ডায়নোসরের মাংস

আহা রে ধনী হওয়ার কষ্ট! শুক্রবার সকাল। সাপ্তাহিক ছুটির দিন। কাঁচাবাজারে প্রচুর ভিড় হয়। অভিজাত ধনীরাও এই দিনটাতে কেনকাটা করতে বাজারে যায়। প্রাণ খুলে দুই হাতে বাজার করে। তাদের বাজার করাটা সবাই দেখে। হিংসা করে। কিন্তু পছন্দের জিনিস কেনার জন্য ধনীদের সংগ্রামটা অনুভব করে না। এই যেমন তহুরা বিবি আজ আরাম আয়েশ বাদ দিয়ে নিজে ডায়নোসরের মাংস কিনতে বাজারে এসেছিলেন।

বাজারে ভিতরে কয়েক সারি মাংসের দোকান। দোকানগুলিতে থরে থরে মাংস সাজানো, লোহার সিকের আংটায় ঝুলছে টুকরো টুকরো মাংস। তহুরা বিবি পৃথিবীর সবচে দামী মাংস, অর্থাৎ ডায়নোসরের মাংস কিনবেন। তিনি ধনী মানুষ, ঘুম থেকে জাগলেই তার মাথাপিছু আয় বেড়ে যায়। প্রতিদিনই ধনী হয়ে ওঠেন। একজন আদর্শ ধনী হিসেবে সাপ্তাহিক ছুটি উদযাপনে ডায়নোসরের মাংস ছাড়া তিনি আর কি’ই বা খেতে পারেন!

আমি তহুরা বিবির তুলনায় কম ধনী। প্রতি সপ্তাহে ডায়নোসরের মাংস কেনার সামর্থ্য নাই। খুব বেশী হলে মাসে অন্তত একবার কিনতে পারি। কিন্তু বৃটেনের মানুষ টমেটো কিনতে হিমশিম খাচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ দু’বেলা খাবার যোগাতে পশুর মত লড়ছে, অস্ট্রেলিয়ায় ঘণ্টায় ঘণ্টায় লোডশেডিং হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যের রাজপরিবারগুলো পান্তা ভাতে নুন পর্যন্ত যোগাতে পারছে না, তখন ডায়নোসরের মাংস খাওয়া অমানবিক বলে মনে করি। শতবার চেষ্টা করলে এতটা অমানবিক হতে পারব না।

গোরু, খাসি আর মুরগির সস্তা দামের নিম্নমানের মাংস হল গখাদ্য। গখাদ্য মানে গোখাদ্য নয়, গরীবের খাদ্য। এসব মাংস কিনলে আমার মত ধনীর মান-সম্মান ধুলোয় মিশে যাবে। রুচি নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। কেও কেও টিপ্পনি কেটে বলবে, “লাখ টাকার কাঁথায় শুয়ে দশ টাকার স্বপ্ন দেখা! ছি:. ছি:. ছি।” তাই ডায়নোসরের তুলনায় সস্তা কিন্তু গখাদ্যের তুলনায় দামী ম্যামথ হাতির মাংস কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ক্ষুধাকাতর বিশ্বে একমাত্র আমাদের বাজারগুলিই ব্যতিক্রম, লক্ষ লক্ষ বছর আগের প্রাণীর মাংসেও স্বয়ংসম্পূর্ণ।

দেরী করে বাজারে আসার কারণেই হয় তো হাতির মাংস পেলাম না। সোবহান কসাই বলল, “সরকারপন্থী মিডিয়া হাউজগুলি ভাবমূর্তির দামে হাতির মাংস কিনে নিচ্ছে। তাই ব্রেকিং নিউজে সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকলেও খালি চোখে মাংস দেখা যাচ্ছে না।”

হাতির পরিবর্তে প্রাগৈতিহাসিক কালের দাঁতাল বাঘের মাংস কিনব কি নেহারি খাওয়ার জন্য দাঁত কিনব সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। তখনই কাজের বুয়া তহুরা বিবির সাথে দেখা হল। সাধারণ কুশল বিনিময়ের পর বললেন, “ডায়নোসরের মাংস কিনতে এসেছিলাম। কোনো দোকানে টিরানোসরাসের মাংসও পেলাম না।”

তহুরা বিবির চেহারায় গভীর ক্লান্তি আর বিষন্নতার ছাপ। তার দুর্দশা দেখে পৈশাচিক আনন্দ অনুভব করলাম। আনন্দে হাসতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলাম। ধনীদের দুর্বিপাকে আনন্দ অনুভব করা গরীবদের সহজাত অভ্যাস, তাই বলে এতটা গরীব হই নাই যে হাসির স্তর পর্যন্ত নামব। তিনি আরও জানালেন, মাছবাজারে তিমি বা হাঙর মাছ নেই। অন্যসব মাছের সাথে তেলেপিয়া ও পাঙ্গাসের দাম এত কমেছে যে একমাত্র গরীব ছাড়া কারো পক্ষে কেনা সম্ভব নয়।

তহুরা বিবি দীর্ঘশ্বাসের সাথে “ধনীরা কি খেয়ে বাঁচবে!” বলার পর প্রস্তাব দিলাম, “তবে মুরগী পট্টিতে যাওয়া যাক।” ধনী হবার পরও, পকেট ভর্তি টাকা আর পাকস্থলী ভর্তি উন্নয়ন থাকার পরও, শুধু ছুটির দিন উদযাপনের স্বার্থে দু’জন বড়লোক মিলে মুরগি পট্টিতে যাই। ব্রয়লারের দাম এত কমেছে যে কিনতে রুচি হয় না। দু’জন মিলে ভাগা হিসাবে সাজানো ডায়নোসরের পায়ের মত দেখতে ব্রয়লার মুরগির ঠ্যাং কিনি, হাতির মাংসের পরিবর্তে ব্রয়লারের গিলা-কলিজা কিনি।

বাজার শেষে বাসায় ফেরার পথে আমরা দু’জন ঐক্যমত পোষণ করি যে, দেশটা স্বল্পসংখ্যক গরীবের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে৷ দয়ায় টইটুম্বুর সরকার শুধু গরীব শাবকদের স্বার্থই রক্ষা করছে। অথচ ধনীরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। অঢেল প্রাচুর্য, প্রতিদিন বেড়ে যাওয়া মাথাপিছু আয়, দু’হাত খুলে বাজার করা আর রাজকীয় বিলাসিতায় মগ্ন ধনীদের বসবাসের জন্য দেশটা ক্রমশ অসহনীয় হয়ে উঠছে।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
ডায়নোসরের মাংস, 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ১ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ০১-০৪-২০২৩ | ৯:১৬ |

    কঠিন এক সময়ের গল্প পড়লাম। সময় বাঁধা থাক শব্দের ফ্রেমে। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...