ডাক্তারের চেম্বার, হোলি বাইবেল এবং

313 গত পরশু গেছিলাম আমার ডাক্তার জেরল্ড টার্নারের কাছে রুটিন চেক আপ করাতে। তখনই তাঁকে বললাম ডান পায়ের সমস্যার কথা। এবং বললাম শহরের দ্য বেস্ট অর্থোপেডিক সার্জনের কাছে রেফার করতে। ডাঃ টার্নার আমাকে যার কাছে রেফার করলেন, তার নাম জেমস হার্ট। এবং ডাঃ টার্নার অভাবনীয় দ্রুততার সাথে আজকের জন্য এপয়েন্টমেন্ট ব্যবস্থা করে দিলেন।

আজ সকাল ১০ টায় মিথীলাকে নিয়ে গেলাম অর্থোপেডিক্স ক্লিনিকে। বিশাল বড়ো পার্কিং গ্রাউন্ড দেখে মিথীলা অবাক, একটা ছোটো শহরে অর্থোপেডিক্স ক্লিনিকে এতো গাড়ি! বললাম, তোর মা ছাড়াও এই শহরে লুলা ল্যাংড়া মানুষের সংখ্যাই বেশী। লুলা ল্যাংড়া শব্দ দুটোর বিদ্রুপাত্মক ব্যবহার সম্পর্কে মিথীলার ধারণা নেই। তাই নিশ্চিন্তে শব্দ দুটো ইউজ করলাম।

যাই হোক, অন্যান্য ফরমালিটিজ শেষ করে নার্সের সাথে ডাঃ জেমসের কক্ষে এসে পৌঁছেছি। নার্স বলে গেলো, দশ মিনিটের মধ্যেই ডাঃ হার্ট আসছেন। মাঝারি সাইজের বর্গাকৃতি কক্ষ, দরজা দিয়ে ঢুকলে হাতের বাম পাশে ডাক্তারের জন্য নির্দিষ্ট একটি টেবিল একটি চেয়ার, কক্ষের মাঝখানে আয়রন রডের তৈরি রোলিং বেড, রোলিং বেডের শিয়রের বাম পাশে রোগীর জন্য একটি চেয়ার, বেডের ডান পাশে আরেকটি চেয়ার।
কক্ষের দুধ সাদা রঙ চার দেয়ালের তিন দেয়ালে তিনটি পেইন্টিং। দুই মিনিটেই কক্ষের চেহারা দেখে নিলাম, সুন্দর ছিমছাম।

আমার জন্য নির্দিষ্ট চেয়ারে বসে মিথীলাকে বললাম আরেক চেয়ারে বসতে। ডাক্তারের জন্য অপেক্ষা করতে করতেই ডাক্তারের জন্য সাজানো টেবিলে নজর গেলো। ছোটো টেবিলের এক কোণে সবুজ রঙের একখানা ফাইল, সাদা রঙের ফাইল অর্গানাইজার আছে। আর আছে পবিত্র গ্রন্থ বাইবেল। আমার চোখটা আটকে গেলো বাইবেলের উপর। সবুজ রঙের ফাইলের পাশেই বাইবেল রাখা, ডাক্তার এবং রোগী উভয়ের চোখ বরাবর।
আমেরিকায় যত্র তত্র বাইবেল গ্রন্থ সাজানো থাকে। গির্জায় তো থাকেই, গির্জা ছাড়াও যে কোনো সরকারি বেসরকারি অফিস আদালত, হাসপাতালে, ডাক্তারের চেম্বারে, ক্লিনিকের অফিস, গ্রসারি শপের কাউন্টার, বাস টার্মিনালের ওয়েটিং রুম, স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটির অফিস- লাইব্রেরি, পাবলিক লাইব্রেরি, হাইওয়ে ধরে যাওয়ার সময় মাঝে মাঝেই রেস্ট এরিয়া থাকে, সেই রেস্ট এরিয়ার অফিসরুমে সেন্টার টেবিলে বাইবেল থাকে। কোথায় থাকে না, সেটাই ভাবছি।

বাইবেল সাজানো থাকে বলেই যে সবাই বাইবেল খুলে বসে থাকে তা নয়। বাইবেলের পাশ থেকে হয়তো ফ্যাশন সংক্রান্ত কোনো ম্যাগাজিন কেউ তুলে নেয়, কেউ তুলে নেয় টাইম ম্যাগাজিন। বাইবেল দেখেছি সর্বত্র কিন্তু কাউকেই বাইবেল হাতে নিয়ে বসতে দেখিনি। এই যে যেখানে সেখানে বাইবেল সাজানো থাকে, বাইবেলের পাশেই হয়তো উন্মুক্ত পা কোনো মডেলের ছবিওয়ালা ম্যাগাজিন পড়ে আছে, বাইবেল না তুলে কেউ হয়তো ম্যাগাজিন থেকে উন্মুক্ত পা মডেলের ছবি দেখছে, তা নিয়ে কোনো খৃষ্টানের মাথা ব্যথা নেই, আপত্তি নেই, অনুভূতিতে আঘাত নেই, গির্জার কোনো ফাদারের চোখ রাঙানি নেই।

গ্রন্থ সবই পবিত্র, গ্রন্থ পড়ার জন্য সাজানো থাকে। ম্যাগাজিনও পড়ার জন্য, নভেলও পড়ার জন্য, ফ্যাশন রান্না বিষয়ক ম্যাগাজিনও পড়ার জন্য, বাইবেলও পড়ার জন্য। যার যেটা প্রয়োজন সে সেটা পড়বে। আমাদের দেশে এটা ভাবা যায় না। আমেরিকায় মদের দোকানেও বাইবেল থাকে, কেউ এর মধ্যে কোনো অন্যায় খোঁজে না। আর আমাদের দেশে পবিত্র কোরান গ্রন্থ নিয়ে কত অপ রাজনীতি চলে।

আমেরিকায় খৃষ্টান ছাড়াও মুচি মেথর গোয়ালা হিন্দু বৌদ্ধ নাস্তিক আস্তিক যে কারো হাতেই বাইবেল থাকতে পারে, যে কারো বাড়িতে বাইবেল থাকতে পারে। তাতে বাইবেলের সম্মান হানি হয় না। পাদ্রীরা তো বাইবেল পড়ার জন্য এরে তারে ফ্রি বাইবেল দিতে চায়। যাকে দিচ্ছে সে হিন্দু না মুসলমান তা জানতে চায় না। অন্য ধর্মাবলম্বীদের ঘরে বাইবেল দেখে তাদের জাত যায় না। অথচ আমাদের দেশে কথায় কথায় কোরানের অবমাননা

হয়েছে ধুয়া তোলা হয়, তাতে কত মানুষের প্রাণ যায় মান যায় ঘর বাড়ি যায়, ব্যবসা বাণিজ্য জায়গা জমি যায়, নারীদের সম্মান যায় এমনকি গোয়াল থেকে গরু বাছুর ছাগলও লুট হয়ে যায়! পবিত্র গ্রন্থ বাইবেলের দিকে চোখ রেখে দশ মিনিটের মধ্যেই আমেরিকা আর বাংলাদেশ ঘুরে ফেললাম। তখনই সাত ফিটের কাছাকাছি উচ্চতা, গৌর বর্ণ, ছিপছিপে গড়ন, বয়স ত্রিশের কোঠায় সৌম্য দর্শন ডাঃ জেমস হার্ট হাসিমুখে প্রবেশ করলেন।
হাসিখুশি মানুষ দেখলেই আমার মন ভালো হয়ে যায়। আর হাসিখুশি মানুষটি যদি হয় সুপুরুষ অথবা সুন্দরী ডাক্তার, ওষুধ দেয়ার আগেই আমার রোগ যন্ত্রণা কমে যায়।

ডাঃ হাসিমুখেই চোখের তারা আমার আর মিথীলার দিকে ঘুরিয়ে প্রশ্ন করলেন, কে রোগী? প্রশ্ন করে নিজেই উত্তর দিলেন, যেহেতু হাঁটুর প্রবলেম তাহলে তুমিই রোগী এবং তুমি রিটা রয়? আমার সাথে কথা বলে ডিটেলস জানার পর ডাক্তার বললেন, তোমার হাঁটু পরীক্ষা করে দেখার আগে বলছি, এক্সরে রিপোর্ট বলছে তোমার এংকেলে বাজে ধরনের ফ্র‍্যাকচার হয়েছে, লিগামেন্ট তো ছিঁড়ে গেছেই হাড়েও ফ্র‍্যাকচার হয়েছে।
এরপর আমাকে রোলিং বেডে উঠে পেছনের রেস্ট সীটে হেলান দিয়ে পা সামনের দিকে ছড়িয়ে বসতে বলা হলো।

আমি পা ছড়াতে গিয়েও সোজা করে ছড়াচ্ছি না দেখে জেমস ভাবলেন পায়ে ব্যথা। বললাম, না পায়ে ব্যথা নেই। পা সোজা মেলতে চাইছি না কারণ টেবিলে হোলি বাইবেল রাখা আছে। আমার পা সোজা করলে বাইবেলের দিকে হয়ে যায়। ডাক্তার বললেন, তাতে কি। হোলি বাইবেল তো হোলি প্লেইসে রাখা আছে, আর তোমার পা আছে বেডে। তুমি তো টেবিলে পা রাখছো না!
আমি কি বলবো বুঝতে পারছি না। আমেরিকান ডাক্তারের ধর্মীয় অনুভূতির মাত্রার সাথে বাংলাদেশী আমার ধর্মীয় অনুভূতির মাত্রা তো মিলবে না।

আমাদের দেশে শিবের মাথায় পবিত্র কোরানের ফেইক ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার অজুহাতে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়! সেই আমাকে যদি পবিত্র বাইবেলের দিকে পা ছড়িয়ে বসতে বলা হয়, আমার তো অস্বস্তি হবেই। ডাক্তার এবার টেবিলের দিকে এগিয়ে গিয়ে আলগোছে বাইবেলটি তুলে ফাইল অর্গানাইজারের উপর রেখে দিলেন। তারপর হাসিতে মুখ ভরিয়ে বললেন, এবার নিশ্চিন্তে পা লম্বা করে বসো।

ডাক্তারের অমায়িকতায় আমার হাঁটু ব্যথা সেরে গেছে। ডাক্তার আমার হাঁটু যতভাবেই টুইস্ট করে পরীক্ষা করছে, আমার ব্যথা লাগছে না। এমনকি এংকেলেও ব্যথা নেই। ডাক্তার বললেন, তোমার এংকেল যেহেতু তোমায় তেমন বদার করছে না, আপাতত তোমাকে কিছু এক্সারসাইজ দেখিয়ে দেয়া হবে, বাড়িতে করবে। আশা করি, আগামী ছয় মাসের মধ্যে এংকেল ঠিক হয়ে যাবে। এবার আসি হাঁটুর প্রশ্নে। হাঁটুতে মেজর কোনো সমস্যা নেই। আর্থ্রাইটিসের লক্ষণ আছে, এক্সরেতেও তেমন সিগনিফিকেন্ট সমস্যা দেখা যাচ্ছে না। টিস্যুতে একটু রাবিং স্পট দেখা যাচ্ছে যার কারণে অল্প ইনফ্লামেশন আছে।

আপাতত এন্টি ইনফ্লামেটরি মেডিসিন দেবো দিনে একটা, আর হাঁটুর এক্সারসাইজ। এক মাস পর আবার আসবে, তখন রেজাল্ট দেখবো।
কি, তোমার কিছু বলার আছে?
বললাম, ডাঃ টার্নারকে অনুরোধ করেছিলাম শহরের বেস্ট অর্থোপেডিক সার্জনের কাছে রেফার করতে। ডাঃ টার্নার আমাকে বেস্ট সার্জনের কাছেই পাঠিয়েছেন।

আমার এই কথাতে জেমস হার্ট বিনয়ের সাথে মাথা এমনভাবে ঝুঁকিয়ে ধন্যবাদ বললেন, আমার মনে হলো, আমার সন্তানের বয়সী এই ডাক্তারটিকে প্রণাম করি।
ডাঃ জেমস হার্টের নির্দেশে ফিজিও থেরাপিস্ট লাল এবং নীল রঙের ব্যান্ড দিয়ে আমায় এংকেল ( লাল ব্যান্ড) আর হাঁটুর ব্যায়াম ( নীল ব্যান্ড) দেখিয়ে দিলেন, শিখিয়ে দিলেন এবং এংকেল ও হাঁটুর ব্যায়ামের ছবি ছাপিয়ে ব্যান্ড সহ ছবিগুলো দিয়ে দিলেন।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
ডাক্তারের চেম্বার, হোলি বাইবেল এবং, 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ১ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ০৪-০৪-২০২৩ | ১৪:০৭ |

    যাপিত জীবনের অসামান্য গল্প। ভালো থাকুন প্রিয় লিখক। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...