ভর দুপুরে আমার উত্তম কুমার গেছেন ইউনিভার্সিটিতে, নতুন ছাত্র ছাত্রীদের অভিষেক অনুষ্ঠানে ঘন্টা দুয়েকের জন্য। একা ঘরে আমি কমপিউটারে ধারাবাহিক ‘সুবর্ণলতা’ দেখছি। কিছুক্ষণ আগে বাইরে থেকে দরজার লক খোলার শব্দ পেয়ে বুঝলাম, অনুষ্ঠান শেষ করে উত্তম ফিরে এসেছেন।
আমি স্ক্রিনে নাটক সিনেমা গান যা-ই দেখি, ভলিউম উঁচুর দিকে থাকে। আমি কথাও বলি উঁচু ভলিউমে যাতে কুড়ি হাত দূরে থাকলেও কারো শুনতে সমস্যা না হয়। আর আমার উত্তম কুমার হয়েছেন আমার উলটো। টিভিতে নাটক দেখছেন অথচ ডায়লগে সাউন্ড নেই, কারো সাথে কথা বলছেন অথচ পাঁচ হাত দূরে থেকে অন্য কেউ শুনতে পাচ্ছে না!
এভাবেই বিয়ের পর ৩৭ বছর উত্তম আর অধম একসাথে থাকতে থাকতে গলার নীচু এবং উঁচু ভলিউমে সমঝোতা হয়ে গেছে। ৩৭ বছরে আরেকটা পরিবর্তন এসেছে। আমরা দুজনেই এখন কথা কম বলি, টিভিতে নাটক সিনেমা দেখি যার যার রুমে বসে অর্থাৎ সাউন্ড ভলিউমের তারতম্য নিয়ে যাতে ঝগড়া না হয় সেই চিন্তা করেই নির্ঝঞ্ঝাট দূরত্বে থাকি! এসব শুনলে মনে হয়, বিয়ের ৩৭ বছর পর স্বামী স্ত্রীতে প্রেম ফুরিয়ে যায়! আমারও তাই মনে হয়, আমাদের মধ্যে প্রেম ফুরিয়ে গেছে মনে হয়!
কিন্তু মাঝে মাঝে উত্তমের ঘর থেকে গান ভেসে আসে, “নীড় ছোটো ক্ষতি নেই, আকাশ তো বড়ো” অথবা “ধন্য আমি ধন্য হে, পাগল তোমার জন্য যে” এমন আরও মন আকুল করা সব গান। এসব গান শুনে আমার মন কেমন করে, ফিরে পেতে ইচ্ছে করে আমাদের প্রথম জীবনের দিনগুলো! আমি বিভ্রান্ত হই, আসলেই কি বিয়ের বয়স দীর্ঘ হলে স্বামী স্ত্রীতে প্রেম ফুরিয়ে যায়! আজও ক্ষণিক আগে দরজা খোলার শব্দ পেয়ে যখন বুঝলাম উত্তম ফিরে এসেছে, সুবর্ণলতায় তখন মেজো বউয়ের মন পাওয়ার জন্য তার স্বামী পেবো বোকা বোকা কান্ড করেই চলেছে।
সব ছাপিয়ে উত্তমের গলা ভেসে এলো। নাটক পজ করে কান খাড়া করলাম উত্তম কি বলছে শোনার জন্য।
শুধোলাম, কি গো, কিছু বলছো?
উত্তম বললো, স্নো কোন খাবে? তোমার জন্য এনেছি।
আমি উত্তমের কথার মানে বুঝিনি বোধ হয়! চেয়ার ছেড়ে উঠে সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে শুধোলাম,
কি এনেছো?
– স্নো কোন
– স্নো কোন কি? কোথা থেকে এনেছো? তুমি কি ভার্সিটি থেকে কোথাও গেছিলে?
– না, অন্য কোথাও যাইনি। ওখান থেকেই এনেছি তোমার জন্য। নতুনদের অভিষেক অনুষ্ঠান, স্ন্যাকসের আয়োজন ছিলো। ছেলেমেয়েরা দেখলাম খুব খাচ্ছে এটা, তাই তোমার জন্য নিয়ে এলাম।
আমি তো মুখ হা করে দাঁড়িয়েই আছি, স্নো কোন কাকে বলে তাই জানি না। উত্তম রঙিন বরফ কুচিতে ভরা কাগজের একটা গ্লাস আমার দিকে এগিয়ে দিলো। বললো, অনেক রকম ফ্লেভার ছিলো, আমি দুই রকমের সিরাপ মিশিয়েছি, আমি নিজেই পছন্দ করেছি ফ্লেভার। একটা ম্যাঙ্গো, আরেকটা গ্রেইপ ফ্লেভার। আমি মন্ত্র চালিত অবস্থায় হাত বাড়িয়ে গ্লাসটা নিলাম। বুঝতে পারছিলাম না, আমি টাইম মেশিনে চড়েছি কি না!
টাইম মেশিন কি আমায় ৩৭ বছর পেছনে নিয়ে গেছে! ৩৭ বছর আগে ঠিক এমনটাই হতো, প্রতিদিন এমন ঘটনা ঘটতো।
এমনকি ২২ বছর আগেও ঘটতো এমন ঘটনা। অফিসের কোনো প্রোগ্রাম, উত্তম আমাকে ছাড়া যেতোই না। অফিসে খাওয়া দাওয়া হচ্ছে, উত্তম আমার পছন্দের খাবার প্যাক করে নিয়ে আসতো। কোম্পানির খরচে তিন দিনের অফিস ট্যুরে দুবাই যাচ্ছে টিম, উত্তম নিজের টাকা দিয়ে আমার জন্য টিকেট কিনে আমাকে সাথে নিয়ে গেছে! বাইরে গেছে, ফেরার সময় আমার জন্য স্যুটকেস ভর্তি সুন্দর সুন্দর শাড়ি নিয়ে এসেছে। এসবই হতো দেশে থাকতে, আমেরিকা আসার পর ধীরে ধীরে আমরা মন মননে বুড়ো বাঙালি হয়ে গেছি!
বাঙালি বুড়ো হওয়ার আগেই মন এবং মগজ থেকে প্রেম, রোমান্সের সুইচ দুটো অফ করে দেয়। বুড়ো বাঙালি দম্পতি পরস্পরের প্রতি প্রেমময় আচরণ করছে, প্রেমের কথা বলছে— এ দৃশ্য বিরল। আমার হতবিহ্বল ভাব কেটে গেলো। হাতে পায়ে স্বভাবগত উচ্ছ্বাস বেরিয়ে এলো।
বললাম, এর নাম স্নো কোন? এটা তো ডেসিয়া।
উত্তম বলল, ডেসিয়া আবার কি?
-আমাদের ছোটো বেলায় সাইকেল ভ্যানে বিশাল কাঠের বাক্স নিয়ে আসতো। হাঁক দিতো, ‘ডেসিয়া, ডেসিয়া’!
কাঠের বাক্সে নানা রঙের সিরাপের বোতল সাজানো থাকতো, আইসক্রিমওয়ালা করাতের মধ্যে বরফের চাকা ফেলে ঘষতো, করাতের নীচে বরফের কুচি জমা হতো। সেই বরফকুচি হাত দিয়ে চেপে চেপে কাঠির মধ্যে বসিয়ে তার উপর সিরাপ ঢেলে দিতো। ওটাই ডেসিয়া, এখানে নাম স্নো কোন। এরপর বললাম, তা এত বড়ো কাপ স্নো কোন আমি একা খাবো কেন? তুমি অর্ধেক নাও।
– না না, এটা তোমার জন্যই। বরফ আমার দাঁতে লাগলে দাঁত সিরসির করে।
– এতোকাল পর তুমি আবার সেই আগের মতো অনুষ্ঠান থেকে আমার জন্য কিছুমিছু নিয়ে এলে, আমি তো আনন্দে বেহুঁশ হয়ে গেছি! তোমাকে ছাড়া আনন্দ কার সাথে শেয়ার করবো?
– আমার জন্যও এনেছি, একটা কোকের ক্যান।
তখনও টাইম মেশিন ২২ বছরের পথ পার হয়নি। এক ছুটে উত্তম কুমারকে আলতো করে জড়িয়ে ধরলাম। খুকীদের মতো নেকু নেকু আবদেরে গলায় বললাম, স্নো কোন-টা খাবো? খেলেই তো সব স্মৃতি হারিয়ে যাবে।
এই স্নো কোন-টা টাইম মেশিন। তুমি আজ আমাকে টাইম মেশিনে তুলে দিয়েছো। স্নো কোন হাতে নিয়ে আমি চলে গেছি আমাদের বাংলাদেশ জীবনে।
ঐ জীবনে আমাদের প্রাণ প্রাচুর্য ছিলো, ভালোবাসা ছিলো, টান ছিলো, রোমান্স ছিলো, আলো ছিলো, মাঝে মাঝে টাকার অভাব ছিলো, কিন্তু কখনও প্রাণের অভাব ছিলো না ——
আমেরিকায় আলো বাড়ি গাড়ি সব আছে শুধু প্রাণ নেই কোথাও।
২১ বছর আগে আমেরিকা এসেছি। ২১ বছর পর আজ নতুন করে আমার দেহে প্রাণের সাড়া পেলাম।
★ সুখ উপস্থিত হয় হঠাৎ, ধরতে পারলেই সুখ তোমার, ধরতে না পারলে সুখ ফুড়ুত।
loading...
loading...
সুখ উপস্থিত হয় হঠাৎ, ধরতে পারলেই সুখ তোমার, ধরতে না পারলে সুখ ফুড়ুত।
loading...