ধর্মাধর্ম

30 একটা বিশাল প্রাসাদ ছিল। কী ছিল না সেখানে! বড় বড় হলঘরের মত শোবার ঘরই যে কতগুলো, তার হিসাব রাখতে রীতিমতো মোটা মোটা জাবদা খাতা লাগত। ছিল চকমিলান বারান্দা, বিস্তৃত খোলা আকাশ মাথায় উঠান, জাঁকজমক ওয়ালা ঝকমকে জলসাঘর, অজানা প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রার্থনার ঘর। ছিল, অনেক কিছুই ছিল। ছিল না শুধু স্বার্থপর আমার আমি। কখন যে চুপিসারে লোভের ময়াল ঢুকে পড়ল সেই প্রাসাদের অন্দরমহলে কেউ বুঝতে পারেনি।

একে একে আমাদের প্রত্যেককে গিলে ফেলতে শুরু করল সেই সাপ, সেই খাওয়া এখনো চলছে। ময়ালের পেটের ভেতরে গিয়ে আমরা ভাগ করা শিখলাম। টুকরো করতে শুরু করলাম আমাদের খাবার জায়গা, শোবার জায়গা, খেলার জায়গা, গল্প করার আর শোনার জায়গা, আদর করার জায়গা। আমাদের সবার প্রার্থনার জায়গা ভেঙে ছত্রখান হয়ে ছোট ছোট খুপরি হয়ে গেল। সেই খুপরিতে কোনক্রমে হাঁটু মুড়ে বসে আমরা তৈরী করে নিলাম আলাদা আলাদা ঈশ্বর, আলাদা আলাদা ধর্ম, আলাদা আলাদা আচার – বিচার – কুসংস্কার – নিয়ম – কানুন – ঘৃণা। আমাদের প্রার্থনার জায়গা থেকে উবে গেল ভালোবাসা।

কে হিন্দু, কবে থেকে হিন্দু, কীভাবে হিন্দু না জেনেই আমরা হিন্দু হলাম। ঠিক সেভাবেই আমরা হয়ে গেলাম মুসলমান, খ্রীষ্টান, ইহুদি, পার্শি, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ আরও কত কী! আমরা নানারকম তকমা এঁটে আমরাই শ্রেষ্ঠ সেটা প্রমাণ করার জন্যে হাতে তুলে নিলাম ধারালো থেকে তীব্রগতির শাণিত নানান অস্ত্র। যার যার শরীরে আমার মতই একই রঙের রক্তস্রোত বইছে, তাদের মাথা কেটে ফেলার চেষ্টা করতে লাগলাম। আমরা চোঙা ফুঁকে চিৎকৃত হলাম, “আমরা আধুনিক”।

আমরা শ্রীমদ্ভগবতগীতা পড়িনি। দেখেছি আমাদের টুকরো ঘরের কেউ মারা গেলে চিল চিৎকার করে কাঁদতে হয়, টিকি নাড়া মানুষের নিদান মত সিদ্ধ ভাত, কাচকলা খেতে হয়, মৃতের সম্পত্তির হিসাব নিতে হয় তড়িঘড়ি। আর অন্তিম দিনে পান, সুপারী, পৈতে, নগদ একটা টাকার কয়েন আর দশকর্মা ভাণ্ডার থেকে কেনা যত কম দামী সম্ভব একটা চটি গীতা নামের খেলনা বই দিতে হয় কিছু মনুর বংশধরকে। সেই চটি বই যাকে দেওয়া হয়, সেও পড়েনা। অথচ দেওয়া নেওয়া চলে কারন এটাই নাকি নিয়ম, এটাই নাকি ধর্মীয় আচার। সুতরাং ওই বিশালদেহী শ্রীমদ্ভগবতগীতা নামের বইটা আমরা পড়িনা। তার ভিতরে কী লেখা আছে আমরা জানিনা, জানতে চাই না।

আমরা শ্রীকৃষ্ণ জানি টিভির সিরিয়াল দেখে, জন্মাষ্টমীর দিন গুগুল ইমেজের হ্যাপি জন্মাষ্টমী ছবি থেকে, ইউটিউবে আমার মতই অন্য আরেক বেরাদরের আপলোড করা ভিডিও দেখে, ফেসবুকের অর্বাচীন পোস্ট দেখে, ইন্সটাগ্রাম বা ট্যুইটার বাণী দেখে। ঠিক এভাবেই আমরা রামায়ণ না পড়েই রাম চিনি, রাবণ চিনি, পুরাণ না পড়েও শিব চিনি, দুর্গা চিনি, মহাভারত না পড়ে দ্রৌপদী চিনি, কিছু না পড়ে বা না বুঝেই ঈশ্বর চিনি। আমরা আদতে কখনো কোনো বই পড়িনা। বেদ, উপনিষদ বলে কিছু আছে সেটা জেনেছিলাম ছোটবেলার পাঠ্যবই পড়ে। আমরা ধর্ম চিনি রাজনৈতিক হুহুঙ্কারে।

ছোট ছোট ঘরে থাকি নিজেকে আর নিজের পরিবারকে নিয়ে। কিন্তু নিজের ওইটুকু ঘরের অন্যদের সম্পর্কেও সদ্ভাবনা নেই আমাদের। হাজার কুচি কুচি অংশে নিজেদেরই কেটেছি ছিঁড়েছি। এ শূদ্র ও চণ্ডাল, এ ব্রাহ্মণ ও ধোপার বউ, এ কুলীন ও নাপিতের মেয়ে এরকম নাক উঁচু হাজার হাজার ভাগ। অথচ আমরা জানিই না যে শাস্ত্র বলে ‘জন্মে ব্রাহ্মণ হয় না, কর্মে ব্রাহ্মণ হয়’। জাতপাতের নোংরা অন্ধকারে নিজেদের গায়ে নিজেরাই পরম আদরে হাত বুলাই।

পাশের ঘরের প্রতিবেশীকে চিনিনা, জানিনা, জানার চেষ্টাও করিনা কখনো। প্রতিবেশীরাও আমাদের মতই কোরাণ, বাইবেল, জিন্দাবেস্তা, ত্রিপিটক নিজে পড়েনি। আমাদের মতই কারো মুখে শুনে যতটুকু জানা তার বাইরে যে কিছু থাকতে পারে তাই জানা হয় নি কোনদিন। তারাও নিজেদের ক্ষুদ্র ঘরের ক্ষুদ্র পরিসরে নানান ভাগে ভাগ হয়ে থাকতে ভালোবাসে। হীনযান – মহাযান, ক্যাথলিক – প্রোটেস্ট্যান্ট, শিয়া – সুন্নি – সুফি – মোহাজির টুকরো টুকরো অংশ এ ওকে সহ্য করতে পারে না, সে তাকে।

রাজনৈতিক ক্ষমতার লোভে রাজারা লড়াই করেছে। আমরা তাদের সৈন্য হয়ে ক্রুসেড লড়েছি, ধর্মযুদ্ধের নামে অন্যের ঘর দখলের চেষ্টা করেছি, জিহাদী হয়ে কাফেরের মাথা কেটেছি এটা জেনে যে একটা শত্রুর মাথা কেটে ফেলতে পারলেই স্বর্গে বা হেভেনে বা বেহেস্তে সুন্দরী হুরিদের বিছানায় পাব, ভালো ভালো খাবার পাব। আমরা একদিন যারা শুধুমাত্র মানুষ ছিলাম আজ মুখে হিংস্র রক্ত মেখে হিন্দুরাজ বানাতে চাই, ইসলামরাজ বানাতে চাই, খ্রীষ্টানরাজ বানাতে চাই। আমরা ভাবি আমাদের রাজ প্রতিষ্ঠা হয়ে গেলেই আর কোনো অভাব থাকবে না আমাদের।

আমরা পড়ি না। পড়ে সময় নষ্ট করি না। নিজের ধর্মের বই পড়ি না। অন্যের ধর্মের বইও পড়ি না। অন্যের ধর্মের কথা কানে এলে দু হাত কানের ওপরে চেপে ধরি, যাতে অন্যের ধর্মের কোনো ভালো শব্দ আমাদের কানে ঢুকে আমাদের বিধর্মী না করে দিতে পারে। যে বদ্ধ পাঁকে আমাদের জন্ম আমরা সেখানেই ক্রমাগত আরও দুর্গন্ধ হতে থাকা পাঁকের ভিতরে চোখ – কান বন্ধ করে জীবন কাটিয়ে দিই। সেই আমাদের পছন্দের নরক, সেই আমাদের প্রিয় দোজখ। আসলে আমরা জানি না যেখানে জ্ঞান থাকে সেটাই স্বর্গ, সেটাই হেভেন, সেটাই বেহেস্ত। আর নরক বা দোজখ জ্ঞানহীন কালো অন্ধকার ছাড়া আর কিছু নয়।

আসলে আস্তে আস্তে চোরাবালির ভিতরে ডুবতে ডুবতে, ডুবছি সেটা না বুঝেই আমরা ধর্ম না জেনেও ধর্মরাজ হতে চাই।

.
(লেখা ©Soumitra Chakraborty, ছবি কৃতিত্ব এই দুঃসময়েও যে মুষ্টিমেয় কয়েকজন সত্যিকারের মানুষ আছেন তাঁদের মধ্যে দুজন Intekhab Alam এবং নিধি কামদারের সৌজন্যে প্রাপ্ত।)

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
ধর্মাধর্ম, 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ১ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ২১-০৮-২০২২ | ৭:৩১ |

    আমরা পড়ি না। পড়ে সময় নষ্ট করি না। নিজের ধর্মের বই পড়ি না। অন্যের ধর্মের বইও পড়ি না। অন্যের ধর্মের কথা কানে এলে দু হাত কানের ওপরে চেপে ধরি, যাতে অন্যের ধর্মের কোনো ভালো শব্দ আমাদের কানে ঢুকে আমাদের বিধর্মী না করে দিতে পারে। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...