ভোর ৩টা ৩০। প্ল্যান মাফিক এগিয়ে চলছে কুয়েত গামী ফ্লাইটের যাত্রা। যাত্রীরা একে একে প্রবেশ করছে। কেবিন ক্রুরা রোবট মার্কা হাসি দিয়ে তাদের স্বাগত জানাচ্ছে। উত্তরে কিছু একটা বলতে হয় এ অভ্যাসটা জাতিগত ভাবে আমাদের নেই, তাই ওদিকে মন না দিয়ে যাত্রীরা হাতের মালামাল নিয়ে পা রাখছে ভেতরে। তাছাড়া ওদিকে মনোযোগ দেয়ার মত মানসিক অবস্থায়ও নেই কেউ।
সবার মন খারাপ। বিমান বন্দরের বাইরে এখনো অপেক্ষা করছে পরিবারের অনেকে। শেষবারের মত কিছু একটা বলার চেষ্টায় হাতে ধরা মোবাইল ফোনের দিকে মনোযোগ সবার। আইলসে দাড়িয়ে উপরের কেবিনে হ্যান্ড-লাগেজ রাখার চেষ্টা করছে অনেকে। ধাক্কাধাক্কি কাড়াকাড়ির দিকে ভাল করে নজর দিলে মনে হবে সদরঘাট হতে রামপুরা গামী লোকাল বাসে উঠছে সবাই। চারদিকে এক ধরণের অসুস্থ প্রতিযোগিতা।
গোটা ফ্লাইটে এলোমেলো অবস্থা। এসব জায়গায় অলিখিত কিছু ভদ্রতা ও রীতিনীতি আছে। ওসবের তোয়াক্কা নেই কারও। কে কার আগে উঠবে এবং জায়গা দখল করে নিজের অবস্থান পোক্ত করবে তা নিয়ে ব্যস্ত। হঠাৎ করে গর্জনটা শোনা গেল। তাকাতেই দেখি আমার পেছনে দুটো সারির পর এক ভদ্রলোক তেড়েফুঁড়ে আসার চেষ্টা করছেন। টার্গেট একজন হোস্টেজ। ইংরেজি ‘f…’ শব্দ সাথে বাংলায় কিছু নান্দনিক গালাগালি হতে ধরে নিলাম মধ্য বয়সী যাত্রীর শেষ গন্তব্য কুয়েত সিটি নয়, বরং অধুনা বিশ্বের অন্যতম উন্নত শহর নিউ ইয়র্ক। অর্থাৎ লম্বা সময়ের জন্য আমার সহযাত্রী।
কিছুতেই থামানো যাচ্ছেনা ভদ্রলোককে। কেবিন ক্রুদের প্রায় সবাই এসে গেছে ইতিমধ্যে। যা যার মত চেষ্টা করছে এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার ইতি টানতে। যাত্রীদের সবার মনোযোগও এখন ওদিকে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছেনা। বরং ভদ্রলোকের গলার আওয়াজ রাজনৈতিক ভাষণের মত তীব্র হতে তীব্রতর হচ্ছে। এক মুখে হয়ে অন্য মুখে আসা তথ্যগুলো এক করলে যা দাঁড়াবে তার সারমর্ম হবে; আইলসে দাড়িয়ে উপরের কেবিনে হ্যান্ড লাগেজ রাখতে ভদ্রলোক অতিরিক্ত সময় নিচ্ছিলেন। তাতে সদ্য প্রবেশকরা যাত্রীরা আটকে যাচ্ছিল এবং লাইন লম্বা হয়ে ফ্লাইটের মূল ফটক পর্যন্ত চলে যাচ্ছিল। কাজ শেষ করে দ্রুত সিটে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ করছিল হোস্টেজ। অনুরোধের ভাষায় নাকি যথেষ্ট বিনয় ও শালীনতা ছিলনা, তাই এ গর্জন।
সীটে বসে সবাই যার যার মত রায় দিচ্ছে… আলোচনা সমালোচনা চলছে। ভেতরের আবহাওয়া আরও উত্তপ্ত হচ্ছে। ইতিমধ্যে পাইলটও বেরিয়ে এসে যোগ দিয়েছেন দরকষাকষিতে। কিছুতেই থামছেন না নিউ ইয়র্ক গামী বাংলাদেশি যাত্রী। উনার দাবি কি সেটাও পরিষ্কার হচ্ছেনা। আমার পাশের ভদ্রলোকও নিউ ইয়র্ক যাচ্ছেন। মুখ তেনারও বন্ধ হচ্ছেনা। অনেকটা রানিং কমেন্ট্রি দিচ্ছেন আমার জন্যে। রাগত স্বরে অভিযোগ করলেন কুয়েত এয়ারওয়েজের এসব কেবিন ক্রুদের স্বভাব চরিত্র নিয়ে।
শুরু হতে আমি চুপ। এ নিয়ে নিজের মতামত শেয়ার করার মত পরিবেশ পরিস্থিতি ছিলনা। কিন্তু ভদ্রলোক অনেকটা জোর করলেন আমার মতামতের জন্যে। কোন ভণিতা না করে সরাসরি উত্তর দিলাম; আর কিছুক্ষণের ভেতর ঐ যাত্রীকে ফ্লাইট হতে বের করে দেবে। এবং তাতে স্থানীয় পুলিশের দরকার হলে সেটাও করা হবে। ভদ্রলোক বেজায় চটলেন আমার উপর।
ইতিমধ্যে দেড়-ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। যা আশ করা গিয়েছিল শেষপর্যন্ত তাই ঘটল; পাইলট এসে জানিয়ে দিল ভাইয়োলেন্ট এ যাত্রীকে নিয়ে তিনি আকাশে উড়বেন না।
এতক্ষণে হুঁশ হল রাজনৈতিক শক্তিতে বলিয়ান এই যাত্রীর। এই ফ্লাইট যে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের শক্তিমত্তা প্রদর্শনীর জায়গা না তা বুঝতে প্রায় দুই ঘণ্টা লেগে গেল। ততক্ষণে দেরী হয়ে গেছে অনেক। ভদ্রলোক একা নন। সাথে আছেন স্ত্রী, দুই সন্তান এবং বয়স্ক একজন মহিলা। হবে হয়ত মা অথবা শাশুড়ি।
ঘটনার নাটকীয়তা মোড় নিলো অন্যদিকে। এই ফ্লাইটে স্বামীকে কিছুতেই যেতে দেয়া হবেনা বুঝতে পেরে স্ত্রী জ্ঞান হারিয়ে (ভান করলেন) ফ্লোরে শুয়ে পরলেন। চারদিকে হাহাকার পরে গেল। কেবিন ক্রুরা দৌড়ে এসে পরিচর্যা শুরু করে দিল। শুরু হয়ে গেল ঘটনার দ্বিতীয় অংক।
আমি মিটিমিটি হাসি আর পাশের সহযাত্রীকে নিশ্চিত করি, স্ত্রীর এসব নাটক কাজে আসবেনা। ইজ্জতে আঘাতপ্রাপ্ত যাত্রীকে নামতেই হবে। এবং তা যত দ্রুত ঘটবে ততই আমাদের জন্যে মঙ্গল। একে একে ৫ জন যাত্রী নেমে গেল। জোর করা হল একজনকে, কিন্তু বাকি চারজন নেমে গেল নিজেদের ইচ্ছায়। অনেকটা সনাতন ধর্মের সহমরণের মত।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সহযাত্রীর দিকে তাকালাম আমি। রাগে ফুঁসছেন ভদ্রলোক। মনে মনে খুশি হলাম, বাকি পথ নিশ্চয় চুপ থাকবেন এবং অনাকাঙ্ক্ষিত বাক্যালাপ হতে আমাকে মুক্তি দিবেন। ফ্লাইট যখন আকাশে ডানা মেললো ততক্ষণে সকাল হয়ে গেছে। হয়ত ঢাকার আকাশ বাতাসে আজানের ধ্বনি ভেসে বেড়াচ্ছে। মেগা শহরে মানুষ হয়ত জেগে উঠতে শুরু করেছে কেবল।
কুয়েত সিটি হতে নিউ ইয়র্ক গামী কানেক্টিং ফ্লাইট ধরতে পারবো কিনা ভয়টা ততক্ষণে মগজে চেপে বসেছে।
loading...
loading...
যেখানেই থাকি না কেন আমাদের আমিত্বকে আমরা অনেকেই সরিয়ে ফেলি না।
loading...