অনেক কিছু চাইলেও আর মনে করতে পারিনা। অথবা মনে করতে ইচ্ছে করেনা। সময়ের সাথে বোঝাপড়া হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। আমরা আর আগের মত বন্ধু নই, বরং রেললাইনের মত পাশাপাশি বয়ে যাওয়া অন্তহীন যাত্রার সহযাত্রী মাত্র।
কিছু ঘটনা আছে যার দাগ মুছার নয়। চাইলেও পাতা উলটে অধ্যায়ের ইতি টানা যায়না। নীপা নদীর গল্প তেমনি এক অধ্যায় যা কোনদিনও পুরানো হবেনা। পাতা উলটে অধ্যায়ের ইতি টানা যাবেনা।
আসলে নীপা নামের কোন নদী নেই। মানচিত্র ঘাঁটলে এ নামের কোন নদীর সন্ধান পাওয়া যাবেনা। এ ছিল কৈশোরের একখণ্ড চপলতা, চাঞ্চল্যে ভরা কিছু আবেগের অভয়ারণ্য।
জাপারোঝিয়া। ইউক্রেইনের দক্ষিণ-পূব দিকের অখ্যাত এক শিল্প শহর। কারখানার চিমনি হতে বেরিয়ে আসা ধোঁয়ার চাদরে মুখ ঢেকে রাখে এ শহর। এবং তা বছরের প্রায় ৩৬৫ দিন। শহরের বাতাসও ভারী। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। প্রকট এক উটকো গন্ধ শরীরের সবকটা অঙ্গে লেপটে থাকে। তেমনি এক শহরে লেখা হয়েছিল আমার লম্বা প্রবাস জীবনের প্রথম অধ্যায়।
আঠার বছরের টগবগে তরুণ আমি। অনেকটা মায়ের কোল হতে বেরিয়ে এসে পা রেখেছি বিস্ময়কর এক জীবনে। সকালে ঘুম ভাঙ্গলে কেউ আর টেবিলে নাস্তা সাজিয়ে অপেক্ষায় থাকেনা। বেলা গড়ানোর আগে দৌড়াতে হয় ক্লাসে। লড়াই করতে হয় হিমাংকের নীচে ২০ ডিগ্রী তাপমাত্রার সাথে। ক্লাস হতে ফিরে আয়োজন করতে হয় রাতের খাবারের। পরদিন ক্লাসের হোম-ওয়ার্ক করতে গিয়ে অনেক সময় মধ্যরাত পেরিয়ে যায়। জাগতিক অনেক চাহিদাকে বিদায় জানাতে হয় পারিপার্শ্বিক বাস্তবতার কারণে।
এর পরেও শনিবার আসে। রাজ্যের স্বস্তি নিয়ে ঘরে ফিরে ভুলে যাই ফেলে আসা ছয় দিনের ক্লান্তি। ডর্ম হতে বেরুলেই একটা বড় স্টেডিয়াম। দিনের বেলা খেলাধুলার বিদ্যাপীঠ হলেও রাতে তা পরিণত হয় মানব মানবীর মিলন মেলায়। আরও একটু হাঁটলে দেখা মিলবে ওপেন এয়ার ডিস্কোটেক। বাদামি চামড়ার এমন আদমদের সাথে এই প্রথম সাক্ষাৎ এ অঞ্চলের মানুষদের। আগ্রহের সীমা নেই। বিশেষকরে তরুণীদের।
ভাষা স্কুলের ছাত্র আমরা। সংখ্যায় ১৭ জন। এক বছর স্থায়ী এ কোর্সের শুরুতে প্রায় সবাই জড়িয়ে যায় সম্পর্কে। একজনের সাথে এক শিক্ষিকার সম্পর্ক বলে দেয় পরিবেশের। জীবন কঠিন ও রুক্ষ হলেও তাতে রঙের কমতি ছিলনা।
প্রথম স্কলারশিপের রুবেল হাতে আসতে নড়েচড়ে বসি সবাই। এতদিনের জমানো সমীকরণ মেলানোর তাগাটা হঠাৎ করে জীবন্ত হয়ে উঠে। এ সমীকরণ একেক জন্যে ছিল একেক রকম। বান্ধবীদের নিয়ে বেরিয়ে পরার মেনুটা ছিল সবার উপরে। আমি ও আমার রুমমেট সজল দুজনেই ছিলাম ঘরকুনো। স্থায়ী বান্ধবী আমাদের বড়শিতে তখনও ধরা পড়েনি। রুবেল হাতে কি করা যায় এ নিয়ে দুজনেই গবেষণায় বসে যাই।
মদের দোকানটা আমাদের ডর্ম হতে খুব একটা দূরে ছিলনা। ট্রামে চড়লে একটা স্টপেজ। ভাড়া ৫ কোপেক। অবশ্য ৫ কোপেকে যতক্ষণ না ট্রাম হতে বেরিয়ে আসছি শহরের শেষ মাথা পর্যন্ত জার্নি করা যায়। আমাদের দুই বন্ধুর সিদ্ধান্ত ছিল ফেলে আসা ১৮ বছরের জীবনকে চ্যালেঞ্জ করা। এক বোতল ভদকা কেনার সিদ্ধান্তটা ছিল সে চ্যালেঞ্জেরই অংশ।
দোকানে ঢুকতেই ধাক্কা। ভাষা জ্ঞান কম হওয়ার কারণে ইতিপূর্বে রেকি করে যাওয়া দোকানের ভাষা বুঝতে পারিনি। শনিবার সন্ধ্যা ৬টার পর ভদকা বিক্রি বন্ধ। এমনটাই শহর কম্যুনিস্ট পার্টির সিদ্ধান্ত। শহরের জনসংখ্যার একটা বিরাট অংশ শ্রমিক হওয়ার কারণে এখানে এলকোহল সমস্যা আকাশচুম্বী। তাই এ সিদ্ধান্ত।
এক বোতল সস্তা লাল ওয়াইন নিয়ে ডর্মে ফিরে আসি। এখানেও সমস্যা। ডর্মে মদ্যপান বৈধ না। ধরা পরলে দেশে পাঠিয়ে দেয়ার মত কঠিন শাস্তিরও বিধান আছে। কিন্তু তাই বলে স্থানীয় ছাত্র-ছাত্রীরা মদ্যপান হতে বিরত থাকবে এমন দেশ এটা নয়। মদ্যপান এখানে অনেকটা বাধ্যতামূলক। শিশুর জন্ম যেমন উৎযাপন করা করা হয় মদ্যপান দিয়ে একই শিশু বেড়ে উঠে কবরের দিকে রওয়ানা দিলে সেটাও সেলিব্রেট করা হয় মদ দিয়ে।
রাতের খাবারে অতিরিক্ত কিছু যোগ করে তৈরি হই নতুন অধ্যায়ের। দরজা বন্ধ করার আগে বাকি সবাইকে অনুরোধ করি কিছুটা সময়ের জন্যে বিরক্ত না করতে।
সজলের চোখে মুখে দুশ্চিন্তার রেখা ধরতে আমার সময় লাগেনি। বোর্ডের পরীক্ষায় প্রথম হওয়া সজলের চেহারায় ছিল শিশু সুলভ একটা ভাব। বুঝা যায় জীবনের অনেক অধ্যায়ের সাথে দেখা হয়নি।
কারণ জানতে চাইলে সে ভেঙ্গে পরল। তার গলায় ঝুলে থাকা দুটো তাবিজের দিকে ইঙ্গিত দিল। চোখ আর নাকের পানিতে ভেসে কোলের সন্তানকে বিদায় দেয়ার আগে মা অনেক কষ্ট করে যোগার করেছিল তাবিজ দুটো। সজলের ভয় তার গলায় তাবিজ নয়, খোদ মা ঝুলে আছেন এবং চোখ কান খোলা রেখে দেখছেন তার কর্ম।
তাবিজ শরীরে থাকা পর্যন্ত সে মদের গ্লাসে হাত দিতে পারবেনা, এমনটাই তার সিদ্ধান্ত। আমিও বাধা দিতে পারলাম না। কারণ মার স্মৃতি আমারও তখন অনেক কাছের। উঠিয়ে রাখলাম মদের বোতল সে যাত্রায়।
পরদিন প্রস্তাবটা দিতেই সজল রাজী হয়ে গেল।
ট্রাম ধরে আমাদের অনেক দূর যেতে হবে। ঘণ্টা খানেকের পথ। অন্য কোন বিকল্প নেই। ওখানে গেলেই দেখা মিলবে নীপা নদীর। আমার প্রস্তাব ছিল নদীতে ভাসিয়ে দিতে হবে তাবিজ দুটো। মদ্যপানে পাপ বলে কিছু থাকলে তারা তার সাক্ষী হবেনা। বরং নদীর পানিতে ডুবে আরও পুত পবিত্র হয়ে যাবে।
সজলের পছন্দ হয়েছিল আমার বিশ্লেষণ। এবং পরের রোববার খুব ভোরে কাউকে কিছু না বলে দুজনে বেরিয়ে পরি নীপা নদীর সন্ধানে।
নীপা নদীটার আসল নাম না। এর নাম দিনেপ্রর। বিশাল এক নদী। লম্বায় ইউরোপের ৪র্থ বৃহত্তম। ভালদাই পাহাড়ে জন্ম নিয়ে রাশিয়া, ইউক্রেইন ও বেলারুশ হয়ে মিশে গেছে কৃষ্ণ সাগরে। ভলগা, দানিয়ুব ও উরাল নদীর পরেই লম্বার বিবেচনায় দিনপ্রর স্থান। স্থানীয়রা আদর করে এর নাম দিয়েছিল নীপা।
বিশাল একটা হাইড্রোলিক পাওয়ার স্টেশনের বাঁধে এসে থামে আমাদের জার্নি। নদীকে আটকে বিদ্যুৎ তৈরির এমন কারখানার সাথে এটাই আমাদের প্রথম পরিচয়। লেনিনের নামে তৈরি এ বাঁধও সোভিয়েত দেশের গর্ব। বাঁধটার ঠিক মাঝেমাঝে এসে দুজনে থেমে যাই। গলায় ঝোলানো স্বর্ণের চেইন হতে তাবিজ দুটোকে খুলে ছুড়ে ফেলি নদীতে। আমি নিজেও অংশ নেই এ অভিযানে। সজলকে নিশ্চিত করতে চেয়েছিলাম পাপ বলতে কিছু থাকলে তা বন্ধুর সাথে ভাগাভাগি করতে আমার আপত্তি নেই।
এবং এখানেই শেষ ও শুরু দুই জীবনের। বলা চলে সীমান্ত অতিক্রম করা। সীমান্তের ওপারে ছিল মা-বাবা ভাই-বোনদের আদর স্নেহ ও ভালবাসা, আর এপারে ছিল নতুন এক জীবনের হাতছানি।
নীপা নদীর কাছে আশ্রয় চাওয়ার এ ছিল কেবল শুরু। এ নদীতে অনেক পানি বইবে। তার সাথে আমি ও আমরাও পাড়ি দেব অনেক অজানা অচেনা ঘাঁট। নদী পাড়ের এক বছরের জীবন নিয়ে লিখতে গেলে হাজার রজনীর আরব্য উপন্যাস লেখা যাবে। যেখানে থাকবে জীবন যুদ্ধে বেড়ে উঠার সব উপাদান।
নীপা নদীকে এ লেখাটা লেখার তাগাদাটা এসেছে আজকে একটা খবর পড়ে। জাপরোঝিয়ার একটা বিরাট অংশ দখলে নিয়ে পুতিন বাহিনী ওখানে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে। কেবল হাইড্রোলিক পাওয়ার ষ্টেশনই না, ইউরোপের বৃহত্তম পারমাণবিক পাওয়ার ষ্টেশনের দখল নিয়ে ব্লাকমেইল করছে স্থানীয়দের জীবন। শহরের পাবলোকিসকাস এলাকার যে মদের দোকানটায় শুরু হয়েছিল জীবনের নতুন এক অধ্যায় তার খুব কাছে দুটো মিসাইল আঘাত হেনেছে। লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে ওখানকার সবকিছু।
শান্ত যে নদীতে এক সময় তাবিজ ডুবিয়ে পুত পবিত্র হওয়ার চেষ্টা করেছি সে নদী এখন অশান্ত। কৈশোর যৌবনের অনেক অলিগলি এখন ক্ষতবিক্ষত। কষ্টটা এখানেই।
loading...
loading...
যাপিত জীবনের উপাখ্যান পড়তে আমার অসাধারণ লাগে। ভালো থাকবেন স্যার।
loading...