একটা ভালোবাসার গল্প বলি।
অদিতি পাল টুম্পাকে আমার ফেসবুক সিনিয়র-জুনিয়র বন্ধুদের অনেকেই আমার নিলাজি কইন্যা নামে চিনে। আমার নিলাজি কইন্যা টুম্পা, সেই ছোট্টো বেলা থেকে আমাকে মামী বলে চিনেছে জেনেছে ভালোবেসেছে।
টুম্পার মা’কে আমি কমলদি ডাকি, কমলদি আমাকে বৌদি ডাকে। আমার উত্তম যখন কেমিস্ট্রির লেকচারার হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিলো, কমলদি থার্ড ইয়ারের ছাত্রী। তখন থেকে উত্তমকে স্যার ডাকা শুরু, উনার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত স্যার ডেকেছেন।
কমলদিরা মাস্টার্স শেষ করার আগেই স্যার বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে কানাডা চলে যায় পিএইচডি করতে। এরপর স্যারের সাথে কমলদির আবার দেখা হয় গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালসে। কমলদি সেখানে সিনিয়র কেমিস্ট হিসেবে কর্মরত, স্যার যোগ দিলেন আরএনডি বিভাগের প্রধান হিসেবে। কমলদি এক বিকেলে পরীর মতো ফুটফুটে এক বাচ্চাকে নিয়ে আমাদের কোয়ার্টারে এলেন স্যারের বউ বাচ্চার সাথে দেখা করতে। আমি তখন সবে জাহাঙ্গীরনগর থেকে কেমিস্ট্রিতে মাস্টার্স শেষ করেছি। একই সাবজেক্টের স্যারের পুচকি বউকে কমলদি বৌদি ডেকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। আর পুচকে পরীটাকে বললেন, টুম্পা এই যে তোমার মামী, আর আমার স্যার হচ্ছেন তোমার মামা। আর মৌটুসি তোমার বন্ধু।
প্রথম দিনেই দুই বছরের ফুটফুটে সুন্দর বাচ্চা পরীটা আমাকে ভালোবেসে ফেললো। মামী ওর ধ্যান জ্ঞান ভালোবাসা। এরপর মিশা জন্ম নিলো, ততদিনে কমলদি ঢাকা আরেক ফার্মাসিউটিক্যালসে জয়েন করেছেন।
টুম্পার সাথে সহজে দেখা হয় না, কিনতু টুম্পা আমাকে ভোলে না।
এরপর আমরা ঢাকা চলে এলাম, অস্ট্রেলিয়া গেলাম, অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরলাম, আবার আমেরিকা চলে এলাম। ততদিনে কমলদি আমার শুভাকাঙ্ক্ষী, বন্ধু, দিদি, আপনার জন হয়ে গেছে। আর টুম্পা? মামার সাথে খাতির নাই, মামার বউ মামী হয়ে গেছে ওর বন্ধু গাইড ফিলোসোফার আরও আরও অনেক কিছু। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার টুম্পা কলেজ জীবন থেকেই চুপি চুপি ভালোবেসেছে ওরই ক্লাসফ্রেন্ড পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার এবং থিয়েটার কর্মী সুদর্শন সঞ্জীবকে। চুপি চুপি নয়, ভালোবাসার কথা মামীকে জানিয়েছে। সেই থেকে আদর করে ওকে আমি নিলাজি কইন্যা ডাকি।
পৃথিবীতে এখনও একমাত্র এই নিলাজি কইন্যাটি আমাকে নি:শর্ত নি:স্বার্থভাবে ভালোবাসে। আমি যদি ওর কাছে কাঠফাটা রোদে এক পশলা বৃষ্টি চাই, ও মেঘ খুঁড়ে আমার জন্য বৃষ্টি নিয়ে আসবে। আমি যদি ওর কাছে ডুমুরের ফুল চাই, বাঘের দুধ চাই, ও যেখান থেকে পারুক আমার জন্য সব নিয়ে আসবে। সাত বছর আগে সঞ্জীবের সাথে ওর বিয়ে হয়েছে, ওর বিয়েতে যাবো বলেই আমি বাংলাদেশে গেছিলাম। কমলদি অঞ্জনদা আর টুম্পা মিলে সে কি আদর আর সম্মান দিয়েছে আমাকে, কেউ বিশ্বাসই করবে না যে ওদের সাথে আমার রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই!
সঞ্জীব টুম্পার ঘরে একটা পরীর মত বাচ্চা এসেছে, উচ্চশিক্ষার জন্য ওরা এখন লন্ডন চলে গেছে। এটুকু ছিলো ভালোবাসার ভূমিকা, এবার উপসংহার।
ক্যান্সারের থাবায় কমলদি মারা গেছেন গত বছর অক্টোবার মাসে, আমি তখন দেরাদুনে ছিলাম। কমলদি যখন হসপিটালে ছিলেন, ফেসবুকে টুম্পার আহাজারি দেখে বিমর্ষ বোধ করতাম, আবার কখনো আশার কথা শুনলে মনটা আনন্দে ভরে যেতো। অথচ আমি টুম্পাকে কল দিয়ে কথা বলার চেষ্টা করতাম না। মাঝে মাঝে মেসেঞ্জারে পজিটিভ মেসেজ পাঠাতাম, ফিংগার ক্রস করতাম যেন কমলদি সেরে ওঠে। আমারই মেয়ের বয়সী টুম্পা, আজ মাকে যমের হাত থেকে রক্ষা করতে কী যুদ্ধটাই করছে। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধটা টুম্পা জিততে পারেনি, ধরে রাখতে পারেনি ওর প্রাণপ্রিয় মা”কে। সেদিনও টুম্পা বলেছে, মামী মায়ের কষ্ট দেখতে পারছি না। তুমি একটু ঠাকুরকে বলো না, তোমার কমলদিকে ভালো করে দিতে। তোমাকে তোমার কমলদি এত ভালোবাসে, তোমার কথা ভগবান শুনবে।
সেই বিকেলে আমি সবে শিখ মন্দিরে প্রার্থনা করে এসেছি, ” হে ঈশ্বর, কমলদির দেহের কষ্ট কমুক, কমলদি দেহে আরাম পাক। গেস্ট হাউজে ঢুকতেই বাংলাদেশ থেকে টুম্পার ফোন, ” মামী গো, মা তো চলে গেলো”! ব্যস এরপর টুম্পার সাথে আর কথা হয়নি। এবার বাংলাদেশে গেলাম। টুম্পা লন্ডনে, ওর বাবা মানে অঞ্জনদা নিজের বাড়িতে। আমি অঞ্জনদার সাথে দেখা করতে যাবো শুনে টুম্পা আমাকে আগেই বলেছিলো, মামী, আমি নাই তো কি হয়েছে, ঘরে তোমার কমলদি আছে। তুমি তোমার কমলদির বিছানায় বসবে, কমলদির ছবিতে হাত বুলিয়ে দিও। তোমার কমলদি কিন্তু খুব খুশি হবে। আমি গেছি, কমলদির শূন্য ঘরে শূন্য বিছানায় বসেছি। অঞ্জনদার সাথে কথা বলছি, লন্ডন থেকে টুম্পা ভিডিও কল দিয়েছে ওর বাবাকে। ভিডিও কলেই কী কান্না, ওর কান্না দেখে মনে হচ্ছিলো আমার মৌটুসি কাঁদছে!
কান্না থামলো, ওর বাবাকে বললো, বাবা মায়ের আলমারির দরজা খোলো। মেয়ের নির্দেশ পালন করলেন অঞ্জনদা। এবার টুম্পা আমাকে বললো, মামী, এই আলমারিতে মায়ের শাড়ি শাল আরও অনেক কিছু রাখা আছে। তুমি তোমার পছন্দমতো মায়ের একটা শাড়ি নাও, আমি চাই মায়ের একটা চিহ্ন তোমার কাছে থাকুক। মা খুব ভালোবাসতো তোমাকে, তুমি মায়ের চিহ্ন নিয়ে যাও।
বললাম, টুম্পা শাড়ি নিতে হবে না। মায়ের চিহ্ন সযত্নে থাকুক তোর জন্য। কমলদি আমার হৃদয়ে থাকবে।
টুম্পা বললো, মামী তুমিও তো আমার মা, মায়ের চেয়ে তো কম না। প্লিজ, আমি চাই মায়ের একটা শাড়ি তুমি নাও।
আলমারির দরজা অর্ধেক খোলা, ভেতরে অন্ধকার। অঞ্জনদা সবে ফোনের টর্চ জ্বালিয়েছেন যেন আমি আলমারির ভেতরটা দেখতে পাই। আমি অঞ্জনদাকে থামিয়ে দিলাম। আলমারির অন্ধকার তাকে হাত ঢুকিয়ে প্রথম যে প্যাকেটে হাত স্পর্শ করলো, সেই প্যাকেটটাই টেনে নিলাম। প্যাকেটের গায়ে আলো পড়তেই আমি চমকে গেলাম। শাড়ির গায়ে লেখা, ” ভালোবাসি মা”! আমার চোখের সামনের দেয়ালে কমলদির যে ছবিটা আছে, এই শাড়িটাই উনার পরনে। টুম্পা বললো, মামী, এই শাড়িটা গত বছর মা’কে মাদার’স ডেতে দিয়েছিলাম। এটাই আমার দেয়া শেষ শাড়ি, এটাই মায়ের শেষ ছবি। এরপর তো মাকে নিয়ে হাসপাতাল আর বাসা করেই কেটে গেলো।
অনেকক্ষণ চোখের জল আটকে রেখেছিলাম, আর আটকাতে পারলাম না। চোখ ভিজে গেলো। টুম্পাকে বললাম, তুই একটু আগেই বললি, আমি তোর মায়ের চেয়ে কম না। এইজন্যই বোধ হয়, এই শাড়িটাই আমার হাতে এসেছে। আমেরিকা ফিরে এসেছি। শাড়িটা খুব যত্ন করে রেখেছি।
আজ এসেছে সেই লগন। ‘ভালোবাসি মা’ শাড়িটা পরে ভিডিও কল করেছি টুম্পাকে। গত পরশু টুম্পার বাবা লন্ডন গেছেন মেয়ে জামাই নাতনির সাথে দেখা করতে। মাত্র দুই সপ্তাহের জন্য গেছেন, তাই টুম্পা সপরিবারে বাবাকে নিয়ে লন্ডন শহর ঘুরছে। ভিডিও কলে আমাকে ওর মায়ের শাড়িতে দেখে কী যে খুশি, কী যে খুশি। বললাম, ‘ভালোবাসি মা’ শাড়ি আর টিপ পরে নেপালি রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ খেতে যাচ্ছি। এই প্রথম মনে হলো, সন্তানের কাছে মাদার’স ডের মান রাখতে পেরেছি।
loading...
loading...
যাপিত জীবনের গল্প বরাবরই আপনার হাতে অসাধারণ উঠে আসে।
loading...
জীবনের গল্প শুনতে আর পড়তে খুবই ভালো লাগে। লেখিকার জন্য শুভকামনা থাকলো।
loading...