আমার বিবাহের তারিখ, ১৪ জুন ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দ, পহেলা আষাঢ়, ১৩৯৩ বঙ্গাব্দ। বিয়ে করেছিলাম, মুন্সিগঞ্জ জেলার সিরাজদিখাঁন থানাধীন সুবচনী সংলগ্ন নয়াবাড়ি গ্রামের এক দরিদ্র হিন্দু পরিবারের মেয়ে।
১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে আমার একমাত্র মেয়ে অনিতা’র জন্ম হয়। মেয়ে অনিতা ভূমিষ্ঠ হয়, নারায়ণগঞ্জ সিটির ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে। তখন আমার গর্ভধারিণী মা জীবিত ছিলো। বাবা ছিলেন পরপারে।
আমি তখন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন ১০নং ওয়ার্ড গোদনাইলস্থ কো-অপারেটিভ মহিউদ্দিন স্পেশালাইজড টেক্সটাইল মিলে নামমাত্র বেতনে চাকরি করি। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার খবর পেয়ে ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে গেলাম।
গিয়ে দেখি আমার স্ত্রী হাসপাতালের সিটে সন্তান পাশে রেখে শুয়ে আছে। মা স্ত্রীর সিটের পাশে বসা। আমি সামনে যাওয়ার সাথে সাথে মা হেসে বললো, “এতক্ষণে এলি? আয় দেখ তোর সুন্দর একটা মেয়ে হয়েছে।”
মেয়ের কথা শুনেই আমি কেঁদে ফেললাম! আমার দু’চোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছিল। মা আমার কাঁদা দেখে এক ধমক দিয়ে বললো, “এ-ই, কাঁদিস কেন? মেয়ে হয়েছে বলে কাঁদছিস? কাঁদবি না, বলছি! যিনি মেয়ে দিয়েছে, তিনিই উদ্ধার করবে। নেয়, মেয়েকে কোলে নিয়ে আশীর্বাদ কর।”
মায়ের কথা শুনে তখনও আমার কান্না থামছিল না। আমি কেঁদে কেঁদে মেয়েকে কোলে নিয়ে বললাম, “মা, আমি মনে হয় মেয়ে বিয়ে দিতে পারবো না। যেই চাকরি করি, তাতে তো সংসারের খরচই হয় না। মেয়ে বড় হলে বিয়ে দিবো কীভাবে? বিয়ে দিতে হলে তো সোনা-দানা, টাকা-পয়সার দরকার হয়, তা কি আমি জোগাড় করতে পারবো, মা?”
এই বলেই আরও জোরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলাম!
মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করে বললো, “পারবি বাবা। তুই এ-নিয়ে চিন্তা করিছ না। দেখবি একভাবে-না-একভাবে তোর মেয়ের বিয়ে হয়ে যাবে।”
মায়ের কথায় শান্তনা পেলাম। মায়ের কথা মেনে নিয়ে নিজেকে সামলে নিলাম। বিধাতার উপর ভরসা রেখে মা আর স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বাসায় এলাম। মনোযোগ-সহকারে কাজ করতে লাগলাম। বেতন যা পেতাম, তা দিয়েই মা-সহ বোন মরা এক ভাগ্নি আর স্ত্রী-সন্তান নিয়ে চলতে থাকলাম। এরইমধ্যে আমার গর্ভধারিণী মা স্বর্গে চলে গেলেন।
এরপর ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে আমার একমাত্র ছেলে তপন’র জন্ম। ওরা ভাই-বোন দুই বছরের ছোট-বড়।ওরা হাঁটি হাঁটি পা পা করে একসময় ওরা বড় হতে লাগলো। মেয়ে স্কুলে ভর্তি হওয়ার দুইবছর পর চেলেকেও স্কুলে ভর্তি করানো হলো।
অনিতা যখন নবম শ্রেণি পাস করে দশম শ্রেণিতে ভর্তি হলো, তখনই মেয়ের বিয়ের ঘর আসলো। বরের বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলার বৌলতলি বাজার সংলগ্ন করপাড়া গ্রামে। এতো দূর থেকে যে, মেয়ের ঘর আসবে তা আমাদের স্বামী-স্ত্রীর দুজনের কল্পনার বাইরে ছিলো।
আমি তখন সিরাজগঞ্জ বেলকুচি এক টেক্সটাইল মিলে চাকরি করি। তখন আমার স্ত্রী নিকটস্থ এক ফোন-ফ্যাক্স’র দোকান থেকে প্রতি মিনিট ৮টাকা রেটে সিরাজগঞ্জ বেলকুচি আমার মালিকের নাম্বারে কল করে। যখন আমার স্ত্রী আমার মালিকের ফোন নাম্বারে ফোন করে, তখন আমি মিলের বাইরে ছিলাম।
আমি মিলের বাইরে থাকার কারণে আমার স্ত্রী মালিকের কাছে সমস্ত বিষয় জানায়। আমি মিলে আসলে আমার মালিক আমাকে স্ত্রীর ফোনে বলা সমস্ত কথাগুলো আমাকে জানিয়ে দেয়। আমি মেয়ের মেয়ের ঘর আসার কথা শুনে রীতিমতো অবাক আর হতাশায় পড়ে গেলাম! ভাবতে লাগলাম, কী করি!
তারপর আমাকে যেই লোক বেলকুচি নিয়ে চাকরি দেয়, সেই লোকের কাছে মেয়ের ঘর আসার কথা জানালাম। ওই লোক ছিলো আমার শাগরেদ। তার নাম ছিলো, টিপু সুলতান। বাড়ি ছিলো কুষ্টিয়া জেলার কয়া গ্রামে। ওই লোক আমাকে সবসময় ওস্তাদ ওস্তাদ বলে ডাকতো। টিপু আমার কথা শুনে আমাকে বললো, “ওস্তাদ এ-তো খুশির খবর! মিষ্টি খাওয়াতে হবে।”
বললাম, “মিষ্টি তো খাওয়াবই, এখন আমি নারায়ণগঞ্জ যাবো কী করে, টিপু? আমার হাতে টাকা নেই। কিন্তু যেতে হবেই।”
শাগরেদ টিপু বললো, “আমি আপনাকে ১০০০টাকা দিয়ে দিচ্ছি, আপনি আগামীকালই নারায়ণগঞ্জ চলে যান। সেখানে গিয়ে মেয়ের বিয়ের কথা পাকাপাকি করে ফেলেন। প্রয়োজনে আমাকে কল করবেন, আমি আপনার মেয়ের বিয়েতে কিছু করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করবো।”
টিপু’র কথা মেনে নিয়ে পরদিন সিরাজগঞ্জ বেলকুচি থেকে নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশে রওনা হলাম। আমার সাথে টাকা ছিলো শাগরেদ টিপু’র দেয়া মাত্র ১০০০টাকা। তা নিয়েই নারায়ণগঞ্জের মাটিতে পা রাখলাম। বাসায় গেলাম। মেয়েকে দেখে যাওয়ার বিস্তারিত ঘটনা জানলাম। স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করলাম, কী আছে আর কী লাগবে, ছেলে পক্ষের দাবিদাওয়া কী কী?
স্ত্রী বললো, “ছেলে পক্ষের কোনও দাবিদাওয়া নেই। যা পারি আর যেভাবেই পারি বিয়ের অনুষ্ঠান সুন্দরভাবে শেষ করে মেয়ে উঠিয়ে দিতে পারলেই হলো। তারপরও অনিতা আমাদের একমাত্র মেয়ে। আবার হিন্দু বিয়ে বলে একটা কথা আছে। সামান্য সোনা-দানা না দিয়ে কি মেয়ে বিদায় করা যাবে। সোনা-দানার মধ্যে আমার কষ্টের টাকায় মেয়ের জন্য একজোড়া কানের দুল আছে মাত্র। এটা ছাড়াও মেয়ের নাকের লাগবে, হাতের চুড়ি লাগবে, পলা লাগবে, গলার লাগবে, হাতের শাঁখা সোনা দিয়ে বাঁধাই করে দিতে হবে। তারপর আছে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করার খরচাদি।”
স্ত্রীর কথা মনোযোগ সহকারে শুনলাম! ভাবলাম, কী করা যায়! ভেবেচিন্তে পরদিন খুব ভোরবেলা আমার জন্মদাতা বাবাকে যেই শ্মশানে দাহ করেছি, সেই শ্মশানের উদ্দেশে ঘর থেকে রওনা হলাম। শ্মশান ঘাটটি হলো নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন বন্দর থানাধীন ১নং ঢাকেশ্বরী কটন মিলস্ ঘেঁষা শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়। যাওয়ার পথেই দোকান থেকে দুটো মোমবাতি আর এক প্যাকেট আগরবাতি কিনে নিলাম।
২নং ঢাকেশ্বরী গুদারাঘাট থেকে খেয়া নৌকায় নদী পার হয়ে চলে গেলাম, ১নং ঢাকেশ্বরী শ্মশানঘাট। শ্মশানে গিয়ে যেই চুলায় বাবাকে দাহ করা হয়েছিল, সেই চুলার সামনে দুটো মোমবাতি আর আগরবাতিগুলো জ্বালালাম। মোমবাতি আগরবাতি জ্বালিয়ে হাতজোড় করে শ্মশানের চুলার সামনে বসলাম। চুলার সামনে বসে হাতজোড় করে নিজের মেয়ের বিয়ের কার্যসম্পাদন সম্পন্ন করার জন্য জন্মদাতা পিতার আশীর্বাদ চেয়ে কান্নাকাটি করলাম। তারপর শ্মশানের চুলার সামনে থাকা কিছু ধুলোবালি হাতে নিয়ে গায়-মাথায় মেখে চোখের জল ফেলতে ফেলতে নিজের বাসায় ফিরে এলাম।
তারপরদিন গেলাম গর্ভধারিণী মাকে যেই শ্মশানে দাহ করেছি, সেই শ্মশান ঘাটে। শ্মশানঘাট হলো, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কেন্দ্রীয় শ্মশানঘাট, মাসদাইর নামক স্থানে। সেই শ্মশানে গিয়ে বাবার শ্মশানে যেভাবে যা করেছি, মায়ের শ্মশানেও হাতজোড় করে মায়ের আশীর্বাদ চেয়েছি। যাতে আমার মেয়ের বিয়ের কার্যসম্পাদন সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে পারি।
এরপর থেকে নিজের পরিচিত ব্যক্তিবর্গের কাছে মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা করে যথেষ্ট সহযোগিতার আশ্বাস পেলাম। নিজের বড় বোনের স্বামী জামাইবাবু মেয়ের বিয়ের কথা শুনে হাতের পলা দিবে বলে জানিয়েছে। বড় বোন তার বড় মেয়ের বাড়ি গিয়ে তাদের নেমন্তন্ন করে আসতে বললে, বড়দাকে সাথে নিয়ে গেলাম বড় ভাগ্নীর বাড়িতে। নেমন্তন্ন করলাম ওদের সবাইকে।
বড় ভাগ্নী নেমন্তন্ন পেয়ে আমার মেয়ের গলার হার বানিয়ে দিবে বলে জানিয়ে দিলো। এভাবে কেউ টাকা, কেউ কাপড়, কেউ থালাবাসন, কেউ লেপ- তোষক দিয়ে সাহায্য করার আশ্বাস দিলে, একসময় মেয়ের বিয়ের দিনতারিখ পাকাপাকি করে ফেলি।
বিয়ের দিনতারিখ পাকাপাকি হলেও বিয়ের আনুষাঙ্গিক নিয়মনীতি পালনীয়-সহ বিয়ের অনুষ্ঠানে বরযাত্রী আর নিজেদের আত্মীয়স্বজনদের খাওয়া-দাওয়ার খরচাদি বাদ থেকে যায়। এসব আনুষাঙ্গিক নিয়মনীতির খরচাদি সামাল দেয়ার জন্য এক এনজিও সমিতি থেকে ৪০০০০ (চল্লিশ হাজার) টাকা উত্তোলন করি।
সেই টাকা থেকে মেয়ের বিয়ের কাপড়-চোপড়-সহ বিয়ের টুকিটাকি যা লাগে তা কেনাকাটা করে রেডি রাখি। বিয়ের অনুষ্ঠানে বরযাত্রী-সহ নিজেদের আত্মীয়স্বজন মিলিয়ে প্রায় ২০০ লোকের খাওয়া-দাওয়ার আয়োজনও করে ফেলি। সিরাজগঞ্জ বেলকুচিতে থাকা আমার শাগরেদ টিপু সুলতানকেও ফোনে নেমন্তন্ন করে বিয়ের দিন যেভাবেই হোক আসতে বলি।
বিয়ের পাঁচদিন কাকি থাকতেই বৃষ্টি আর বৃষ্টি! বৃষ্টি আর থামছিল না। সেই বৃষ্টিতে যেই মহল্লায় থাকতাম সেই মহল্লা বন্যার মতো প্লাবিত হয়ে গেলো। বিয়ের বাকি দুইদিন। আমি আমার মা-বাবা’র স্মরণে কান্নাকাটি করে বিয়েতে বিঘ্ন না ঘটানোর জন্য প্রার্থনা করতে থাকি। একসময় বৃষ্টি থামলো। মহল্লায় জমে থাকা বৃষ্টি জল শুকিয়ে গেলো। ঝামেলা বাঁধে বিদ্যুৎ।
তখন সারাদেশে প্রচুর লোডশেডিং চলছিল। এমন লোডশেডিং চলছিল যে, একবার বিদ্যুৎ চলে গেলে আবার কখন আসবে তার কোনও নিশ্চয়তা ছিলো না। আবার বিদ্যুৎ আসলে কতক্ষণ থাকবে, তারও কোনও গ্যারান্টি ছিলো না।
এমন অবস্থাতেই আমার মেয়ের বিয়ে। তা দেখে আমি শুধু আমার গর্ভধারিণী মা আর জন্মদাতা পিতাকে স্মরণ করতে থাকলাম। মনে মনে প্রার্থনা করে বলতাম, “মা, এভাবে বিদ্যুৎ চলে গেলে মেয়ের বিয়ের সময় বিঘ্ন ঘটবে। তুমি মা আমার সহায় হও। বাবাকে স্মরণ করেও একই প্রার্থনা করতাম।”
এর ফলস্বরূপ তাঁদের আশীর্বাদে মেয়ের বিয়ের অধিবাসের দিন বিদ্যুৎ যাওয়া বন্ধ হলো। মানে বিয়ের আগেরদিন থেকে। এই যে বিদ্যুৎ যাওয়া বন্ধ হলো, মেয়ের বিয়ের পরদিন মেয়েকে বিদায় দেয়ার পর বিদ্যুৎ গেলো! তা দেখে মহল্লার সবাই বলতে লাগলো, “অনিতার বাবা মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে জেনারেটর চালু রেখেছে।”
মোটকথা বিশেষ করে বিদ্যুতের ব্যাপারে সবাই অবাক হয়ে গেলো! আমার মা-বাবার আশীর্বাদস্বরূপ এমন আরও অলৌকিক কাণ্ড ঘটতে লাগলো। তারমধ্যে অবাক হবার মতো একটা কাণ্ড ঘটলো, ধুতরা গোটা। যা ছাড়া আর হিন্দু বিয়ের কার্যসম্পাদন সম্পন্ন করা যায় না।
❝হিন্দু বিয়ে কার্যসম্পাদনের সময় নানারকম ফুল-ফল, কলাগাছ, ধান, দুর্বা, বেল-তুলসী-সহ আরও আরও অনেককিছুর প্রয়োজন হয়ে থাকে। তারমধ্যে একটি হলো, বিয়ের কার্যসম্পাদনের সময় ৮টি ধুতরা গোটার দরকার হয়। ওই ধুতরা গোটা মাঝখানে কেটে দুভাগ করে তার ভেতরের বিচিগুলো ফেলে ঘি’র প্রদীপ জ্বালানো হয়। ওই ধুতরা গোটা ছাড়া বিয়ের কার্যসম্পাদন সম্পন্ন হবে না। মোটকথা ওই বিয়ে অসম্পন্নই রয়ে যাবে।❞
বিয়ের আগেরদিন অধিবাস শেষে বিয়ের দিন সকালবেলা যথারীতি পুরোহিত বাসায় এসে বিয়ের কার্যসম্পাদন সম্পন্ন করার যা যা দরকার তা গোছাতে লাগলো। সবকিছু ঠিকটাক গোছগাছ করার পর বাকি থাকলো, ৮টা ধুতরা গোটা। পুরোহিত ধুতরা গোটা আর খুঁজে পাচ্ছিল না।
পুরোহিত ধুতরা গোটা হাতের কাছে না পেয়ে তাড়াতাড়ি ৮টা ধুতরা গোটা সংগ্রহ করতে বললে, আমার বড়দা ধুতরা গোটা সংগ্রহ করার জন্য ঘর থেকে বের হলো। এই ধুতরা গোটা সংগ্রহ করার জন্য আমার বড় দাদা প্রথমে পুরো মহল্লার আনাচে-কানাচে থাকা ঝোপঝাড় জঙ্গলে তল্লাশি চালালো। মহল্লার কোথাও ধুতরা গোটা না পেয়ে গেলো, শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্বপাড়, লক্ষ্মণখোলা গ্রামে।
লক্ষ্মণখোলা পুরো গ্রামের আনাচে-কানাচে ঘুরে ধুতরা গোটা না পেয়ে গেলো নিকটস্থ দাসেরগাঁও গ্রামে। সেখানেও ধুতরা গোটা পেলেন না। গেলো, ১নং ঢাকেশ্বরী কটন মিলে। সেখানেও ধুতরা গোটা পাওয়া গেলো না। বড় দাদা ধুতরা গোটা না পেয়ে মন খারাপ করে নিরাশ হয়ে বাসায় ফিরে এলো। আমি তখন বাসায় ছিলাম না। আমি একটু দূরের মহল্লার একটা চায়ের দোকানে ছিলাম।
বড়দা আমাকে খুঁজতে খুঁজতে সেই চায়ের দোকানে গিয়ে আমার পাশে মন খারাপ করে বসলো। আমি বড়দা’র মনটা খারাপ দেখে জিজ্ঞেস করলাম, “দাদা তোর মনটা খারাপ কেন?”
বড়দা মলিন স্বরে বললো, “ধুতরা গোটা পাইনি। শীতলক্ষ্যা নদীর এপার-ওপার দুপাড়ের অনেক অচেনা জায়গায়ও খুঁজেছি, কিন্তু কোথাও একটা ধুতরা গোটা পাওয়া গেলো না। এখন তোর মেয়ের বিয়ে কি করে হবে, সেই চিন্তাই করছি।”
বড়দা’র কথা শেষ হতেই আমি চা-দোকানদার জহির মিয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, “জহির ভাই ক’দিন আগে আপনার বাসার সামনে কয়েকটা ধুতরাগাছ দেখেছিলাম। সেগুলো কি এখনো ঠিক জায়গামতো আছে?”
আমার কথা শুনে চা-দোকানদার বললো, “দাদা গত পরশুদিন ওই গাছগুলো তুলে ফেলেছি। একটু কষ্ট করে গিয়ে দেখুন তো গাছগুলো আছে কি-না?”
দোকানদার জহির ভাইয়ের কথা শুনে দু’ভাই মিলে তাড়াতাড়ি জহির ভাইয়ের বাসার সামনে গেলাম। গিয়ে দেখি ধুতরাগাছগুলোর পাতা সামান্য শুকিয়ে গেছে। কিন্তু কয়েকটা ধুতরা গোটা দেখা যাচ্ছে। ধুতরা গাছের সামনে গেলাম। গাছগুলো ওলোট পালোট করে দেখি গাছগুলোতে ৮টা ধুতরা গোটাই আছে। একটা কমও নয়, একটা বেশিও নয়। তা দেখে সাথে সাথে গাছগুলো থেকে ধুতরা গোটাগুলো ছিড়ে বড়দা’র হাতে দিয়ে জহির ভাইয়ের বাসা থেকে বেরিয়ে চায়ের দোকানে এলাম।
দোকানে আসার সাথে সাথে চা-দোকানদার জহির ভাই জিজ্ঞেস করলো, “দাদা পেয়েছেন?”
বললাম, “হ্যাঁ দাদা, আমার মা-বাবার আশীর্বাদে আমার যেকটা গোটার দরকার, সেকটাই গাছগুলোতে ছিলো। আমি সেগুলো ছিড়ে নিয়ে এসেছি। আমি এখন একরকম চিন্তামুক্ত!”
আমার কথা শুনে চা-দোকানদার জহির ভাই-সহ কাস্টমার আরও অনেকেই অবাক হয়ে গেলো।
এর আগে অবাক হয়েছিল, আমার বড়দা! ধুতরাগাছ থেকে এক-এক করে যখন ধুতরা গোটাগুলো ছিড়ে আমার দাদার হাতে দিচ্ছিলাম, তখনই আমার বড়দা বলতে লাগলো, “এ কী অলৌকিক কাণ্ড! কত জায়গায় ঘুরে কোথাও একটা ধুতরা গোটা পাইনি। শেষমেশ এখানে আসে মরা গাছে ৮টা ধুতরা গোটা পেয়েছি। দরকারও ছিলো এই ৮টা ধুতরা গোটা, পেয়েছিও ৮টা। ছিলও ৮টা। সবই বিধাতার ইচ্ছা!”
তারপর চা দোকান থেকে দুইভাই চা পান করে বাসায় গিয়ে ৮টা ধুতরা গোটা বিয়ে কার্যসম্পাদন সম্পন্ন করার পুরোহিতের হাতে দিলাম। পুরোহিত সেগুলো হাতে পেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললো, “এখন আর কোনও টেনশন নেই, সবকিছু ঠিকটাকমত আছে।” বিয়ের কার্যসম্পাদন সম্পন্ন করতে আরও কোনও ঝামেলায় পড়তে হবে না।” বিয়ের লগ্ন রাত ১১টায়।
রাত ১০.৩০মিনিটের সময় বরযাত্রী নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন ১০নং ওয়ার্ড গোদনাইলস্থ চিত্তরঞ্জন কটন মিলস্’র আটপাড়া এসে হাজির হলো। ঢাক-ঢোল, সানাই বাজিয়ে বরযাত্রীদের স্বাগত জানিয়ে বিয়ের আসরে আনা হলো। তারপর একদিকে শুরু হলো বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা, অন্যদিকে চলছিল খাওয়া-দাওয়ার পর্ব।
বরযাত্রী-সহ নিজের আত্মীয়স্বজন ও পরিচিত শুভাকাঙ্ক্ষী মিলে প্রায় ২৫০জন লোকের খাওয়া-দাওয়ার পর্ব একসময় শেষ হলো। বিয়ের প্রথম পর্যায়ের পর্ব শেষে হতে রাত ভোর হয়ে গেলো। সকালবেলা বাসি বিবাহের কার্যসম্পাদন সম্পন্ন হয়ে গেলে জামাই মেয়ে-সহ বরযাত্রীরা তাদের গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা হয়। তখন দিনের ১১টা।
মেয়ে-সহ বরযাত্রীদের বিদায় করার কিছুক্ষণ পরই গোদনাইল এলাকা থেকে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। এর পরই শুরু হলো আবার বৃষ্টি। মেয়ের জন্য আমরাও কাঁদছি, আমাদের সাথে যেন আকাশও কাঁদছিল! এই ছিলো আমার মা-বাবার আশীর্বাদস্বরূপ আমাদের একমাত্র মেয়ের বিয়েতে কিছু অলৌকিক ঘটনা। যা কখনোই ভোলার মতো নয়।
তাই আমি এখনো যেকোনো আপদে-বিপদে মা-বাবার শ্মশানে গিয়ে দুটো আগরবাতি আর মোমবাতি জ্বালিয়ে হাতজোড় করে তাঁদের আশীর্বাদ চাই। তাঁদের আশীর্বাদের আমার সমস্যার সমাধান হয়।
loading...
loading...
যাপিত জীবনের স্মৃতিচারণ। আত্মীয় পরিজনের আশীর্বাদ আর ঈশ্বরের সহায় আমাদের সকলের জীবনে শুধু কল্যাণই নয়; মুশকিল আসান করে দেয়।
ভালো এবং আরও ভালো থাকবেন মি. নিতাই বাবু।
loading...
আপনাদের সকলের আশীর্বাদে ভালো আছি, দাদা। আমার মেয়েও ভালো আছে।
loading...