আমার বড়ো মেয়ে মৌটুসি ঢাকা ওয়াইডাব্লিউসিএ স্কুলে যখন নার্সারিতে পড়তো, স্কুলের ফাংশানে ওর ক্লাসের এক বন্ধুকে নাচ করতে দেখে ওরও নাচ শেখার শখ হলো।
ঐ স্কুলেই নাচের ক্লাসে ওকে ভর্তি করালাম। সপ্তাহে দুইদিন ওকে নাচের ক্লাসে নিয়ে যাই।
টিচার বাচ্চাদের নাচ শেখাতেন, বাচ্চাদের মায়েরা নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করতো।
আমি মায়েদের গল্পে মনোযোগ না দিয়ে তাকিয়ে থাকতাম নাচের টিচারের দিকে।
টিচার হাতের ইশারায়, হাতের আঙুলের আঁকিবুঁকি দিয়ে নাচের মুদ্রা তৈরি করতেন, আমি মুগ্ধ চোখে দেখতাম।
টিচার যেদিন দুই হাতের আঙুল আর মুঠি দিয়ে ‘পাখি’র মুদ্রা দেখালেন, আমার মাথার ভেতর তোলপাড় শুরু হলো। কোথায় দেখেছি, এমন পাখি কোথায় দেখেছি! কিছুতেই মনে পড়ছিলো না!
মৌটুসি ঘরে ফিরে প্রতিদিন নাচের প্র্যাকটিস করার সময় আমাকে বসিয়ে রাখতো। ওর ভুল হলে যেনো ভুলগুলো ঠিক করে দিতে পারি।
‘সুন্দরী কমলা নাচে’ গানের সাথে নাচের মুদ্রা প্র্যাকটিস করতে গেলেই হাতের আঙুল আর মুঠি দিয়ে পাখির মুদ্রা করতে হতো।
মৌটুসির হাতের মুদ্রার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই একদিন চট করে মনে পড়ে গেলো, এই পাখি কোথায় দেখেছি!
পূর্ব পাকিস্তান আমলে আমরা থাকতাম নারায়ণগঞ্জের নগর খানপুর এলাকায়। তখন আমি খুব ছোটো ছিলাম।
একজন বুড়ো বেহালা বাজিয়ে ভিক্ষে করতো।
বুড়ো আমাদের কোয়ার্টারেও আসতো ভিক্ষে নিতে।
উনার বেহালার মাথাতেই দেখেছি ঠিক এরকম একটা পাখি (কাঠের তৈরি)!
বুড়ো বেহালা বাজাতো, আমি পাখিটার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতাম।
পূর্বপাকিস্তান পিরিয়ডের কথা বলছি। তখন পথে ঘাটে খুব বেশী ভিক্ষুক ছিলো না।
যারা ভিক্ষে করতে মানুষজনের বাড়ি যেতো, তারাও একেবারে খালি হাতে ভিক্ষে চাইতো না।
কেউ একতারা দোতারা বাজিয়ে গান শোনাতো, কেউ খোল করতাল বাজিয়ে হরে কৃষ্ণ গেয়ে ভিক্ষে করতো।
একজন ফকির বাবা আসতো, আমরা ডাকতাম ‘ মুশকিল আসান’!
কারণ সেই ফকির বাবা বাড়ির উঠোনে পা দিয়েই জোরে বলতো, মুশকিল আসান। সেই থেকেই ফকির বাবার নাম হয়ে গেলো মুশকিল আসান।
মুশকিল আসান বাবা এসে উঠানে দাঁড়ালেই বাচ্চারা সব ছুটোছুটি করে মুশকিল আসানকে ঘিরে ধরতো।
মুশকিল আসানের পোশাক ছিলো বিশাল আলখাল্লার মতো, কতো রঙের কাপড় জোড়াতালি দিয়ে বানানো। গলায় থাকতো এক গোছা বড়ো দানা পুঁতির মালা।
মুশকিল আসান দুই চোখে কাজল দিতো।
উনার কাঁধে থাকতো ঝোলা, হাতে ধরা থাকতো টিনের পাতে তৈরি ধুনুচি। সেই ধুনুচি থেকে ধোঁয়া বের হতো।
মুশকিল আসান হাঁকডাক, হম্বি তম্বি করতেন না। উঠোনে এসে মুশকিল আসান বলে দাঁড়াতেন, তাতেই সাড়া পড়ে যেতো।
আমরা কাছে গেলে মুশকিল আসান আমাদের সবার কপালে ধুনুচি থেকে ছাইকালির টিপ পরিয়ে দিতেন, তাতেই আমরা খুশি হতাম।
মুশকিল আসান খুব শান্ত হলেও উনাকে আমার ভয় করতো। উনার কাছে গিয়ে টিপ পরতাম ঠিকই, কিন্তু উনার কাঁধে ঝুলানো ঝোলার দিকে তাকালেই মনে হতো, হঠাৎ আমাকে ধরে ঐ ঝোলার ভেতর ভরে ফেলবে।
আরেক জন আসতো গাজীর পট নিয়ে। কাপড়ের ক্যানভাসে রঙ দিয়ে আঁকা কত ছবি। কি কি যেন ছড়া কেটে গান করতো গাজীর পট নিয়ে আসা মানুষটা।
গাজীর পটের লোকটাই মনে হয় আমাদেরকে বিচিত্র সব ছবি দেখিয়ে বলতো, পাপ করলে নরকে যাবে। নরকে যমরাজ কঠিন শাস্তি দেয়। মিথ্যেবাদীদের জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলে, তারপর গরম তেলের কড়াইয়ে ফেলে—- আরও কত ভয়ঙ্কর সব কথা! পটে আঁকা নরকের ছবি দেখাতো।
আরও কয়েকজন সাদা থান পরা বৈষ্ণবী আসতো। তাদের নাকে তিলক আঁকা ছিলো। তারা করতাল বাজিয়ে গান গাইতো,
” প্রভাত সময়কালে শচির আঙিনা মাঝে, গৌর চাঁদ নাচিয়া বেড়ায় রে!”
শচি শুনলেই আমার মনে হতো শচি’দার কথা। আমার দাদা বৌদির নতুন সংসারে কাজ করতো শচি’দা। বড়োরা শচি’দাকে ডাকতো শইচ্চা।
এরপর তো মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। নয় মাস যুদ্ধশেষে দেশ স্বাধীন হলো, নতুন দেশে নতুন জীবন শুরু করতে গিয়ে মাত্র নয় মাস আগের জীবনটা পুরনো হয়ে গেলো, নাকি পূর্ব জনমের স্মৃতি হয়ে হারিয়েই গেলো!
স্বাধীন দেশে প্রতিদিন শত শত ভিক্ষুকের ভীড়ে হারিয়ে গেলো পূর্ব জনমে দেখা বেহালা বাদক বুড়ো, মুশকিল আসান, গাজীর পট, “শচির আঙিনা মাঝে গৌর চাঁদ নাচিয়া বেড়ায় রে” গান গাইয়ে বৈষ্ণবীদের মুখ।
বেহালা বাদক কোথায় হারিয়ে গেছে! পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে তাঁর বুক ঝাঁঝরা হয়ে গেছে হয়তো, হয়তো গুলিতে বেহালার মাথায় বসা পাখিটাও ঝাঁঝরা হয়ে গেছিলো!
স্বাধীন বাংলাদেশে আমাদের নতুন জীবনে সকল পুরাতনেরা হারিয়ে গেছিলো! বেহালা বাদকও হারিয়ে গেছিলেন!
পরের শৈশবেই ভুলে গেছিলাম পূর্বের শৈশবের কথা। ভুলে গেছিলাম বেহালা বাদক বুড়োর কথা।
স্বাধীন দেশে সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া জীবনের প্রতিটি দিন সংগ্রাম করতে করতেই বড়ো হয়ে গেলাম, নিজের সংসার হলো। পাকিস্তান পিরিয়ডে যে মেয়েটি ছোট্টো ছিলো, বাংলাদেশে সেই মেয়েটির কোলে এলো নতুন ছোট্টো মৌটুসি
*********************
স্বাধীনতার অনেক বছর পর, ছোট্টো মৌটুসিকে নাচের মুদ্রা শেখাতে গিয়ে আমার মনে পড়ে গেলো আমার শৈশবে দেখা কত জনের কথা! বেহালা বাদকের কথা, মুশকিল আসানের কথা, গাজীর পটে আঁকা নরকের ছবি!
**************************
সেই ছোট্টো মৌটুসিও আর ছোটো নেই। আমিও বুড়ো হতে চলেছি।
বুড়ো হতে হতেও যেন বুড়ো হতে পারছি না। গতরাতে আবার সেই বেহালা বাদককে স্বপ্নে দেখলাম!
হয়তো স্বপ্নে দেখিনি, আজকাল ঘোরের মধ্যে থাকি তো, থেকে থেকেই নিষ্পাপ নিষ্কলুষ শৈশবের কথা মনে পড়ে!
হয়তো গতরাতেও ঘোরের মধ্যেই বেহালা বাদকের কথা মনে পড়েছে। মনে পড়েছে সেই কাঠের পাখিটার কথা, যে লেজ ঝুলিয়ে বসে থাকতো বেহালার মাথায়।
loading...
loading...
যাপিত জীবনের গল্প অসাধারণ ভাবে উঠে এসেছে। নস্টালজিক হলাম প্রিয় লেখক।
loading...
স্মৃতিচারণ ভালো লাগল। ধন্যবাদ।
loading...