আমাদের বেড়াল আমাদের মতো হয়নি

আঠাশ (ক)
বাবার ঘরে ঢুকতেই হাতে একখানা থিন বিস্কুট আর ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ থাকার ইশারা। চাঁদ দেখল, তর্জনীর সমান্তরালে বাবার দু’গালে জলের দুটো সোঁতা। মা গাইছে “যে জানে না পথ কাঁদাও তারে”। কোন পথ? ফস ক’রে মনে পড়ে, গত বছর রেশনবাড়ির রথের মেলাতে সে দু’ থেকে আড়াই মিনিট হারিয়ে গেছিল।

রাস্তা ভিড়ের মধ্যে ব্যক্তির পা থেকে মাথায় উঠে আসে, অথবা যে-কোনও জমায়েতই প্রথমে আহার করে সড়কটিকে। মানুষ মূলত অচেনা ব’লে মানুষের ভেতর দিয়ে খুঁজতে গেলে নিজের বাড়ির দিশা আর পাওয়া হয় না। তখন কান্না আসে শিথিলতার মতো। একটু কেঁদে নিই, পরে নয় আবার খুঁজব। বাবার রোদনও গানের সঙ্গে ওই রকম একটা সমঝোতায় এসেছে মনে হল। নইলে, তার তো এতবড় হাঁ ক’রে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে ছিরকুট্টি করার কথা। নাকি বাবাদের হৃদয়ব্যথা এরকমই হয়! চাঁদ বিস্কুট হাতে ব’সে থাকল কিশমিশের জন্যে, যদিও ধূপের ধোঁয়ার মতো ময়ানের মাখন-গন্ধটা তাকে অবশ ক’রে দিচ্ছে। ঝুঁকে বাবার মুখ পড়তে গেল “অংকবই নিয়ে আসব?” প্রশ্নসহ; কিন্তু মুড বদ্‌লে নির্মল এখন স্যাঁতসেতে চোখেই মুচকি হাসি দিচ্ছে। মায়ের নতুন গানে অনেক দুখদরদের কথা থাকার পরেও বাবার এত পুলক কীসের!

চাঁদ তো দ্যাখেনি, ভটচাজরা ছিল খুলনার ‘ধানি-পানি গিরোস্তো’, দক্ষিণ-এ মানে সুন্দরবনে তাদের বেশ কিছু ঘর প্রজা ও আবাদ। রানী রাসমণিরও জমি-জিরেত সে-আবাদের পাশে। এ-হেন ফ্যামিলিতে মেধাবী, সুপুরুষ কিন্তু অনভিলাষী ছোট ছেলেটা কাব্যতীর্থ পাশ ক’রে দৌলতপুর স্কুলে মাস্টারি জোটাতেই বাড়ির লোকজন তাকে সংসারী করতে ব্যস্ত হল। ঘটক খবর নিয়ে আসে — পালটি ঘর, সম্পন্ন পরিবার, সুন্দরী পাত্রী; কিন্তু নির্মলের এক কথা, পড়াশুনোর বাইরে অন্য কোনও ঝক্কিতে সে ঘাড় পাতবে না।

এর মধ্যে এক বর্ষাভোরে সেনহাটির লাগোয়া গ্রাম মহেশ্বরবাসা থেকে ননীবালা নামের বিধবা মহিলাটি এসে খুব করে ধরে বসলেন নির্মলের ঠাকুরদাকে। তার দুই মেয়ের বড়কে যদি একটিবার দেখে আসা হয়। মেয়ের বাবা ঝালকাঠির জমিদার ঘোষালের আসর-ম্যায়ফিলে বাঁশি বাজাত, হঠাৎ করে কালাজ্বরে মারা গেছে গতবছর। তারা নিতান্ত গরীব, দেওয়া-থোয়ার সামর্থ্য নেই, মেয়ে যে রূপবতী এমন দাবীও করছেন না, তবু…।

টালির চাল ফুটো হয়ে বৃষ্টিতে বিছানা ভেসে যাচ্ছে, এদিকে ঘরে ডুগি-তবলা, ফ্লুটবাঁশি… এক কোণে ছেঁড়া চাদরে জড়ানো একটা এস্রাজও। গান জানো, মা?

শ্যামরঙা রোগাসোগা মেয়েটা গেয়েছিল ‘দুঃখের বরষায় চক্ষের জল যেই নামল’। শেষ হতে সে মুখ-নিচু ব’সে, আর চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে পাত্রের বাবা, ঠাকুরদা, দুই পিসি…গোটা শ্বশুরবাড়ি টিম। এরপর থেকে প্রতিদিন সন্ধেবেলা সেনহাটির সেই ভদ্রাসনে হাঁক পড়ত, কি ছোটবৌমা, আজ রবি ঘটকের গান শুনতি পাবো না বুঝি!

এ-বঙ্গে আসার পর নির্মল কাউকে না ব’লেক’য়ে একটা পুরোনো সিঙ্গল-রিড হারমোনিয়াম কিনে আনল। নয়ত কবেই তার বউ কলতলায় খ্যানখেনে চোপা করা মাথায় বড়িখোঁপা বাঙালি সামুরাই হয়ে যায়! পাত্রীদেখার দিনের মতো চায়ে অতটা চিনি মায়া এখন দেয় না, তেমনি তার সেই প্রথম শোনানো গানের লিকার, দুধ, খুশবু আরও টনকো হয়েছে গত তিরিশ বছরে।

নির্মল হাসবে না কেন?

আঠাশ (খ)
আসলে বাসুরই ভুল; শুরুতেই যাওয়া উচিত ছিল চাষিপাড়ার ডিরেকশানে, ধরো, ইসুবাটি কি কালিয়ানই। ওদিককার লোকজন সন্ধে একটু ডাগর হলেই খাওয়া-দাওয়া সারে, খুব ভোরে উঠে মাঠ নিড়োতে যেতে হবে না? অনেকটা হেঁটে যশোর রোড, তেঁতুলতলার ব্রিজ পার হয়ে বাসু এসে ঢুকল ইসুবাটির মুখে। তারপর একটা ঘনমতো বাঁশবাগান দেখে থলে উপুড়।

ফিরে আসার রাস্তায় নিজের পাদুটো আর টানতে পারছিল না তাকে। কিশমিশ কী করছে এখন ভরপুর ভয়ে স্ট্যাচু হয়ে থাকা গাছপালার অন্ধকারে? মিউ-মিউ ডেকে বেরিয়ে এসেছে রাস্তায়, গা ঘেঁষে হর্নের ধমক বাজিয়ে ছুটে যাচ্ছে টেম্পো বা সাইকেল? হয়ত কুকুরের দল সারারাত ওকে তাড়া করে মেরে ফেলতে চাইবে আর রেহাই পেলে কাল সকালে স্কুলের বাচ্চাদের হাতের টিপ-প্র্যাকটিস! কেন সে কিশমিশের জন্যে ভাইবোনের সঙ্গে গলা মেলাল না? নয় ঘরে ঢুকতে দিত না, ছুঁতোই না, শুধু খাবার বেড়ে দেওয়া কলতলার চাতালে। তবু চোখের সামনে থাকত তো বেড়ালটা! কত বড় জহ্লাদের মতো সে তাকে যমের মুখে ফেলে দিয়ে এসেছে।

মৈত্রী সংঘ পেরিয়ে আর একটা বাঁক, তার পরই নিজের পাড়ায় ঢুকে যাবে। মায়ের গলা প্রজাপতির মতো বাতাস সাঁতরে আসছে — ধন্য এ জাগরণ, ধন্য এ ক্রন্দন, ধন্য রে ধন্য। হঠাৎ…আরে, সামনে ওটা কী…কে ওটা…কিশমিশ না! বাসু ছুট্টে গিয়ে কোলে তুলে নিয়েছে—কীভাবে চিনে এলি এতদূর থেকে, আমি তো খেয়ালই করিনি… চল চল, মাকে সব বুঝিয়ে বলব। কিন্তু কিশমিশ কেমন ছটফট করছে কোলের মধ্যে; ওহ নামবি, হিসু করবি বুঝি? বাসুদেব ওকে রেখে দিচ্ছে মাটিতে। আর তখুনি সেই বেড়াল লাফ দিয়ে উঠে গেল চণ্ডীবাবুস্যারের বাগানঘেরা বাড়ির ছ’ফুট পাঁচিলে। তখন অর্ধেক চাঁদ মাথার ওপর বিচারকের আসনে, জ্যোৎস্নায় গোটা পৃথিবী ধোয়ামোছা পুজোমণ্ডপ। আর পাঁচিল থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে ভীষণ এক অচেনা চোখে তাকিয়ে আছে কিশমিশ! ঘাবড়ে গিয়ে যেই অল্প একটু হাত বাড়াবে, চটাং ক’রে লাফ দিল ওই অতোটা উঁচু থেকে, বাগানের ভেতর। কিচ্ছু বুঝতে পারছিল না বাসু। অপেক্ষা করল… অপেক্ষা করল, তারপর “কোথায় গেলি, ফিরে আয় লক্ষ্মীটি, তোকে আর কোনওদিন ফেলে আসব না, মা ষষ্ঠীর দিব্যি”। ডাকতে ডাকতে তার গলা থ’কে যাচ্ছে, বাতাসে নামা কদমরেণুর মতো হিমে ভিজে যাচ্ছে কথাগুলো।

চাঁদের আলো ঠিকরোনো বাগানের কলাপাতা শুধু মাথা নাড়ছিল — না, না, না…।

.
(শেষ)

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
আমাদের বেড়াল আমাদের মতো হয়নি, 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

২ টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ২ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ১৭-০৪-২০২৩ | ১৩:২৪ |

    এককথায় এই কথা গল্পের একদম পারফেক্ট শুভ সমাপ্তি। শুভ কামনা প্রিয় কবি। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    GD Star Rating
    loading...
  2. নিতাই বাবু : ১৯-০৪-২০২৩ | ১৮:০৭ |

    যাপিত জীবনের গল্প! ভালো লাগার এক গল্প পড়লাম। প্রিয় লেখকের জন্য শুভকামনা থাকলো। 

    GD Star Rating
    loading...