আমেরিকা, land of the free, home of the brave!

34 বাহির হতে দেখলে মনে হবে এ আর এমন কি সমস্যা যা নিয়ে জাতি হিসাবে আমাদের ভাবতে হবে? আমেরিকা তার দেশে প্রবেশের উপর কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করেছে যার চলমান কোন ইমপ্যাক্ট নেই। সবটাই সামনের নির্বাচনকে ঘিরে। ভবিষ্যতে কি হবে তা নিয়ে বর্তমানকে বিষাদময় করার কোন কারণ সাধারণ বাংলাদেশিদের নেই। অতীতেও ছিলনা বর্তমানেও নেই।

আমেরিকান ভিসা! বাংলাদেশের চলমান রাজনীতির জন্যে এটাও কি একটা ফ্যাক্টর? এমনটা তো হওয়ার কথা ছিলনা। আর দশটা দেশের মত আমেরিকাও দূরের একটা দেশ। যুব সমাজের অনেকের কাছে আকর্ষণীয় হলেও কোটি কোটি সাধারণ বাংলাদেশির কাছে আমেরিকা একটি দেশের নাম। ভিসা নিয়ে ঐ দেশে যাওয়ার কোন কারণ নেই তাদের জন্যে। অথচ দেশে তোলপাড় হচ্ছে ভিসা নিয়ে মার্কিনীদের নতুন সিদ্ধান্তে। অনেকে এটাকে দেশটার চলমান নির্বাচনী রাজনীতিকে বদলে দেয়ার ইঙ্গিত হিসাবে দেখছেন।

একটা দেশের ভিসা নীতি তৃতীয় বিশ্বের আরেকটা দেশের রাজনীতি বদলে দেবে অবাক হওয়ার মত ঘটনা বৈকি। আসুন কাহিনীর ভেতর যে আরেক কাহিনী আছে সেখান হতে ঘুরে আসি। আলী বাবা ৪০ চোরের কাহিনীর সাথে আমাদের কমবেশি সবার পরিচয় আছে। এই কাহিনীর যদি একটা ম্যাথম্যাটিক্যাল মডেল তৈরি করি আমেরিকা হবে সেই গুহা যাকে চল্লিশ চোরের দল তাদের লুণ্ঠিত সম্পদ সংরক্ষণের নিরাপদ জায়গা হিসাবে ব্যবহার করে আসছে।

অনেকে প্রশ্ন করবেন গণতন্ত্র নিয়ে আমেরিকার আহাজারির শুরুটা হতে পারে নিজ দেশে চল্লিশ চোরের গুহার প্রবেশদ্বার বন্ধ করে দেয়ার মাধ্যমে। বাস্তবতা হচ্ছে আমেরিকা এটা কোনদিনই করতে যাবেনা। যেমনটা করবে না নিজ দেশে ঘাপটি মেরে থাকা চল্লিশ চোরদের কাউকে আইনের আওতায় আনতে। এর কারণ খুঁজতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে আমেরিকার ফাউন্ডেশনে।

১৫০০ বিসি’র শুরুর দিকে আদিবাসীদের আগমন শুরু হয় আমেরিকায়। ইউরোপিয়ানদের আগমন আরও পরে। পৃথিবীর বিভিন্ন কোনা হতে মানুষ ছুটে এসেছিল ভাগ্য পরিবর্তনের আশায়। দেশটার মাটির তলায় লুকিয়ে থাকা সোনা আহরণ ছিল অন্যতম কারণ। এভাবে লতায় পাতায় বেড়ে উঠেছে আমেরিকা। ১৭৬০ সালের মধ্যে ২৩ লাখ মানুষ নিয়ে ব্রিটিশরা ১৩টা কলোনি গঠন করে আটলান্টিক সাগরের পাড় ঘিরে। সাউদার্ন কলোনি গঠনের মূল ভিত্তি ছিল কৃষিকাজ। এই কলোনিই আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ হতে মানুষ ধরে এনে দাস প্রথার প্রচলন করে। এই সাউদার্ন কলোনির এলাকা গুলোই পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছিল গৃহযুদ্ধে পরাজিত হয়ে। এইসব অঙ্গরাজ্য গুলোই আজকে রেড সত্যায়িত হিসাবে পরিচিত, যার বাসিন্দারা ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রিপাবলিকান দলীয় সমর্থক।

লং স্টোরি শর্ট, আমেরিকা অভিবাসীদের দেশ। এ দেশে মানুষ এসেছিল ও আসছে ভাগ্যের সন্ধানে। আসছে লোভের বশবর্তী হয়ে। সময়ের বিবর্তনে এ দেশে ফাউন্ডাররা ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে সর্বোচ্চ মূল্যায়ন করে এমন একটা শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করেন যার ভিত্তি ছিল গণতন্ত্র ও ব্যক্তি স্বাধীনতার নিশ্চয়তা। সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার কথিত অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা ও বাসস্থানের নিশ্চয়তার মত নিশ্চয়তা নেই আমেরিকান শাসনতন্ত্রে। এখানে বাঁচতে হলে লড়তে হয়, আয় করতে হয়, শ্রম দিতে হয়।

আমেরিকায় আপনি বাহির হতে কত আনলেন আর কত নিয়ে গেলেন এ নিয়ে কারও মাথা ব্যথা নেই। বরং আনা-নেয়ার পথ সুগম ও মসৃণ রাখার নামই আমেরিকান ফ্রীডম। এই ফ্রীডমের সুযোগ নিয়েই বাংলাদেশের মত তৃতীয় বিশ্বের করাপ্ট মানুষ আমেরিকাকে নিজেদের অন্যায় ও অবৈধ উপার্জন সুরক্ষা করার গুহা হিসাবে ব্যবহার করে থাকে।

বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ছেলের কথা নাই-বা টানলাম, বরং নীচের লেভেলে অনেকে যেভাবে অর্থ পাচার করেছেন তার ক্ষুদ্র একটা উদাহরণ হিসাবে উপস্থাপন করা যায় দেশটার এক কালের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মরহুম মোহম্মদ নাসিমের সন্তানের কথা। নিউ ইয়র্ক প্রবাসী এই ছাত্র ইতিমধ্যে ঐ শহরে ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন।

বর্তমান আওয়ামী সরকারের প্রায় সবার বিনিয়োগ আছে আমেরিকায়। এর সাথে যোগ হয়েছে দেশটার আমলা, সেনা, পুলিশ সহ সরকারী প্রতিষ্ঠানের অনেক হোমরা চোমরা। রাজনৈতিক ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট-খোরদের অনেকের পরিবার এখন আমেরিকায়। সন্তানরা লেখাপড়া করছে। স্ত্রীরা পানির মত অর্থ উড়াচ্ছে। ওরা আর দশটা খেটে খাওয়া বাংলাদেশির মত আমেরিকা হতে দেশে অর্থ পাঠায় না, বরং দেশ হতে অর্থ আনে। ওরা অর্থনীতির সবকটা খাত হতে লুটছে। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্ট ভেঙ্গেও অর্থ সরাচ্ছে। এসব জাতীয় লুটেরাদের মতে দেশ এখন পশ্চিমা বিশ্বের অনেক দেশের অর্থনীতিকেও নাকি হার মানিয়েছে। হ্যাঁ, হার মানিয়েছে সত্য, তবে তা সাধারণ মানুষের জন্যে না, বরং তাদের নিজেদের জন্যে।

আমেরিকা কি খুব একটা কেয়ার করে বাংলাদেশে গণতন্ত্র চর্চা নিয়ে?
সহজ উত্তর হবে, মোটেও না। আমেরিকা দেশে দেশে ছড়িয়ে থাকা এক ব্যাক্তি, এক দলীয় ও এক পরিবারের শাসনের ঘনিষ্ঠতম বন্ধু। এই তালিকায় যেমন আছে মধ্য প্রাচ্যের রাজা-বাদশার দল, তেমনি আছে সামরিক শাসকদের দল। নিজদের স্বার্থ অবিচ্ছিন্ন রাখার জন্যে আমেরিকা দেশে দেশে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতায় বসিয়েছে স্বৈরশাসকদের। সেই আমেরিকা বাংলাদেশের মত দুর্বল ও বিশ্ব জিও-পলিটিক্স খেলার ইনসিগ্নিফিকেন্ট খেলোয়াড়কে নিয়ে খেলা শুরু করেছে। রহস্যটা কোথায়?

আমার দৃষ্টিতে বাংলাদেশ নিয়ে মার্কিন আগ্রহের অন্যতম কারণ হচ্ছে দেশটার চীন প্রীতি। বিশ্ব রাজনীতিতে চীন তার ফুট-প্রিন্ট শক্ত করার মানসে তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলোতে দেদারসে বিনিয়োগ করছে। এবং এসব বিনিয়োগ দেউলিয়া বানাচ্ছে অনেক দেশের অর্থনীতি। চীনা বিনিয়োগের অন্যতম কম্পোনেন্ট হচ্ছে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের দুর্নীতি। যেহেতু চীনা অর্থের মালিক দেশটার সরকার, তাই পদ্মা সেতু প্রকল্পের মত মেগা প্রকল্পে নিজদের হিস্যা আদায়ে রাজনীতিবিদদের বিশ্ব ব্যাংকের মত প্রাইভেট এনটিটিতে ধর্না দিতে হয়না। চীনা প্রকল্পে লেনা-দেনা রাজনীতিবিদদের জন্যে সুস্বাদু ও পানির মত মসৃণ। কারণ তা হয় অতি গোপনে উচ্চ পর্যায়ে।
চীনের সাথে মার্কিনীদের বৈরী সম্পর্ক। তার সাথে মরার উপর খরার ঘায়ের মত কাজ করেছে রুশদের ইউক্রেইন আক্রমণ। এই আক্রমণ পশ্চিমা বিশ্বকে এক করেছে। ইউরোপ ও আমেরিকা একহাট্টা হয়ে ইউক্রেইনকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার সাহায্য দিচ্ছে। এবং এই জোট চাইছে বাকি বিশ্বও তাদের সাথে থাকুক।

এখানেই সমস্যা বাংলাদেশের। বাংলাদেশ জাতিসংঘ সহ অনেক উঁচু পর্যায়ে রুশদের পক্ষ নিয়েছে। ভোট দিয়েছে রুশদের অবৈধ আক্রমণ জাস্টিফাই করতে। আমেরিকা চোখ রেখেছে এসব রুশ মিত্রদের দিকে। নিশ্চিত ভাবে বলা যায় বাংলাদেশ উঠে এসেছ এ তালিকার অনেক উপরে।

মার্সিয়া বার্নিক্যাটের উপর আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হামলা আমেরিকা হালকা ভাবে নিয়েছে ভেবে থাকলে আমরা ভুল করব। তার উপর যোগ হয়েছে বর্তমান রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ঘেরাও অধ্যায়। বর্তমান সরকার গায়ে পড়ে আমেরিকার সাথে ঝগড়া বাধিয়েছে। পা দিয়েছে চীনের অনৈতিক অর্থনীতির ফাঁদে। বাংলাদেশ আমেরিকার চোখে এমন কোন দেশ নয় যা নিয়ে তাদের মাথা ঘামাত হবে। কিন্তু খোঁচা দিয়ে ঘুমন্ত সিংহকে জাগিয়ে দিলে কিছুটা যে ভয় পেতে হয় তার কিছু নমুনা ধেয়ে এসেছে সরকারের দিকে।

আমেরিকার সাথে ইটের বদলে পাটকেল ছোড়ার লড়াইয়ে নেমেছে বাংলাদেশের আপাদমস্তক করাপ্ট সরকার। ভিসা বিধিনিষেধের বদলা নিতে উঠিয়ে নিয়েছে রাষ্ট্রদূতদের নিরাপত্তা। এ অবস্থার সুযোগ নিয়ে ইসলামী সন্ত্রাসীরা যদি মার্কিন রাষ্ট্রদূতের উপর হামলা চালায় তার দায়-দায়িত্ব হাসিনা সরকারকেই নিতে হবে। এমন কিছু হলে আমেরিকার বদলা হবে আরও কঠিন।

মোরাল অব দ্যা স্টোরি হচ্ছে, জালিয়াতির মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে গেলেও তা বৈধ হবেনা আমেরিকার চোখে। তার প্রতিক্রিয়া কি হবে তা তারা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে। সমস্যা এখানেই শেখ হাসিনার। দেশে হয়ত উচ্ছিষ্ট-খোরদের নিয়ে বহাল তবিয়তে রাজত্ব করতে পারবেন কিন্তু এই রাজত্বের মূল্য দিতে হবে তার আমেরিকা প্রবাসী ছেলেকে। মন্ত্রী সভার সদস্যরা যার বিনিয়োগ করেছেন আমেরিকায় তাদের। এই তালিকায় যোগ হবেন আমলা, সেনা অফিসার সহ আরও অনেকে। হারাবেন লুটের সম্পদ। এক কথায় আমেরিকার হাতে চলে যাবে সিসিম ফাঁক মন্ত্র। আর এই মন্ত্র বলে তারা উন্মুক্ত করবে শেখ হাসিনাদের ডার্টি লন্ড্রি।

আরও একটা বাস্তবতা আমাদের মনে রাখতে হবে; আমেরিকা একক একটা দেশ হলেও তার প্রভাব ও প্রতিপত্তি বিশ্বব্যাপী। আমেরিকানদের ভিসা বিধি-নিষেধের উত্তাপ যে ইউরোপ সহ উন্নত বিশ্বের বাকি দেশেও ছড়িয়ে পারবেনা তারই বা নিশ্চয়তা কোথায়?

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
আমেরিকা, land of the free, home of the brave!, 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ১ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ২৭-০৫-২০২৩ | ৬:৩৯ |

    বাস্তবতা আমাদের মনে রাখতে হবে; আমেরিকা একক একটা দেশ হলেও তার প্রভাব ও প্রতিপত্তি বিশ্বব্যাপী। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...