পর্ব – ৭
মামাবাড়ি থেকে ফেরার পর মনটা খুব খারাপ হয়ে যায় মিলুর। সারাক্ষণ চুপচাপ থাকে। দুইদিন বাগানে উঠোনে তেমন একটা ঘোরাঘুরিও করেনি। আজ বিকেলে মায়ের বইয়ের তাক থেকে একটা কবিতার বই হাতে নিয়ে ঠাকুরমার ঘরের দিকে যায়।
ঠাকুরমার এই ঘরটি একটু বেশি নির্জন। শোয়ার সময় ছাড়া ঘরটিতে সারাদিন তেমন কেউ আসে না। কাঠের বেড়া আর গোলপাতার ছাউনি দেওয়া আটচালা ঘরের চারপাশে খোলা বারান্দা। মুল ঘরে দু’টো কক্ষ। একটাতে থাকেন ঠাকুরমা ও মিলুর ছোট পিসিমা স্নেহলতা দাশ। শিক্ষিকা ছোট পিসিমা বিয়ে থা করেন নি। আর অন্যটিতে থাকেন ঠাকুরমার চিরকুমার ভাই মানে মিলুর মামাদাদু।
ঘরটির পেছনের দিকের খোলা বারান্দায় গিয়ে বসে মিলু।
বইটি খোলে। পড়ার চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুতেই যেন মন বসাতে পারছে না বইয়ে। শুধুই মনে পড়ছে মামাবাড়ির ঘোরাঘুরির কথা। দুপুরে সাঁতার শেখার কথা। কলার ভেলায় চড়ে ভেসে বেড়ানোর কথা। জলসিঁড়ি ধানসিড়ি…
বইয়ের পাতার দিকে চোখ আর মন তার ঘুরে বেড়াচ্ছে স্মৃতির পথে পথে।
এদিকে অনেকক্ষণ মিলুকে দেখতে না পেয়ে মা খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিয়েছেন। এ ঘর সে ঘর বাগান কোথাও না পেয়ে শ্বাশুড়ি মায়ের কাছে গিয়ে বলেন- মা, মিলু কি কারো সাথে কোথাও গেছে ? অনেকক্ষণ ধরে ওকে দেখতে পাচ্ছি না।
শ্বাশুড়ি মা মৃদু হেসে বৌমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন তার ঘরের পেছনের দিকে। তিনি অনেক আগেই মিলুকে গুটিগুটি পায়ে পেছনের বারান্দার দিকে যেতে দেখেছেন।
বলেন- দেখো, ঐ যে বই পড়ছে তোমার ছেলে। এবার মনটা শান্ত হয়েছে তো?
– ও এখানে বসে আছে আর আমি সারাবাড়ি খুঁজে খুঁজে হয়রান।
– আমি আগেই দেখেছি। ও একটু একা একা নির্জনে থাকতে চায় বুঝতে পেরে আমি আর বিরক্ত করতে কাছে যাই নি।
ঠাকুরমা বলেন।
মা আস্তে আস্তে ছেলের কাছে যান। ডাকেন – মিলু, সন্ধ্যে হয়ে এল যে। এখন ঘরে চল। পড়তে বসতে হবে।
মিলু শান্ত চোখে মায়ের দিকে তাকায়। কোনো কথা বলে না। বইটি গুটিয়ে নেয়। তারপর সুবোধ বালকের মত ঘরের দিকে পা বাড়ায়।
ঘরে গিয়ে যথাস্থানে বইটি রাখে।
মা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন- মন খারাপ লাগছে বাবা ? মামার কথা মনে পডছে ?
মিলু মায়ের প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে ভাইয়ের পাশে গিয়ে বসে।
মা ছেলের মনের এই ভাব জানেন। সে যখন কোনো একটা ভাবনার ঘোরে থাকে তখন এরকমই চুপচাপ হয়ে যায়। তিনিও আর বিরক্ত না করে দুইভায়ের জল খাবার আনতে রান্না ঘরের দিকে চলে যান।
মিলুর বাবা ঘরে ঢুকে দু’ভাইকে শান্তশিষ্ট ভাবে বসে থাকতে দেখে বললেন – কী রে, তোমরা চুপচাপ কেন? মা কোথায়?
পোশাক পাল্টাতে পাল্টাতে আবার বললেন – মিলু, তোমার জন্য ফাইভের একটা ইংরিজি বই এনেছি। দেখেছ?
এতক্ষণ বাবার কোনো কথারই সে উত্তর দেয়নি। কিন্তু নতুন বইয়ের কথা শুনে কী যাদুবলে যেন তার মৌনব্রত ভেঙে যায়। চোখে মুখে ফুটে ওঠে খুশির রেখা। কৌতুহল আর উৎসাহের সাথে বলে – ইংরিজি বই ? কই – দেখিনি তো?
এমন সময় মাও ঘরে ঢোকেন দুইহাতে দু’টো খাবারের বাটি ধরে। মিলুর খুশিভরা মুখটা দেখে বুঝতে পারেন নিশ্চয়ই ওকে ওর বাবা এমন কিছু বলেছেন যা ওর পছন্দের। আর তাতেই একনিমেষে ছেলের মন থেকে পালিয়ে গেছে মনখারাপের দুষ্টু ভূতটা।
মাকে দেখতে পেয়েই মিলু বলে – মা, বাবা আমার জন্য নতুন বই এনেছেন – তুমি জানো ? কোথায় রেখেছ?
মা এতক্ষণে বুঝতে পারেন ছেলের হঠাৎ মন ভাল হয়ে যাবার কারণ। তিনি জানেন মিলুর দু’টো জিনিস সবচেয়ে পছন্দের – বই আর প্রকৃতির মধ্যে ঘুরে বেড়ানো।
মৃদু হেসে বলেন- হ্যাঁ, আছে আমার কাছে।
-তা আমাকে তো বলো নি?
আসলে তিনি বিষয়টি বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন। বললেন – আমার মনে ছিল না বাবা। এইতো এখুনি সেই বইটাই পড়াবো। কিন্তু তার আগে এগুলো খেয়ে নাও দু’ভায়ে।
বলে দু’টো বাটি বাড়িয়ে দিলেন দুই ছেলের দিকে।
মিলু বাটিটা হাতে নিয়ে মুড়ির ভেতরে কয়েকটা নারকেল নাড়ু দেখে খুবই খুশি হল। এই খাবারটি মিলুর ভারি পছন্দের। মা জানেন মিলু একটু মিষ্টি খাবার খেতে বেশি ভালবাসে। তাই ঘরে পিঠে নাড়ু এমন করে রাখেন।
খেতে খেতে মিলু বলে – মা, আর নাড়ু আছে ?
– আছে। কাল আবার খেয়ো।
মিলু আর কথা না বলে খেতে থাকে।
হঠাৎ মেঝ বৌঠান, মেঝ বৌঠান – বলে ডাকতে ডাকতে মনমোহনবাবু ঘরে ঢোকেন।
সত্যানন্দ বলেন- কলকাতা থেকে কখন ফিরলে ?
– এই এখুনি। বৌঠানকে একটা সুখবর জানানোর জন্য সোজা চলে এলাম।
আনন্দ-উত্তেজনায় যেন ফেটে পড়লেন মনমোহন বাবু।
কুসুমকুমারী বলেন- আমার জন্য সুখবর ?
সত্যানন্দ কিছুটা কৌতুহলের সাথে বললেন – কী এমন সুখবর যে বাড়ি না গিয়ে সোজা এখানেই চলে এলে?
-কলকাতা গিয়ে মুকুল পত্রিকার অফিসে গিয়েছিলাম। রামানন্দবাবুকে তো চেনেন। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। উনি বললেন ওনার প্রকাশিত বর্ণশিক্ষা প্রথম ভাগ বইটির একটি নতুন সংস্করণ করতে চান।
কুসুমকুমারী বলেন- তো?
– তার জন্য আপনাকে কিছু যুক্তাক্ষর বর্জিত ছোট ছোট পদ্য লিখে দিতে হবে। ভাবুন তো, কি সম্মানের কথা। আপনার লেখা শিশুদের পাঠ্য বইয়ে থাকবে!
মায়ের লেখা শিশুদের পাঠ্যপুস্তকে থাকবে খবরটি শুনেই মিলুর মনটা গর্বে ভরে ওঠে। সোৎসাহে বলে –
আমার মায়ের কবিতা শিশুরা পড়বে ?
-পড়বেই তো! তোমার মা কি আর আর দশজনের মায়ের মত ? আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে বৌঠান ! – মনমোহনবাবু উচ্ছ্বসিত৷
আমি কি পারবো? – কুসুমকুমারীর কন্ঠে সংশয়।
– কেন পারবে না? খুব পারবে।
মিলুর মুখ থেকে সাথে সাথেই কথা কটা বেরিয়ে যায়। আসলে মায়ের প্রতিভা আর যোগ্যতায় মিলুর আস্থা আর বিশ্বাস প্রশ্নাতীত।
সত্যানন্দ একটু মজা করে বলেন- তোমার বড়পুত্র যখন বলছে তখন নিশ্চয়ই পারবে। লেগে যাও।
মায়ের প্রতি ছেলের এই অটুট বিশ্বাস দেখে সত্যানন্দ আর মনমোহন অবাক হয়ে যান। আর ছেলের কাছ থেকে এই দ্বিধাহীন স্বীকৃতি পেয়ে মায়ের দু’চোখও আনন্দাশ্রুতে টলমল করে ওঠে।
loading...
loading...
অনেক অনেক শুভেচ্ছা প্রিয় কবি মি. শংকর দেবনাথ। আপনার এই আয়োজনে আপনার যে শক্তিশালী মনন এবং প্রজ্ঞার পরিচয় পেতে চলেছি তা সত্যিই অসাধারণ।
loading...
অসংখ্য ধন্যবাদ দাদা ৷ উৎসাহিত করার জন্য ৷ ভালো থাকুন৷


loading...