এত লম্বা লেখা আমিও লিখতে পারি ভুলে গেছি প্রায়!

3115

প্রকৃতির পরিবর্তন কত দ্রুত ঘটতে পারে পূর্ব ইউরোপের ঐ অংশে বাস না করলে হয়ত বুঝতে পারতাম না। শীতের রাজত্ব ঐ অঞ্চলে প্রশ্নাতীত। সেই যে সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে তুষারপাত শুরু হয় তার শেষ কবে কেউ জানেনা। ডিসেম্বরের শুরুতে বরফ এসে জায়গা করে নেয় তুষারপাতের। জমজমাট শক্ত বরফ এতটাই শক্ত হয় নদীর পানি জমে যায়। সে নদীতে সাদা সাদা পাল তোলা নৌকার বদলে চলে যন্ত্রচালিত ট্রাক। মৎস শিকারীর দল নদীর উপর তাবু গেড়ে রাতের পর রাত কাটিয়ে দেয় শিকারের আশায়। আর আমার মত যারা পৃথিবীর অপর প্রান্ত হতে এ অঞ্চলে পাড়ি জমায় তারা ক্যালেন্ডারের পাতা উলটে প্রহর গোনে বসন্তের। অনেক সময় বসন্তও কথা রাখেনা। মুষলধারার তুষারপাতের নীচে চাপা পরে যায় অপেক্ষার পালা।

মে মাসের নয় তারিখেও তুষারপাতের মোকাবেলা করতে হয়েছিল এক বসন্তে। শীতে তাপমাত্রা মাঝে মধ্যে হীমাংকের নীচে ৪০ ডিগ্রী পর্যন্ত নেমে যায়। স্থবির হয়ে যায় জনজীবন। বরফ ডিঙ্গিয়ে স্কুলে যাওয়া সম্ভব হয়না বাচ্চাদের। অঘোষিত ছুটিতে যেতে হয় তাদের। সাইবেরিয়ার দিকে অবস্থা আরও কঠিন, আরও কষ্টের। সোভিয়েত লৌহ শাসনের গোড়ার দিকে যারা বিরুদ্ধচারন তাদের অনেককেই নির্বাসনে পাঠাতো সাইবেরিয়ার কঠিন প্রকৃতির সাথে লড়াই করতে। ঐ দিকটায় শীতের দিকে যাওয়া আমার মত এশিয়ান কারও পক্ষে যাওয়া মানে আত্মহত্যার দিকে পা বাড়ানো।

কোন এক গ্রীস্মে ঘটনাচক্রে সৌভাগ্য হয়েছিল রুশ দেশের তুন্দ্রা অঞ্চলে ঘুরে আসার। মনুষ্য জীবন ওখানে কঠিন। বেঁচে থাকতে প্রতিদিন প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম করতে হয়। এসব নিয়ে ঐ অঞ্চলের মানুষের খুব যে একটা অভিযোগ আছে তা নয়। বরং খাপ খাইয়ে নিয়েছে প্রকৃতির এসব রুদ্রমূর্তির সাথে।

বসন্ত হঠাৎ করেই চলে আসে। ছাদ হতে বরফের বিশাল সব চাই মাটিতে আছড়ে পরে। ডর্মের রুমটায় বসে সে আওয়াজ শুনলে মন হাল্কা হয়ে যায়। আমরা বুঝতে পারি বসন্ত আসছে। বরফ গলতে শুরু করে। রাস্তা-ঘাট পানি আর কাঁদায় ভরে যায়। তারপর একদিন সূর্য পূব দিগন্তে মুখ তুলে জানায় আগমনী বার্তা। কদিন একনাগাড়ে উত্তাপ ছড়ালে রাস্তা-ঘাট পরিস্কার হয়ে যায়। গাছে গাছে সবুজের সমারোহ কখন যে জায়গা করে নেয় টেরই পাওয়া যায়না।

পোল্যান্ড সীমান্ত ঢুকে গেছি অনেকক্ষণ হয়েগেছে। বেলাওয়াস্তকে ট্রেনের চাকা বদলানোর সময় ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস হাজির হয়। ওদের চেক করার বিশেষ কিছু থাকেনা। কারণ দেশটায় আমার মত যাত্রীরা থাকতে আসেনা। ট্রানজিট ভিসা নিয়ে পাড়ি জমায় পশ্চিমের দিকে। যদিও ষ্ট্যুরিষ্টদের আকর্ষণ করতে সরকারী চেষ্টার অন্ত থাকেনা।

অদ্ভূত এক দেশ এই পোল্যান্ড। সোভিয়েত বলয়ের অন্যতম প্রধান দেশ। ওয়ারশ সামরিক প্যাক্টকে ঘিরে পল্লবিত হয়েছে সোভিয়েত সামরিক শক্তি। অথচ দেশটার সীমান্তে পা রাখলেই চোখে পরে এর দৈণ্যতা। চারদিকের বাড়ি-ঘরে ক্ষয়ের চিহ্ন। চোখে পরার মত কোন জৌলুষ নেই। একজন ইমিগ্রেশন অফিসার এসে যখন জিজ্ঞেস করে এক্সচেঞ্জের জন্য ডলার-পাউন্ড আছে কিনা, এক লহমায় ধরে নেয়া যায় দেশটার অর্থনৈতিক ভীত

ঘটনা আরও কয়েক বছর আগে। সে বছর গ্রীস্মকালীন ছুটি কাটিয়ে লন্ডন হতে সেন্ট পিটার্সবার্গে ফিরে যাচ্ছি। ওয়ারশতে আমার ট্রানজিট। ট্রেন বদলাতে হবে। ইউরোপের আর দশটা দেশ মনে করে কাউন্টারে হাজির হয়ে আমার ফিরতি জার্নির টিকেট দেখাই। রাতে ঘুমানোর মত একটা সীট দরকার আমার। কাউন্টারে মধ্যবয়সী এক মহিলা ম্যাগাজিন উলটে সাজগোজের কিছু একটা দেখছিল। আমাকে দেখে মুখ কুচকে ফেললো। রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করলো কি চাই। পূর্ব ইউরোপের মানুষদের গায়ের রঙ নিয়ে এলার্জিতে ততদিনে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। তাই অবাক না হয়ে বিনয়ের সাথে একটা রাতের ট্রেনের একটা সীট চাইলাম। মহিলা কোনদিক না তাকিয়ে নিমিষের মধ্যা আমাকে জানিয়ে দিল আগামী ৭ দিনের জন্যে কোন সীট নেই। মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পরলো। আগামী ২৪ ঘণ্টায় আমাকে সোভিয়েত সীমান্তে পা রাখতেই হবে। নইলে কোনদিনই ঢুকতে পারবোনা দেশটায়। কঠিন আইনের দেশ এই সোভিয়ত ইউনিয়ন।

মন খারাপ করে প্লাটফর্মের বেঞ্চে বসে আছি। সম্ভাব্য সব সিনারিও বিশ্লেষন করছি। পাশে কেউ একজন বসেছে টের পেলাম। কালো আফ্রিকান একজন। হাতের পোটলা পুটলি দেখে বুঝতে পারলাম সে-ও আমার মত সোভিয়ত ইউনিয়নে যাচ্ছে। পার্থক্য হচ্ছে, ওর মুখে হাসি এবং প্রাণ খুলে মনের আনন্দে গান গাইছে।

আমার সমস্যা তুলে ধরতে সে হো হো করে হেসে উঠলো। মিনিটের ভেতর সমাধান দিল। কারণ সেও একই সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিল।

বুক পকেটে একটা পাঁচ পাউন্ডের নোট রেখে আবারও গেলাম কাউন্টারে। একই মহিলা। আমার মুখ দেখার আগে দেখলো আমার বুক পকেট। লম্বা একটা হাসি দিয়ে আবারও জানতে চাইলো আমার প্রয়োজন। উদ্দেশ্য পরিস্কার করার পর জানতে চাইলো মূল্য পরিশোধ করবো কোন কারেন্সিতে। সদ্য পরিচিত আফ্রিকান বন্ধুর উপদেশ মত আঙ্গুল তুলে বুক পকেটের দিকে ইশারা দিলাম।

মন্ত্রের মত কাজ দিলো। তোতা পাখির মত উত্তর দিল, রাতের জন্যে অপেক্ষা করতে না চাইলে আধাঘণ্টার ভেতর একটা ট্রেন আসবে। গাদানক্স ঘুরে গ্রদনোর দিকে যাবে। রাতের সীটেই ফয়সালা করলাম। মূল্য ৫ পাউন্ড। সমাজতন্ত্র পৃথিবীর এ অঞ্চলের মানুষকে কতটা কলুষিত করেছিল তার চমৎকার একটা ডিসপ্লে এই ট্রেন জার্নি।

ঘণ্টা দেড়েক পর রাজধানী ওয়ারশ এসে থেমে গেলো আমার ট্রেন। এখানে লম্বা একটা বিরতি। রিফ্রেশমেন্টের জন্য সবাই ট্রেন হতে নেমে পরে। এই নেমে পরায়ও অনেক রকম বিপদ থাকে। এই যেমন পোলিশ মহিলাদের খপ্পর। ভুলিয়ে বালিয়ে নিজেদের আস্তানায় নিয়ে সব কিছু রেখে উলংগ করে ছেড়ে দেয়ার কাহিনীও শুনেছি অনেকের মুখে। এ পথে এতবার জার্নি করেছি সবকিছু আমার মুখস্ত। কারও চেহারা দেখে বলে দিতে পারি তার উদ্দেশ্য। ষ্টেশনে নেমে কিছু কেনাকাটি করলাম। এখানে সোভিয়েত মুদ্রা রুবেলেও কেনাকাটি করা যায়। পকেটে বেশকিছু রুবেল ছিল, যতটা সম্ভব খরচ করে অতিরিক্ত কিছু খাবার ও পানি কিনে ফিরে গেলাম ট্রেনে।

এবার লম্বা একটা ঘুমের পালা। খুব ভোরে ট্রেন সীমান্ত শহর ফ্রাঙ্কফোর্ট-আন-ডের-ওডের দিয়ে পূর্ব জার্মানীতে ঢুকবে। অবশ্য মাঝখানে পোলিশ শহর পজনানে কিছুক্ষণের জন্যে ট্রেন থামবে যা আমি টের পাবোনা। আমাকে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ঢুকতে হবে সমাজতন্ত্রের ফাইনাল ফ্রন্টিয়ার পূর্ব জার্মানীতে। শেষ রাতের দিকে জার্মান সীমান্তরক্ষীদের কর্কশ ডাকে ঘুম ভাঙ্গবে।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এত লম্বা লেখা আমিও লিখতে পারি ভুলে গেছি প্রায়!, 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ১ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ০৪-১১-২০২২ | ১১:০৮ |

    অসাধারণ একটি স্মৃতি কথা ছিলো … বিকেলে ভোরের গল্প।

    আজ তারই আভাষ যেন পড়লাম মি. ওয়াচডগ। Smile

    GD Star Rating
    loading...