ট্রেজার!

riiitu

অনেক কাল আগলে রেখেছি তিন কন্যার স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটি লাইফে জেতা রাশি রাশি ট্রফি মেডেল সার্টিফিকেট। তিন কন্যারই একাডেমিক শিক্ষা জীবন আপাতত শেষ, এবার তাদের যত অর্জন সবই প্রত্যেকের নামে নামে র‍্যাপ আপ করা শুরু করেছি। বাড়ির বিভিন্ন স্পটে সাজানো ছিলো ট্রফিগুলো, বিভিন্ন কক্ষে যখন যেখানে পা দেবো মেয়েদের সাফল্যের স্বীকৃতি যেনো আমার চোখে পড়ে।

আজ সকালে যখন আমার বুক শেলফে সাজানো ঝকঝকে ট্রফিগুলো সরিয়ে আনছিলাম, এক কোণে পুরানো কালচে রঙের একটা ট্রফির দিকে নজর চলে গেলো। কালচে হয়ে যাওয়া ট্রফিটা আমার, বাংলাদেশে মায়ের কাছে ছিলো। দশ বছর আগে মা মারা গেলো, আমার ট্রফির গুরুত্ব ফুরিয়ে গেলো। মা চলে যাওয়ার পর আমি ট্রফিটা সাথে করে এনেছিলাম।

কারণ এই ট্রফির গুরুত্ব আর কেউ বুঝবে না, আমার বাবাও না। আমার বাবা শুধু একাডেমিক সার্টিফিকেটের গুরুত্ব দিতো, নাচ গান খেলাধূলা অভিনয় নিয়ে মাথা ঘামাতো না। ট্রফিটা মিসিসিপিতে এনে আমার উত্তম এবং কন্যাদের দেখিয়েছিলাম। তখন মিথীলা ছোটো, ট্রফির গুরুত্ব বুঝে ওঠেনি। মেয়েরা নিজেদের ট্রফিই ঠিক করে রাখে না, মায়ের ট্রফি নিয়ে আর কতটুকু উৎসাহ দেখাবে! তবে মুখে ওয়াও বলে এপ্রিসিয়েট করেছিলো।আমিও ট্রফিটা বুক শেলফের এক কোণে রেখে দিয়েছিলাম।

আজ কত কথা মনে পড়ছে। ছোট্টো বাড়ির চারদিকে স্মৃতির পাহাড় জমেছে। আজকাল নির্মোহ হতে চাইছি। স্মৃতি টিতি জমিয়ে রাখলে নির্মোহ হওয়া যাবে না। ঘরবাড়ি থেকে অতিরিক্ত জিনিস সরিয়ে ফেলতে চাইছি, আমার এই কাজে মিথীলা খুব হেল্প করছে। আমার এই ছোটো কন্যাটি একটু অন্যরকম, আধুনিক যুগের হয়েও পুরানোকে অস্বীকার করে না। বুড়ো মানুষ, ছেঁড়া কাঁথা, ঝাপসা হয়ে যাওয়া ছবি থেকে শুরু করে বাঙালির ডাল ভাত মাছ সুক্তো শাক সবই অন্তর দিয়ে গ্রহণ করার চেষ্টা করে।

এইজন্য আমি মিথীলার সাথে অনেক গল্প করি, আমার অনেক অনুভূতি শেয়ার করি, আমার ব্যথা বেদনা আনন্দ পাওয়া না পাওয়ার গল্প সবই শেয়ার করি। আমার নিত্য দিনের কাজে মিথীলা নিজ থেকে হেল্প করে। আমার পায়ে ব্যথা, গায়ে ব্যথা হলে ও অস্থির হয়ে যায় কিভাবে আমার ব্যথা কমাবে! রাবারের ফিতা বেঁধে আমার পায়ের এক্সারসাইজ করতে দিয়েছে থেরাপিস্ট, লেটেক্সে আমার কঠিন এলার্জি। থেরাপিস্টের দেয়া ফিতা পায়ে বাঁধলেই আমার সারা শরীরে চুলকানি শুরু হয়।

মিথীলা ছবি দেখে দেখে রাবারের ফিতে ছাড়াই আমার পায়ের এক্সারসাইজ করিয়ে দেয়। আমি আর্জেন্টিনার পাঁড় সাপোর্টার, মিথীলা ব্রাজিলের সাপোর্টার। প্রথম খেলাতেই আর্জেন্টিনা হেরে গেছে। আমার উত্তম কুমার অলরেডি বলছে, ধুর! ধুর! মিথীলা জানে, আমার মন খুব খারাপ হয়ে গেছে, তাছাড়া ফেসবুকে ব্রাজিল সমর্থকদের ট্রল সহ্য করতে পারবো না। সাথে সাথে ও বসে গেলো ক্যালকুলেশন করতে। যেদিন আর্জেন্টিনা হারলো, সেদিনই ও বললো, ” মা, চিন্তা করো না। এখনও আর্জেন্টিনার চান্স আছে। যদি পোল্যান্ড আর মেক্সিকোর খেলা ড্র হয়, তবেই আর্জেন্টিনার পথ সহজ হয়ে যাবে। এবং আমি উইশ করি, পোল্যান্ড মেক্সিকো খেলা ড্র হবে”!
এবং সত্যি সত্যি পোল্যান্ড মেক্সিকো খেলা ড্র হলো!

ট্রফিটা হাতে নিলাম, মিথীলার সবে ঘুম ভেঙেছে। চাকরি শুরু করার আগে ইচ্ছেমতো ঘুমিয়ে নিচ্ছে। মিথীলা চোখ মেলেই দেখে আমি ওদের ট্রফি গুছাচ্ছি।
“মা, আমাকে ডাকোনি কেন? তুমি একা ঘর পরিষ্কার শুরু করেছো” বলে সে তড়বড় করে বিছানা থেকে নামার চেষ্টা করলো। আমার হাতে ধরা ট্রফির গায়ে লেখা সমস্ত লেখা কালচে হয়ে গেছে। বুঝতে পারছিলাম না, ট্রফিটা কত আগের! এটা কি স্কুলে পেয়েছিলাম না-কি ইউনিভার্সিটিতে! টিস্যু পেপার দিয়ে ঘষে ঘষে মুছলাম ট্রফিটা। এক পিঠে লেখা, নওয়াব ফয়জুন্নেসা হলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার নাম।
ততক্ষণে মিথীলার চোখ পড়েছে ট্রফিটার দিকে। জানতে চাইলো, কিসের ট্রফি।
বললাম, ইউনিভার্সিটির বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় পাওয়া। এবং এই ট্রফিটা পেয়েছিলাম, ‘তিন পায়ে দৌড়’ রেইসে দ্বিতীয় পুরস্কার হিসেবে।

বাসায় যখন ট্রফি আনলাম, মায়ের মুখে সে কি হাসি! সেই ট্রফিটাই মা যত্ন করে রেখে দিয়েছিলো তাঁর ট্রেজার বক্সে! পরের বছর প্রথম পুরস্কার পেয়েছিলাম ‘যেমন খুশী সাজো’ ইভেন্টে। অই ইভেন্টের ট্রফিটা মনে হয় হারিয়ে গেছে! মিথীলা অবাক হয়ে গেলো! ” মা, তুমি ইউনিভার্সিটিতে খেলাধূলা করতে? তুমি দৌড়াতে? কমপিটিশনেও পার্টিসিপেট করেছো, ট্রফি জিতেছো! আমি তো কিছুই জানি না। তুমি কখনো বলোনি কেন?
বললাম, ইউনিভার্সিটি কেন, আমি তো স্কুলেও ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় পার্টিসিপেট করতাম, পুরষ্কারও পেয়েছি। শুধু তো খেলাধুলা নয়, আমি ইন্টার স্কুল, ইন্টার কলেজ প্রবন্ধ লেখা প্রতিযোগিতা, বক্তৃতা প্রতিযোগিতা, বিজ্ঞান মেলা সবকিছুতে পার্টিসিপেট করেছি এবং প্রায় সবগুলোতে প্রথম পুরষ্কার পেয়েছি।

মিথীলা তখনও অবাক।
বললাম, আমার গান শেখার খুব শখ ছিলো। গান শেখার সুযোগ পেলে গানেও পুরষ্কার পেতাম। গান না শিখেই আমি সুর তাল লয় ঠিক রেখে গান গাইতাম। যখন টিচার্স ট্রেনিং কলেজে বি এড করি, তখন কলেজের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় কবিতা আবৃত্তি করে প্রথম স্থান পেয়েছি, খালি গলায় গান গেয়ে দ্বিতীয় স্থান পেয়েছি।
মিথীলা অবাক।

*** বললাম, আমাদের দেশে মেয়েরা যতই টেলেন্টেড হোক, বিয়ের পর তার টেলেন্ট রান্নাঘরের ভাতের হাঁড়িতে মিশে যায়। আর সেই মেয়ের স্বামী যদি বড়ো কোনো বৃক্ষ হয়, তাহলে সেই মেয়ের টেলেন্ট তার স্বামী বৃক্ষের ছায়ায় ঢাকা পড়ে যায়!***

জানো মিথীলা, এই যে তোমাদের এতো টেলেন্ট, বলতে গেলে তোমরা তিনজনই মাল্টি টেলেন্টেড। নাচ গান আবৃত্তি আর্ট রাইটিং স্পীচ –সবকিছুতেই তোমাদের দখল আছে, তোমাদের পারফরম্যান্স দেখে সবাই ওয়াও ওয়াও বলে। আর প্রশ্ন করে, এমন অজ পাঁড়াগাঁয়ে থেকেও কোথা থেকে তোমরা এত দিকে সমৃদ্ধ হলে! প্রশ্ন শুনে আমি অবাক হই না। শুধু মনে মনে আমার স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটির সময়ে ফিরে দেখি, উত্তর পেয়ে যাই।
এই যে তুমি বাংলায় কথা বলো, বাংলা পড়তে চেষ্টা করো, এটাও তো তোমার এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটি যা তুমি আমার কাছ থেকে পেয়েছো।

মিশা কোথাও নাচ শিখেনি, অথচ দেখো মিশা কতো ভালো নাচ করে। ও এখন নাচের ট্রেইনার হিসেবেও কাজ করে। জানো, আমার খুব মনে পড়ে ছোটোবেলার কথা। আমাকে তো দিদা স্কুল আর ঘরের বাইরে কোথাও যেতে দিতো না। ছুটির দিনে সবাই যখন বাইরে চলে যেতো আমি কি করতাম জানো! আলনা থেকে দিদার শাড়ি নিয়ে পরতাম, এরপর একা ঘরে টিভিতে দেখা নায়িকাদের মতো অভিনয় করে গান গাইতাম, গানের সাথে নাচতাম। শাড়িও পরতাম নাচের মেয়েদের মতো করে। এবং আমি জানি, আমি খুব ভালো নাচতাম। লেখাপড়ার চেয়েও আমার ভালো লাগতো গান গাইতে, নাচতে, আয়নায় তাকিয়ে নায়িকাদের মতো অভিনয় করতে।
এখন মনে হয়, মিশা আমার ভেতর ঘুমিয়ে থাকা নাচের স্কিল পেয়েছে। আমি খুব পরিশ্রম করেছি তোমাদের এক্সট্রা কারিকুলার এক্টিভিটিগুলো এক্সপোজ করার কাজে,
আমার বাবা মায়ের বোধ হয় সেই সুযোগ ছিলো না আমার সুপ্ত প্রতিভাকে প্রকাশ হতে দেয়া।

**আজ আমাকে দেখলে কেউ বলবে না, আমিও বাবা মায়ের মাল্টি টেলেন্টেড মেয়ে ছিলাম।**
ভাগ্যিস আমার মা এই ট্রফিটা কোনোমতে তার ট্রেজার বক্সে আগলে রেখেছিলো! নাহলে তো আমার সকল এচিভমেন্ট স্মৃতির আড়ালে চলে যেতো। প্রমাণ ছাড়া আমি তো তোমাদের বলতেই পারতাম না আমার এচিভমেন্টের কথা! মিথীলা বলে, মা তুমি এখনও মাল্টি টেলেন্টেড আছো। পাপার শেডে তুমি কভারড না। এখনও তুমি কত কাজ করো, সেভেনটিন ইয়ারস তুমি ওয়ালমার্টে সাকসেসফুল্লি চাকরি করেছো, রিটায়ার করার পরেও এখনও ম্যানেজার তোমাকে আবার ফিরে যেতে বলে।

তুমি ব্লগার, তুমি রাইটার, তুমি ভালো ফেসবুকার, তুমি দারুণ কুক, এত কিছু সামলে তুমি একজন পারফেক্ট হোম মেকার। কালচে হয়ে যাওয়া ট্রফিটা কোথায় রাখা যায় ভাবছিলাম। মিথীলা বললো, এই ট্রফিটা তুমি আমাদের ট্রফির সাথে রাখো। এতোদিন দিদা তোমার ট্রফিটা যত্ন করেছে, এখন আমরা তোমার ট্রফিটা যত্ন করবো। মা আর মেয়েদের ট্রফি এক সাথে থাকবে, আমরা যত্নে রাখবো।
এটা আমাদের প্লেজেন্ট ডিউটি।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
ট্রেজার!, 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

২ টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ২ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ১১-০৪-২০২৩ | ১১:১৯ |

    যাপিত জীবনের ছোট ছোট গল্প কথা; অসামান্য এবং অনবদ্য হয়ে প্রকাশ পেয়েছে। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    GD Star Rating
    loading...
  2. নিতাই বাবু : ১২-০৪-২০২৩ | ১০:২৪ |

    যে কারোর জীবনের গল্প শুনতে আর পড়তে খুবই ভালো লাগে। আপনার এই গল্পটাও অনবদ্য https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif

    আশা করি ভালো থাকবেন।

    GD Star Rating
    loading...