পিচার প্ল্যান্ট এবং আলেকজান্দ্রিয়া

295

আর্কাইভ ঘেঁটে পিচার প্ল্যান্টের ছবিটা পেয়েছি।
পিচার প্ল্যান্ট, মানে কলসি গাছ। গাছ থেকে লালচে রঙের ঝুলন্ত বস্তুগুলোই পিচার বা কলসি।

এই গাছের কলসিতে জল রাখা হয় না, এর ভেতর পোকা থাকে। পোকা মাকড় গাছের গায়ে বসলে সেই পোকা কলসির ভেতর পড়ে যায়, সাথে সাথে কলসির মুখ বন্ধ হয়ে যায়।

এই কথাগুলো আমার নয়।

আলেকজান্দ্রিয়া নামে ৮/৯ বছরের মিষ্টি এক বালিকা তার ছোট ভাইকে তথ্যগুলো দিচ্ছিল। পাশে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে আমি শুনছিলাম।

২০১৬ সালের জুলাই মাসে আমি আর উত্তম আরেক বন্ধু দম্পতির সাথে বেড়াতে গেছিলাম নর্থ ক্যারোলাইনা। সেখানে ভ্যান্ডারবিল্ট সাহেবের প্রাসাদ আছে, সেই প্রাসাদের চারদিকে ছড়ানো সাজানো বাগানেই এক জায়গায় অনেকগুলো পিচার প্ল্যান্ট ঝুলছিলো।

আমি বিশাল বাগানের চারদিকে ঘুরছিলাম। তখন পদ্মপুকুরের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। বিশাল বড় পুকুর ভর্তি কত রঙের পদ্ম ফুটে আছে!

দূর থেকে উত্তম আমায় ডাকছিল পিচার প্ল্যান্ট দেখার জন্য।

কিছুক্ষণ আগেই আমি এই পিচার প্ল্যান্টের ছবি তুলেছিলাম। আবার কেন ডাকছে উত্তম!

কাছে আসতেই উত্তম আলেকজান্দ্রিয়াকে দেখিয়ে বলল, দেখো এই বাচ্চাটা গাছ সম্পর্কে কতকিছু জানে।

আমি দেখলাম, কাছাকাছি বয়সী দুটো বাচ্চা ছেলেমেয়ে পিচার প্ল্যান্ট দেখছে। মেয়েটি বড়, সে-ই চোখ মুখ ঘুরিয়ে টক টক করে কথা বলছে, আর বাচ্চা ছেলেটি মনোযোগ দিয়ে কথা শুনছে।

ওদের পাশে দাঁড়িয়ে উত্তমও ওদের কথা শুনছিল।

মেয়েটির নাম আলেকজান্দ্রিয়া, ওর ভাইয়ের নামটা মনে পড়ছে না। আলেকজান্দ্রিয়া খুব গুছিয়ে কথা বলে এবং খুব সম্ভবত কথা বলতে ভালোও বাসে।
আমি যখন আলেকজান্দ্রিয়ার সাথে গল্প করছি, হঠাৎ একজন আমেরিকান নারী আমাকেই জিজ্ঞেস করলো, ” আর ইউ ফ্রম বাংলাদেশ?”

আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, সে কী করে বুঝল আমি বাংলাদেশের মেয়ে!

আমেরিকান মেয়ে বলল, আই এম অলসো ফ্রম বাংলাদেশ।

এবার জানতে চাইলাম, সে বাংলা বলে কিনা।

আমেরিকান মেয়েটি স্পষ্ট বাংলায় বললো, সে বাঙালি। বাংলা তার মাতৃভাষা, তাই বাংলায় কথা বলতে পারে।
তার কথা শুনে নিশ্চিন্তের হাসি হেসে ফেললাম।

মেয়েটির নাম নেলি, ৮৬ সালে আমেরিকায় এসেছে। বিয়ে যাকে করেছে, সে আমেরিকান। আলেকজান্দ্রিয়া আর ওর ভাইয়ের দিকে দেখিয়ে বললো, আমার দুই ছেলেমেয়ে।

ওরা বাংলা বোঝে?

নেলি বললো, আমার বাংলা বোঝে, তবে কেউ বাংলা বলতে পারে না। আমার সাহেব বরও বাংলা বোঝে। আমার সাহেব স্বামীই কিন্তু একটু আগে আমায় ডেকে বলেছে, “দেখো, ঐ ভদ্রলোক ভদ্রমহিলা মনে হয় বাংলাদেশের, ওদেরকে বাংলায় কথা বলতে শুনেছি মনে হয়।”

বরের মুখে এই কথা শুনেই নেলি আমার কাছে এগিয়ে এসে জানতে চেয়েছিল আমি বাংলাদেশের কিনা।

নেলির বর তখন উত্তমের সাথে গল্প শুরু করেছে, আর আমি গল্প করছি নেলির সাথে।
নেলিকে দেখে কিছুতেই মনে হয় না সে বাঙালি।
ভীষণ নরম স্বভাবের আমেরিকান মেয়ে যেমন হয় দেখতে, নেলি ঠিক তেমন।

সবচেয়ে অবাক হয়েছি আলেকজান্দ্রিয়ার কথা শুনে।
ও আমাকে ইংরেজিতেই জিজ্ঞেস করলো, ” তুমি কি সালোয়ার কামিজ পরেছ? জানো, আমি একটা বাংলা কথা বলতে পারি, “আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
আচ্ছা তুমি কি প্রতিদিন রাইস রান্না করো? আমার মা প্রতিদিন রাইস রান্না করে।”

নেলির ৬ বছরের ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম সে কোনো বাংলা জানে কিনা। ৬ বছরের শিশুবালক হেসে বলল, “শুনতে পাও’?

বললাম, — “শুনতে পাও” কেনো বলো, কাকে বলো?

ছয় বছরের শিশু বললো, মা বলে শুনতে পাও?

নেলি বুঝিয়ে দিল, “আমি যখন বাংলাদেশে কথা বলি, নেটে গোলমাল থাকলে বলি তো, আমার কথা কি শুনতে পাও? সেখান থেকে ও “শুনতে পাও” কথাটা পিক করেছে।

আরও অনেকক্ষণ গল্প করার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু আমাদের সফরসংগি কমলেশ আর করবী আমাদের জন্য বাইরে অপেক্ষা করছিল।

নেলির সাহেব বর ইংলিশে বলল, “আমরা খুব সহজে কোন বাংলাদেশির দেখা পাই না। আজ তোমাদের দেখে খুব ভাল লাগল।’

নেলি আর ওর চমৎকার পরিবারকে হাত দেখালাম, ভালোবাসা প্রকাশ করে গার্ডেন থেকে বেরিয়ে এলাম।

পৃথিবীর কত জায়গায় কত বিস্ময় যে অপেক্ষা করে!!

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
পিচার প্ল্যান্ট এবং আলেকজান্দ্রিয়া, 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

২ টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ২ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ০১-০২-২০২৩ | ১৮:৩২ |

    অনেকদিন পর আপনার লিখা পড়লাম।

    আপনার লিখার যে বিশেষত্ব আমার বরাবরই ভালো লাগে, সেটি হচ্ছে লিখায় যাপিত জীবনের হাসি কান্না দুঃখ বেদনা যাতনা সবই অসাধারণ উঠে আসে। শুভেচ্ছা। Smile

    GD Star Rating
    loading...
  2. ফয়জুল মহী : ০২-০২-২০২৩ | ২:০০ |

    চমৎকার লিখেছেন

    GD Star Rating
    loading...