উজ্জ্বল স্মৃতির উজ্জ্বল গল্প!

rty ২০১৭ সালের কথা। মৃত্যুপথযাত্রী বাবা মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরেছেন। হসপিটাল থেকে একটু সুস্থ করে চলৎশক্তি রহিত বাবাকে বাড়িতে আনা হয়েছে। বাবার চার সন্তানই বাবার সামনে উপস্থিত। নতুন জীবন ফিরে পেয়েছেন এবং তিন সুপুত্র আর হাড়জ্বালানো কন্যাটিকে সারাক্ষণ চোখের সামনে দেখতে পেয়ে রাশভারী রাগী স্বভাবের বাবা শিশুর মতো সহজ সরল হয়ে উঠেছেন। চেষ্টা করছেন শোয়া অবস্থায় কারো সাহায্য ছাড়া নিজে নিজে এপাশ ওপাশ করতে। হাড় জ্বালানো কন্যা সামনে থাকলে বাবা নিজে নিজে শোয়া থেকে উঠে বসার চেষ্টা করেন, কন্যার কাছে প্রমাণ করতে চান, ৯০ বছর বয়সেও বাবা কারো সাহায্য ছাড়াই চলতে পারেন!

বিশেষ করে যখনই তাঁর পুত্রদের কাছে পান, নিজে নিজেই শোয়া থেকে উঠে বসেন। পুত্ররা বাবার কেরামতি দেখে অবাক হয়, আশ্বস্ত হয়। সাথে যোগ হয়েছে, কথা বলা। শিশু যখন নতুন কথা বলতে শিখে, সারাক্ষণ টর টর করে, বাবাও তেমনি। হাসপাতালে তো অচেতন ছিলেন দিনের পর দিন, তাই নতুন জীবন ফিরে পেতেই কত রকমের কথা বাবার ঠোঁটের আগায় চলে আসতো! কন্যাকে কিছুটা সমঝে চললেও পুত্রদের কাউকে কাছাকাছি পেলেই কাছে ডেকে গল্প করতো।

সেদিনও বড়ো পুত্র, মেজো পুত্রকে বাবার কক্ষে প্রবেশ করতে দেখেই বাবা নিজে নিজেই শোয়া থেকে উঠে বসেছেন। বড়ো পুত্রের হাতে চানাচুর মুড়ি ভর্তি বাটি, বাবাকেও সাধলো মুড়ি। বাবা শিশুর মত উচ্ছ্বল হয়ে সাধু চলিত মিলিয়ে বলল, “অবশ্যই খামু। এমন সুযোগ জীবনে আর আসিবে না। আমার বিদেশ ফেরত পুত্র নিজের বাটি থেকে আমাকে চানাচুর মুড়ি খাওয়াচ্ছে “।
বাবার কথা শুনে আমরা খুব মজা পাচ্ছিলাম।

এরপর দুই পুত্রকে কাছে বসালেন, দুই পুত্রের সাথে বাবা তাঁর ছেলেবেলার গল্প জুড়ে দিলেন। বাবার ছোটো পুত্র তখন নরসিংদী কলেজে অধ্যাপনা নিয়ে ব্যস্ত, আর আমি দুই কান খোলা রেখে পাশের ঘরে ল্যাপটপ খুলে বসেছি এবং বাবা পুত্রের গালগল্প শুনছি। বাবার বলা গল্প থেকে বাবার জীবনের না-বলা অনেক তথ্য উদ্ধার করলাম।

** বাবার ঠাকুরদাদা ছিলেন অঞ্চলের নামকরা তালুকদার, ঠাকুরদাদার মেজাজও ছিলো তালুকদারি। বিশাল বাড়ি, বাড়ি ভর্তি জ্ঞাতি গুষ্ঠি, ভাই বোন স্বজনের মেলা। ঠাকুরদাদার বয়স বাড়ে, বয়স বাড়ে, বয়স বাড়ে সেই সাথে ধীরে ধীরে তালুকদারি চলে যায়, স্বজনের ভীড় কমে যায় শুধু বংশের তালুকদারী তেজটাই রয়ে যায়। সেই তেজই পুরুষানুক্রমে বাবার মধ্যেও এসেছে। এরপর বললো, বাবার বাপ কাকাদের গল্প। নিজের বাবার সাথে বেশী সময় কাটানোর সুযোগ হয়নি, কারণ বাবার বয়স যখন তেরো, বাবার বাবা মারা যান।

এক পুরুষে তালুকদারি ফুরিয়ে গেলেও, তালুকদার বাড়ির ছেলেমেয়েদের জেঠা, কাকা পিসীদের সাথে মধুর সম্পর্ক টিকে ছিলো। বাবার ছিলেন পাঁচ কাকা। সোনা কাকা, ধন কাকা, সুন্দর কাকা, সেইজা কাকা, দুদু কাকা।
বাবার সকল কাকাদের তালুকদারি তেজ থাকলেও সেইজা কাকা ছিলেন ব্যতিক্রম। সেইজা কাকা জলের মতো সরল সহজ। সেইজা কাকা ছিলেন গ্রামের শত বর্ষ পুরনো স্কুলের শিক্ষক। সেইজা কাকার মধ্যে শিশুতোষ সরলতা ছিলো। ফলে ছোটো ছোটো ভাতিজা ভাতিজি ভাগ্নের সাথে খুব ভাব ছিলো।

স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেই ভাতিজা ভাতিজিদের হাঁক পেড়ে ডাকতেন। স্কুলে শিক্ষক রুমে যে সকল গল্প শুনে আসতেন, বাড়ি ফিরে ভাতিজাদের সাথে সেসব গল্প করতেন। সেই সব শোনা গল্পের মধ্যে একটা গল্পের কথা বাবার আজও মনে আছে। গল্পটা এমনঃ

লন্ডনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কে ডি ঘোষ মহাশয়। যে সময়ের কথা, তখন ভারতবর্ষের গ্রামবাংলার বিভিন্ন স্কুলের ইন্সপেকশনে বিলাত থেকে আসতেন বড়ো বড়ো স্কুল কলেজের শিক্ষকরা। একবার এক স্কুলের ইন্সপেকশানে এসে কে ডি ঘোষ মহাশয় চুপি চুপি পেছনের দরজা দিয়ে শ্রেণীকক্ষে ঢুকে ছাত্রদের সারিতে একেবারে পেছনের বেঞ্চে বসলেন। সেই ক্লাসে শিক্ষক মহাশয় তখন ছাত্রদের একেকজনকে দাঁড় করিয়ে নানা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছেন, উত্তর সঠিক না হলে উনার হাতের বেত ছাত্রের পিঠে মারছেন।
এক ছাত্রকে জিজ্ঞেস করলেন,
“জগা, বল দেখি, চিরুনি মানে কি?
জগা প্রথমে কিছু বলে না, ভয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
শিক্ষক হুংকার ছাড়েন, চিরুনি মানে বলতে না পারলে বেত পিঠে ভাঙবো।
জগা বলে, “চিরনি মানে ফারুনি”
শিক্ষক তেড়ে আসেন, “কী বললি? চিরুনি মানে ফারুনি? আমার সাথে রসিকতা?”

জগার পিঠে বেত পড়ার আগেই ছাত্রদের মাঝ থেকে ইন্সপেক্টর কে ডি ঘোষ উঠে দাঁড়ালেন, শিক্ষককে বলেন, ” থামুন। এই ছাত্রকে বেত্রাঘাত করবেন কেন? সে কী ভুল বলেছে? চিরুনি মানে সে সঠিকই বলেছে। চিরুনি মানে তো ফারুনিই হয়। কাঠ চেরা হয় যা দিয়ে, তাকে বলে চিরুনি। কাঠ চেরা মানে কাঠ ফাড়া। তাহলে আপনিই বলুন, চিরুনির আরেক অর্থ কি দাঁড়ায়? এই ছাত্রটি অত্যন্ত বুদ্ধিমান। সে তার বুদ্ধি দিয়ে চিরুনির সমার্থক শব্দ বের করেছে। কোথায় তাকে পুরষ্কৃত করবেন, তা নয়, তাকে তিরস্কার করছেন!”

**জগা নামের সেদিনের বালক পরবর্তিতে স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু হয়েছিলেন।**
বাবা গল্পে আরও যোগ করলেন,
“আমরা যখন প্রাইমারী স্কুলে পড়তাম, এই ইন্সপেক্টর কে ডি ঘোষ কিন্তু আমাদের স্কুল ইন্সপেকশানেও আসতেন। এবার বুঝে দ্যাখ্, তখনকার দিনের শিক্ষা ব্যবস্থা কেমন ছিলো! অক্সফোর্ডে যিনি অধ্যাপনা করেছেন, তিনি গ্রামের স্কুল ইন্সপেকশানে আসতেন। ভাবতে পারিস? আর দুই পাতা ইংলিশ পড়ে আজকালের পোলাপান ডক্টরেট ডিগ্রীর গরম দেখায়!”

কিছুদিন পর বাবা হামাগুড়ি দিয়ে বিছানা থেকে নেমে নিজে নিজেই চেয়ারে বসেন, নিজে হাতে ভাত মেখে খান, চায়ের কাপে চুমুক দেন, আমাদের আশ্বস্ত করেন খুব তাড়াতাড়ি তিনি লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটবেন। আমরা চার ভাইবোন আবার যার যার ঘরে ফিরে যাই। বড়দা আর আমি চলে আসি বাবার দেশের বাইরে যার যার নিজের দেশে।

২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমি আবার দেশে যাই। ততোদিনে বাবা আবার আগের ফর্ম ফিরে পেয়েছেন। ঘরে নিয়মিত ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করেন, পত্রিকা পড়েন, কন্যার লেখা বই শিয়রে রেখে ঘুমান।
************************
**বাবা আমাদের ছোটোবেলায় নিজেই আমাদের প্রত্যেককে ইংলিশ পড়াতেন। পড়ানোর সময় যখন কেমব্রিজ, অক্সফোর্ড হার্ভার্ডের নাম বলতেন, বাবার গলার স্বরে ঝরে পড়তো সমীহ, মুগ্ধতা। সাধ্য তো ছিলো না ওখানে যাওয়ার, হয়তো মনে মনে কল্পনার জাল বুনতেন, হয়তো সাধ হতো কেমব্রিজ অক্সফোর্ডের মাটি ছুঁয়ে দেখার!

২০১৯ সালের জুলাইয়ের শেষে ছয়দিনের সফরে বন্ধু বন্যা আর আমি লন্ডন গেছিলাম। আমার মাসতুতো বোনের বাড়িতে উঠেছি। বোনের বর প্রথম দিনেই আমাদেরকে নিয়ে গেছিলেন কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে।
কেমব্রিজে পৌঁছে প্রথমেই যাঁর মুখ মনে পড়েছিলো, তিনি আমার বাবা। প্রচুর ছবি তুলেছিলাম। ফেসবুকে তখন ব্যান ছিলাম তাই ছবিগুলো পোস্ট করতে পারিনি। ছবিগুলো পোস্ট করতে পারলে হয়তো আমার মেজদা অথবা ছোটো ভাই বাবাকে কেমব্রিজের ক্যাম্পাসে দাঁড়ানো বাবার হাড়জ্বালানো কন্যার ছবি দেখাতে পারতো!

আমি ঠিক করে রেখেছিলাম, ২০২১ সালে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর বাবার সাথে সেলিব্রেট করবো! তখন কেমব্রিজের ছবি, কুইন ভিক্টোরিয়ার বাড়ির ছবি, বাকিংহাম প্যালেসের ছবি দেখাবো! ২০২০ সালের সেপ্টেমবারে বাবা মারা যান। আসলে কিছু কিছু স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়! এবং সেটাই ভালো। স্বপ্নের অতীত বর্তমান ভবিষ্যত নিয়ে খেলা করতে করতেই আমার অবসর সময় বেশ কেটে যায়।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
উজ্জ্বল স্মৃতির উজ্জ্বল গল্প!, 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ১ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ০৯-০৫-২০২৩ | ১৮:১২ |

    আসলে কিছু কিছু স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়! এবং সেটাই ভালো। স্বপ্নের অতীত বর্তমান ভবিষ্যত নিয়ে খেলা করতে করতেই আমার অবসর সময় বেশ কেটে যায়। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...