মৃত্যু এখন আমাদের দলে হানা দিতে শুরু করেছে। মৃত্যু এলে মরে যেতে হয়। যদি কখনো সুযোগ না পাই, কয়েকটা কথা এখানেই বলে রাখি। আমি সাধারণত জেনে বুঝে ইচ্ছে করে কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করি না, কারো মনে আঘাত দেয়ার সুযোগ খুঁজি না, মনের অজান্তেও কারো ক্ষতি করি না।
হ্যাঁ মতে না মিললে একটু ঝাঁজিয়ে উঠি, অভিমান করি, দুই দিন গাল ফুলিয়ে রাখি। তারপরেও আমার আচরণে, কথায় কেউ কেউ নিশ্চয়ই মনে ব্যথা পায়। আমি যদি বুঝতে পারি আমার উপর কারো অভিমান হয়েছে অথবা আমার কোনো কথায় আহত হয়েছে, আমি অনুতপ্ত হই, তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেই। আমি তো দেবী নই, শয়তানও নই। রক্ত মাংসে তৈরি মানুষ। অসৎ নই ঠিক, তার পরেও কাজে কথায় ভুল ভ্রান্তি তো হয়ই।
ফেসবুকে সম মানসিকতার নারী পুরুষ কয়েকজন মিলে আমাদের একটা বন্ধু পরিবার গড়ে উঠেছে। সেই পরিবারে বয়সে আমার চেয়ে বড়ো সদস্য আছেন, বয়সে আমার চেয়ে অনেক ছোটো সদস্য আছে, আর আমরা কাছাকাছি বয়সীরা তো আছিই। ২০১৯ সালে দেশে যাওয়ার পর আমাদের দলের প্রায় সকলের সাথেই দেখা হয়েছে, আড্ডা হয়েছে।
কয়েক মাস পর সেই দল থেকে প্রথম চলে গেলেন মাসুদ করিম ভাই। মাসুদ করিম ভাই চলে যাওয়ায় ধাক্কা খেয়েছি প্রচন্ড, কারণ আমেরিকা ফিরে আসার দিন মাসুদ ভাই খুব করে চাইছিলেন আমার সাথে একটু দেখা করার জন্য। আমেরিকা ফেরার দিন আমি এমনিতেই মানসিকভাবে কাতর থাকি, তাই মাসুদ ভাইয়ের সাথে বাইরে কোথাও বসে চা খাওয়ার চিন্তাই করিনি। মাসুদ ভাই হাল ছাড়েননি, তিনি রাত বারোটার সময় এয়ারপোর্টে গিয়ে আমার সাথে দেখা করতে চাইলেন। উনার এই আকুলতার প্রতি আমি সম্মান দেখাতে পারিনি। বরং রাত বারোটায় উনি এয়ারপোর্টে এসে আবার বাসায় ফিরতে উনার কষ্ট হবে ভেবেছিলাম, তাই উনাকে এয়ারপোর্টে আসতে মানা করেছি।
তার কয়েকমাস পরেই মাসুদ ভাই মারা যান। মাসুদ ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ শুনে মর্মাহত হওয়ার পাশাপাশি খুব গ্লানি বোধ হয়েছিলো। মাসুদ ভাই কি মৃত্যুর গন্ধ টের পেয়েছিলেন, তাই কি শেষবার দেখা করতে চেয়েছিলেন! আহারে, আমার ব্যবহারে উনি নিশ্চয়ই কষ্ট পেয়েছিলেন। এরপর সব কিছু মোটামুটি ঠিক চলছিল। করোনা এসেই আবার সব লন্ডভন্ড করে দিলো।
আমার আর দেশে যাওয়া হলো না।
২০২২ পর্যন্ত আমাদের দলের সকলেই ভালো ছিলো, কেউ কেউ করোনা আক্রান্ত হয়েও ফাইট দিয়ে সুস্থ হয়ে গেছে।
২০২৩ চলে এলো, চার বছর পেরিয়ে গেছে দেশে যাইনি। এত লম্বা সময় দেশে না যাওয়ার রেকর্ড আমার নেই। বাবাকে দেখতে যেতাম, ২০২০ সালে বাবা চলে যাওয়ার পর কি তবে আমার দেশে যাওয়ার তাড়া কমে গেছে? না, তা নয়। দেশে আমি এমনিতেই যাই, দেশে আমার ভালো লাগে, ধূলা বালি মশা মাছির সাথেই তো বড়ো হয়েছি, তাই ধূলা বালি, রাস্তা ভর্তি গিজগিজ করা মানুষেই আমি অভ্যস্ত। মাত্রই ভাবছিলাম আবার দেশে যাওয়ার কথা। সবার সাথে দেখা হবে, আড্ডা হবে। এবার আর কারো মনে ব্যথা দেয়ার মতো কাজ করবো না। সবাই মিলে মাসুদ ভাইয়ের জন্য একটু প্রার্থনা করবো।
শফি আজিম ভাই, আখতার ভাই, জাহিদ ভাই, ইদু ভাই, আতাউর ভাই, সুজিত দাদা প্রমুখ সকলেই আমার বন্ধু হিতাকাঙ্ক্ষী পরমাত্মীয়। কত দিন উনাদের সাথে দেখা হয় না, মেসেঞ্জারে মাঝে মধ্যে কথা হয়। এবার দেশে গেলে প্রত্যেকের বাড়িতে আমি নিজে গিয়ে দেখা করবো, আড্ডা দেবো।
ওমা, জানুয়ারির ১০ তারিখে আমার অতি প্রিয়জন ছোটো মেসোর মৃত্যুসংবাদ হজম করতে পারিনি, ১১ তারিখেই হাসপাতাল থেকে শফি ভাইয়ের স্ট্যাটাস, উনি হাসপাতালে।
অথচ আগের দিনই আমাকে উনি মেসোর মৃত্যুতে সমবেদনা জানিয়েছেন!
ইনবক্সে মেসেজ দিলাম, দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন, দেশে এসে জমিয়ে আড্ডা দেবো। শফি ভাই সাথে সাথে আমার কমেন্টে লাভ ইমো দিয়ে উত্তরে লিখলেন, হৃদযন্ত্র বিকল হতে হতে এই যাত্রায় বেঁচে গেছি রে দিদি।
সেই শফি ভাই ১৫ তারিখে মারা গেলেন। শফি ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদে ইদু ভাই শোক প্রকাশ করে কমেন্ট দিলেন। আতাউর ভাই গত পরশু দিনের আগের দিন ইদু ভাইয়ের বাসায় গেছেন, গল্পগুজব করেছেন৷ চা খেয়ে ফেরার সময় ইদু ভাই নিজেই আতাউর ভাইয়ের সাথে সেলফি তুললেন। তার পরদিন আতাউর ভাই শুনলেন, ইদু ভাই হাসপাতালের আইসিইউতে। আর আজ ইদু ভাইও চলে গেলেন।
এবার আমার ভয় করছে। মৃত্যু আমাদের দলের সীমানা চিনে ফেলেছে। হাতের কাছে যাকে পাবে, খপ করে ধরবে আর ঝোলার ভেতর ভরবে। এখন আর মৃত্যু সংবাদে আশ্চর্য হবো না। মৃত্যুকে আমার বেজায় ভয়, মৃত্যু থেকে পালিয়ে থাকতে চাই, তারপরেও জানি, মৃত্যু একদিন আমায় ঠিকই ধরে ফেলবে।
মৃত্যু যখন আমায় ধরে ফেলবে তখন তো কারো কাছে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগও দিবে না! তাই এখানেই আজ আমি তাদের কাছে ক্ষমা চাইছি, আমার অনিচ্ছাকৃত ভুলে, আচরণে, কথায় যারা মনে ব্যথা পেয়েছেন।
আপনাদের ক্ষমা আমার মনের শক্তি। আগে ভাগেই সকলের কাছে ক্ষমা চাইছি কারণ মৃত্যু যখন আমায় ধরবে, আমি যেনো নির্ভয়ে হাসিমুখে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে পারি।
loading...
loading...
যাপিত জীবনের গল্প এবং যাপিত জীবনের অনুভব। ভালো থাকুন লেখক।
loading...