এক ছিলো টোনা আর এক ছিলো টুনি। একদিন টোনা আহ্লাদ করে টুনিকে বলে,
— টুনি, ও টুনিইই..
টুনি হাই তুলে,
— হ্যা, বলো।
— আমার খুব ভাপা পিঠা খেতে ইচ্ছে করছে। খুব ইচ্ছে করছে।
টুনি রাগে চোখ পাকায়,
— তোমার কি খেতে ইচ্ছে করছে!
— পিঠা, ভাপা পিঠা।
— তোমার সুগার লেভেল হাই। শরীরে চর্বি জমছে। ফ্যাটি লিভার। আর ডায়েট না করে তুমি ভাপা পিঠা খেতে চাইছো! হাও সিলি!!
টোনার মন খুব খারাপ হলো। চোখে পানি চলে এলো। টুনিকে কান্নাভেজা স্বরে বলে,
— তোমার চটপটি খেতে ইচ্ছে হলো, বৃষ্টির মধ্যে আমি গিয়ে ননভেজ চটপটি কিনে আনিনি! তোমার ফুচকা খেতে ইচ্ছে হলো, তোমাকে কানিবগের ফাইভস্টার রেস্টুরেন্টে নিয়ে চিকেন ফুচকা খাওয়াইনি! আর আজ আমি সামান্য দুটো ভাপা পিঠা খেতে চেয়েছি বলে.. তুমি এভাবে..
“এক্কেবারে ঢং করবে না” বলে টুনি ধমকে উঠে। এরপর ঠোঁটে পায়ের নোখ কাটতে কাটতে বলে,
— জানু, ভাপা পিঠা খাবে বললেই তো বানানো যায়না। এর জন্য জিনিসপত্র লাগে। তুমি ঢং না করে জিনিসপত্র এনে দাও, ভাপা পিঠা বানিয়ে দিচ্ছি।
টোনার মনে খুব আনন্দ হয়। পাখায় চোখ মুছে বলে,
— কি কি জিনিসিপত্র লাগবে, সোনামনু?
— চালের গুড়ি লাগবে। গুড় লাগবে, মাওয়া লাগবে, নারকেল লাগবে। মাটির ঢাকনা লাগবে, ওই ঢাকনা বসানোর জন্য হাড়ি লাগবে, গ্যাস সিলিন্ডার লাগবে আর আমার মোবাইলে পাঁচ জিবি ডাটা লাগবে।
টোনা অবাক,
— ভাপা পিঠা বানাতে ৫জিবি ইন্টারনেট ডাটাও লাগবে!
— হ্যা, লাগবে। বেশী কথা না বলে এখনি বাজারে যাও।
টোনা বাজারে গিয়ে চালের গুড়ি, গুড়, মাওয়া, নারকেল, মাঝখানে ফুটো করা মাটির ঢাকনা, ঢাকনা বসানোর হাড়ি কিনে। বাজারের বাইরে এসে এলপি গ্যাস সিলিন্ডার কিনে। টুনির মোবাইলে ৫জিবি ডাটা ভরে, সব নিয়ে বাসায় ফিরে।
টোনার মনে খুব সুখ — আজ ভাপা পিঠা খাবে। ওইদিকে টুনি ইউটিউবে ঢুকে ভাপা পিঠা বানানোর রেসিপি খুঁজছে, কিন্তু পাচ্ছে না। বারবার আসছে শুধু নুডলসের রেসিপি। নুডলসের খিচুরি, নুডলসের চাটনি, নুডলসের পুড় দেওয়া বেগুনের স্যান্ডুউচ। স্ক্রল করতে করতে নুডুলস দিয়ে ভাপা পিঠা বানানোর একটা রেসিপিও পেয়ে গেলো। ভিডিওটা খুলতেই মনে পড়লো ঘরে নুডলস নেই। এখন টোনাকে নুডুলস আনার কথাও বলা যাবে না। খুব রাগ করবে। ভাববে টুনি ভাপা পিঠা না বানানোর বাহানা করছে। টুনি আবার চালের গুড়ি দিয়ে ভাপা পিঠা বানানোর রেসিপি খুঁজতে শুরু করে। কথায় বলে, যেখানে মাহফুজের ভয় সেখানে হিরো আলম হয়, আসল রেসিপি খুঁজতে যেতেই বাফারিং শুরু হয়। ইটারনেটের গতি এক্কেবারে স্লো হয়ে আসে।
টুনি বারবার চেষ্টা করছে। বারবার রিফ্রেশ দিচ্ছে। রিলোড অপশনে ক্লিক করছে। কিন্তু নেট গাল ফুলিয়ে বসে আছে। কাজই করছে না। এমন সময় পাশের গাছের বাসা থেকে চড়ুই গিন্নি মাথা উঁচিয়ে চিৎকার করে বলে ,
— টুনি ভাবীইইই, টুনি ভাবীইইই আপনার ইন্টারনেট কি কাজ করছে!
— কি যে বলেন ভাবী, ইউটিউবের ভিডিওটা এক ঘণ্টায়ও ওপেন করতে পারলাম না।
— আমি ‘নাজুক দিল’ সিরিয়ালটা দেখছিলাম। নায়িকা সবে শ্বাশুড়ির সাথে ঝগড়া শুরু করেছে, গেলো হ্যাং হয়ে। সিরিয়ালের ফ্রিজ শট মনে করে তাকিয়ে আছি। পরে দেখি ইন্টারনেট স্লো। নায়িকার জন্য খুব টেনশন ফিল করছি ভাবী..
— ওহ, তাই! এদিকে আমি খুঁজছিলাম ভাপা পিঠার রেসিপি।
এ কথা শুনেই চড়ুই গিন্নি অভিমানী স্বর,
— হায় খোদাআআ! ভাবীইইই আপনারা একা একা ভাপা পিঠা খাবেএএএএন! আমাদের কথা মনেই পড়লো না ভাবীইইই, আজ চড়ুই না হয়ে বুলবুলি হলে ঠিকই দাওয়াত দিতেন ভাবীইইইই..
টুনি বিব্রত হলেও নিজেকে সামলে নেয়,
— কি যে বলেন, ভাবী! আপনাকে দাওয়াত দিতে হবে কেনো! আপনি তো ঘরের মানুষ, সবাইকে নিয়ে চলে আসবেন।
— থ্যাঙ্কু ভাবীইইই। আপনার হাতে বানানো ভাপা পিঠা খেতে আমরা তো আসবোই ভাবীইইইই। আমাদের উপরের ডালে কাজিন থাকে, ওর ফ্যামিলিকেও সাথে নিয়ে আসবো, ভাবীইইইইই।
টুনি রেগে মনে মনে “ঢং দেখলে শরীরটা জ্বইল্যা যায়” বললেও, মুখে হাসি মেখে উত্তর দেয়,
– অবশ্যই নিয়ে আসবেন। খুব খুশি হবো।
চড়ুই গিন্নী বাড়ির ভেতর ঢুকে যেতেই টুনি ধমকের সুরে টোনাকে বললো,
— চড়ুই ভাবী এলে এক্কেবারে রংঢং করবে না। যদি করো তবে চালের গুড়ির ভেতর তোমার মাথা পুরে সিদ্ধ করে মাসালা ভাপা পিঠা বানাবো, মনে থাকে যেনো, হু।
কোকিল পাখির গাওয়া কাকসংগীতের একটা সিডি লো ভলিউমে টোনা আয়েশ করে শুনছে আর ভাবছে কখন বানানো হবে ভাপা পিঠা। এদিকে বাফারিং হতে হতে টুনির মোবাইলের চার্জ শেষ। মোবাইল সেটটা চার্জে দিয়ে টুনি নারকেল কুড়ালো। গুড় মিহি করে টুকরো টুকরো করলো। চালের গুড়ির সাথে মাওয়া মিশালো। হাড়িতে পানি ভরে চুলোয় বসালো।
সবকিছু ঠিকঠাক করে টুনি মোবাইল অন করে। মোবাইল অন করে মন খারাপ হয়ে যায়, দেখে ইন্টারনেট স্পিড এক্কেবারে কম। মাত্র ভাবতে শুরু করেছে ইউটিউব না খুললে ভাপা পিঠা বানাবে কিভাবে, তখনই বটগাছের পূব পাশের মগডালের ওপেন এয়ার ডুপ্লেক্সে বাস করা ব্যাচেলর চিলটা উপরের ডালে উড়ে এসে বসে,
— হ্যালো টুনি ভাবী, বাসায় আছেন?
চিলের কথা শুনে উচ্ছসিত টুনি বলে,
— কি আশ্চর্য! ভাইয়াআআআ, এদ্দিন পর আমাকে মনে পড়লো!
— না, ঠিক তা না। রোজই আপনার কথা মনে হয়, কিন্তু..
কথা শেষ করতে না দিয়েই টুনি কপট রাগ দেখায়,
— থাক.. থাক। বানিয়ে বানিয়ে আর মিথ্যে বলতে হবে না, ভাইয়ায়ায়ায়া। আপনার তো শুধু ডাহুক ভাবী, পায়রা ভাবীর কথা মনে পড়ে, ভাইয়ায়ায়া। আমার মত ছোট্ট টুনির কথা কি আর মনে পড়বে, ভাইয়ায়ায়ায়া।
চিল প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলে,
— টুনি ভাবী, ইন্টারনেটের স্পিড কি ঠিক আছে?
— না, ভাইয়ায়ায়া, ঠিক নেই। খুব স্লো, ভাইয়ায়ায়া।
টুনির এমন বিগলিত অবস্থা দেখে ঘরের ভেতরে টোনা রাগে দু’বার পাখা ঝাপটালো। বিষয়টা বুঝতে পেরে চিল টিটকারি মারে,
— কত স্লো, ভাবী! টোনার মত? প্রতি মৌসুমেই তো আপনার ডিম পাড়তে দেরী হয়ে যায়।
লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে টুনি। চিল প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে,
— এত আয়োজন কার জন্য?
— আপনার ভায়ের ভাপা পিঠা খেতে খুব ইচ্ছে হয়েছে, ভাইয়ায়ায়া। সব রেডি কিন্তু ইন্টারনেট স্পিড কম বলে পিঠা বানাতে পারছি না, ভাইয়ায়ায়ায়ায়।
চিল ভিরমি খেয়ে দুটো ঢোক গিলে বিস্ময় প্রকাশ করে,
— ভাপা পিঠা বানাতেও আজকাল ইন্টারনেট লাগে না কি!
— হ্যা, ভাইয়ায়ায়া। ইন্টারনেট না থাকলে ইউটিউবে রেসিপি দেখে পিঠা বানাবো কিভাবে!
— ও আচ্ছা।
টুনি আন্তরিক স্বরে বলে,
— ভাইয়ায়ায়ায়া, আজ কিন্তু আপনার দাওয়াত, না বলতে পারবেন না।
ঘরের ভেতর টোনা রাগে আবার পাখা ঝাপটায়। পাখা ঝাপটানোর শব্দ কানে যেতেই মুচকি হেসে চিল বলে,
— ঠিক আছে টুনি ভাবী। আপনি দাওয়াত দিচ্ছেন, এ দাওয়াত কি মিস করা যায়! আপনার হাতের পিঠা বলে কথা..
টোনা আগেই রেগে ছিল। ইন্টারনেট স্পিড ঠিক হচ্ছে না দেখে টোনার রাগ খুব বাড়লো। কখন ইন্টারনেট স্পিড ঠিক হবে তা জানাতে কাস্টমার কেয়ারে ফোন করতেই শালিকের লাস্যময়ী কণ্ঠ,
— সম্মানিত গ্রাহক, আমাদের সার্ভিসে আপনাকে স্বাগতম। মোবাইল রিচার্জের জন্য এক চাপুন। কল রেট জানতে দুই চাপুন। ইন্টারনেট প্যাকেজ কিনতে তিন চাপুন। দশটাকায় পাঁচটা ফ্রি এসএমএস পেতে চার চাপুন। যে কোনো অভিযোগ জানাতে ডিসকানেক্ট বাটন চাপুন।
টোনা ডিসকানেক্ট বাটনে চাপাতে লাইন কেটে গেলো। দ্বিতীয়বার কল সেন্টারে ফোন করতেই ভেসে এলো ফিঙের কণ্ঠ,
— সম্মানীত গ্রাহক, আপনার একাউন্টে পর্যাপ্ত পরিমাণ ব্যালেন্স নেই। কথা বলতে হলে রিচার্জ করুন। দ্রুত ডিম পাড়াতে হলে সঠিক পদ্ধতিতে টুনিকে আদর করুন। কল অপারেটরকে গালাগাল করার জন্য মোবাইল সেটের ‘পাওয়ার অফ’ অপশনে ক্লিক করুন এবং ইন্টারনেট স্পিড ছাড়া ভাপা পিঠা খেতে চাইলে মা’কে অনুরোধ করুন।
.
নব টোনাটুনি।
সাঈদের গল্প বইয়ের একমাত্র রম্যগল্প।
loading...
loading...
গল্পটি আমার কাছে বরাবরের মতো অসাধারণ লেগেছে।
আপনার উপস্থাপন ভঙ্গী ই আর সবার থেকে স্বতন্ত্র।
loading...