বিভাগের আর্কাইভঃ জীবন

খোলা চিঠি

রক্ত

প্রিয়তমা,

কলম হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে বসে আছি। কী লিখব, কোথা থেকে শুরু করব, বুঝে উঠতে পারছি না। বুকের মধ্যে একরাশ কষ্ট আর অপরাধবোধ জমাট বেঁধে আছে। তবুও আজ তোমার কাছে মনের সবকিছু খুলে বলতে চাই।

তুমি কেমন আছো? এই প্রশ্ন করাটা হয়তো বোকামি, কারণ আমি জানি, তোমার সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না সবই আজ আমার ব্যর্থতার সাথে জড়িয়ে আছে। তোমার মুখের সেই নির্মল হাসিটা বহুদিন দেখিনি। তোমার চোখের গভীরে যে স্বপ্নগুলো ছিল, সেগুলো যেন ফিকে হয়ে যাচ্ছে, আর আমি শুধু নির্বাক দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে দেখছি।

জানো, আমি কতটা চেষ্টা করি? প্রতিদিন নতুন করে শুরু করতে চাই, প্রতিদিন প্রতিজ্ঞা করি যে, তোমার জীবনটাকে সুখের আলোকিত পথে নিয়ে যাবো। কিন্তু বাস্তবতা আমাকে প্রতিবার থামিয়ে দেয়। একের পর এক ব্যর্থতা আমাকে গ্রাস করে, আর আমি ধীরে ধীরে এক অন্ধকার গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছি। তবু তুমি আছো, আমার পাশে, নিরব সাক্ষী হয়ে।

আমি জানি, আমার অভাব-অনটন তোমাকে কষ্ট দেয়। হয়তো অন্যদের মতো তোমার জীবনটা সুন্দর হতে পারত, নিশ্চিন্তে কাটাতে পারতে তোমার দিনগুলো। কিন্তু আমি কিছুই দিতে পারিনি তোমাকে, কিছুই না! শুধু এই অপরাধবোধে আমি প্রতিদিন নিজেকে শাস্তি দিচ্ছি।

তবুও আমি তোমাকে অসম্ভব ভালোবাসি, এক নিঃশ্বাসে, এক অন্তরের গভীরতম কোণ থেকে। তুমি আমার জীবনের সেই আলো, যে আমাকে বারবার ভেঙে পড়ার পরও বাঁচতে শেখায়। তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি এখনো স্বপ্ন দেখি, এখনো বিশ্বাস করতে চাই, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।

যদি কখনো মনে হয় আমি তোমার বোঝা, যদি কখনো মনে হয় আমার ব্যর্থতা তোমাকে দাবিয়ে ফেলছে—তবে একটিবার আমার হৃদয়ের ভেতরটা অনুভব করো। দেখবে, সেখানে শুধু একটাই নাম লেখা—তোমার নাম!

তুমি আমার শ্বাস, আমার অস্তিত্ব, আমার শেষ আশ্রয়। যদি আমি শতবারও ভেঙে পড়ি, তবুও আমি তোমার হাতটা ছাড়বো না। কারণ, আমি তোমাকে সত্যি সত্যি, নিখুঁতভাবে, অসম্ভব রকম ভালোবাসি।

চিরদিনের জন্য,
অকৃতজ্ঞ এক মানুষ

একা অবসরে কল্পনায় আমি বিশ্ব ভ্রমণ করি

ritt

একখানা পুরানো খাতার ছেঁড়া পাতা নজরে এলো। ভাঁজ খুলে দেখি ছেঁড়া কাগজে লেখা আছে, বাঁধা ধরা লেখাপড়ার প্রতি কোনকালেই আমার খুব বেশী আগ্রহ ছিল না। স্মৃতিশক্তি প্রখর হওয়ায় বাড়তি সুবিধা ছিল, স্কুলের পড়া একবার দু’বার পড়লেই মনে থাকতো। তাই স্কুলের পড়া নিয়ে কখনও টেনশান করিনি।

আমার ভালো লাগতো রূপকথার গল্প পড়তে। নতুন বছরে নতুন বই হাতে পাওয়া মাত্র ইংলিশ র‍্যাপিড রিডার বই থেকে সবগুলো গল্প পড়ে ফেলতাম। মায়ের ছিল গল্পের বই পড়ার প্রচন্ড নেশা। আমার মেজদাদা আর আমি, এই দু’ভাইবোন পেয়েছিলাম মায়ের চরিত্রের এই দিক। আমাদের ঘরে আসবাবপত্রের বাহুল্য ছিল না, যে ক’খানা কাঠের চেয়ার, তক্তপোশ, টেবিল ছিল, সেগুলোতে ছিল না কোনো নান্দনিক সৌন্দর্য্য, শোয়া-বসার প্রয়োজন মেটাতে যথেষ্ট ছিল। এইসব সস্তা দামের আসবাবপত্রের মাঝে একটি সস্তা কিন্তু খুবই মূল্যবান ছোট বুকসেলফ ছিল।

সেই ছোট বুকসেলফে অনেক বড়ো বড়ো গল্পের বই সাজানো থাকতো। বেশীর ভাগ বই ছিল স্বদেশী আন্দোলনের উপর লেখা। আমার মা আর মেজদাদা পড়তো সেইসব স্বদেশী আন্দোলনের বইগুলো। আমার মা কেন স্বদেশী আন্দোলনের বইগুলো পড়তে এত ভালোবাসতেন তা আমার জানা নেই। ইদানিং মনে হয়, মা সাধারণ পরিবারে জন্মালেও মন মানসিকতায় উনি গৃহী ছিলেন না। তাঁর মাঝে প্রবল দেশাত্মবোধ ছিল, চলনে-বলনে প্রতিবাদী ছিলেন, ব্যক্তিত্ব ছিল কঠিন। রান্নায় পারদর্শী হলেও গৃহকর্মে সুনিপুন ছিলেন না। উনার ভালো লাগতো গল্পের বইয়ের মাঝে ডুবে থাকতে। পেশায় শিক্ষক ছিলেন তাই বইখাতা নিয়েই উনার সময় কেটে যেত।
আমাদের সাথে রাজা রাণী, ভূত পেত্নীর গল্প করেননি। সব সময় ক্ষুদিরাম, মাস্টার দা, প্রীতিলতা, বেগম রোকেয়া, বিনয়, বাঘা যতীন, বাদল, দীনেশ প্রমুখদের জীবনের গল্প করতেন, আমরা ভাইবোন মন্ত্রমুগ্ধের মত এঁদের গল্প শুনতাম।

আমার মেজদাদা বয়সে আমার চেয়ে তিন বছরের বড় হলেও সে ছোটবেলা থেকেই মায়ের সঞ্চিত বইগুলো অনায়াসে পড়তো। মা কিছুই বলতো না, আর আমি মায়ের মুখের গল্প শুনেই সন্তুষ্ট থাকতাম, অত মোটা বইগুলো পড়ে দেখার ইচ্ছে হতো না। ঐ যে বললাম, আমার ভালো লাগতো রূপকথার গল্প। ঠাকুরমার ঝুলি থেকে রাক্ষস ক্ষোকসের গল্প গোগ্রাসে গিলতাম। আমার সংগ্রহে একটামাত্র বিদেশী রূপকথার গল্পের বই ছিল, ‘সোভিয়েত দেশের নানাজাতির রূপকথা’।

আমাদের ছোটকাকা এই বইটি উপহার দিয়েছিলেন মেজদাকে। মেজদা বইটা দিয়েছে আমাকে। আমার উপর মায়ের কড়া শাসন ছিল, ঘরে থাকতে হবে, পাড়া বেড়ানো যাবে না। তাই ঘরে থেকে সোভিয়েত দেশের নানাজাতির রূপকথা বইটিই বার বার পড়তাম। রূপকথার গল্প পড়ে আমার একটা উপকার হয়েছে, আমি কল্পনা করতে শিখেছি।

যখনই একা থাকতাম, চলে যেতাম রূপকথার রাজ্যে। রূপকথার চরিত্রগুলো জীবন্ত হয়ে উঠতো। দিনে দুপুরে স্বপ্ন দেখতে শুরু করি, কোনো একদিন চলে যাব চাষীর ছেলে ইভানের বাড়িতে, নয়তো দেখে আসবো পগাতিক গরোশেককে। এভাবেই কল্পনায় বিদেশ যাওয়ার জন্য স্বপ্নের জাল বুনতে শুরু করি।

আজও সেই অভ্যাস রয়ে গেছে। একা অবসরে কল্পনায় আমি বিশ্ব ভ্রমণ করি।

rit

সত্য খোঁজার জন্য প্রশ্ন করুন

প্রশ্ন করা মানুষের উন্নতির ভিত্তি। প্রশ্ন জিজ্ঞাসার মাধ্যমেই আমরা নতুন ধারণা আবিষ্কার করি, পুরানো অনুমানকে চ্যালেঞ্জ করি এবং যা সম্ভব তার সীমানা ঠেলে দিই। আমরা একটি নির্দিষ্ট বিশ্বাস বা কর্ম সম্পর্কে যতই নিশ্চিত বোধ করি না কেন, এটি কেবলমাত্র প্রশ্ন করার মাধ্যমেই আমরা সত্যই জানতে পারি যে এটি সঠিক বা ভুল। তাই আসুন আমরা আমাদের অভ্যন্তরীণ কৌতূহলকে আলিঙ্গন করি এবং কখনই কঠিন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা বন্ধ করি না যা বৃহত্তর বোঝা পড়া এবং জ্ঞানার্জনের দিকে নিয়ে যায়।

বৃষ্টিভেজা শব্দেরা

ria

মাঝেমধ্যে মনে হয় নিরপেক্ষ ব্যবচ্ছেদ হোক। সময়ের আবর্তনে মনের অলিগলি বড় ক্লান্ত। আকাশও উপচে পড়ছে। এক ফোঁটা-দু ফোঁটা, তারপর মুষলধারে আঙুল বেয়ে, চিবুক ছুঁয়ে, হাতের পাতায়।

একাই বন্ধ ঘরে নিজের সঙ্গে তর্কে কখনো হেরে যাই, কখনো জয়ী। মাঝরাতে দেখি একটা একটা করে তারা জমায় আকাশ, কখনো আধখানা, কখনো বা পুরো চাঁদ অপেক্ষায় থাকে। কতকিছুই যে আবোল তাবোল ভেবে চলি! মাঝেমধ্যে স্বপ্নগুলো কাছে টেনেই পরমুহূর্তে আবার দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া মন্দ লাগে না।

কিন্তু শব্দেরা যখন ছেড়ে যায়, ঠিক তখনই ইচ্ছে করেই নিজেকে আঁকড়ে ধরি। বৃষ্টি ফোঁটায় ফোঁটায় দাগ কাটে কাচ রঙা চোখে, সোঁদা গন্ধে ধুয়ে যায় চুল, সবুজ হাওয়া এসে বলে যায় শরৎ এসেছে। মন টেনে নিয়ে যায় মনখারাপী আবরণ ফেলে আনমনে কোনো কাশবনে।

ওহে জয়দেব

এক
মাটি থেকে ছিটকে উঠে মাটিতেই ভেসে যাবে,
জানা।
ঝরনা হল মাথার পাগড়ি, তাতে গোঁজা ময়ূরের ডানা
ঝরনার কোমরে বাঁকা নদী, চার চাঁদের আলোয় ঝলসাচ্ছে কাজল
ও মন ময়না ময়না ময়না… কৃষ্ণকথা বল

দুই
আমার যে ভবঘোরা — সুন্দর হবে
বনপাস স্টেশনে আচমকা ট্রেন থেমে গেলে
ব্যাগ থেকে বের করব রিভল…, নাহ বিস্কুট
কষ্টের নাড়িভুঁড়ি দুহাতে ভেতরে ঠেলে
গুণছুঁচ দিয়ে খুলি সেলাই করেছি
এবার এক প্যাকেট সবুজ আমলকি… খুচরো পয়সা
মেঝেয় ফেলে দিয়ে হকার মেয়ের পা ছোঁব।
ছায়ায় দাঁড়িয়ে সিগারেটে টান থাকবে এ-জীবনে;
প্রুফে একটা বানান ভুল তন্ন তন্ন করার মতো
আমি খুঁজব প্রেম…

খুঁজতেই তো এসেছি

তিন
সে গৌরহরি সেবাশ্রমই হোক, কি
পবন বাউলের আখড়া
আমাকে দুপুরদুপুর ভাতে বসিয়ে দাও
সে হোক অজয়ে সোয়া-নগ্ন মেয়েবউ, কি
লোভে ফাজিল সাধু
আমাকে ঘুরঘুর করাও গাঁজাকলকের চারপাশে
গোল অন্ন-মুগডাল গোল পাতে
গোল ডাবুহাতায় বিতরণ করো
সে ফানাফানা কলার কাঁদি হোক, বাস্‌নায় জড়ানো,
মুসলমান কুটুমবাড়ি নেবে
কিম্বা দুশোমতো কুঠোভিখিরি
নদীকাটা দুধারি রাস্তায়;
আমাকে ভ’রে উঠতে দাও কান্নাসজলে

যেটুকু যাবে, তার সঙ্গে অবশিষ্ট উব্‌জে চলে যায়
তারপর যাবজ্জীবন আমার পরিবেশনা
আর তোমাদের ‘দারুণ খেলাম’!

দাঁড়াও, আগে নিজে মুগ্ধ হয়ে নি’

চার
তোমাকে কৃষ্ণনগরে দেখেছি না, দাঠাকুর?
আমি রবি, বউ খুঁজে পাচ্ছি না, সেবাইতকাকা।
জয়দেব-পদ্মাবতী মিলনমন্দির থেকে নেমে
আমরা আলাদা হয়ে গেনু। মেলায় পুলিশ আছে
নাম জিগ্যেস করার জন্যে। লিখে নিয়ে
চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে মাইকে অ্যালাউন্স ক’রে দেবে।
কিন্তু বউটা বড় কাঁচা আমার, পূর্ণিমা।
এবারে যে-সে ডাক দেবে — পূর্ণিমা ধীবর,
এদিকে এসো; পূর্ণিমা ধীবর, চলো আমার সঙ্গে…

বউ হারিয়ে গেছে, ফিরে পাব
চলে গেলে আর ফেরত আসবেনি

পাঁচ
গৌরীদাসের সঙ্গে চৈতন্যের মিলন হল কোথায়?
কেউ বলছেন শ্রীখণ্ডে, কেউ কাটোয়ায়,
কেউ বা মাধাইতলা। আমরা বলি,
স্থান গুরুত্বের নয়, কথা হল কাল।
কোন কালে দেখা?
যেথা যেথা নিত্য হরিনাম সংকীর্তন।
সেথায় নিত্য নবদ্বীপধাম, নিত্য বৃন্দাবন।।

গোরাচাঁদ নিত্যানন্দাদি বন্ধু ও শিষ্যদের নিয়ে নগর-পরিক্রমায় বেরিয়েছেন, বদনে হরিনাম — এমনি সময়ে গৌরীদাস উপস্থিত। তাকে দেখতেই গৌরাঙ্গের মনে পড়েছে শ্রীরাধার কথা। কেননা,
এই গৌরীদাস তো আর কেউ নন,
তিনি বৃন্দাবনের সুবল। মহাপ্রভু গৌরীকে জড়িয়ে ধ’রে “রাধা রাধা” ব’লে উচ্চস্বরে…

আহা, সে কী অশ্রু! কোনও ভক্ত বলছেন
প্রভুর দু’চোখ বেয়ে মুক্তো গড়িয়ে পড়ছে। আবার কোনও ভক্ত — না না, গড়িয়ে পড়ছে মুক্তি। শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যের ভক্তিরূপ গাল বেয়ে মুক্তি গড়িয়ে পড়ছে গো!

.
[প্রথম অংশ। ‘ভুবনভোজন চলছে’ কাব্যগ্রন্থ থেকে।]

মিথীলার জন্মদিনে সকলের কাছে মিথীলার জন্য আশির্বাদ চাই

376t প্রতি বছর মিথীলার জন্মদিনে একই কথা আমি লিখি, মিথীলার জন্মের পর কেঁদেছিলাম। লিখি, কারণ এটাই আমার কৃত অপরাধের জন্য নিজেকে শাস্তি দেয়ার উপায়। ১৯৯৯ সালের ১০ই সেপ্টেম্বরের সকাল ৯টায় সিজারিয়ান অপারেশানের মাধ্যমে যখন আমার তৃতীয় কন্যার জন্ম হলো, আমি খুব কেঁদেছিলাম। কেঁদেছিলাম কারণ, প্রথম দুই কন্যার জন্মের পর “দুটি সন্তানই যথেষ্ট” ভেবে দুই সন্তান নিয়েই জীবন কাটাবো সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তারপরেও খাঁটি বাঙালি মায়ের মনে এক টুকরো আক্ষেপ ছিলো, দুটি কন্যা না হয়ে যদি আমার কন্যা এবং পুত্র দুইই থাকতো, তাহলে দুজন দুরকম মানুষ হতো।

কে আমায় বেশি ভালোবাসতো! পুত্র নাকি কন্যা? নিশ্চয়ই কন্যা তার বাবাকে বেশি ভালোবাসতো, পুত্র বেশি ভালোবাসতো তার মাকে। কিন্তু আমার তো দুটোই কন্যা, পুত্র সন্তান কেমন হয় ভেবে তো লাভ নেই! দুই কন্যা নিয়েই আমরা সুখী ছিলাম। ওরা একটু বড়ো হতে অস্ট্রেলিয়ার ইমিগ্রেশন ভিসা নিয়ে মেলবোর্ন চলে গেলাম। মেলবোর্নের আলো বাতাসে দুই কন্যাই লেখাপড়া নাচ গান আবৃত্তি অংকনে তুখোড় হয়ে উঠছিল। দুই কন্যার মেধার প্রকাশ দেখতে দেখতে কখন যে পুত্র সন্তানের জন্য আক্ষেপ মিটে গেলো টেরই পাইনি। এরপর অস্ট্রেলিয়ান পাসপোর্ট হাতে আমরা আবার দেশে ফিরে এলাম। দেশে ফিরেই আমি একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে যোগ দেই। অই স্কুলে ক্লাস ওয়ান- টু’র ক্লাস টিচার হিসেবে সারাক্ষণ বাচ্চাদের মাঝেই কেটে যেতো।

বাচ্চাদের মাঝে থাকতে থাকতেই দ্বিতীয় কন্যার জন্মের আট বছর পর তৃতীয় সন্তানের অপ্রত্যাশিত আগমন টের পেলাম। ভাবলাম, না চাইতেই যখন ঈশ্বর আরেকটি সন্তান আমার কাছে পাঠাচ্ছেন, নিশ্চয়ই পুত্রসন্তান হবে।
ঈশ্বর তো ভক্তের মনের কথা জানেন, আমি যে আগে খুব চাইতাম আমার একটা ছেলে একটা মেয়ে হলে ভালো হতো! তাই বোধ হয় ঈশ্বর এবার পুত্র সন্তান পাঠাচ্ছেন। এদিকে ভয়ও পাচ্ছিলাম ভেবে, প্রথম দুটি সিজারিয়ান অপারেশানের পর তৃতীয় বারেও নিশ্চয়ই সিজারিয়ান অপারেশান হবে! পর পর তিন বার সিজারিয়ান অপারেশন হলে আমিই যদি মরে যাই! মনকে বুঝ দিলাম, আমি তো দুই কন্যা নিয়েই সুখে ছিলাম, পুত্রের কথা ভুলেও গেছিলাম। তারপরেও ঈশ্বর যখন পাঠাচ্ছেন পুত্রকে, ঈশ্বরই রক্ষা করবেন।

প্রায় ভুলে যাওয়া পুত্র সন্তানের ইচ্ছে আবার আমার মনকে চাঙ্গা করে তুললো। আমি পুত্রের মুখ দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে নয় মাস কাটিয়ে দিলাম। দুই কন্যার অফিশিয়াল নামের আদ্যক্ষর ঋ, আর পুত্রের বাপের নামের আদ্যক্ষর জ। আমি ঋ এবং জ দিয়ে পুত্রের নাম বের করতে ব্যস্ত, কন্যার নাম খুঁজিই নি। ডাক্তার হাফিজ যখন সিজারিয়ান অপারেশন করে তৃতীয় কন্যার আগমন ঘোষণা করলেন, আমি ভেবেছি ডাক্তার আমার সাথে মজা করছে। আমার শিয়রে দাঁড়ানো ডা: হাসি ভাবীর দিকে তাকালাম, ভাবী আমার হাতে একটু চাপ দিয়ে ইশারায় বললো, মেয়ে হয়েছে।

আমার মনে হলো, ঈশ্বর আমার সাথে ঠাট্টা করেছেন, অকারণে ঈশ্বর আমার সাথে চরম ফাঁকিবাজি করলেন! ঈশ্বরের প্রতি প্রচন্ড অভিমানে অপারেশান টেবিলেই আমার দুই চোখ ফেটে জল এলো। আমি একেবারে চুপ হয়ে গেলাম। হাসি ভাবী আমার মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে বলে চলেছেন, মৌটুসির আম্মু, কাঁদছেন কেন? কী সুন্দর পুতুলের মতো বেবি হয়েছে। আমি তখন কারো সাথে কথা বলতে রাজী নই। সেই যে কান্না শুরু হলো, অঝোরে দুই চোখ দিয়ে জল গড়াতেই লাগলো। কেবিনে উপস্থিত- অনুপস্থিত আত্মীয় বান্ধব স্বজন সকলেই ধরে নিলো, ছেলে সন্তানের আশায় আমি তৃতীয়বার বাচ্চা নিয়েছি, তৃতীয় বারেও মেয়ে হওয়ায় আমি এভাবে কাঁদছি।

তাদের কারোরই জানার কথা নয়, আমি ঈশ্বরের সাথে অভিমান করে কাঁদছি। আমি তো খুশিই ছিলাম দুই কন্যা নিয়ে, পুত্র যদি ভাগ্যে নাই তবে কেন ঈশ্বর আমায় এত বছর পরে আরেকটা মেয়ে দিয়ে আত্মীয় বন্ধুদের কাছে হাসির পাত্র সাজিয়ে দিলো! আমার আত্মীয় স্বজনেরা অবশ্য মনে মনে যেটাই বলুক, আমার সামনে সকলেই ভালো কথা বলেছে। তাদের কথা শুনে মনে হয়েছে, তৃতীয় কন্যার জন্ম বিশাল সৌভাগ্যের ব্যাপার, আর কন্যা যদি হয় এমন চাঁদের মতো, তাহলে পাঁচ কন্যাতেও ক্ষতি নেই! বর্তমান যুগে মেয়েরাই ছেলের চেয়ে ভালো হয়, মেয়ে বিয়ে দিলে এখন জামাই ছেলে হয়ে যায়! কারো কোনো আশার বাণী, উচ্ছ্বাসের বাণীই আমার অভিমান ভাঙাতে পারেনি।

তৃতীয় দিনে আমার সমস্ত অভিমান ভেঙে সত্যিকারের বোধ জেগেছিলো মায়ের দুটো কথায়। মা বলেছিলো, “মিঠু তুই যে এভাবে কানতেছিস, তুই তো ঈশ্বরের দানকে অবজ্ঞা করছিস। ফুলের মতো শিশুটা নয় মাস তোর পেটে বড়ো হলো, এখন তারে দেখে তুই এমন মরাকান্না জুড়ে দিছিস, ঈশ্বর নাকি তোরে অপমান করেছে! এই ছোট্ট শিশুটা তো মান অপমান কিছুই বোঝে না। সে তোর কোলে এসেছে আর তুই কিনা মরা কান্না কেঁদে দুই দিন বয়সের শিশুটাকে অপমান করতেছিস। বেশী বাড়াবাড়ি করলে কিন্তু ভগবান অসন্তুষ্ট হবেন। কান্না বন্ধ কর। তৃতীয় মেয়ে হইছে বলে কানতেছিস, দুই মেয়ে যখন কলেজ ইউনিভার্সিটি চলে যাইবো, এই তিন নাম্বার মেয়েই তোর মাঝবয়সে একলা সময়ের সাথী হবে।”

মায়ের কথায় আমি ঝাঁকুনি খেলাম। ছোট্টো শিশুটির নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে মরমে মরে যেতে ইচ্ছে করলো। বাড়ি ফিরলাম। দুই কন্যার ডাক নামের আদ্যক্ষর ম। আমার দাদু নাম পাঠালো মধুমিতা, মামাতো ভাই নাম দিলো মুর্ছনা, আরও কয়েকটি নাম। কোনো নামই আমার মনে ধরে না। বাবা তো জানতে পেরেছে তৃতীয়বার কন্যা সন্তান পেয়ে আমার পাগলামির কথা। আমাকে খুশি করার জন্য সবাই চেষ্টা করছে, আমার সিংহ পুরুষ বাবাও চেষ্টা করলো খুশি করতে। বললো, তোর মেয়ের নাম রাখ মিথীলা। ব্যস, মিথীলা নাম মনে ধরে গেলো আমার। এটাও ভাবলাম, আমার মায়ের কথায় যে বাচ্চার দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছি, আমার বাবার দেয়া নামে ওকে ডাকবো।

এবার মিথীলার জন্য অফিশিয়াল নাম রাখতে হবে। আমি তো ছেলের নাম ঠিক করে রেখেছিলাম, ক্লিনিকে তো বাচ্চার নাম দিতে হবে। আমি তো তখন কেঁদেই আকুল, কন্যার বাবা চট করে কন্যার নাম দিয়েছে আয়ুষী। যখন আমি ধাতস্থ হয়েছি, আয়ুষী নাম বাতিল করে দিয়েছি। বড় দুই কন্যা ঋত্বিকা ঋজয়া, ছোটোটার নামও তো ঋ দিয়ে হতে হবে। ঝট করে মনে হলো, ঋষিজা। মাকে জিজ্ঞেস করলাম, মা আত্মজা মানে যদি আমার কন্যা হয়, তাহলে ঋষিজা তো ঋষির কন্যা হবে।
মা বলল, হ্যাঁ। বললাম, আমি তো দজ্জাল মা হলেই কি, কন্যার বাবা তো সাক্ষাৎ ঋষি। তাহলে ওতো ঋষির কন্যাই হলো, ওর নাম হোক ঋষিজা। ঋষিজা রায় মিথীলা।

মিথীলা হয়ে গেলো ওর দুই দিদির খেলার পুতুল। মিথীলাকে আমি বড়ো করে তোলার সুযোগই পেলাম না। ওর দুই দিদি কলেজে যাওয়ার আগ পর্যন্ত মিথীলাকে নিজেদের মন মতো খাইয়ে সাজিয়ে বড়ো করেছে। এরপর দুই দিদিই যখন কলেজ ইউনিভার্সিটি চলে গেলো, আমাদের ফাঁকা বাড়িতে মিথীলাই হয়ে গেলো বুড়ো বাবা মায়ের জিয়নকাঠি। আমার মায়ের কথাই সত্য প্রমাণিত হয়েছে। বড় দুই কন্যা বাপ সোহাগি হলেও মিথীলা রয়ে গেলো মা সোহাগি হয়ে। মেয়ের হাতের সেবা যত্ন পাওয়ার জন্য আমাকে বুড়ো হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়নি।

মিথীলা যখন ক্লাস ফোরে পড়ে, তখন থেকেই ও আমাকে ঘরের কাজে হেল্প করে। মাঝরাতে চা বানিয়ে খাওয়ায়, কাজ থেকে মাথা ব্যথা নিয়ে ফিরলে মাথা টিপে দেয়। আমি বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত মিথীলা না খেয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করে। রান্নাঘর পরিষ্কার করা, কাপড়চোপড় গোছানো, ঘর গোছানো, খাবার দাবার গরম করা– প্রতিটি বিরক্তিকর কাজ মিথীলা অসীম ধৈর্যের সাথে করে।

মিথীলার জন্মের সময় আমার বয়স পঁয়ত্রিশ। একটা ভয় ছিলো, পারবো তো মিথীলার পায়ের তলায় মাটি এনে দিতে! বেঁচে থাকবো তো ততোদিন! মিথীলা যখন স্কুল গ্র‍্যাজুয়েশন শেষ করে এমোরি ইউনিভার্সিটিতে আন্ডারগ্রাড করতে যাবে, ওর বয়স ১৮ হয়নি। ওকে ডেকে বললাম, মা গো, তুমি আমার অধিক বয়সের সন্তান। তোমার দুই দিদি আমাকে যতদিন পেয়েছে, তুমি তার চেয়ে অনেক কম সময় আমাকে পাবে।

তুমি যখন লেখাপড়া শেষ করে চাকরি বাকরি করবে, বিয়ে করে সংসার করবে— আমি হয়তো ততদিন বেঁচে থাকবো না। ভালো কিছু দেখলে, ভালো কিছু পেলে তুমি হয়তো মনে মনে আফসোস করবে, মা থাকলে মাকেও দেখাতাম। হয়তো ভাববে, মায়ের খুব শখ ছিলো অনেক আরাম বিলাসে থাকার। মা থাকলে মাকে অনেক আরাম দিতে পারতাম। যখনই তোমার আফসোস হবে, তুমি আমার আজকের কথা স্মরণ করো। তুমি অলরেডি আমাকে সারাজীবনের সুখ দিয়েছো মিথীলা। যখন সুখ তোমার কাছে আসবে, তুমি সুখটা উপভোগ করবে। তোমার দেহটা তো আমার দেহ থেকেই তৈরি হয়েছে, তাই তুমি সুখি হলেই আমার সুখ।

এখন মিথীলা ইউনিভার্সিটি ডিগ্রি শেষ করে চাকরির জগতে ঢুকে গেছে। ওর দুই দিদি কবেই পড়াশুনা শেষ করে যার যার প্রফেশন নিয়ে ব্যস্ত। এত ব্যস্ততার মধ্যেও ওরা মিথীলার জন্য মন প্রাণ উজাড় করে দেয়। আর মিথীলা? সত্যিই মিথীলা ঈশ্বরের পাঠানো এক পরম উপহার। মিথীলা সত্যিই আমার একলা সময়ের অনেক বড়ো অবলম্বন। আমি আজও নিজের কাছেই নিজে লজ্জিত হই আমার তৃতীয় কন্যার আগমনে কেঁদেছিলাম বলে। আজও নিজের কাছেই নিজে দুঃখ প্রকাশ করি সেদিনের কৃতকার্যের জন্য।

মিথীলা চাকরি শুরু করার পর আমি চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। মিথীলা ওর বেতন থেকে আমাকে হাতখরচ বাবদ টাকা দেয়। কয়েক মাসের টাকা একসাথে একটা খামের ভেতর ভরে এতো ভদ্রভাবে বিনয়ের সাথে খামটা আমার হাতে দেয়, আমার চোখে জল চলে আসে। এটাও বলে, মা এই খাম থেকে টাকা নিয়ে তুমি খরচ করবে। তোমার তো ওয়ালমার্টে গেলেই শুধু গাছ কিনতে ইচ্ছে করে, বাসনকোসন কিনতে ইচ্ছে করে, তুমি কিনবে।
টাকা ফুরিয়ে গেলে আমাকে বলবে, টাকা জমিয়ে রাখবে না।

গত মাসে ওয়াশিংটন ডিসি বেড়াতে গেলাম মিশার কাছে, মিথীলা আমাকে নিয়ে কত জায়গা বেড়ালো। সাজগোজের দোকান সেফোরাতে গেছিলো নিজের জন্য পারফিউম কিনতে। কয়েক বছর আগে সেফোরা থেকে আমার মামাতো বোন টুম্পা অনেক দাম দিয়ে আমাকে একটা লিপস্টিক কিনে দিয়েছিলো। তখন মিথীলা স্কুলে পড়ে, লিপস্টিকটা আমার এতো প্রিয় ছিলো, কিন্তু কোথায় যে হারিয়ে গেছে!

এরপর থেকে আমি ওয়ালমার্ট থেকেই লিপস্টিক কিনি রেগুলার ব্র্যান্ডের। সেদিন সেফোরাতে গিয়ে মিথীলার মনে পড়েছে লিপস্টিকটার কথা। আমাকে তখনই সেই একই রঙের লিপস্টিক কিনে দিলো, কনসেলার কিনে দিলো। আমার কেবলই মনে পড়ছিলো মায়ের কথাগুলো। সেদিন আমার কান্না থামাতে মা তিরস্কার করে যে কথাগুলো বলেছিলো, মায়ের সেদিনের তিরস্কারের কথাগুলোই আমার জন্য আশির্বাদ হয়ে গেছে!

মিথীলা করোনার সময়টাতে এনভায়রনমেন্টাল হেলথ এবং কেমিস্ট্রি, দুই সাবজেক্টে অনার্স কমপ্লিট করেছে এবং গত বছর এনভায়রনমেন্টাল হেলথে মাস্টার্স কমপ্লিট করেছে। পাঁচ বছরের পড়া সোয়া চার বছরে কমপ্লিট।
মিথীলাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম পিএইচডি করতে চায় কিনা! মিথীলা দুই হাত জোড় করে, ‘ না, মা আর পড়তে পারবো না” বলে দিয়েছে! তাতে আমি একটু আশাহত হয়েছি।

আমি চেয়েছিলাম আমাদের মেয়েরা ওদের বাবার মতো পড়ুয়া হোক, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তিন কন্যাই তাদের মায়ের মতো লেখাপড়া বিমুখ হয়েছে, কী আর করা! গত বছর চাকরি খোঁজার আগে আমি বলেছি, মিথ তোমার পড়া শেষ, কিছুদিন বাবা মায়ের সাথে সময় কাটাও। চাকরিতে ঢুকে গেলে সারাজীবন ক্যালেন্ডারের পাতা আর ঘড়ির কাঁটার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। বাবা মায়ের সাথে নিরলস সময় কাটানোর সুযোগ পাবে না! পাপা ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে দুই মাসের জন্য ভারত যাচ্ছে, আমিও যাচ্ছি।
তুমিও চলো, আমরা ভারত ঘুরে আসি।

তীর্থ ক্ষেত্রে যাবো, গঙ্গায় ডুব দিয়ে মনের যত কালি, গ্লানি সব বিসর্জন দিয়ে আসবো। তুমি ইয়াং জেনারেশনের প্রতিনিধি, বুড়ো বাবা মায়ের সাথে থাকলে অজানা অচেনা জায়গায় আমরা মনে বল পাবো। তাছাড়া তুই সবার আদরে আহ্লাদে বড়ো হয়েছিস বলে জীবনের কঠিন বাস্তবতাকে চোখের সামনে দেখিসনি। আমাদের সাথে তুইও ভারতে চল, এরপর বাংলাদেশেও নিয়ে যাবো।

জীবন কি, জীবনের পথ কেমন, জীবনের পথ চলতে আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা কত ঠোক্কর খায়, সব নিজের চোখে দেখে আসবি। অভিজ্ঞতা হওয়া দরকার। মিথীলা মহানন্দে রাজী হয়েছে। গত বছর এই সময়ে আমরা ভারতের উত্তরাখণ্ডের রাজধানী দেরাদুন পৌঁছেছি। দেরাদুন থেকে তীর্থক্ষেত্র হরিদ্বার, ঋষিকেশ ঘুরেছি, দিল্লী আগ্রা জয়পুর আজমের ঘুরেছি, কলকাতার দুর্গাপূজা দেখেছি, আপনজনদের সাথে দেখা করেছি। মিথীলা দারুণ এনজয় করেছে। লাক্সারি বাসেও যেমন চড়েছে, ভীড়ের ট্রেন, টেম্পো গাড়ি, ভ্যান রিক্সাও চড়েছে।

376 গত বছর মিথীলার জন্মদিনে আমরা দেরাদুন ছিলাম। এই বছর মিথীলা আছে ওয়াশিংটন ডিসিতে মিশার কাছে। মিশা দুই দিন আগে থেকেই মিথীলাকে প্রতিদিন ট্রিট দিচ্ছে। মৌটুসি ডালাস থেকে ট্রিট পাঠাচ্ছে। মিথীলা ভোজন রসিক। নানা স্বাদের খাবার পেলে মিথীলা খুশি হয়। ওর দুই দিদি সেভাবেই ওকে ট্রিট দেয়।

আমি যখন লেখাটি শেষ করে এনেছি, দেখি ঘড়িতে রাত এগারো, অর্থাৎ ভার্জিনিয়ায় রাত ১২টা। লেখা থামিয়ে মিথীলাকে ফোন করলাম। এক রিং হতেই মিথীলা কল রিসিভ করেছে। আমি সেই চিরাচরিত প্রথায় গান গেয়ে মিথীলাকে হ্যাপি বার্থডে বললাম। মিথীলা বললো, মা এবার তো তোমার গান দ্য বেস্ট হয়েছে। আমি তো রেকর্ড করতে পারিনি! দ্য বেস্ট হওয়ার কারণটা বলে দেই: মিথীলাকে একেক জন একেক নামে ডাকে। আমি প্রতিটা নাম মেনশন করে গানে গানে উইশ করেছি। এতো অল্পেই মিথীলা এতো বেশি খুশি হয়।

প্রতি বছর জন্মদিনে একই কথা আমি লিখি, অই যে মিথীলার জন্মের পর কেঁদেছিলাম। লিখি, কারণ এটাই আমার কৃত অপরাধের জন্য নিজেকে শাস্তি দেয়ার উপায়। আমার একটাই চাওয়া, জীবনে যদি ভালো কিছু করে থাকি, তার পুরস্কার হিসেবে ঈশ্বর যেনো আমাদের তিন কন্যাকে সুস্থদেহে দীর্ঘজীবী করেন। মিথীলার জন্মদিনে সকলের কাছে মিথীলার জন্য আশির্বাদ চাই।

অজানা গন্তব্যের প্রতি ভালোবাসা

shamim

অজানার রাজ্যে, ভালবাসা তার পথ খুঁজে পায়,
একটি অজানা যাত্রা, যেখানে হৃদয় দুলতে সাহস করে।
অনিশ্চয়তার কুয়াশার মধ্য দিয়ে, আমরা দুজনেই অন্বেষণ করি,
একটি প্রেমের গল্প উদ্ঘাটন, চিরকাল আমরা অনুনয়.

রাতের গভীরে, আমাদের আত্মা উড়ে যায়,
তারা দ্বারা পরিচালিত, কখনও এত উজ্জ্বল উজ্জ্বল.
কোন মানচিত্র নেই, কোন কম্পাস নেই, শুধু আমাদের হৃদয়ে বিশ্বাস,
আমরা এই ভালবাসা পরিক্রমণ করার সময়, যেখানে প্রতিটি মুহূর্ত প্রদান করে।

যদিও পথ মোচড় দিতে পারে, এবং সন্দেহ দেখা দিতে পারে,
আমাদের ভালবাসা বাতিঘর, আমাদের চূড়ান্ত পুরস্কার।
এই অজানা রাজ্যে, আমরা অনন্তকাল ঘুরে বেড়াব,
প্রেমের গন্তব্যের জন্য, আমরা এটিকে আমাদের বাড়ি করব।

আগমনীর প্রারম্ভ মূহুর্তে

সেই কালো ছেলেটা দেখছিল।
এই সময়টায় এবং
শুধুমাত্র এই সময়টায় সে সময় পায়
তার রূপকথার পৃথিবীটা কেমন
আস্তে আস্তে মাথা তুলছে।

কালো অ্যাসফল্টের রাস্তার অর্দ্ধেক জুড়ে
ও পাশের একফালি ফাঁকা জায়গায়
কয়েকদিনের সমূহ ব্যস্ততা,
কত রকমারী জিনিসপত্র জোড়াতালি
কত মানুষের আনাগোনায়
কখনো রাজপ্রাসাদ, কখনো প্রেমের দূর্গ।

ছেলেটা এত শত বোঝেনাকো,
বোঝার কিম্বা ওগুলো ছোঁয়ার কোনো
মৌলিক অধিকারও নেই তার;
তাতে কিচ্ছুই যায় ও আসেনা
বিস্মিত দুই সরল চোখের,
আসলে সে এত জানেই না!

একবার সে একটা আস্ত সিনেমা দেখেছিল।
কারা যেন সারা বিকেলের সূর্যডোবা আলোয়
মাঠজুড়ে টাঙিয়েছিল অত্যাশ্চর্য এক কাপড়,
আর ঝুপ করে অন্ধকার লাফিয়ে পড়তেই
সে এক মায়াবী জগৎ তার মনে সেঁধিয়ে গেল।
মাঝেমাঝে ঘুমের অবকাশে সেও
হয়ে যায় সিনেমার সেই মায়াবী পুরুষ…
তারপরেই, খিদের অসভ্য খোঁচায় সব উধাও।

কিন্তু এখানে, চোখের সামনে
যে রোশনাই জুড়ে চারদিনের অলীক পৃথিবী
ওরা কিছু খেতে দেয়না কেন?
ওরা কিছু খুদ তুলে দিলে মা টাও
ফুটপাথে মরতো না ওষুধের অভাবে।
ছেলেটা তখন তাকিয়েছিল একদৃষ্টিতে,
সেই কালো হাড়জিরজিরে ছেলেটা।

গায়ে কোনো জামা ছাড়াই দাঁড়িয়েছিল
সূর্যাস্তের পরম আদরী আলোয়,
শতচ্ছিন্ন প্যান্ট অবহেলায় নেমে যাচ্ছিল নিচে,
কিন্তু আশ্চর্য, ছেলেটা উলঙ্গ হচ্ছিল না।
ছেলেটা দেখছিল আগমনীর তুমুল ব্যস্ততায়
সেই সুগন্ধী সুবেশ কর্ত্তাদের পরনেই
কোনো কাপড় নেই, চোখে কোনো পাতা নেই,
ওদের স্বচ্ছ অলিভ ত্বক কোথায় উধাও।

ছেলেটা ক্রমশই আকাশ ছাড়িয়ে উঠছিল।
সেই কালো শতচ্ছিন্ন ছেলেটা,
তার সমস্ত খিদের আগুন হাতের তালুতে নিয়ে
একদৃষ্টে তাকিয়েছিল
সেই সুন্দর মায়াবী জগতের দিকে, যেখানে
মা কোনোদিনই আসবে না।

28
.
(আসছে পুজো। আমার তিতলিঝোরা কাব্যগ্রন্থের একটা কবিতা এসময়ের জন্য দিলাম এখানে)

সব যাত্রা পূর্বনির্ধারিত নয়

সব যাত্রা পূর্বনির্ধারিত নয়
রাত নেমে এলে গাছেরাও হিংস্র হয়ে উঠে। পাতাগুলো ছড়াতে থাকে বিষাক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড।

আমার যে কী হয়! রাত নামলেই ইচ্ছে করে কোন ঝোপালো গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসে সারারাত পাতার বাঁশি বাজাই। যেমন বাজাতাম শৈশবের অলস উদাস দুপুর গুলোতে। বাজাই আর পান করি সোনালি জ্যোৎস্নার অমিয়দ্রাক্ষারস।

আমার কোন আপত্তি নেই রাতভর পাতার বিষাক্ত নিঃশ্বাসে ফুসফুস ভরে নিতে। সারাদিন কত মানুষের ছড়িয়ে দেওয়া বিষ ঢুকে যায় শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। আর শরীর সেই বিষগুলো নিতে নিতে হয়ে গেছে নীলকণ্ঠ পাখি। কণ্ঠনালীতে জমে আছে কালকুটের ভরা থলে।

হয়না। রাতগুলো থাকে লৌহদরোজার নিরাপত্তাবেষ্টনীতে বন্ধী। দূরে থাকে গাছ। পাতার বাঁশি।
পাহাড়সমান অনতিক্রম্য বাধা অতি ক্ষুদ্র এক ইচ্ছেপূরণের পথেও!

পুনর্জন্মবিশ্বাসী হলে আমি চাইতাম খোঁপায় বুনোফুল গোঁজা এক পাহাড়ী আদিবাসি রমনীর জীবন। হ্যাঁ জন্মে জন্মে আমি এক নারীই থাকতে চাই। কিন্তু সেই নারী এই নিগড়বন্ধী সমাজের কেউনা। জীবন হবে মুক্তবিহঙ্গের মতো, প্রজাপতির মতো স্বচ্ছন্দবিহারের। যে নারীরা অবগুণ্ঠনের আড়ালে লুকোয়না তাদের নারীত্ব——–বিব্রত নয় লোভীচোখের নগ্ন-চাহনীতে। উৎসবের রাতে মহুয়ার নেশায় ঘোরমাতাল হয়। নাচে তার পুরুষের হাতে হাতে ধরে, পায়ের তালে তালে তাল মিলিয়ে। ঝোরার জলে পা ডুবিয়ে বঁড়শিতে মাছ ধরে। চুলে মহুয়ার ফুল গুঁজে ঘুরে বেড়ায় পাহাড়ীঝর্ণার মতো বন্ধনহীন।

জীবনতো হবেই এমন সহজ আর অনাবিল।
নিরিবিলি রাতে পাতার বাঁশি বাজানোর সুযোগহীন জীবন আমার চাইনা।
এমন নয় যে এই বাঁশির সুরে তৈরি হয় কোন মোহনীয় আবেশ, বরং খানিকটা বিকট অথবা উদ্ভট মনে হয় কখনো কখনো। কিন্তু বাজাতে পারলে প্রাণের অফুরান স্পন্দনের শব্দ বেজে উঠে ঠিকই।
এই ইচ্ছেপূরণের ব্যর্থতাকে আমূল গ্রাস করে ফেলে সীমাহীন বিষাদের নীলঢেউ। আর সারারাত সেই উথালপাথাল ঢেউয়ের নাগরদোলায় দুলতে থাকে পৃথিবী।

ঘুম আসেনা। ঘুমপাড়ানি মাসীপিসী কেবলই পালিয়ে বেড়ায়। ছড়াগানের ছন্দে ছন্দে ঘুমে ঢুলু ঢুলু সেই চোখ দু’টোই যে ফেলে এসেছি সহস্র আলোকবর্ষ দূরের শৈশবে —- কেন যে বারবার ভুলে যাই! সেই মায়াভরা শিশুকাল আর ফিরবেনা। তবু হাতছানি দেবে। পিছু ডাকবে। আরো অনিদ্রায় অনিদ্রায় ভরে দেবে ব্যাকুল রাতগুলো।

খুব চড়ামূল্যে কিনে নিতে হয় নিজস্ব নির্জনতাটুকু। আর এই মহামূল্য নির্জনতার ভেতরেই ঢুকে পড়ে পৃথিবীর সমস্ত কোলাহল। নিজের সাথে কথা বলতে গেলেই শুরু হয়ে যায় চাওয়াপাওয়া যোগবিয়োগের অংক। জীবনতো কখনো শুরু হয়না কোন অংকের সূত্রে। তবে কেন এত হিসেবের মারপ্যাঁচ উঠে আসে ! কেন যে খুব সামান্য সময়ের জন্য হলেও মনটাকে স্মৃতিশূন্য কিংবা একেবারে অনুভুতিশূন্য করে ফেলা যায়না ! কেন যে!

বেঁচে থাকার কোন মানেই হয়না জীবনে কিছু পাগলামি না থাকলে। এই এখন যেমন একশ তিন ডিগ্রী জ্বর নিয়ে কুয়াশাভেজা ব্যালকনিতে বসে হি হি করে কাঁপছি। মনে হচ্ছে এর চাইতে আনন্দদায়ক আর কিছু ঘটেনি এই জীবনে। এমনকি এখন যদি আকাশভাঙ্গা জ্যোৎস্না নেমে এসে প্লাবিত করে দিতে চায়, তাকে বলবো– ‘এখন নয়। এখন এই জ্বরতপ্ত অন্ধকার নির্জনতাই আমার প্রিয়। আলো চাইনা’।

যাপিতজীবন আর স্বপ্নের মাঝখানে এক রেললাইন ফাঁক। আজীবন পাশাপাশি তবু কেউ কাউকে ছোঁয়না ; কেবলই সমান্তরে ছুটে চলা আকাশ আর সমুদ্রের মতো।

দৃশ্যতঃ আমার কোথাও যাবার ছিলনা।
তবু চোরাটানে আবার এসে দাঁড়াই ইস্টিশনে। টিকেট কাউন্টারের জানালায় হাত বাড়িয়ে এক অচেনা গন্তব্যের টিকিট কিনে ফেলি।

সব যাত্রাইতো আর পূর্বনির্ধারিত নয়।

ওয়ালমার্ট সুপার সেন্টার

rty আমি ততদিনে ফোন সার্ভিস ডিপার্টমেন্টের কাজ ভালোবাসতে শুরু করেছি এবং বহাল তবিয়তে কাজ করছি। ফোন সার্ভিস ডিপার্টমেন্টে আমাদের কাজ হচ্ছে ফোন সার্ভিস নিতে আগ্রহী গ্রাহকদের সহযোগিতা করা। এবং আমি তা অতি আনন্দের সাথে করার চেষ্টা করি। এই কাজ করতে করতে অল্প অসুন্দরের পাশাপাশি অনেক সুন্দর সুন্দর অভিজ্ঞতা হয়।

অসুন্দর কিছুই আমি মনে রাখি না।
আর সুন্দর যা কিছু দেখি সবই চিন্তা চেতনা স্মৃতিতে জমা রাখি।

আমেরিকায় এসে তো এমনিতেই চারপাশ সুন্দর দেখি। আর ওয়ালমার্টে চাকরি করতে করতে সুন্দর সুন্দর মানুষজনও দেখি, মানুষজনের কাজকর্ম দেখে সুন্দর সুন্দর অভিজ্ঞতাও হয়। আমেরিকার ইয়াং জেনারেশান হচ্ছে হুজুগে টাইপ। ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে খুব কম আমেরিকান, তারা চিন্তা করে জীবনের বর্তমান মুহূর্ত নিয়ে। আমাদের দেশে ভিটে মাটি বিক্রি করে হলেও বাবা মা চায় সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়ে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বানাতে। আর আমেরিকায় ইয়াং জেনারেশান ঘটি বাটি বিক্রি করে হলেও লেটেস্ট মডেলের গাড়ি, জুতো আর লেটেস্ট মডেলের ফোন কিনবে! এই জিনিসগুলোর প্রতি এদের কী যে নেশা!
★***********************★

আজ আমাদের কাছে ফোন সার্ভিস নিতে এসেছে অনেকেই। তাদের মধ্যে দুটো ভিন্ন অভিজ্ঞতা হলো। যাদের দেখা পেলাম, তাদের সাথে গল্প করে মনটা ভালো লাগায় ভরে গেছে। কাজ শেষে বাড়ি ফিরেও ভালো লাগার রেশটা ছিলো।

এক হোয়াইট আমেরিকান ভদ্রমহিলা, বয়স আনুমানিক ৫৩ বা ৫৪ বছর হতে পারে, এসেছিলো ফোনের নেটওয়ার্কের সমস্যা নিয়ে কথা বলতে। যদিও এটা বিভিন্ন ফোন কোম্পানির টাওয়ারের সমস্যা, তবুও আমাদের গ্রাহক আমাদের লক্ষ্মী তাই ফোন কোম্পানির হয়ে আমিই এই কথাগুলো ভদ্রমহিলাকে বুঝিয়ে বললাম। ভদ্রমহিলা ফোনের নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণ জানার পর এটা নিয়ে আর কথা বললেন না, চলেও গেলেন না। ভাবলাম, আরও কিছু জানতে চায়। ভদ্রমহিলার কাছে জানতে চাইলাম, আর কিছু জানতে চায় কিনা।

না, তিনি আর কিছু জানতে চায় না। শুধু বললো যে, আমার ইংলিশ উচ্চারণ নাকি তার কাছে খুব ভালো লেগেছে। পরবর্তী প্রশ্ন ছিলো আমি কোন্ দেশ থেকে এসেছি। বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনেই ভদ্রমহিলা, ‘এমিলি এমিলি শীগগীর আসো’ বলে ডাকতেই যে এসে হাজির হলো আমাদের সামনে, অপূর্ব সুন্দরী ২৪-২৫ বছর বয়সী এক তরুণী। একেবারে আমাদের দেশের মেয়েদের মতো অভিব্যক্তি চেহারায়। মুখে সলজ্জ হাসি, কী অমায়িক ভাব চেহারাতে! ভদ্রমহিলা যখন জানলেন যে, আমি বাংলায় কথা কই, খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, এমিলিও বাংলা বলতে পারে!

আমেরিকান তরুণী বাংলা বলতে পারে শুনেই তো আমার চোখ ছানাবড়া! ভদ্রমহিলা জানালেন, এমিলি কলকাতায় থেকেছে এক বছর। অই এক বছরে বাংলা পড়তে ও লিখতে শিখেছে, বলতে তো পারেই। উনার দেয়া তথ্যের সত্যতা জায়গায় দাঁড়িয়ে প্রমাণ করার জন্যই হয়তো তিনি এমিলিকে অনুরোধ করতে লাগলেন আমার সাথে বাংলায় কথা বলার জন্য। এমিলি নামের সুন্দরী মেয়েটি বাঙালি মেয়েদের মতোই খুব লজ্জা পাচ্ছিলো! আমিই পরিস্থিতি সহজ করে দিলাম, বাংলায় বললাম, এমিলি তুমি কথা শুরু করো।

এমিলি স্পষ্ট বাংলা উচ্চারণে বললো, “আমার নাম এমিলি, কলকাতাতে আমার স্বামীর সাথে এক বছর ছিলাম। ওখানে গড়িয়াহাটে থেকেছি। আধুনিক শিশু শিক্ষা বিষয়ে পড়াশোনা করতে গিয়েছিলাম আমি। আজ আমি খুব আশ্চর্য্য হয়েছি এই ওয়ালমার্টে একজন বাঙালিকে দেখতে পেয়ে”। এমিলির বাংলা শুনে আমার আক্কেলগুড়ুম! মাত্র এক বছর বাংলা পড়ে এমন শুদ্ধ বাংলা বলতে আমি অন্ততঃ কাউকে দেখিনি। আমি এমিলির সলজ্জ মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ।

বাংলাতেই জিজ্ঞেস করলাম, ‘এমিলি, তোমার সাথের মানুষটি তোমার কে হন?”

এমিলি বললো, ‘উনি আমার শাশুড়ী। আচ্ছা রীতা আন্টি, আপনি কি রান্নাও করেন এখানে? সব বাঙালি খাবার রান্না করেন?”

এমিলির কথা শুনে আমার জ্ঞান হারানোর অবস্থা। এই মেয়ে আমাকে আন্টি ডাকছে! বুঝলাম সে অলরেডী শিখেছে, আমাদের দেশে কাউকে নাম ধরে ডাকার রেওয়াজ নেই, তাই সে আমার নামের ব্যাজ থেকে নামটি নিয়ে সাথে আন্টি যোগ করে ফেলেছে। বাঙালি নারীর যে রান্নাবান্নাই প্রধান কাজ, এটাও সে জেনে গেছে! তাকে জানালাম যে আমি প্রতিদিন রান্না করি, এবং বাঙালি খাবার রান্না করি।

এমিলির শাশুড়ী এবার জানালেন যে উনারা মিসিসিপির অধিবাসী নন, উনারা এসেছেন ইন্ডিয়ানা থেকে। বললাম, তাই তো বলি, আমার ইংরেজি উচ্চারণ কেন তোমার পছন্দ হয়েছে! মিসিসিপির মানুষ তো আমার ইংরেজি উচ্চারণ কিছুই বোঝে না, আমিও মিসিসিপির ইংলিশ কিচ্ছু বুঝি না। মিসিসিপির মানুষদের সাথে কথা বলতে বলতে আমি ইংলিশই ভুলে যাচ্ছি— বলে হেসে ফেললাম।

এমিলির শাশুড়িও খুব হাসলেন। স্বীকার করলেন, সাউদার্ন ইংলিশ উনিও বলতে পারেন না, বুঝতেও পারেন না! ওরা মিসিসিপিতে এসেছে কারণ এমিলির স্বামী, অর্থাৎ ভদ্রমহিলার ছেলের চাকরির পোস্টিং হয়েছে মিসিসিপি এয়ারবেসে, তাই ছেলে- বৌমার কাছে উনি বেড়াতে এসেছেন। ভদ্রমহিলা বললেন, তাঁর ছেলে ফুল ব্রাইট স্কলারশীপ পেয়ে ইন্ডিয়াতে গিয়েছিল উচ্চ শিক্ষার জন্য, সাথে এমিলিও গেছে। এমিলি কলকাতায় বসে থাকেনি, শিশু শিক্ষা নিয়ে পড়াশোনা করেছে। এক বছরে ওরা দুজনেই যতখানি বাংলা শিখেছে, এখানে ফিরে এসে কারো সাথে বাংলা চর্চা করার সুযোগ পাচ্ছে না বলে দুজনেই খুব আপসেট ছিলো।

আজ আমার দেখা পেয়ে ভদ্রমহিলা মহাখুশি। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানালেন আমার মত একজন খাঁটি বাঙালির খোঁজ পেয়ে গেছেন বলে। আর চিন্তা নেই, ছেলেকে গিয়ে বলবেন বাংলা চর্চা করার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। উনার ফোন নাম্বার দিলেন, এমিলির ফোন নাম্বার দিলেন এবং আমার ফোন নাম্বার নিলেন। ফিরে যাওয়ার সময় ভদ্রমহিলা ইংলিশে ধন্যবাদ জানালো এবং অনুরোধ করে বললো, আমি যেনো মাঝে মাঝে ফোনে এমিলির খোঁজ নেই। আর এমিলি বাংলায় বললো, আবার কথা হবে রিটা আন্টি!

এমিলিরা চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই কালো এক তরুণ এলো নতুন ফোন সার্ভিস কন্ট্র্যাক্ট নিতে। তখনও আমিই ছিলাম ডিউটিতে। কেউ নতুন ফোন সার্ভিস নিতে চাইলে আমাদের প্রথম কাজ হলো, গ্রাহকের ক্রেডিট হিস্ট্রি চেক করা। গ্রাহকের সমস্ত পারসোন্যাল ইনফর্মেশান কম্পিউটারে সাবমিট করার পর ক্রেডিট ব্যুরো থেকে রেজাল্ট আসে। সেই রেজাল্টের ভিত্তিতেই ঠিক হয় গ্রাহককে কোনো ডিপোজিট মানি জমা দিতে হবে কিনা।
ক্রেডিট হিস্ট্রি চেক করার কথা শুনে তরুণ একটু আমতা আমতা করছিলো।

তাকে বুঝিয়ে বললাম যে এটা ফোন কোম্পানিগুলোর বেঁধে দেয়া নিয়ম। ক্রেডিট স্কোর ভালো হলে গ্রাহককে কোনো ডিপোজিট মানি জমা দিতে হয় না। আর ক্রেডিট স্কোর খুব ভালো না হলে কিছু ডিপোজিট দিতে হয়। এক বছর সার্ভিস কন্টিনিউ করতে পারলে ডিপোজিট মানি ওরা মান্থলি বিলের সাথে ব্যালেন্স করে দেয়। সব শুনে তরুণ আধ ঘন্টার মধ্যে ফিরে আসবে বলে চলে গেলো। আধঘন্টা বাদে সে সত্যিই ফিরে এলো, এবার একা আসেনি। সাদা আমেরিকান সুন্দরী এক মেয়েকে বগলদাবা করে এনেছে।

অভিজ্ঞ চোখ দিয়ে দেখলাম, এরা প্রেমিক- প্রেমিকা। ইদানিং প্রায়ই দেখি কালো ছেলেদের সাথে সাদা মেয়েকে গলাগলি করে চলতে। কিনতু সাদা ছেলের পাশে কালো মেয়ে এখনও দেখিনি। কে জানে, এদেশেও হয়তো সাদা চামড়ার কদর বেশী! বাচ্চা মেয়ে, কেমন অভিমানী অভিমানী মুখ করে পাশে দাঁড়িয়েছে। ছেলেটির ক্রেডিট স্কোর চেক করে দেখলাম দুই ফোন লাইনের জন্য তাকে জমা দিতে হবে ৬০০ ডলার ডিপোজিট।
এবার ফোন পছন্দ করার পালা। মেয়েটি পছন্দ করেছে ‘ আইফোন ফোর’। দুই বছরের জন্য কন্ট্রাক্ট, প্রতি আইফোন ফোরের জন্য দিতে হবে আরও ৯০ ডলার।

টাকার পরিমাণ শোনার পর ছেলেটির মুখের চেহারা করুণ হয়ে গেলো। আমি তাকে অন্য ফোন পছন্দ করতে বললাম, যেগুলো দামে একটু সস্তা হবে। কিন্তু অভিমানী বালিকার জেদ, ‘আইফোন ফোর’ দিতেই হবে তাকে।ছেলেটি মেয়েটির দিকে অনুনয়ের চোখে তাকাতেই মেয়ে মুখ ঘুরিয়ে ছেলেটির পাশ ছেড়ে সোজা হাঁটা দিলো। ছেলেটি উতলা হয়ে বললো, বেইবি ফিরে আসো, তোমার পছন্দের ফোনই নেয়া হবে। বলেই আমাকে বললো, ঠিক আছে, আমি ৬০০ ডলার ডিপোজিট দিবো। ছেলেটিকে বললাম যে, তুমি তো অনেক বড়লোক মনে হয়, নাহলে ৬০০ ডলার ডিপোজিট দেয়া তো সোজা কথা না!

সে বললো, আমি খুবই সাধারণ মানুষ, কিনতু আমার ফিঁয়াসেকে এত ভালোবাসি যে এই টাকার পরিমাণ তুচ্ছ আমার কাছে। শেষ পর্যন্ত প্রিয়ার আবদারে সে ৬০০ ডলার ডিপোজিট, ২০০ ডলার ফোনের জন্য , ৮০ ডলার একটিভেশান ফি দিয়ে দুটি ‘আইফোন ফোর’ নিতেই মেয়েটির মুখ অনিন্দ্য সুন্দর হাসিতে ভরে গেলো। তরুণ যখন চুক্তিপত্রে সাইন করছিলো, আমি জানতে চাইলাম তারা কবে বিয়ে করতে যাচ্ছে। সাথে সাথে তরুণ বললো, ‘এই ডিসেম্বারে আমরা বিয়ে করবো”

আর মেয়েটি ধীরে সুস্থে বললো, “আমি এখনও জানিনা কবে বিয়ে করবো। এক বছর আগে আমাদের এমগেজমেন্ট হয়েছে, আরও সময় দরকার বিয়ের ডিসিশান নিতে।” মেয়েটির বয়স ১৮, ছেলেটির বয়স তো আমি আগেই জেনেছি ২৬ বছর। মনে মনে স্বীকার করতেই হলো, এই জগত সংসারে সব দেশেই মেয়েরা খুব হিসেবী হয় এবং ছেলেরা হয় বেহিসেবী। ছেলেদের সাথে সম্পর্ক তৈরির আগে প্রায় প্রতিটি মেয়ে সম্পর্কের বর্তমান এবং ভবিষ্যতের কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নেয়, সম্পর্ক চলকালেও সম্পর্কের বর্তমান এবং ভবিষ্যতের কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নেয় সম্পর্কটা রাখবে কিনা।

*এবং পরিসংখ্যান খতিয়ে দেখলে জানা যাবে, বেশীর ভাগ প্রেমিক- প্রেমিকার ব্রেক আপ হয় প্রেমিকার হিসেবী স্বভাবের কারণে, আর ছেলে-মেয়ের বিবাহিত সম্পর্ক ভেঙে যায় ছেলেদের বেহিসাবী স্বভাবের কারণে।* চুক্তিপত্র সাইন হয়ে যেতেই দেখি মেয়েটির মুখে হাসির বন্যা দেখা গেলো, ছেলেটির মুখেও প্রশ্রয়ের এক অপূর্ব হাসি। আমার দেখে এত ভালো লাগলো যে ছেলেটিকে বলেই ফেললাম, ‘জীবনে টাকা আসে টাকা চলেও যায়, কিনতু এমন মুহুর্ত বার বার আসে না। তোমাদের সুখী সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য শুভকামনা রইলো”।

বাড়ি ফিরে আমার স্বামীর কাছে এমিলি আর তার শাশুড়ির গল্প করলাম। কিছুক্ষণ পরে আমার স্বামী বললেন যেনো নেক্সট ছুটির দিনে এমিলি, তার বর আর এমিলির শাশুড়িকে আমাদের বাড়িতে ডিনারের নেমন্তন্ন করি।
মনে পড়ে গেল, এমিলির শাশুড়ীও আমাকে বলেছিল, মাঝে মাঝে যেনো এমিলির খোঁজ খবর নেই!★★

কিন্তু আমি এমিলির শাশুড়ির দেয়া ফোন নাম্বার লেখা কাগজের টুকরোটি আর খুঁজে পাইনি। খুব সম্ভবতঃ এমিলির শাশুড়িও আমার ফোন নাম্বার লেখা কাগজটি খুঁজে পাননি।

তাই আমাদের আর কখনো কথা হয়নি।

— ওয়ালমার্ট সুপার সেন্টার

ষোলকলা কৌশল

আমি অকর্মা বলে- বাকীরা লুটাইতো গাছে ছড়ার মুনাফা সুকৌশলে। বরই পাকলে বরই, জাম পাকলে জাম, গাছে ছড়তে পারতাম না বলে ঢিল ঢাল ছুড়ে যা পড়তো তাই খাইতাম।
ওরা মচকা মেরে খেতো কচকচে পেয়ারা, কাঁচা আম।
…তলায় থেকে আমি হুদাই চিল্লাইতাম।

শীতের মৌসুমে আমাদের খেজুর গাছ খোদাই হতো। গাছির বাটালের ধারে সব ক’টা খেজুর গাছ তৈরি হতো পরিপাটি রমণীর সাজে, চেঁচে চেটে যাদের গ্রীবার নিচে চাঁদের মত চকচক করতো উজ্জ্বল মোহনা, সিনা সন্ধি, যেখান থেকে ঝরতো ফোঁটা ফোঁটা রসের ধারা। আমি ঐ একটা গছেই চড়তে পারতাম, খোপ বেয়ে বেয়ে। রসের লালসায় সকাল সন্ধ্যা হতাম উন্মুখ, নিকষ বরষায় প্রেতে দিতাম জিহ্বা, লুটাইতাম গাছে চড়ার সুখ।

রোজ রোজ।
আমিও করতাম মধুবালার খোঁজ। যার জন্যে- জাগতো মালতী লতার দোলা, কোকিলার সুরে গাইতাম গান, ডাকতাম গোপনে- মোহন জলে, হংসমিথুন লীলায়, অবিরাম তই তই বোলে।
এই মর্ম জ্বালা। সাপ লুডু খেলা। তুরুপের তাস। চড়াই উৎরাই ফেরিয়ে শিখি আরোহণ। ষোলকলা কৌশল। রসে- কষে মাখামাখি, চিনি সাধের জীবন।

যারা রক্তের বন্ধনকে শত্রুতায় পরিণত করে

আমাদের সমাজ ও পরিবার থেকে উচ্ছনে যাওয়া কিছু বিবেকহীন অপদার্থ মানুষদের বলছি যারা রক্তের বন্ধনকে শত্রুতায় পরিণত করে।

১. হত্যার উদ্দেশ্যে সন্ত্রাসী ভাড়া করেছেন?
২. বিচারিক কাজকে ভিন্ন খাতে নেয়ার জন্য প্রভাবশালী মানুষের দ্বারস্থ হয়ে বিচারককে ফোন দিচ্ছেন?

৩. ভুয়া কাগজপত্র ঠিক করে জোর করে অর্থ সম্পদ আত্মসাৎ এর উদ্দেশ্যে বিভিন্ন মহলে ধরনা দিচ্ছেন?
৪. সেই সকল লোকেরা কি জানে আপনি গিলটি অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করেছেন?

৫. আপনি কি সত্যিই মনে করেন বিচারক ন্যায় অন্যায় বোঝেনা? আপনি কি মনে করেন ন্যায়ের পক্ষে কথা না বলে অন্যায়ের পক্ষে থাকবে বিচারক?

৬. আপনার কি ধারণা কারো মাধ্যমে ফোন দিলেই বিচারক আপনার পক্ষে রায় দেবে? দুনিয়াতে ন্যায় অন্যায় বলে কিছু নেই?

Noted: আমাদের দেশে ম্যাক্সিমাম সম্পদ নিয়ে ঝামেলা হয় ভাইদের সাথে আমি তাদের উদ্দেশ্যে বলছি। একটা অপরাধ থাকতে যেমন হাজারটা অপরাধ করতে হয় আর সেটা সামাল দেওয়াটা কি খুবই সহজ?

যতটুকু পাওয়া যায়, স্নেহ, ভালবাসা, যত্নে রেখে দিতে হয়

ria

একটা সময় আসে যখন ডাকনাম ধরে ডাকার মানুষগুমো কমে যায়। একটা সময় আসে যখন ভীষণ আপন ভেবে ভালোবেসে শাসন করার মানুষ কমে যায়। একটা সময় এমন আসে যখন মুখোশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে, স্বার্থের হিসেব স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

একটা সময় আসে যখন “কি রে বেলা হল, কখন স্নানে যাবি, কখন খাবি, কম আলোতে গল্পের বই পড়লে চোখ খারাপ হবে” এই রকম আগলে রাখার মানুষ কমে যায়। একটা সময় আসে ভীষণ জ্বরে বিছানায় শুয়ে থাকলে কেউ বলার থাকে না, কেমন আছিস? ওষুধ খেয়েছিস? একটা সময় আসে ছোট ছোট ভুলগুলো ধরিয়ে দেওয়ার মানুষ কমে যায়।

একটা সময় আসে আবদার করার মানুষ কমে যায়। একটা সময় আসে যখন দোষগুলো তুড়ি দিয়ে উড়িয়ে আবার হাতে হাত রেখে চলার মানুষ কমে যায়। একটা সময় আসে চারপাশের অসংখ্য মানুষের ভীড়ে একা মনে হয়। একটা সময় আসে যখন মেপে কথা বলতে হয়। মেপে পথ চলতে হয়।

সময়, জীবন, সম্পর্ক ঠিক নদীর মতোই, প্রতি বাঁকে বদলে যায়। তাইতো, প্রতি মুহূর্তে যতটুকু পাওয়া যায়, স্নেহ, ভালবাসা, ভীষণ যত্নে রেখে দিতে হয়। এই মুহূর্তগুলো অসময়ের সঙ্গী। এরা ঠিক একই রকম ভাবে ভালোবেসে আগলে রাখবে।

অঞ্জলি লহো হে কবি…

3017

30095 যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে, অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে –

কাজী নজরুল ইসলাম (মে ২৫, ১৮৯৯ – আগস্ট ২৯, ১৯৭৬), (জ্যৈষ্ঠ ১১, ১৩০৬ – ভাদ্র ১৪, ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ), অগ্রণী বাঙালি কবি, বিংশ শতাব্দীর অন্যতম জনপ্রিয় বাঙালি কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, সংগীতস্রষ্টা, দার্শনিক, যিনি বাংলা কাব্যে অগ্রগামী ভূমিকার সঙ্গে সঙ্গে প্রগতিশীল প্রণোদনার জন্য সর্বাধিক পরিচিত। তিনি বাংলা ভাষার অন্যতম সাহিত্যিক, দেশপ্রেমী এবং বাংলাদেশের জাতীয় কবি। আজ তাঁর ৪৬ তম প্রয়াণ দিবস।

পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ – দুই বাংলাতেই তাঁর কবিতা ও গান সমানভাবে সমাদৃত। তাঁর কবিতায় বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাঁকে বিদ্রোহী কবি নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাঁর কবিতার মূল বিষয়বস্তু ছিল মানুষের ওপর মানুষের অত্যাচার এবং সামাজিক অনাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ। বিংশ শতাব্দীর বাংলা মননে কাজী নজরুল ইসলামের মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম। একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ এবং সৈনিক হিসেবে অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে নজরুল সর্বদাই ছিলেন সোচ্চার। তাঁর কবিতা ও গানে এই মনোভাবই প্রতিফলিত হয়েছে। অগ্নিবীণা হাতে তাঁর প্রবেশ, ধূমকেতুর মতো তাঁর প্রকাশ। যেমন লেখাতে বিদ্রোহী, তেমনই জীবনে –- কাজেই “বিদ্রোহী কবি”। তাঁর জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকী বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে উভয় বাংলাতে প্রতি বৎসর উদযাপিত হয়ে থাকে।

নজরুল এক দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রাথমিক শিক্ষা ছিল ধর্মীয়। স্থানীয় এক মসজিদে মুয়াজ্জিন হিসেবে কাজও করেছিলেন। কৈশোরে বিভিন্ন থিয়েটার দলের সাথে কাজ করতে যেয়ে তিনি কবিতা, নাটক এবং সাহিত্য সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান লাভ করেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কিছুদিন কাজ করার পর তিনি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। এসময় তিনি কলকাতাতেই থাকতেন। এসময় তিনি ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। প্রকাশ করেন বিদ্রোহী এবং ভাঙার গানের মত কবিতা; ধূমকেতুর মত সাময়িকী। জেলে বন্দী হলে পর লিখেন রাজবন্দীর জবানবন্দী। এই সব সাহিত্যকর্মে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা ছিল সুস্পষ্ট। ধার্মিক মুসলিম সমাজ এবং অবহেলিত ভারতীয় জনগণের সাথে তার বিশেষ সম্পর্ক ছিল।

3023

তার সাহিত্যকর্মে প্রাধান্য পেয়েছে ভালবাসা, মুক্তি এবং বিদ্রোহ। ধর্মীয় লিঙ্গভেদের বিরুদ্ধেও তিনি লিখেছেন। ছোট গল্প, উপন্যাস, নাটক লিখলেও তিনি মূলত কবি হিসেবেই বেশি পরিচিত। বাংলা কাব্য তিনি এক নতুন ধারার জন্ম দেন। এটি হল ইসলামী সঙ্গীত তথা গজল। এর পাশাপাশি তিনি অনেক উৎকৃষ্ট শ্যামাসংগীত ও হিন্দু ভক্তিগীতিও রচনা করেন। নজরুল প্রায় ৩০০০ গান রচনা এবং অধিকাংশে সুরারোপ করেছেন যেগুলো এখন নজরুল সঙ্গীত বা “নজরুল গীতি” নামে পরিচিত এবং বিশেষ জনপ্রিয়।

মধ্যবয়সে তিনি পিক্‌স ডিজিজে আক্রান্ত হন। এর ফলে আমৃত্যু তাকে সাহিত্যকর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়। একই সাথে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে ১৯৭২ সালে তিনি সপরিবারে ঢাকা আসেন। এসময় তাকে বাংলাদেশের জাতীয়তা প্রদান করা হয়। এখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।।

3014

শ্রদ্ধেয় মরহুম কবি কাজী নজরুল ইসলামের রুহের মাগফিরাত কামনা করছি।

শ্রদ্ধার সাথে তাঁকে স্মরণ করছি, এবং তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। সেই দিনের সেই দুখু মিয়া যদি পৃথিবীতে না আসতেন, তবে সম্পদশালী বাংলা সাহিত্য তাঁর বিপুলাংশের ঐশ্বর্য্য, সাহিত্যের রত্নভান্ডার হতে বঞ্চিত হতো।

আল্লাহ উনাকে জান্নাত নসীব করুন।

লেখকঃ দাউদুল ইসলাম
( কবি ও প্রাবন্ধিক )

তুমি কোথায়?

nit

তোমাকে খুঁজি!
পথেঘাটে, বনজঙ্গলে, পাহাড়ের কোণে,
হিমালয় পর্বতে, এখানে-সেখানে,
খুঁজেছি বহু এই পৃথিবীর সবখানে
পাইনি কোথাও, দেখি-ও-নি দু’নয়নে।

তুমি কোথায়?
খুঁজে পাই অন্তর দৃষ্টিতে,
আকাশে-বাতাসে, বজ্রপাতে, বৃষ্টিতে,
তুফানে, জলোচ্ছ্বাসে, সুস্বাদু ফলের মিষ্টিতে,
সাগর নদীতে আর তোমার সৃষ্টিতে।

তুমি সত্যি আছো!
পাহাড়-পর্বত হিমালয় বলে,
নদী বলে, পাহাড়ের ঝর্ণায় বলে,
পূর্ণিমার চাঁদ বলে, আকাশে তারা বলে,
মনের বিশ্বাস বলে, এ দেহের নিশ্বাস বলে।

নিতাই বাবু
২৬/০৮/২০২৩ইং।