আমাদের বেড়াল আমাদের মতো হয়নি

আঠাশ (ক)
আকাশ থেকে টাঙানো ছায়ার কুচি দেওয়া ফুল সাইজ বিকেল, সেই চাঁদোয়ার নীচে হারমোনিয়াম বেজে উঠল। কলোনির বাচ্চারা ডিঙি পেড়ে জানলা দিয়ে তাকিয়ে খিকখিক ক’রে হেসে পালাচ্ছে — এমা এত বড় কাকিমা গান গায়! মায়ের মুখোমুখি বিভোর শিউলি; পাশে চাঁদ বেলোর ফুটোয় পায়ের আঙুল ঢুকিয়ে দিচ্ছে আর ততবার মাথায় হালকা চাঁটি সঞ্জুর। ননীবালা ঘরে ঢুকে চৌকাঠের কাছে করজোড়ে বসে পড়ল। তাই দেখে নাতিনাতনির হাসি — হিন্দি সিনেমার গান শুনলেও দিদ্‌মা হাতজোড় ক’রে দেয়।

সংগীত, ঈশ্বর, মৃত স্বামী — তিনটির ‘পরে ভক্তি ননীবালা এই প্রার্থনাভঙ্গির ভেতর দিয়ে একজোটে প্রকাশ করে। পাশের ঘরে চায়ে চুমুক দিতে দিতে নির্মল ভাবছিল শ্বশুর জানকী চাটুজ্জের কথা। যত রকম সুষিরযন্ত্র, সবই নাকি বাজাতে পারতেন ভদ্রলোক। বাঁশিজানকীর বাজনা শুনে কেঁদেছে এমন মানুষ পূর্ববঙ্গে অবিরল। আর তার মেয়ের ঠোঁটের বদলে গলায় লেগেছে সুর।

‘প্রভু আমার প্রিয় আমার’ দিয়ে মায়ার শুভ মহরত, হারমোনিয়ামে কন্ঠ মিশে কাঠের উনুনের ধোঁয়ার মতো ভরিয়ে দিল ঘর। কথাসুরের চাপ বাড়তে বাড়তে ‘মুক্তি আমার বন্ধনডোর’-এ বাড়ির দেয়াল ধপাধপ মাটিতে লুটোচ্ছে, সন্ধের বাতাসপথে নির্মল হাঁটতে লাগল ‘দুঃখসুখের চরম’-এর ভেতর দিয়ে। ‘চরম’ শব্দে ধানিধা-র তিরতিরিয়ে কেঁপে ওঠা এই সংগীতপরিধির শ্রেষ্ঠ বক্রতল, অন্তরার পরে গান থেমে গেলেও ক্ষতি ছিল না।

নির্মল রবীন্দ্রসংগীতের কোল ঘেঁষে বসেনি কোনও দিন। অল্প বয়েসে জমিদারবাড়িতে ওস্তাদের কাছে তালবাদনে দীক্ষার পর অপরিসীম ঝালমশলা-পছন্দ মানুষের মতো সুর আর লয় যত গুরুপাক, ততই ফুর্তি তার। অথচ রবি ঠাকুরের খেয়ালআশ্রিত গানে তানালাপ নেই, ধ্রুপদাঙ্গের গানে বাঁটের কৌশল মার গেছে। রাগসংগীতের পর নির্মলের চরাবরা ছিল কাঙাল ফিকিরচাঁদের বাউল, কালী মির্জার টপ্পা, গোবিন্দ অধিকারীর পদাবলী, মধু কান-এর ঢপ কীর্তন বা মনোমোহন বসুর পাঁচালীগানে। গীতিকবিদের ঘনিষ্ঠ সেই জনসংখ্যাও দিন দিন ক্ষয়ে আসছে।

মায়া গাইতে গাইতে আবার ঘুরল পূজাপর্যায়ে — চারিদিকে দেখ চাহি হৃদয় প্রসারি। স্থায়ীটুকু শুনেই নির্মল বুঝেছে, মালকোষে ‘লাগি মোরে ঠুমক পলঙ্গনা, রীন নদিয়া ধরতী রণমোহি’ ভেঙে তৈরি এ-গান। শুধু রবীন্দ্রনাথ কোমল রে আর কড়ি মা লাগানোয় ‘আনন্দধারা’ মিশ্র-মালকোষে গিয়ে দাঁড়াল। মায়া পণ্ডিতি জানে না, তার গলা এক দীর্ঘ কবিতা যার মর্মকথা বীভৎস ভালো টোনাল কোয়ালিটি; এমন ওজনদার অথচ মিছরি অথচ জিভে লেগে থাকা ইনোসেন্স তুমি কোনও তালিমে হাসিল করতে পারো না। গায়কের বৈশিষ্ট্য বলতে গিয়ে শার্ঙ্গদেবের সংগীতরত্নাকর লিখছে, ‘হৃদ্যশব্দঃ সুশারীরো গ্রহমোক্ষবিচক্ষণঃ’; গায়কের প্রথম গুণটাই হতে হবে হৃদ্যশব্দ — মনোহর কন্ঠের অধিকার। আর সব শেষে লাগবে ‘সুসম্প্রদায়ো গীতজ্ঞৈর্গীয়তে গায়নাগ্রণীঃ’, মানে উত্তম গুরুপরম্পরা। আজকাল যতই গুরু আর ঘরানা নিয়ে মাতামাতি হোক, দেখা যাচ্ছে সাতশো বছর আগে শিল্পীর স্বশিক্ষা আর প্রতিভার ওপরেই ভরসা রাখা হতো বেশি। কিন্তু কলকাতার লোকজন কাঁচা, জ্যান্ত, এখনও-লাফাচ্ছে অনুভূতি গানে বসায় না; শিল্পীরা রবীন্দ্রসংগীত গায় হাঁমুখ না খুলে। নির্মলের আবার সংগীতরত্নাকর মনে পড়ল — গায়কের প্রথম দোষ হল ‘সংদষ্ট’, দাঁত চেপে গান।

আঠাশ (খ)
ফাঁকা রেলস্টেশনে একটা হৃদপিণ্ড-বসানো থলে হাতে দাঁড়িয়েছিল বাসু।

— তোমাগো বিড়েল অ্যাক্কেবারে তোমাগো মতোই হইছে, সেই রকম পাকা চোর আর নেমোখারাম!
এটা মা।
কিশমিশ আগে থেকেই কর্তৃপক্ষের কুনজরে ছিল, শিকে লুটপাট ক’রে দু’পিস মাংস খেয়ে নেওয়াটা তার খুব কৌশলগত ভুল হয়ে গেছে।

বাসু হয়ত শিউলি-চাঁদের মতো বিল্লিপাগল নয়, তবু একটা দুপুর বেড়াল দেখেই কাটিয়ে দিতে পারে। চান না করেও ওরা কেমন ডালিয়া ফুলের মতো ঝকঝকে আর পিঠে একটু হাত ছুঁইয়েছ কি গলায় গার্গল করার শব্দ। মুখের দিকে ঠায় তাকিয়ে এমন বসে থাকবে, এতবার মিউ মিউ ডাকবে যে সন্দেহই থাকে না তোমার দেওয়া মাছের কাঁটাটা, পাঁউরুটির টুকরোটা, এমনকি সকালের মুড়ির বাটি থেকে মেঝেয় ছড়ানো মুড়িগুলো তাড়া করে খেতে পারছে বলেই ও বেঁচে আছে। আশ্রিতকে ত্যাগ করা ঘোর অন্যায় — এটা বাবার উক্তি।
আর কিশমিশই তো তাদের একমাত্র আশ্রিত।

ব্যাগের হ্যান্ডেল একটু ফাঁক ক’রে তাকায় বাসু — নিশ্চিন্তে শুয়ে থাবা চেটে যাচ্ছে! এবার সে ডাউন বনগাঁ-য় উঠে পরের স্টেশন বামনগাছি আসতেই ব্যাগ থেকে বার ক’রে কোলে নেবে কিশমিশকে। ট্রেন স্টেশান যেই ছেড়েছে, আস্তে করে নামিয়ে দেবে প্ল্যাটফর্মে। “কী হল বাসুদাদা, তুমি নামবে না” — কিশমিশ ছুটছে ট্রেনের পাশে-পাশে। তারপর যখন টের পেল সামথিং ইজ মেছো, মারল একটা প্রাণপণ ঝপাং। কিন্তু রানিং করা তো শেখেনি, উঠেই ডিগবাজি খেল, মাথা ঠুকে গেল গাড়ির লোহার দেয়ালে। তক্ষুনি কোলে তুলে নিয়েছে বাসু। কিশমিশ গোল শুঁয়োপোকার মতো চার হাতপায়ে বাসুর ডান কবজি পেঁচিয়ে ধরে আছে — “আবার ফেলে দেবে না তো”!

আঠাশ (ক)
মায়ার গলায় ব’সে থাকা দীর্ঘ কবিতার দ্বিতীয় গুণ তার অসহ্য নরমতা। সারাক্ষণ সংসার দাবড়ে রাখা মহিলা একটা সুর উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে ধানের ছড়ার মতো নুয়ে পড়ে কীভাবে? নির্মল ভাবে, রমণে আর সংগীতে ফনফনে লম্বা মায়া যেন কুঞ্জরাস্য — পেশিময় অথচ তুলতুলে! যেভাবে রেওয়াজ চাও, এক-ডাকে সাড়া দেবে।

শিউলির স্কুলে অ্যানুয়াল ফাংশান আছে, তার বায়না মেনে মায়া ধরল ‘ওরা অকারণে চঞ্চল’। ওমনি চাঁদের “আমিও এই গানটা পারি” ব’লে বেসুরো বেহেড চিৎকার। ভটচাজবাড়ির সবার গলায় সুর আছে, শুধু এ-ছেলেটা হল “রাজু পোড়া বাজু”। শ্লোকের মানে বোঝে না চাঁদ; যেমন ওকে ছোঁড়া আর একটা ঢিল “গলা নেই গান গায় মনের আনন্দে, বউ নেই শ্বশুরবাড়ি যায় পূর্বের সম্বন্ধে”-র দ্বিতীয় অংশ রহস্যগল্পের মতো ঠ্যাকে। পুব দিকের সঙ্গে সূর্য ওঠার সম্বন্ধ আছে, কিন্তু বউ কোথায় গেল? কলোনিতে বিভাসকাকুর বউ বিন্দুকাকিমা পালিয়ে গেছে, সে সারাদিন মদ খেয়ে টাকাপয়সা এদিকসেদিক হারিয়ে ফেলে। তাছাড়া এই কলোনির কেউ শ্বশুরবাড়ি যায় চাঁদ শোনেনি, সবার শ্বশুরই নিরুদ্দেশ।

তখন মায়া গলা তুলে নির্মলকে বলল, শুনতিছেন, শয়তানডারে এট্টু আপনার কাছে ডাকেন না! গাতি দেচ্ছে না যে। এবং তখুনি ছেলের দিকে ফিরে: ওই যে বাবা ডাকিছে, ওঘরে যাও।
— কই, আমি তো শুনতি পালাম না!
— তুই শুনতি পাস? তুই কানপচা কালা না? ব’লে শিউলি তার বাঁকানের কাছে নাক নিয়ে যাওয়ার উপক্রম করেই মুখ সরিয়ে আনে :
— বাবা রে, কী গন্দো!
এইভাবে সাজানো চিত্রনাট্যের শিকার চাঁদ নির্মলের ঘরে উঠে যেতেই মায়া আবার জলে খেলা করা মাছের মতো পেছল, প্রশমিত, রহস্যবর্ণ। সঞ্জুর মনে হয় মনোহারি জিনিস বেচা ফেরিওলার হাতে যেমন কাচ লাগানো সুটকেস থাকে, মায়ের হারমোনিয়ামও ঢাকনা খুলে এক-একটা গয়না বের করে আনছে। এবার ছাই রঙের কারুকাজ করা আংটিটা তোলা হল : ‘আমার জ্বলেনি আলো অন্ধকারে’।

আঠাশ (খ)
‘মিশন পণ্ডশ্রম’ সেরে উলটো দিকের ট্রেন ধরে ফিরে এল বাসু। স্টেশানে নেমে হাঁটা দিল নিবাধুই স্কুল ছাড়িয়ে চড়কপাড়ার ওপাশটায়। মা কাল রাতে বুঝিয়েছে, চাঁদের সর্দিকাশির অসুখ বেড়াল ঘাঁটলে কোনওদিন সারবে না। তাছাড়া কিশমিশ তো মেনি, একটু বড় হলেই ছ’মাস অন্তর সংসার বাড়াতে থাকবে। তার চেয়ে এখন পার কর।
শুনে চাঁদের সে কী রাগ! বাবার সিগারেটের ধোঁয়াতেও তো আমার টান বেড়ে যায়, তাহলে বাবাকে পার করছ না কেন? ছ’বছরের ছেলের আস্পদ্দা দেখলে ভয় লাগে। বড় হয়ে খুনি-ডাকাত হবে, কুষ্ঠি কি আর ভুল লেখে কখনও!
—- বাবারে তাড়ালি খাবি কী? তাছাড়া, মানুষ আর বিড়েলের বাচ্চা এক হলো!
— ইশকুলে লেখাদিদিমনি বলেছে, বিজ্ঞানী জগদীশ বসু আবিষ্কার করেন, উদ্ভিদেরও প্রাণ আছে। তার মানে মানুষ-বেড়াল-গাছপালা সব এক।

এদেশিদের পাড়া জোড়াবটতলা পৌঁছে দেখা গেল, মোড়ের মাথায় চায়ের দোকান জমজমাট, কিন্তু সামনের কাঁচা রাস্তার অনেকখানি অন্ধকারে ডুবুডুবু। সেই ভুতুড়ে ঘুপচিতে ঢুকে বাসু যেই ব্যাগ থেকে নামিয়েছে কিশমিশকে, কোত্থেকে টর্চের আলো — “কী হচ্ছে এখানে?” পেটমোটা লোকটার গায়ে কঠিন সেন্টের গন্ধ: “এ-পাড়ায় অলরেডি ছত্রিশটি ষষ্ঠীর বাহন। আমি নয়ন মুখার্জি, নাট্যকার, পাক্কা খবর রেখেছি, সামনের ফাল্গুনেই আমরা হাফ সেঞ্চুরি ক্রস করে যাব। কিন্তু বে-আইনি ভাবে তো জনসংখ্যা বাড়াতে দেওয়া যায় না, বাবুসোনা! পাসপোর্ট নেই, ভিসা নেই, মানে পিয়োর অনুপ্রবেশ। সোজা তুলে নিয়ে চলে যাও।“

.
(পরের বার শেষ)

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
আমাদের বেড়াল আমাদের মতো হয়নি, 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ১ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ১১-০৪-২০২৩ | ১১:৩৯ |

    শব্দ-কথায় নিঃসন্দেহে এক অতূলনীয় প্রকাশ। শুভেচ্ছা রইলো প্রিয় কবি চন্দন দা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    GD Star Rating
    loading...