মাদারিং সানডে

images এক
ইংল্যান্ডের লিংকনশায়ারের পটভূমিতে লেখা গ্রাহাম সুইফটের উপন্যাস ‘মাদারিং সানডে’। নাম না বদলে সিনেমা করেছেন ইভা হাসন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে দশ বছর হল, কিন্তু তার ছেটানো রক্ত লেগে নাগরিকের জীবনে। শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত নিভেন-পরিবারের সন্তানেরা যুদ্ধে নিহত, তাদের বন্ধু শেরিংহাম ফ্যামিলিতে শুধু বেঁচে আছে পল নামের ছেলেটা।

১৯২৪ সালের মাদারিং সানডে, এদিন বাড়ির প্রত্যেক কাজের লোককে ছুটি দেওয়ার নিয়ম যাতে তারা নিজেদের মায়ের সঙ্গে সময় কাটাতে পারে। নিভেন-পরিবারের হাউজমেড জেন ফেয়ারচাইল্ডও ডে-অফ পেয়েছে, যদিও জেন অনাথ, দেখা করার মতো মা নেই তার। দিনটাকে উদ্‌যাপন করার জন্যে নিভেনরা প্রতিবেশী শেরিংহাম আর হবডে-দের সঙ্গে মিলে পিকনিকের ব্যবস্থা করল।

এদিকে, পলের সঙ্গে জেনের গোপন যৌনসম্পর্ক। জেন ভালোবাসে তাকে। লন্ডনের আইন-কলেজের ছাত্র পল “পড়ার চাপ, একটু পরে যাচ্ছি” ব’লে আপ্‌লি টাউনে নিজের বাড়িতে একা থেকে গেল আর চুপিচুপি ডেকে নিল জেনকে। দুজনে গভীর শারীরিক ঘনিষ্ঠতায় কাটাচ্ছে কয়েকটা ঘন্টা।

দুই
একশো বছর আগে ইংল্যান্ডের কাউন্টির সৌন্দর্য এই ছবির প্রথম তুক। সমান ক’রে ছাঁটা ঘাসের লম্বা মাঠ, ফুলগাছে সাজানো ফার্মহাউজ, পেশি-ঝলসানো ঘোড়ার চারণভূমি দেখতে দেখতে ইয়োরোপের সুস্বাদু শীত অনুভব করা যায় নিজের জিভে। আর অভিজাততন্ত্রের রেশ টেনে চলা ধনী ব্রিটিশদের বাড়ির ভেতরটাও যেন ঈশ্বরের মতো — পুরনো, সুমহান, নড়চড়বিহীন।

পল চড়ুইভাতির জন্যে রওনা হলে নগ্ন তরুণী সেই বাড়ি ঘুরে ঘুরে দ্যাখে। গোঁফদাড়িভরা তেলরঙের পূর্বপুরুষ পার হয়ে আলমারি খুলে পলের পোশাকের গন্ধে বিভোর হয়, পৌঁছোয় পারিবারিক লাইব্রেরিতে — চামড়ায় বাঁধানো, নিশ্ছিদ্র সার দেওয়া বইয়ের আবলুশ যক্ষপুরী। বেরোনোর আগে পল ব’লে গেছে এমা হবডে-র সঙ্গে তার আজ এনগেজমেন্ট, যে-এমা পলের বন্ধু ও নিভেনদের ছেলে জেমসের বাগদত্তা ছিল। প্রেমিকের সঙ্গে নিজের বিয়ে সে কল্পনাতেও আনেনি, তবু খবরটা শোনার পর জেন ক্যামন ভ্যাবলা মেরে গেছে। পল বলছিল, আমরা দুজন সারা জীবন খুব ভালো বন্ধু হয়ে থাকব, কেমন? জেন মরা চোখে তাকিয়ে পুতুলের মতো ঘাড় নেড়েছে। পলের সিগারেটের নেশা, কিন্তু এ-পর্যন্ত একটাও স্টিক না-ধরানো জেন পল-বিদায়ের পর থেকে নন-স্টপ ধোঁয়া টেনে যাচ্ছে (সিনেমার শেষ পর্যন্ত তার ঠোঁট থাকবে সিগারেটে)। এবং সে আর পোশাকও পরছে না (কী আসে-যায়)! আমরা যারা ছবির শুরুতে লিংকনশায়ারের ল্যান্ডস্কেপে রঙিন বৃক্ষবসন্তে ডুবে গেছিলাম — বাড়ির ভেতরে নিষ্পত্র ওকগাছের মতো, বরফভাসা ঝর্নাজলের মতো বাদামি খোলা চুলের আর এক প্রকৃতিকে দেখি। যৌবনের আদুল পরমাকৃতি যতদূর বিষণ্ণ হতে পারে ততখানি ফুঁপিয়ে ওঠে সংগীত-পরিচালক মরগ্যান কিবি-র পিয়ানো। কিছুক্ষণ পরে জেন আপ্‌লি থেকে নিভেনদের বাড়ি ফিরে যায় এবং শোনে পল গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। এবার তার দ্বিতীয় পরীক্ষা। উচ্চবংশীয় প্রেমিকের বিয়ে মেনে নিতে হয়েছিল, এখন সে মরে গেছে জেনেও আকাশ চুরমার করা কান্না গিলে ফেলতে হবে।

তিন
এই ছবির প্রথম অংশে ক্যামেরা দাঁড়িয়ে আছে তাক লাগানো নিসর্গদৃশ্য আর নারীশরীরের উদ্ভাসে, দ্বিতীয় অংশে বিদ্যুৎগতিতে এসেছে-গেছে ফ্ল্যাশ ব্যাক আর ফ্ল্যাশ ফরোয়ার্ড।

জেন অসম্ভব পড়তে ভালোবাসে। তাকে একবার নিজের বাড়ির লাইব্রেরিতে স্টিভেনসনের কিডন্যাপড-এর পাতা ওলটাতে দেখে ফেলেছিল হতবাক নিভেন-কর্তা গডফ্রে। পল চলে যাওয়ার পরে সে পরিচারিকার পেশা ছেড়ে একটা বুকশপে কাজ নেয় এবং লিখতে শুরু করে। ওই দোকানেই বইয়ের তাকের গলিঘুঁজিতে জেনের পরিচয় দর্শনের ছাত্র অনুভূতিপ্রবণ কালো যুবক ডোনাল্ডের সঙ্গে। তাদের ভালোবাসা এবং বিয়ে হল। সে জেনকে জিগ্যেস করেছিল, তোমার লেখক হওয়ার পেছনের কারণ কী? জেন বলে, তিনটে। এক : তার জন্ম (না হলে লিখত কী করে?), দুই : টাইপরাইটার উপহার পাওয়া, তিন… তিন… তিন নম্বরটা থাকগে। ডোনাল্ডের ধরা পড়ল দুরারোগ্য ব্রেন টিউমার। মৃত্যুশয্যায় সে তৃতীয় কারণ জানতে চাইলে বউ কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল — আমি তোমাকে ভালোবাসি।

পরের ঘটনা সামান্য। জেন বড় লেখক হল, বৃদ্ধ হল (অভিনয়ে গ্লেন্ডা জ্যাকসন), প্রচুর পুরস্কার জুটল তার। এমনই এক স্বীকৃতি পাওয়ার দিন সাংবাদিকেরা বাইট নিতে এসেছে, এই দৃশ্যে সিনেমা শেষ।

চার
এ-ছবিতে খল নয় কেউ, পরিপ্রেক্ষিতের দাসদাসী যেন, শুধু শ্রেণিপার্থক্য বয়ে আনে দুঃখঅপমান। পল জোর ক’রে প্রেমিকাকে বশ করেনি, ক্যাপ পরলে গর্ভধারণ এড়ানো যাবে শুনে মেয়েটি চোখ কপালে তুললে সস্নেহে বলে, তোমার ইচ্ছে না হলে থাক। তখন মনে পড়ে, জেনের মাও গর্ভবতী পরিচারিকা ছিলেন। এদিকে, সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পলের এমাকে বিয়ে করতে হচ্ছিল, তাই তার মৃত্যু আদতে আত্মহত্যা কিনা এটা বারবার ভাবিয়েছে গডফ্রে নিভেনকে। আবার গডফ্রে-র স্ত্রী ক্ল্যারি যখন কাঁদতে কাঁদতে জেনকে চুমু খাচ্ছে, বলছে, তোমার সৌভাগ্য তুমি জন্ম থেকে অনাথ, আত্মজন নেই ব’লে বিচ্ছেদকষ্টও নেই (You’re comprehensively bereaved at birth — ঠিক এই বাক্যটা), তখন জেনের সঙ্গে আমরাও চমকে উঠি! তাই কি হয়, মানুষ তার দীর্ঘ জীবনে কত অপরিহার্য সংযোগ তৈরি ক’রে বসে, সেসব কি রক্তের বাঁধনের চেয়ে কিছু কম? এভাবে অভিজাত আর নিম্নবর্গের শোকস্রোত পাশাপাশি বয়ে যায়, কেউ কাউকে বুঝতে পারে না।

কত কত স্মরণযোগ্য দৃশ্য আছে ছবিতে! ঘন্টা-বাজা এক মিষ্টি চার্চ থেকে বেরনো নতুন দম্পতিকে দেখে জেন জিগ্যেস করছে, ওরা কি সব সত্যি বলবে একে অন্যকে? অথবা জেনের শরীর উন্মোচিত করতে করতে পল হাসিমুখে : You are slightly interesting than law books, বা ওই দৃশ্যটা যখন আদরকালীন জেন প্রেমিককে গুনগুনিয়ে বলল, তোমার বীজ মাটিতে ফ্যালো, আমরা দুজন তাতে সার-জল দেব, গাছ বড় হবে। আবার, আপ্‌লির বাড়ি থেকে বেরনোর আগে ফুলদানি থেকে একটা হোয়াইট ক্রিম ছিঁড়ে বুকের ভেতর ভ’রে নিল জেন। কিম্বা ধরো, এক পলকে গা কাঁপিয়ে দেওয়া খবরের কাগজের হেডলাইন — প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সাড়ে ছ’লাখ ব্রিটিশ সেনা মারা গেছে!

এত নিখুঁত চিত্রনাট্য, এমন যত্নে বানানো ফিল্ম, পর্দায় সিগারেটের প্রত্যেক টানে শুকনো পাতা পোড়ার শব্দ। যেমন ‘অভি’ থেকে ‘নয়’ আলাদা হওয়ার নয়, আমার কাছে জেন মানেই ওডেসা ইয়ং। আবার, নগ্ন প্রেমিকের ধাপে-ধাপে পোশাকে সেজে ওঠা দেখে জোশ ওকনোর ছাড়া আর কাকেই বা সে বলত, তুমি বড্ড হ্যান্ডসাম? তেমনি শোপে ডিরিসু ছাড়া আর কারও মুখেই মিলত না উদারতা-সারল্য-প্রজ্ঞার থ্রি ইন ওয়ান।
তবু ছবির শেষ পর্যন্ত জেগে থাকে জেনের লেখক হওয়ার তৃতীয় অজুহাত… তারপর দেখি এক স্বপ্নদৃশ্যে পল জেনের পাশে ব’সে বলছে : তোমার লিখতেই হবে। আমার জন্যে এই অতীত পুনর্নির্মিত করো। তোমার নিজের জন্যেও।

সেই মুহূর্তে আরও একবার মনে হয় — আমাদের কীই বা করার আছে, এই ক্ষুদ্রমহৎ জীবন লিখে যাওয়া ছাড়া — যতদিন না ঘরের টেলিফোনে বাইরের অনন্ত ডাক পাঠায়, যে-শব্দে জেনকে তার প্রেমিক ডাকত। বৃদ্ধ জেনের পাদুটো আজও সেই বাজনা শুনলে থামে, কথা মুছে দিয়ে স্তব্ধ হয় সে।

শ্রেষ্ঠ শিল্পও দর্শককে এভাবে বারবার নিথর করবে।

mot

[সিনেমা : মাদারিং সানডে। কাহিনি : গ্রাহাম সুইফট। পরিচালনা : ইভা হাসন। ক্যামেরা : জেমি রামসে। সুর : মরগ্যান কিবি। অভিনয় : ওডেসা ইয়ং (জেন) , জোশ ওকনোর (পল), শোপে ডিরিসু (ডোনাল্ড)। মুক্তি : কান চলচ্চিত্র উৎসব, ২০২১। সময় : ১০৪ মিনিট। দেশ : ইউকে।]

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
মাদারিং সানডে, 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ১ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ০২-০৯-২০২৩ | ১২:০১ |

    অসম্ভব সুন্দর রিভিউ লিখেছেন প্রিয় কবি চন্দন ভট্টাচার্য দা। গুড লাক। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    GD Star Rating
    loading...