হয়তো অতিরিক্ত যত্ন করে ফেলেছিলাম, তাই ছবির অর্কিডটা ফুল পাতাসহ তিন বছর আগে মরে গেছিলো। টবটার মধ্যে রয়ে গেছিল শুধু কাঠের চিপস।
চোখের সামনে জলজ্যান্ত অর্কিডটা মরে গেলো, কী যে খারাপ লাগছিলো। হাতে ধরে টবটাকে বাইরে ফেলে দিতেও পারিনি। আমি তো এমনিতেও ওয়ালমার্ট থেকে মরে হেজে যাওয়া গাছ সস্তায় কিনে এনে ঠিক বাঁচিয়ে ফেলি। আমার কিচেনল্যান্ডের প্রতিটি গাছ আমার হাতে পুণর্জন্ম পেয়েছে।
তিন বছর আগে মরে যাওয়া অর্কিডের শূন্য টবটা আমাদের বেডরুমের জানালায় অন্যান্য অর্কিডের পাশে রেখে রোদ জল দিয়ে যাচ্ছিলাম। প্রায় পাঁচ মাস পর লক্ষ্য করলাম, কাঠের চিপসের ভেতর থেকে আধা সে:মি সাইজের কালচে সবুজ কিছু বেরিয়ে আসছে। আমি শকড হয়ে গেছিলাম। আমি তো গাছপালা ভালোবাসি, কিন্তু কোন্ গাছের যত্ন কিভাবে নিতে হয় তা জানি না। বিশেষ করে অর্কিড, অর্কিড তো মাটিতে জন্মে না। অর্কিড পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ, অন্য গাছের ডালে ওরা জন্মায়। তাই টবের মধ্যে মাটির পরিবর্তে কাঠের চিপস থাকে।
নিয়ম না জেনে একবার একটা তাজা অর্কিড ছোটো টব থেকে সরিয়ে মাটি ভর্তি বড়ো টবে দিয়েছিলাম। পনের দিনের মধ্যে সেই সবুজ বড়ো বড়ো পাতাসহ অর্কিডটা মরে একেবারে মাটির সাথে মিশে গেলো। তখনই এক বাগান বিশেষজ্ঞ বৌদির কাছ থেকে জেনেছি, অর্কিড নাকি মাটিতে বাঁচে না।
যা বলছিলাম, গত তিন বছরে সেই মরে যাওয়া অর্কিডটা বেঁচে উঠে ছোটো ছোটো তিনটি পাতাও মেলেছে। আমি গত ছয় মাস বাড়িতে ছিলাম না, স্বামীর কর্মসূত্রে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছি। মিথীলার স্কুল জীবন থেকে বন্ধু এমিলির কাছে দায়িত্ব দিয়ে গেছিলাম সপ্তাহে একদিন ঘরে ঢুকে যেন মানিপ্ল্যান্ট, অর্কিডে জল দিয়ে যায়। মাঝে প্রচন্ড গরমের সময় আমাদের বাড়ির ইলেকট্রিসিটি লাইন দশ দিনের জন্য বন্ধ ছিলো এবং এমিলিও অই সময়ে আসতে পারেনি।
যখন এসেছে, ঘরে ঢুকে দেখে চারদিকে আগুনের মতো গরম, সব লতা পাতা, অর্কিড শুকিয়ে হলুদ হয়ে প্রায় মরে গেছে। আমাকে ফোন করতেই এই সংবাদ শুনে আমার দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম। এমিলি শুধু সরি সরি বলে চলেছে, ও কেন আরও আগে আসতে পারলো না তার জন্য আফসোস করছে। আমি বললাম, আমরা ফিরে আসা পর্যন্ত তুমি গাছগুলোয় আবার জল দিতে থাকো। আমরা বাড়িতে ফিরেই আমি ঘরের গাছগুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। সব গাছের বিপর্যস্ত বিধ্বস্ত অবস্থা। কিন্তু এমিলির দেয়া জল খেয়ে তখনও বেঁচে আছে।
নতুন বছর ২০২৩ এলো। গত তিন মাসে আমার ঘরের মানিপ্ল্যান্ট সবুজ হয়ে লতিয়ে উঠেছে, অর্কিডে আবার ফুলের স্টিক বেরিয়ে ফুল ফুটতেও শুরু করেছে, সেই বেঁচে ওঠা তিন পাতার অর্কিডটাও দেখি দাঁড়াতে শুরু করেছে। অর্কিডের তিন পাতার দিকে তাকিয়ে প্রায়ই ভাবি, এই অর্কিডের পাতা কবে বড়ো হবে, কবে হৃষ্টপুষ্ট হবে তবেই ফুলের স্টিক বের হবে! চার পাঁচ দিন আগে জানালায় থাকা অর্কিডগুলোকে বাথরুমের বেসিনে রেখে স্নান করাচ্ছিলাম, তিন পাতার অর্কিডটাকেও স্নান করিয়েছি।
স্নান শেষে যখন ওদের সবাইকে আবার জানালায় এনে বসিয়েছি, দেখি তিন পাতার অর্কিডে সরু কাঠির মতো একটা নতুন ডালা বের হচ্ছে। এই ডালাগুলোকে আমি চিনি। এটাই ফুলের স্টিক, তবে অর্কিডের স্টিক এতো সরু হয় তা আগে দেখিনি। নতুন বছরে ভাবছিলাম নতুন জন্ম পাওয়া এই তিন পাতার অর্কিড কবে বড়ো হবে, কবে ফুল ফুটবে! আর দশ দিন পরেই কিনা সেই অর্কিডে ফুলের স্টিক বের হলো!
আজ দুপুরে এই ছোট্টো অর্কিডের টবটা বাথরুমে নিয়ে স্নান করালাম। এরপর মিথীলার কাছে নিয়ে এলাম, বললাম ওর পুণর্জন্মের কাহিনী। সব শুনে মিথীলা বিস্মিত! এক দৃষ্টিতে অর্কিডের দিকে তাকিয়ে মুখে বললো, মা, তোমার অনেক ধৈর্য। অনেক ধৈর্য। তুমি একটা মাত্র মানিপ্ল্যান্ট থেকে এতোগুলো পট বানিয়েছো, দুইটা ব্যাম্বু প্ল্যান্ট থেকে এতোগুলো ব্যাম্বু প্ল্যান্ট বানিয়েছো! তুমি চেয়েছিলে মানিপ্ল্যান্ট লতা দিয়ে আমাদের সিঁড়ির রেলিং পেঁচাতে। অলরেডি সেই লতা সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাচ্ছে! আর আর্যর জন্য কত বছর ধরে ফান্ড রেইজ করেই যাচ্ছো। ফান্ড ঠিকমতো না এলে তোমার মন খারাপ হয়, তুমি চিন্তায় পড়ে যাও। তবুও নতুন করে আবার স্টার্ট করো।
আমার মনে হচ্ছে, তোমার অর্কিডটা যেমন বেঁচেছে, নতুন ফ্লাওয়ার স্টিক বেরিয়েছে, আর্যর জন্য তুমি ফান্ড রেইজিং সাকসেসফুল হবে। আর্যও সেরে উঠবে। মিথীলার কথা শুনে আমার চোখে জল এসেছে। বললাম, এই প্রথম আমার পরিবারের কেউ একজন স্পষ্ট করে আমায় চিনলো। মিথীলা, তুমি আমায় ঠিক চিনেছো। বাইরে থেকে আমাকে যতোই হুড়ুমদুড়ুম মনে হোক, ভেতরে আমি অনেক স্থির, আমার অসীম ধৈর্য, এবং আমি লক্ষ্যে স্থির থাকি। এবং আজ আমি বলছি, আমার চেয়েও অনেক বেশী ধৈর্য তোমার। আমাদের কত কঠিন কাজ তুমি করে দাও। মা বাবাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া, বাজারে নিয়ে যাওয়া, বেড়াতে নিয়ে যাওয়া, অনলাইনের ভেজাল সামাল দেয়া— কী না করো তুমি!
আর্যর জন্য ফান্ড রেইজ করা অত সহজ হতো না যদি না তুমি রাত জেগে অসীম ধৈর্য নিয়ে বারবার Go Fund Go Fund খুলে দিতে।
loading...
loading...
যাপিত জীবনের অসামান্য একটি লিখা। অশেষ শুভকামনা প্রিয় লিখক।
loading...