি নিমপাতার রস গেলার মতো একটা এক্সিসট্যান্স। সুতরাং কথা খরচ করতে হলে আমি একেবারেই নাচার।

একই অবস্থা হয় লেখার বেলাতেও। একখানা অক্ষর লিখতেও আঙুল চলে না। খাতায় কলমে লেখা তো কবেই বিগত শতাব্দীর গোলাপফুল আঁকা মরচে ধরা তোরঙের মতো গতায়ু হয়ে চিলেকোঠার ঝুল ধুলোয় কিছুটা কেতড়ে পড়ে আছে। তার উপর ঠাকুমার গায়েহলুদে পাওয়া মাদুরখানা কাঠি ও সুতোর বাঁধন আলগা হয়ে গুটনো আছে মণখানেক ধুলো মেখে। তাকে দেখে মনে হবে একদা অষ্টাদশী বিয়ের কনেটি রূপ-যৌবন ও তৎসহ পেশিটেশি হারিয়ে ঝুল, মানে ঝুলঝুলে চেহারাপ্রাপ্ত। খাতা-কলম জিনিস দুটোর এখন অনেকটা সেই দশা। কেবল মাঝে মাঝে সরকারী ফাইলের অন্তবিহীন গতিহীন লাইনে লাইন লাগানোর জন্য দরখাস্ত-টরখাস্ত লিখতে দরকার লাগে। তো লিখতে ইচ্ছে করে না যেমন তেমন বিষয়, তার থেকেও বড়ো কথা হলো মনে হয় যেন লিখতেই পারব না। – আমি লিখতে জানিই না – কোনো দিন লিখিইনি! এসব ভাবনার পাশাপাশি প্রচন্ড একটা ভয় জেঁকে বসে।

ধরুন, আমার পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোবে। বড়দি ক্লাসে ঢুকছেন, এক্ষুণি রেজাল্ট ঘোষণা হবে। আর ভয়ে আমার হাত-পা কাঁপছে। মানে চোখ মাথায় উঠে গিয়ে মাথা লাট্টুর মতো ঘুরছে আর থেকে থেকে দ্যাখ বাবাজী দেখবি নাকি করে চোখের সামনে অন্ধকারের ভেতর বিদ্যুত ঝিলিক মারছে। কারণ আমি তো জানি, কী হতে চলেছে! ক্লাস ফাইভে অঙ্কে ছিলাম গ্যালিলিওর জ্যাঠাইমা। অঙ্ক পরীক্ষা দিয়ে ঘন্টা পড়ার দশ মিনিট আগে হল থেকে বেরিয়ে এসেছি এবং অনেক হিসেব করে আমার ধারণা দৃঢ় হলো অঙ্কে চব্বিশ পাবো। কিন্তু সবথেকে বড়ো ট্রাজেডিটা হলো, অঙ্কে মেরেকেটে তিরিশ পেলেও আমি প্রথম বা দ্বিতীয় স্থানে গেঁটিয়ে বসতে পারতাম। কেন, কীকরে সে অন্য গপ্প। তো বারফাট্টাই থাক। বড়দি তো রেজাল্ট বলছেন, – বলছেন – ভালো ভালো রেজাল্ট বলা হয়ে গেল, নিজের নামটা কানে শুনলাম না। নাকি নিজের নামটাই ভুলে গেছি রে, বাবা! তাহলে কি আমার ধারণাই ঠিক? টেনশনে নন-সেন্স হবার মুখে প্রায় সব শেষে একটা বিষয়ে ফেল মেরে উত্তীর্ণ হবার ঘোষণায় আমার নাম এক্কেবারে পেত্থমে! হুঁ হুঁ বাবা! এরপরের ঘটনা ইতিহাস। অঙ্ক শিখি যে কাকুর কাছে তাঁর কাছে যথেষ্ট পরিমাণে উত্তমমধ্যম খেয়ে মুখের ভূগোল পাল্টে গেল বটে, ক্লাস সিক্সে কিন্তু এ শম্মাই অঙ্কে হায়েস্ট নম্বর পেল এটাও মনে রাখবেন! তবে জীবনে ওই একটিবার। তারপর মাধ্যমিক পর্যন্ত ঘষটে ঘষটে মাজা ব্যথা নিয়ে অঙ্ক টপকেছি।

কিছু মনে করবেন না, এক কথা বলতে বসে অন্য কথায় কিস্যা বহুদূর চলে এলো। একেবারে “শিবেরগীত” শেষ করে বাঁকের মুখ থেকে ফেরৎ আসছি। যা বলছিলাম, লেখার ভয়ে তো হার্টবিট মাথায় ফিল করি আমি। নানা জায়গাতেই ফিল করি, এমনকি যেখানে হার্ট আছে তার ঠিক উল্টো দিকেও ঢিপ ঢিপ করে। মানে বাম দিকের বুকের পাঁজর পার করে পিঠের দিকে হার্টবিট চলে।

দূর ছাই! আবার ফালতু বকছি! বলছিলাম লেখা ও কথা মাঝে মাঝে মনের ভেতর হুুড়কো লাগিয়ে অন্ধকারে চুপ করে বসে থাকে। সন্দেহ হয়, অ্যালঝাইমার হলো নাকি! একটা শব্দ, একটা ইনিয়ে বিনিয়ে বাক্য – কিচ্ছু মনে পড়ে না মাইরি! অথচ বিদ্যাসাগর মশাই বর্ণপরিচয় দ্বিতীয় ভাগে লিখেছিলেন – ঐক্য বাক্য মাণিক্য। কিন্তু আমার তো সব ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। হার্ট ফুসফুস কিডনি মগজ – সব ছতিচ্ছন্ন। সুতরাং ঐক্য ও বাক্যের হাত ধরাধরি প্রেমের মাণিক্য আসবে কোত্থেকে?

অথচ কথার চাষ চলছে দুনিয়াময়। কত ধরনের কথা। রূঢ়, প্রেমময়, স্নেহময়, তৈল নিষিক্ত ইত্যাদি ইত্যাদি। সামাজিক মাধ্যমগুলোতে খুব ভালো উপলব্ধি হয় উক্ত ধরনগুলি। আর দরকারী কথা বাদ দিয়ে ফালতু কথায় তীরের মুখ ঘুরিয়ে দিতে পারে, না-কে হ্যাঁ, আর হ্যাঁ-কে না, দিনকে রাত, রাতকে দিন করতে পারে এমন এলেমদার কি কম পড়েছে? রাজনীতির লোকেরা আছেন তো! পড় পড় পড় পড়বি পাখি ধপ! – চোখ সরু করে মনে মনে বীজমন্ত্র আওড়ালেও, পাবলিক প্লেসে কথা বলার সময় সাধারণত কপালের চামড়ায় ইস্ত্রি মারা থাকে।

আর যারা কথা বেচে খান, সে সেক্টরটাও নেহাৎ কম যায় না। কাউকে একটুও ছোট করার নটখটামি না করেই হাত তুলছি, ছাড়ুন তো – কথা বেচতেও “এলেম” লাগে আগেই বলেছি! সংবাদমাধ্যম এ ক্ষেত্রে এক নম্বরে। কত সূক্ষ্ম হিসেব কষতে হয় বলুন তো? দল, অর্থ, টিআরপি, কাকে চটাবে, কাকে রাখবে – তেমন তেমন ঘটনা ঘটে গেলে অচানক চানক্যবাজি সহজ নয়। আরও আছে, শুধু ওরাই যে নন সে যে বাপু আর বলে দিতে হবে না, তা আপনারা খুব ভালো করেই জানেন।

দুঃখ হচ্ছে, “কথা বেচে খাওয়া” লোকজনের কথা বাদ দিলে কথার চাষ অধিকাংশ সময় শব্দদূষণ ছাড়া কিছুই করে না। কারণ ঠিক কথাটা ঠিক সময়ে আমরা সম্মিলিতভাবে বলতে পারি না। হয়তো বা বলতে চাইও না। ছা-পোষা মানুষ আমরা, বাঁশ খেতে চাই না, বড়ো ভয় পাই কার লেজে কখন পা পড়ে যাবে ঠিক কী! হতে পারে সে কোনো গনহত্যা বা এককের উপর অবিচার। হতে পারে কোনো কোটি কোটির ঘাপলা কেস। আমরা ফুটানি করি, ট্রোল করি, ফাজলামি করি – এই পর্যন্ত। আবার ধরুন, হয়তো আপনাকে কেউ বেশ দু-কথা বলল, আপনি ঠিকই বুঝলেন, সে লোক যতই দাঁত কেলিয়ে বলুক না কেন, কথাখানা অপমানেরই। অথচ আপনিও দাঁতটাই কেলালেন, কিন্তু উপযুক্ত যে কথা দিয়ে তাকেও আচ্ছা করে কেলানো যেত, সেটা পরে মনে করে নিজের মনেই ফুঁসবেন। তখন গালাগালটা যে অ্যাকচ্যুয়েলিই কেবল নয়, বরং “দুইচ্যুয়ালি”ই নিজেকেই দেওয়া উচিত সেই মুহূর্তে ফিল করে নিজের গালেই চড় কসাবেন।

কথা না বলেও যথেচ্ছ প্রতিবাদ করা যায় বটে! ভেরকরের বই পড়েছিলাম, সাইলেন্স অফ দ্য সি। অনেকদিন আগে পড়া। স্মৃতি ল্যাং দিতে পারে, তবু যদ্দূর মনে হচ্ছে ঘটনাটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে। ফ্রান্সের এক গ্রামে জার্মানীর সৈনিকদের সঙ্গে কেউ একটি কথাও না বলে নিরুচ্চার ঘৃণা দিয়ে তাদের ইগো দুরমুশ করে দিয়েছিল গ্রামবাসী। তাই কথার সঙ্গে সঙ্গে নৈঃশব্দও হাতিয়ার হতে পারে ক্ষেত্রবিশেষে। আমরাও যদি পারতাম, অসৎ রাজনীতির লোকেদের নিঃশব্দে উপেক্ষা করতে!

সংসার রাজনীতিতে কথার চাষাবাদ, সার-চাপান, ল্যাং মারামারি হামেশাই চলে। কুরুক্ষেত্র রণাঙ্গনের কিংবা রামায়ণের যুদ্ধুর ব্রহ্মাস্ত্র, দিব্যাস্ত্র, ব্রহ্মানন্দ অস্ত্র, শিলীমুখ, ঐশিক, অশ্বমুখ ইত্যাদি হরবখতই কথার ধনুকে পরিয়ে বেমক্কা ছোঁড়াছুড়ি চলছে। তাতে ঘায়েল হয়ে অসার জীবনসহ দিল দরিয়ায় ভেসে যেতে চায় বটে, তবে অচিরাৎ মৃতসঞ্জীবনী আমাদের দিব্যি বাঁচিয়ে তোলে। বেড়ালের নটা জীবন তো সংসার রণাঙ্গনে বাঁচার ফিরিস্তির তুলনায় নস্যি।

তবু এক একসময় দুম করে আঁতে লেগে যায় বইকি! তখন মনে হয় কে আমি, আমি কার। দারা পুত্র, থুড়ি পতি কন্যা কে কার!

সবমিলিয়ে জীবনের সারসত্য আবিষ্কার হয়েছে ধীরে ধীরে। আমাজনের জঙ্গলে খিদে তেষ্টায় কাতর পথহারা আবিষ্কারকের থেকে কম অভিজ্ঞতা লাভ হয়নি সেজন্য। এই অভিজ্ঞতা থেকে অর্জিত প্রত্যেকেরই প্রায় নিজস্ব পাদটীকাটি হলোঃ এযাবৎ ভুবনে ভ্রমে ভ্রমণ করেছি।

যে চুলোর পাড়ে গেলে সত্যি সত্যি মানবজনমের সোনা ফলে তেমন কোনো চুলোর পাড় তো জোটে না। তাই সমাজ ও সংসারের চুলোয় দিবারাত্র পুড়ে কয়লা হতে হতে কখনও কখনও বোবায় ভর করে। অথচ শেষ পর্যন্ত কোথাও যাই না আমরা। অশ্বডিম্ব প্রসব করে কাঁটার মুকুট পরে জীয়ন্তে আমরা জলে ডোবা মৃতদেহ। ফুলে ঢোল উপুড় হয়ে ভাসছি চারদিকে নাচতে নাচতে। পুব থেকে হাওয়া বয় নাচতে নাচতে ঘুরে যাই পশ্চিমে। পশ্চিম থেকে হাওয়ার তালে পুবে। এইভাবে চারদিকে ঘুরে ঘুরে মরা ব্যাঙের নাচন নাচছি – যে মরা ব্যাঙের ভেতর একদা বিদ্যুৎ ছিল।

মরা ব্যাঙকে নাচিয়েছিলেন বিজ্ঞানী লুইজি গ্যালভানি জীবদেহে বিদ্যুতের অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে গিয়ে। কোনো গ্যালভানি কোনো একদিন কি আমাদের আগাপাশতলা এমনই বিদ্যুৎ ফুঁড়তে পারেন না, যাতে আমরা নড়ে উঠতে পারি চরমভাবে বিদ্যুৎবাহিত হয়ে? কে জানে, কখনও হবে কিনা! তা যদি হয় কোনোদিন, তবে হয়তো কথার উৎসমুখ খুলে গিয়ে আমাদের অসহ্য এই নোনাধরা জীবনে আর কখনও তাকে বোবায় পাবে না।

(প্রকাশিত)

জিততে গেলে হেরে যাব

চার
শিমূলগাছের শেকড় থেকে উড়ে আসছে পিন্টু; উড়ছে ব’লে অবিরাম সাইকেলচালনার দিনে খোঁড়া গর্ত, ছাগলবাঁধার খুঁটো, একতাল গোবর — কিছুই তাকে থামাতে পারছে না। পৃথিবীর দীর্ঘতম রান-আপ নেওয়া বোলার হয়ত পিন্টুই। মাঠের শেষে একটা ছোট নালা, ওপারে রাস্তা, তার পেছনে ঝোপঝাড়। ব্যাটসম্যান বুঝে পিন্টু অনেক সময় সেই অরণ্য ফুঁড়েও টেক-অফ করে। ক্যাম্বিজ বল আর বাঁশের চটা কেটে বানানো উইকেটের মধ্যে যে দাঁড়িয়ে, তাকে সরানোর জন্যে সে জীবন দিতে রাজি।

ডেলিভারি দিয়েই পিন্টু দাস, ক্লাস সেভেন, গাজন-সন্ন্যাসীর মতো উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। খুব বেশি আত্মাহুতি সহকারে বল করলে এমন হয়। ওদিকে চাঁদ হাফ ক্রিজ পর্যন্ত দেখতে পেল বলটা আসছে। এরপর সে অন্ধ হয়ে যায়। কোথায় ড্রপ, কোন স্ট্যাম্পে পড়বে এসব তথ্য না পেয়ে তার মাথা একশোভাগ আন্দাজের বশে শরীরকে চালিত করে। এবারও হাফ প্যান্টের নীচে ডান হাঁটু ভাঁজ খুলে হালকা এগোল, নজরুলমিস্তিরির বানানো লৌহশালকাঠের ব্যাট মুখ বের করল পায়ের পেছন থেকে এবং ঘটে গেল হলুদ ক্যাম্বিজের সঙ্গে নিখুঁত আঘাতময় হ্যান্ডশেক। মনে হতে পারে বলটাই অংক ক’ষে ছুটে এসে তার ব্যাটে ঘা মেরেছে। একজন দর্শক চেঁচাল, আরে আস্তে বল কর। বাচ্চা ছেলে, লেগে যাবে।
— বাচ্চা ছেলে? হুঃ! পুরো বিটিশ মাল। আউট ক’রে দেখাও দেখি।

চাঁদের জীবন মানে অর্ধেক জানা আর অর্ধেক ভাবনা। কিছুটা বোঝার পর সে বাকিটুকু আইডিয়া ক’রে দ্যাখে — যা ভেবেছিল, মিলে গেছে। সত্যি বলতে, কোনও কিছুরই শেষ দেখা যায় না, তামাম দৃষ্টিগোচর করতে গেলে এক অন্ধত্ব চেপে ধরবে। সত্তার অথৈ জায়গায় চাঁদ দৃষ্টিহীন, সেই তমসার ক্রমপ্রসার হয়ে চলেছে। কল্পনা দিয়ে সে প্রাণপণে নিজের গা-ভর্তি অন্ধকারকে আটকাতে চায়।

পাঁচ
আহ, ব্যাটেবলে হতেই গ্রিপে একটা বিনবিনে ঝাঁকুনি কী যে আরামের! মাঠভর্তি ফিল্ডিং খাটছে আজাদ হিন্দ ক্লাবের পুজো-সেক্রেটারি রঞ্জনমামা, কোলকুঁজো ভাইডি, দোতলাবাড়ির বড়লোক বিশ্বরঞ্জন, ট্রেনে রুদ্রাক্ষ বিক্কিরি করে জয়ন্ত; আর ভালো ক’রে সাত বছরও হয়নি একটা বাচ্চা তাদের টাকাপয়সা, মস্তানি ব্যর্থ ক’রে দিচ্ছে গোটা বিকেল ধ’রে। আরও বেশি শহিদ-মনোভাব নিয়ে রান আপে ফিরে যাচ্ছে পিন্টু, হাবুল এত ছোট সিলি পয়েন্টে উবু হয়েছে যে বোলারের ডেলিভারি তার পেছন শুলিয়ে দেওয়ায় হা-হা অট্টহাস মাঠে। খেলায় এতক্ষণ এলবিডবলিউ ছিল না, এবার “পায়ে লাগলে আউট কিন্তু”। ওমনি রাজনৈতিক নির্দেশ আসছে, পায়ে মার। সেরা চোট্টা মানিক মালো উইকেটের পেছনে হুমড়ি খেয়ে; চাঁদ একটা বল ফসকালেই অফ স্ট্যাম্প হাত দিয়ে ফেলে দাবি করবে — বোল্ড! সেও হচ্ছে না দেখে মানিক বোলারকে ইশারা করল বাম্পার দে, চাঁদ ব্যাকফুটে আসতেই লেগের বেল খসিয়ে দিয়েছে — যাও, হিট উইকেট! মাঠে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ার হাততালি, কেউ দৌড়ে যাচ্ছে শয়তানটার ব্যাট কেড়ে নেবে, সেই মুহূর্তে চক্ষুলজ্জাপূর্ণ সেক্রেটারি বলল, ভ্যাহ্‌, ওকে খেলতে দে। কলকাতা থেকে বেড়াতে এসেছিল একটা ভোটকা-মতো লোক, পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে দেখে বন্ধুকে : পুরো এম এল জয়সিমা!

পিন্টু শুনতে পেয়েছে।
— ল্যাটা ব্যাটসম্যান না? উইকেট গার্ড ক’রে খ্যালে। ডান হাতে খেলুক, চ্যালেঞ্জ দিলাম — এক বলে প্যাভিলিয়ানে ফেরত পাঠাব!

ওসব বাতেলা পরে। এই চাঁদ, এবার ছাড়; পার্টি ক’রে খেলা হবে।

ইশ, আজ তার হাত একদম জ’মে গেছিল; টানা রুখে যাচ্ছিল বলের অপরাধ প্রবণতা। উইকেট ভেঙে যাওয়ার মধ্যে একটা সন্ত্রাস আছে — বাড়ির খোড়ো চালে দাঙ্গার আগুন লাগিয়ে দেওয়ার মতো। তখন গৃহস্থ যেভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে ছুটছে, ব্যাটসম্যানকেও ক্রিজ ছেড়ে পালাতে হয়। ব্যাটিং ক্রিজ মানে ঠাকুরের থান, লক্ষ লক্ষ মানুষ এখানে ব্যাট ঠুকেছে, একটা কাঁকর জমতে দেয়নি; এবং পরিস্থিতির দাবি মেনে নিজেকে নিয়ে গেছে কখনও কেল্লা কখনও গোলাবারুদের ভূমিকায়।

ছয়
চাঁদপ্রতাপ সারা জীবন চিতোরের দুর্গ হয়েই থাকতে চায়। কলোনি-কিশোরদের দুজন নিতাই আর বলাই ক্যাপ্টেন হয়ে পার্টিভাগ করছিল। নিতাইয়ের বাবা আর বলাইয়ের মা ভাইবোন। মামার ছেলে নিতাই প্রথমেই ডাকল — চাঁদ। ভুল হল, কম্পিটিশান ম্যাচে ভাইডি বা সুরজিতের মতো তাড়ু ব্যাটসম্যান নেওয়া উচিত, চাঁদ তো চার মারতেই পারে না।

টসে জিতে মাসির ছেলে বলাই ব্যাটিং নিতেই খালি গায়ে মায়ের শাড়ি পরা ভাইডি ওপেনিংয়ে। কাপড়ে বল আটকে যাবে আপত্তি আসায় সে মালকোঁচা মেরে নিচ্ছে। এবং বোলারের মুখোমুখি দুপা ফাঁক ক’রে দাঁড়িয়ে মাঝখানে লুচিভাজার ঝাঁঝরি-হাতায় বলটা নিয়ে উইকেটকিপারের মাথা টপকে বাউন্ডারিতে পাঠিয়ে দিল। হু-হু ক’রে রান উঠছে দেখে মাসির ছেলে এই বেআইনি অরাজক ব্যাটিংয়ের প্রতিবাদ করে, খেলা তিন মিনিট বন্ধ থেকে আবার শুরু হয়।

একা ভাইডিই মামার ছেলের দলের রানকে লোভনীয় জায়গায় নিয়ে গেছে। এবার মাসির ছেলে ওপেনিং-এ দলের শ্রেষ্ঠ হয় ছক্কা নয় ফক্কা প্লেয়ারের সঙ্গে এক দিক ধরে থাকবি-কে নামিয়ে দিল। চাঁদ মর্যাদা সহকারে ঠুকে যাচ্ছে, ক্কচিৎ ব্যাট কাত ক’রে স্লিপের মাঝখান দিয়ে বাউন্ডারি ওয়ান; কিন্তু শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হচ্ছিল স্ট্রোক মেকাররা। ফোকলা দাঁতের মতো তাদের মিডল স্ট্যাম্প উড়ে যাচ্ছে, অথবা কারও তীব্র হাঁকড়ানো বাড়ানো হাতে জমিয়ে নিল ফিল্ডার। তখনও সন্ধে মিনিমাম আধঘন্টা দূরে, জিত আঠাশ রান তফাতে, ব্যাটসম্যানেরা প্যাভিলিয়ন নামের ওলটানো জংধরা বাতিল রেলের পাটির ওপর। একা চাঁদ নট আউট ব’লে ম্যাচ খতম হয়নি।

এই রকম সংকটে বাবা-কাকারাও দাঁড়িয়ে যায় মাঠের পাশে, পতৌদি-চন্দ্রশেখর-সেলিমদুরানি পর্যায়ে চলে যায় স্থলযুদ্ধের গভীরতা। ফিল্ডাররা চাঁদকে প্রণাম-দূরত্বে ঘিরে আছে আর সে হোমিওপ্যাথির সূক্ষ্ম মাপে নিজের আবছা চোখদুটো বসিয়ে নিয়েছে ব্যাটের গায়ে। নির্যাতিত ঘাসের গন্ধ, নিকেলের মতো বিকেল, লেগসাইডে শাপলাপাতার সরপড়া পুকুর — সবকিছুর মাঝখানে বল বোলারের চেয়ে ব্যাটসম্যানের ঘনিষ্ঠ হতে চাইছে বেশি। দর্শকদের মধ্যে এসেছে কানাইস্যার, নিবাধুই স্কুলের গেমস টিচার :
— ওডারে কী কয়, খ্যালা না ক্যালা? তহোন থে’ কুলো পাতে যাচ্ছিস মায়েগোর মতো! মারবি কবে?

পরের বলটা হাঁকাতে যায় চাঁদ, মিস ক’রে এক চুলের জন্যে বাঁচে। ডাঙশের মতো ভারি ব্যাট চাগাতে গেলে ব্যাক লিফট নামার আগেই বল উইকেট ভেঙে দেবে। খালি পায়ে মাটির ঠান্ডা তাত নিতে নিতে সে আবার ঝুঁকে স্টান্স নেয়। পেছনের তিনটে উইকেট আসলে মা-বাবা-দিদিমা, অথবা তার তিন দাদা-দিদি। তাহলে ছোটবোন কী হবে? গোপু একটা বেল, আর একটা বেল কিশমিশ, যদি কোনও দিন ফিরে আসে!

সাড়ে পাঁচটা বাজতেই মাসির ছেলে চিৎকার পাড়ছে : খেলা বন্ধ, ম্যাচ ড্র। মামার ছেলের কড়া প্রতিবাদ — বন্ধ কিনা, একমাত্র আম্পায়ার বলতে পারে। অনেক চাপাচাপির পর রঞ্জনমামা বুঝিয়ে দিল, ব্যাটসম্যানকেই ‘আলোকাভাব’ ব’লে তার কাছে আবেদন করতে হবে। শব্দটা কলোনিতে কোনও জীবজন্তুপশুপাখির মুখে শোনা যায় না, চাঁদ তারক ডাক্তারের বাড়ি দৈনিক বসুমতী পড়তে যায় ব’লে জেনেছে। ক’দিন আগেই তো ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে টেস্টে মনসুর আলি খান পতৌদি গোপালকৃষ্ণণকে অনুরোধ করেছিল। খান না খাঁ; পতৌদি, পাতৌদি নাকি পতাউদি — এসব কনফিউশান মাথায় নিয়েই তাকে দলের চাপে ভারত-অধিনায়ক হতে হয়। তারপর সবাই চাঁদের পিঠ থাবড়ে দিচ্ছে; মাসির ছেলে বলছে, কেন কুলোপাতা প্লেয়াররে নিছিলাম, এবার বুঝিছো? আর ফাস্ট বোলার পিন্টু :
— সুব্রত-র ফুলটস বলও ঠুকে দিচ্ছিলিস কেন, এগিয়ে এসে মারবি টেনে ছয়! আর তো মোটে আট রান বাকি ছিল, জেতার চেষ্টা করলি না?

এখনও দিগ্বিজয়ের সময় আসেনি! ইশকুল, তারপর নাকি কলেজ, তারপর চাকরি, তারপর যতখুশি আইসক্রিম, চিটে গুড়, বুটভাজা বিজয় করো। নাকেমুখে ঘুষি খেয়েও পুরো বারো রাউন্ড টিকে থাকা মানেই কেল্লা ফতে, তারই বয়েসি বলরামকাকুর মেয়ে কর্ণফুলির মতো হঠাৎ নাকমুখ দিয়ে কৃমি উঠে শুঁটি নদীর শ্মশানে যাওয়া নয়। ড্র-ই ভালো, খেলায় থাকুক দু’পক্ষই, বাজিমাত করতে গিয়ে হট ক’রে না হারের মুকুট কিনে ফেলি!

.
(চলবে)

সহযাত্রী

নাম তার জানিনা
একই বাসে আসি
সকাল বেলা আমার অফিস নয়টায়, তারো
আমি ভাবি, আহা! আমাদের মাঝে কত মিল

সে বাসস্টপে আসে ঠিক আটটায় কিংবা আরো আগে
আর আমি ঘুম থেকেই উঠতাম আটটায়
সময়ের সাথে মেয়েদের একটা বিপরীত
সম্পর্ক থাকলেও এইখানে তার ব্যাতিক্রম

এখন আমিও উঠে যাই সাতটায়
আটটার পাঁচ মিনিট আগেই টিকিট কাটি
টিকেট কাটতে না কাটতেই
তার টিকেটের অর্ডার পরে।

সাগ্রহে জিজ্ঞেস করি কেমন আছেন
তার মুচকি হাসির জন্য আমার
সারা রাজ্যের সমান সকাল বেলাকার ঘুম
বিক্রি করে দিয়েছি

টেবিলে ফাইলের স্তুপ শেষ হয় না
আমি তবু ঠিক ছয়টায় বের হয়ে যাই
উপরে নিচে সবাই ভাবে
ব্যাপার খানা কি

এই ভাবে সে আমার সহ যাত্রিনি
আস্তে আস্তে পার্শ্ববর্তিনি
মনে মনে স্বপ্নের জাল বুনি
রাতে ঘুম আসে না
সকালে সাতটাই উঠি

টুকটাক কথা হয়
রাজনীতি বাজার দর
ভারত পাকিস্তানের ক্রিকেটের খবর

আমার স্বপনের জাল বড় হতে
বুকের মোচড়ানি বেড়ে যায়
খাবারে অরুচি ধরেছে
চোখের নিচে কালি।

আমার গায়ের গন্ধে টের পেয়েছিল বোধহয়
বললে স্মোক করেন?
বললাম আজই ছেড়ে দেব
মনে ভাবি, শুধু সিগারেট কেন
আমার জন্ম জন্মান্তরের সব ছেড়ে দেব

কিন্তু এইভাবে তো আর চলে না
কত কথা হয়
আসল কথা বলতে গেলে
আমার গলার জল শুকিয়ে যায়

যা থাকে কপালে-
বলতেই হবে
চলুন যাই কোন রেস্তোরাঁয়
কত কাজেই তো লেট হয়
আজকে বুঝি আমার জন্য
এইটুকু হতে পারে না
জানা সব কবিতা সব গান
মাথার মধ্যে ঘুর ঘুর করে

আজ তার দেখা নাই
কাল তার দেখা নাই
পরদিন দেখা নাই

আর কোন দিন তার দেখা পাই নাই

জিততে গেলে হেরে যাব

দুই
শিউলি ফাঁক খুঁজছিল। আড্ডা ভেঙে ননীবালা খোপের ঘরে গিয়ে পানের ডাবর খুলতেই সে গায়ে গা ঠেসিয়ে বসেছে :
— ও দিদ্‌মা, স্যানাটির সেনগুপ্তরা আমাগো আত্মীয় না?
বুড়ি ভুরু কোঁচকায়।
— টোরে টোইছে টেডা?
— মা তো চাপে গেল। সাজে-র মুখি শুনিছিলাম।

সাজে মানে সেজোপিসিমা কুন্তলা; বরফের মতো গায়ের রঙ, অখণ্ড সুন্দরী, জেদি মহিলাটি। নির্মলের চার বোনের মধ্যে মেজোজনের বাচ্চা বিয়োতে গিয়ে গোবিন্দপ্রাপ্তি হলে জামাইবাড়ি থেকে পরের মেয়েটিকে চাওয়া হয় এবং বাণীনাথ জামা থেকে টোকা মেরে পিঁপড়ে ফেলার মতো সে-প্রস্তাব বাতিল করেন। কিন্তু সেজো জানায়, বিয়ে করলে ওখানেই করবে। তার বোনপোকে তার মতো কেউ ভালোবাসতে পারবে নাকি!

পৃথিবীতে রাশি রাশি খোলামকুচির মতো মৃত্যু দেখেছে মানুষ, তার হাত-চোখ-কলজে-ফুসফুসের অধিক প্রিয়জনেরা চলে গেছে শ্মশানে-কবরে, তবু সে নিজের তিমির, নিজের নীরবতা, নিজের চিত্রার্পিত, নিজের গুহাবাস হয়ে কাটিয়ে গেছে আরও কত যুগ! অপরিণত মৃত্যুগুলো পরস্পর মিশে গিয়ে এক একটা প্রাণকে যেন পাথরের পরমায়ু দান ক’রে যায়।

কুন্তলাও বিয়ের পাঁচ বছরের মধ্যে মা শীতলার কৃপায় স্বামীসন্তান হারিয়ে সিদ্ধান্তপাড়ায় ফিরে এল। এবার প্রথম গল্পের হাত থেকে ব্যাটন নিয়ে দ্বিতীয় আখ্যান ছুটতে শুরু করবে। হঠাৎ জানাজানি, বাণীনাথের বড় মেয়ে আভাময়ীর ছেলে ঋজু প্রেমে পড়েছে অব্রাহ্মণ, দু’বছরের বড়, বিধবা মল্লিকার। দামড়া নাতির পিঠে খান তিন কচার ডাল ভাঙার পরেও পথে আনতে না-পেরে বাণীনাথ তাকে ত্যাজ্য করলেন। সেটা উনিশ শো বেয়াল্লিশ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে জোর কদমে। বছরের শুরুতেই জাপান বার্মা আক্রমণ করেছে আর পাঁচ লাখ বার্মিজ শরণার্থী একটু ক’রে ভরিয়ে তুলছে ভারতবর্ষ, যেমন ১৯৪০ সাল থেকে প্রতি বছর বাংলার তিন লক্ষ টন চালের শূন্যতা বার্মা রাইস পূরণ করত। ১৯৪২-এর মার্চে জাপান রেঙ্গুন কবজা করে নেওয়ায় সেই আমদানি বন্ধ। আগের মাসে জাপান ব্রিটিশদের থেকে সিঙ্গাপুর কেড়ে নিয়েছে। আর, মার্চেই সার সার নিপ্পনি যুদ্ধজাহাজ উড়িষ্যা-মাদ্রাজের উপকূল ধ’রে এগোচ্ছে দেখে তারা বাংলা আক্রমণ করবে এই ভয়ে ইংরেজ সরকার ‘ডিনায়াল পলিসি’ ঘোষণা ক’রে দিল।

এদিকে, বাড়িখেদা হওয়ার পর ঋজুর আস্তানা সিদ্ধান্তপাড়া থেকে সিকি মাইলটাক দূরে চন্দনীমহল। গ্রামের শিকদার পরিবার কবেই ম’রেছেড়ে গেছে, পোড়ো বাড়িটার জঙ্গল সাফ ক’রে ব্লিচিং ছড়িয়ে গোটা তিনেক সাপ মেরে দুটো গিরগিটিকে বন্ধু পাতিয়ে সে থাকে। থাকে রাতের ঘুমটুকুর নিমিত্ত। গত সপ্তাহে আইএ পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোলে দেখা গেল ঋজু গোটা খুলনা জেলায় প্রথম। জেলাবৃত্তি তো পাবেই, তাকে সদর থেকে ডাক পাঠিয়েছেন অবিনাশচন্দ্র ঘোষ — খুলনা জেলা স্কুলের অধ্যক্ষ এবং ‘জ্ঞানাঞ্জন সমিতি’র সভাপতি। আগামী মাসে সমিতি ঋজুকে সম্বর্ধনা দেবে একগুচ্ছ বই, মিষ্টি আর ফুলের মালায়। তখন কথায় কথায় যেই জানা গেল বাড়ি থেকে উচ্ছেদের পর ছেলেটার থাকাখাওয়ার ঠিক নেই, অবিনাশবাবু চিঠি লিখে ঋজুর হাতেই পাঠালেন তার ভায়রার কাছে, কাটানীপাড়ায় — যুবকটিকে মাসিক আট টাকা বেতনে তোমার দুই যমজ সন্তানের গৃহশিক্ষক রাখিয়ো।

প্রতিদিন বিকেলবেলা কুন্তলা থালায় ভাত বেড়ে বোনপোর বাউন্ডুলে-আবাসে পৌঁছে যায়। ঘরে খাবারটা থালাচাপা দিয়ে মশারির চারকোনা বেঁধে একটা হারিকেন জ্বালিয়ে রেখে আসে। বাণীনাথ অনেক ধমকেছেন, কথা না শোনায় সেই কবে থেকে মেজোমেয়ের সঙ্গে তার আড়ি। এছাড়া ভটচাজবাড়ি থেকে নিয়মিত দুবেলা গাল পড়ে সেনগুপ্তদের উদ্দেশ্যে। কোনও দুপুরে চন্দনীমহলের বকুলতলায় ঋজু-মলিকে কথা বলতে দেখা গেলে, কোনও বিকেলে দুজনকে দিঘলিয়ার হাটে গরুর গাড়ির পেছনে ঠ্যাং দুলিয়ে বসতে শোনা গেলে তিরস্কার পালটে যায় অভিশাপ-প্রদানে : আমার ছেলেডার জীবন নষ্ট করিছিস, মুখি রক্ত উঠে মরবি সবাই। তোগো জন্যি চোখের জল ফেলারও লোক থাকপে না।

এভাবে একদিন পরিত্রাহি চিৎকার রাস্তার ওপার থেকে… বিভাময়ী ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে গিয়ে দ্যাখে, নার্সিং স্কুল থেকে ফেরা, খাতার পৃষ্ঠার মতো রোগা মেয়েটাকে মা টানতে টানতে রান্নাঘরে এনে এক হাতে মাটিতে মুখ খুঁসে ধরেছে, অন্য মুঠোয় খাঁড়া অথবা আঁশবঁটি। সেদিন সন্তানহত্যার পাপ থেকে বেঁচে গেল মলির মা, তাকে নির্বংশ হওয়ার শাপ দেওয়া মহিলাকে জড়িয়ে হাউহাউ কাঁদতে থাকল।

তিন
সরকারি ‘প্রত্যাখ্যান নীতি’ লাগু হতেই রুক্ষ হাওয়ায় যেমন দীঘির পদ্মপাতার তেলতেলে ওপরপিঠ উলটে গিয়ে শিরাজালে ভরা ফ্যাকাশে নিম্নতল দেখা যায়, গ্রামজীবনের শান্ত নকশার নীচে তার চিরবহমান ক্ষিদের ছবিটা ফুটে উঠেছে। জাপানি সৈন্য বাংলায় ঢুকলে যাতে খেতে না পায় — বাখরগঞ্জ, খুলনা আর মেদিনীপুরের সমুদ্রবন্দর থেকে তিরিশ হাজার টন চাল তুলে উত্তরবঙ্গে পাঠিয়ে দিল সরকার। তারপরেও বাতাসে ফিসফিসানি পাক খায় : আমাদের সেনারা চারদিকে মজুত চাল নষ্ট করে বেড়াচ্ছে; পূর্ববঙ্গের তিনটে নদীবন্দরে রাখা আরও হাজার টন শস্যকে দেওয়া হয়েছে জলকবর। অথচ দেশের খবরের কাগজগুলোয় এ-সংবাদ নেই, রেডিয়ো নিউজ টুঁ শব্দও করছিল না। ঋজু বিএ-তে ব্রজরাজ কলেজে ভর্তি হয়েছে ব’লে এখন মাসের অর্ধেক অবিনাশ ঘোষের বাড়িতে কাটায়। একদিন ভোরে অবিনাশবাবু তাকে সমিতির দশবারোটা ছেলের সঙ্গে পাঠিয়ে দিলেন রূপসা-ঘাট। সেখানে পৌঁছে দেখা গেল, নদীর চরে পাহাড় সমান উঁচু চালের বস্তার লাটে চারপাঁচটা পুলিশ আর ক’জন মজুর বড় বড় টিন থেকে কেরোসিন ঢালছে।

দেখে চোখ জ্বালা ক’রে ওঠে ঋজুর। পূর্ববঙ্গে নীচু বর্ণ আর নীচু অর্থের মানুষ একটা অফুরন্ত অর্ধাহার-অনাহারের কুয়োর ভেতরে সার্কাস-খেলোয়াড়ের মতো গোল-গোল ঘুরে যাচ্ছে। অন্নাভাবে থাকে ব’লেই এদের মধ্যে নষ্ট খাবার খাওয়া আর পেটের রোগ বাধানোর হিড়িক। সাধে কি মেঝেয় পড়া পাতের ভাত খুঁটে না খেলে আমাদের মা লক্ষ্মী রুষ্ট হন!

সেই মুহূর্তে সমিতির এক যুবক তাকে রূপসাচর থেকে চলে যেতে বলছিল, অবিনাশকাকুর তেমনই নির্দেশ। ঋজু মাথা নাড়িয়ে ফিরে আসতে আসতে ওয়্যারহাউজের ভাঙা দেয়ালের পেছনে লুকোলো। সঙ্গীরা এগিয়ে গেছে বালিতে উলটে থাকা একটা বাতিল কন্টেনারের দিকে। তারপর হঠাৎ ওই লোহার খাঁচার পেট থেকে কাঁড়ি কাঁড়ি পাথর ছুঁড়তে লাগল পুলিশগুলোকে। তাদের ‘বন্দে মাতরম’ স্লোগান উৎকট বাতাসে ভাঙা ভাঙা রামধনুর মতো এদিক-সেদিক ছিটকে যাচ্ছিল। ঋজু একলাফে বেরিয়ে এসে বন্ধুদের সঙ্গে খোয়া ছোঁড়ায় হাত লাগিয়েছে। পুলিশ তখন ধন্দে — চালের বস্তায় আগুন লাগাবে না ধাওয়া দেবে কংগ্রেসিদের? আসলে ওটা ছকবাজি, সেই ফাঁকে যে ক’জন স্টিমার-প্যাসেঞ্জার এত সময় ঋজুদের পেছনে বাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল, হুড়মুড়িয়ে ধেয়ে আসছে। পালা, শিগগির পালা!

ছুটতে ছুটতে ছেলের দল চক্রাখালি পার হয়, গজালমারি ফুঁড়ে বেরিয়ে যায় একবারও পেছনে না তাকিয়ে। পেটমোটা গোয়েন্দা পুলিশের ঝাঁক কোথায় হারিয়ে গেছে… তারপরেও ঋজুরা দৌড়োতে থাকে — ডোবায় হাত-জাল ছোঁড়া জেলের গা ঘেঁষে, সদরমুখো সবজিবোঝাই ভ্যানরিকশাকে হারিয়ে… যেন এক গুচ্ছ অ্যাথলিট অলিম্পিকের প্র্যাকটিসে নেমেছে। ঋজু যত হাঁপায় তত হালকা হয় মাথা — অবিনাশবাবুর ওকে ব্রজরাজ কলেজে ভর্তি করানো, বিশেষ বিশেষ বই পড়তে দেওয়া, ইংরেজদের অত্যাচারের গল্প শুনিয়ে সেটা ইংরাজিতে রিপোর্টের ঢংয়ে লিখতে বলা… সবই কোনও ভারি রাগের শুরুতে স্বরপরিচয়ের মতো না? ভাবতে গিয়ে আর একখানা মুখ মনে আসে — নাকের দুপাশে তীক্ষ্ণ পেনসিলে আঁকা গাঢ় লাফ লাইন, অথচ দুঠোঁটের আংটায় ছোট্ট টিপতালা।

অবিনাশকাকু বলেছে, ইংরেজদের আসল উদ্দেশ্য জাপানিদের মারা নয়, দেশে দুর্ভিক্ষ ডেকে এনে বাংলা আর বাঙালির মাজা ভেঙে দেওয়া। এমন মন্বন্তরের ঋতুতেই প্রেম হল ঋজু-মল্লিকার?

.
(চলছে)

ছায়াসঙ্গী

০১
তখনো পাখি ডাকা শুরু করেনি। ভাঙেনি রাতের গোঙানি। তবুও প্রতিদিনের অভ্যাস মতো আজকেও ঘুম ছুটে যায় ছায়ার। দিনের আগে দিন শুরু হওয়ার আনন্দটা একেবারেই আলাদা। যে রোজ ভোরের পাখি হয়, সে ছাড়া অন্যকারো পক্ষে এর স্বাদ বুঝতে পারা শুধু কঠিনই নয়; একেবারে দুঃসাধ্য। এই আমেজের কেবল একটি উপমা-ই দেওয়া যায়, যেমনঃ লবণ, কাঁচামরিচ, আদা, খাঁটি সরিষার তেল পরিমাণ মতো চিড়ামুড়ির সাথে মাখিয়ে মচমচে করে খাওয়া। ছায়া জানলার ছিটকিনি খুলে বাইরে একবার চোখ ঘুরিয়ে নেয়। সেই চোখ কী যেন খোঁজে.. কাকে যেন খুঁজছে…! এখনও ঘুটঘুটে আঁধার। এমন আধাঁর… যে আঁধার বাসি, পঁচা জলের মতোন আসক্তিহীন। তবুও এর একটা ভিন্ন ঘরানার জৌলুশ আছে। আদিমকালের মতো আটকোরা রুপ-যৌবন আছে। এখানেই বোধ করি মানুষের সাথে সৃষ্টিকর্তার সবচেয়ে বড় পার্থক্যটি খুঁজে পাওয়া যায়। তাঁর সবকিছুই এমনি নিখুঁত, এমনি অকৃত্রিম।

ব্রাশ হাতে নিয়ে বারান্দায় চলে আসে ছায়া। বারান্দা তো নয়, যেনো ইনডোর ক্রিকেট খেলার পিচ। যেমন ইচ্ছে ব্যাটিং, বোলিং করার মতো জায়গা আছে। বল কুঁড়ানোর জন্য ৩/৪ জন ফিল্ডারও দাঁড় করিয়ে দেয়া যাবে অনায়াসেই। যদিও বল বাইরে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। গ্রিলের বাঁধা ডিঙিয়ে বাইরে যাবে এমন সাহস কার? ছায়া বারকয়েক পায়চারি দিয়ে মর্নিংওয়াক সেরে নিলো। শরীরটা এখন আগের চেয়ে বেশ হালকা লাগছে। বারান্দার ঠিক মাঝ বরাবর চমতকার ফ্রেমে বাঁধানো একটি আয়না ঝুলছে৷ ছায়ার অনেককিছু না হলেও চলে কিন্তু আয়না ছাড়া চলে না। এজন্য মেয়েবেলায় তাকে মজা করে আয়নামতি বলে খেপানো হতো।
ছায়া আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে আর দেখছে৷ এ দেখা যেনো কিছুতেই শেষ হচ্ছে না৷ নিজেই বুঝতে পারছে না সে কি যুবতী, না কিশোরী৷ দুই তৃতীয়াংশ ফোঁটা একটা গোলাপ যেনো ছায়ার রুপের কাছে কিছুই না৷ নাক, মুখ, চোখ সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার পর ছায়া কিছু একটা ভাবতে ভাবতে নিচের দিকে নামতে লাগলো।

অবশেষে স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হলো, তার মতো সুডৌল বক্ষ পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় কোনো মেয়ের নেই। জান্নাতের হুরদের থাকলেও থাকতে পারে। ছায়া বেশ কিছুক্ষণ নিজের চোখে, মুখে, গালে, থুতনিতে, বাঁশির মতো খাড়া নাকে হাত বুলিয়ে আদর করে। আয়নার সামনে নিজেকে আদর করতে ছায়ার বেশ লাগে। একটা সময় ছায়ার অবাধ্য হাত দুটি নিচে নামতে চায়। ছায়া সাথে সাথে হাত দুটিকে শাসন করে। সরিয়ে নেয়। এসব করতে করতে হঠাৎ ছায়া খেয়াল করে আজও তার অবাধ্য চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। ছায়া ওড়নার একপ্রান্ত দিয়ে জল মুছে নেয়। বুঝতে পারে তার মনটা এখন মোটেই ভালো নেই। একে যে করেই হোক ভালো করে তুলতেই হবে।

ছায়া আবার বাইরের দিকে তাকায়। কয়েকটা শেয়াল আর কুকুর একসাথে খেলা করছে। একটা আরেকটার মুখে মুখ ঘষে দিচ্ছে। নাকে নাক ঘাষ দিচ্ছে। লেজের দিকে আলতো কামড় দিচ্ছে। প্রকৃতির এই বিরুপ দৃশ্য দেখে ছায়া রোজকার মতো আজ আবারও আশা বেঁধে রাখে। ছায়া নিজেকে খুব ভালোবাসে। প্রত্যেক মানুষই তাই করে। ছায়া জানে মানুষের স্বভাবের, আচার আচরণের পরিবর্তন হয়। শিয়াল কুকুরের হয় না।
ছায়া বিশ্বাস করে যে মানুষটিকে একদিন সে সুতীব্র ঘৃণা করতো, সেই মানুষটিকে সে এখন সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। এমনকি তার নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসে।

বড়লোক জামাই পেয়ে মা-বাবা একপ্রকার জোর জবরদস্তি করেই মানুষটার সাথে ছায়ার বিয়ে দিয়েছিল। তারপর ছায়ার জীবনেও আসে সেই বাসর ঘর! যে বাসর ঘরে সে তার প্রেমে পাগল পারা স্বামী বেচারাকে এতটুকু শরীর স্পর্শ করতে দেয়নি। লোকটি তাকে কত যে অনুনয় করেছে, কতবার যে তার বিনয়ের বাহু প্রসারিত করেছে, কতবার যে তার নিখাদ ভালোবাসার কসম করেছে… কিন্তু একটিবারের জন্যও জোর করেনি। তবে এতকিছুর পরও ছায়ার মন গলেনি। কেন গলেনি সেই ইতিহাস ছায়া আজও জানে না। অপমানে, ক্ষোভে সেই নিরপরাধ মানুষ টি ভোর ফুটার একটু আগে তার প্রাসাদের মতো বাড়িটি ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। সেই যে গেল… তো গেল… আর ফিরে এলো না!

তারপর থেকেই শুরু হয় ছায়ার নতুন এক জীবন। যে জীবনে ছায়া নিজেই নিজের সঙ্গী। বলা যায়, ছায়াসঙ্গী। রোজ রোজ ভোরের বিছানা ছেড়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে আর তার হারিয়ে যাওয়া মানুষটির পথের বাঁকে তাকিয়ে থেকে নিজেকে খোঁজে!!
—————

জিততে গেলে হেরে যাব

এক
— ও মা, আজকে আমাদের গল্পটা করো না!
— এখন হাত আট্‌কা। অপ্‌সার হই, দুফোরব্যালা খায়ে উঠে করবানে।

মা-দিদিমা একটা নতুন ঠাকুরমার ঝুলি বুনেছে ঠোঁট দিয়ে, সে নিয়তিবৃক্ষের ডালে দোল খায়। ভেতরটা ভাঙা বাসার রূপকথায় ভর্তি; কিন্তু যে-জীবনে প্রাণে বাঁচাটাই হুররে, খেতে পাওয়াই ভি-সাইন, সেখানে দু’চারটে তছনছ-কে কপালে হাতের ঘা মেরে ভুলে যাওয়াই মঙ্গল।

— আমাদের বাড়ি ধরো এক বিঘে জমির ওপরে একতলা, তাতে চারটে ছাদওলা পাকা ঘর, লাল শানমেঝে। পেছনে পুকুর, বারদুয়োরে বেল আর জগ্‌ডুমুর গাছ। ডেয়োঁ পিঁপড়ে বেল খেয়ে যায়। ভিটের বাঁদিকে সেনগুপ্ত বাড়ি; সাবিত্রী, মালতী, মল্লিকা, রেবা, শিপ্রা এই রকম আটটা মেয়ে তাদের। এক মেয়ের বিয়ে দিতে দিতে আর এক মেয়ের বিয়ের বয়েস পার হয়, তার ওপর মল্লিকা শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার তিন মাসের মাথায় সিঁদুর মুছে ফেরত এল।

মা ছোট্ট কাশি দিয়ে প্রসঙ্গ পালটায় : — বাড়িতে নাটমন্দির আছে, দোল-দুর্গোৎসব হয়, কালীপুজো মানে শ্যামাকালী, লক্ষ্মী, সরস্বতী, ব্রত, ষষ্ঠী, সত্যনারায়ণ ইস্তক। তোমার বাবাই করেন; উনি দক্ষিণের আবাদে গেলে তখন জ্যাঠামশাই।

— পুজো হয় বলছ কেন, বলো আগে হতো।
— একই কথা। মোটে দশ-এগারো বছর বন্ধ, ফিরে গেলে আবার সব ধুমধাম ক’রে চালু হবে, বাড়ি বিনিময় ক’রে তো আসিনি তোমার কাকাপিসির মতো।

— হ্যাঁ যাও, তোমারে বাড়ি খাওয়ায় দেবেনে। অনামী পপাটি ঘোষণা ক’রে সরকার সেখেনে কবে জাতভাইগো বসায় দেছে।
ননীবালা মেয়েকে স্বপ্নের চিড়িয়াখানা থেকে বের ক’রে আনতে চায়। মায়া ছেলেমেয়ে নিয়ে ইন্ডিয়ায় চলে আসার পর ফাঁকা বাড়িতে নিজের নিঃশ্বাসের শব্দে নিজেরই ভয় লাগত নির্মলের। যাতে গোপালসেবাটুকু বন্ধ না হয়, শ্রীফলতলা গ্রামের কিঙ্কর চক্রবর্তীকে সপরিবারে বাড়িতে রেখে টিনের স্যুটকেসে খানকয়েক বই নিয়ে সে বেনাপোল সীমান্ত অতিক্রম করে। বছর দুই পরে কিঙ্করকে দ্যাখা গেল বসিরহাটে, অগ্রদানী বামুন এ-বঙ্গে এসে মাছের ব্যবসায় লেগে গেছে।

এমনভাবে কত-যে পরিবার ছিঁড়েছুটে গেল; শিক্ষিত লোকেরা তবু চিঠিপত্র লিখে আত্মীয়দের একত্র করার উপায় খুঁজত, নিরক্ষর মানুষের আপনার জন ফিরে পেতে দশ-বিশ বছর পার।
— বাগেরহাটে-বাড়ি তোদের এক পিসির (আপন পিসি না) বিয়ে হয়েছিল মোল্লারহাট। মুসলমান এলাকা, দেশ স্বাধীন হতে না হতে তারা হিন্দুবাড়ি থেকে মেয়ে তুলে আনতে লাগল। একদিন দুদিন রাখে, তারপর ফেরত দিয়ে যায়। জবা তখন নতুন বউ, তার শ্বশুরবাড়ির সবাই — কাউকে কোনও খবর না — রাতারাতি পালিয়ে হিন্দুস্তানে চলে এল। তারও এক যুগ পরে তোদের বাবা অগ্রদ্বীপের মেলায় গেছে, হঠাৎ এক মেয়েছেলে এসে, বলা নেই কওয়া নেই, হাত ধ’রে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে! বউটার দশ-এগারোর বাচ্চা মেয়ে দেখেশুনে খুবই বিরক্ত; বাবাকে এসে বলছে, তুমি মাকে আর মেলায় এনো না। ততক্ষণে বাবা-মা সেই অপরিচিতের পায়ে ঢিপঢিপ প্রণাম।

অবশেষে নির্মল জবাকে সঙ্গে ক’রে এল বারাসাতে, খুড়তুতো ভাইয়ের কাছে। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বৈদ্যনাথের সে-হাপুস কান্না যদি দেখতে!

চাঁদ হঠাৎ বলে, বদ্যিনাথকাকু তখন খালি গায়ে একটা নীল রঙের লুঙি প’রে ছিল না? আর জবাদিদি ঘোমটা দিয়ে ছিল?
— তুই কী ক’রে জানবি? তোর তো জন্মই হয়নি!
— আমি সব দেখতে পাই। সেদিন বর্ষাকাল, রাস্তায় কাদা ছিল, বাবা একবার পিছল খেয়ে পড়ে গেছিল বারাসাত স্টেশানে।
— পাগলের ছাতা! দোল পূর্ণিমার পরের কৃষ্ণা একাদশীতে গোপীনাথের মেলা, তখন বৃষ্টি কোথায়?
— হইছিল, তোমার মনে নেই।

বাসুর কিন্তু দাঙ্গার স্মৃতি ফটফটে পরিষ্কার।
— মা, তোমার খেয়াল আছে, একবার সন্ধেবেলা ভৈরবের ওপারে হিন্দুপাড়ায় বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছিল মুসলমানেরা, আকাশ পুরো লাল, তারপর নদী পার হয়ে সেনহাটিতে এসে পড়ল মশাল হাতে পঁচিশ-তিরিশ জন লোক, আমরা একটা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পালাচ্ছিলাম, শিউলি তোমার কোলে, এক মিঞাভাইয়ের বাড়ি গিয়ে লুকিয়ে থাকলাম সারা রাত। ওরা কী যেন খেতে দিয়েছিল?

সঞ্জুর অতীতও জাগ্রত হয় তখন।
মুসলমানরা তারপর আক্রমণ করল আমাদের। মিঞাভাইয়ের দুই ছেলে সারা রাত বন্দুকের গুলি ছুঁড়তে লাগল।

মায়া হেসে ফ্যালে :
— এত কিছু হয়নি। তোর বাবা গেছিল যশোরে, ন’-মামার বাড়ি। সন্ধেবেলা আমি রান্নাঘরে, হঠাৎ মনোজ ঘটকের ছেলে এসে বলে, বৌদি খবর পালাম আজ হিন্দুপাড়া লুঠ করবে ওরা। রায়েট বেধে যেতে পারে। এই গোনে বাচ্চাদের নিয়ে লালু মিঞার বাড়ি যেয়ে ওঠো। লালু আড়তদার, খুলনা ব্যবসায়ী ইউনিয়ানের কী বলে… সহ-সভাপতি। কড়াইতে যেমন তরকারি তেমনি প’ড়ে থাকল, বাড়ি হাট ক’রে খোলা, যেয়ে দেখি আমাদের মতো প্রায় একশোজন, বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে বসে আছে। লালুর ছেলে ব’লে গেল আপনারা নিশ্চিন্তে থাকেন, তামার টাটে গুড় আর বস্তায় চিঁড়ে রেখে গেলাম। জল দিলি তো ছোঁবেন না, ঘরের পেছনে টিউকল, হাত-কোশ ক’রে খেয়ে আসবেন।

— তারপর কী হল?
— আর কী হবে! সিদ্ধান্তপাড়ার লোকজন সজাগ হয়ে গেছে বুঝে মোল্লারা আর এগোল না। আমরাও সারা রাত্তির না ঘুমিয়ে সকালবেলা বাড়ি ফিরে রান্নাবান্না আদাড়ে ফেলে আসলাম।

চাঁদ বলল, উঁহু মুড়িচিঁড়ে খেতে দেয়নি। দিয়েছিল … সে ঠোঁট সুঁচোলো ক’রে ঘরের ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকে … চা আর সন্দেশ।
— হ্যাঁ, তুই অন্তরীক্ষ থেকে দেখেছিলি তো!

সে যাই হোক, মায়ের বোনা ঠাকুরমার ঝুলি বড্ড সাদা-সাদা। বরং মনিদার কাহিনিতে একদিকে নদীর আকাশ ন্যাড়াপোড়ার রাতের মতো আগুনের স্ফুলিঙ্গ ওগরাচ্ছে, আর একদিকে অনেক বাচ্চা বালক ধ্রুব-র আদলে ‘হা-কৃষ্ণ হা-কৃষ্ণ’ ক’রে ছুটছে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে।

ছুটতে ছুটতে তারা কলোনির পঞ্চু, ছোটবাবু, বাবলা, খোকোন, কানু হয়ে গেল।
— এ চাঁদ, মাঠে যাবি না?
— মা, এখন আর আমাদের গল্প করবে না কিন্তু। আমি খেলে আসি, তারপর।

.
(শুরু হল)