যাত্রীর মিছিল শেষ হতে লম্বা সময় লেগে গেল। অনেকে একাধিক হ্যান্ড লাগেজ ও শিশু নিয়ে প্রবেশ করায় তাদের বসাতে যথেষ্ট সময় ব্যায় করতে হল এয়ার হোষ্টেসদের। আমার দু লাইন সামনে ছোট দুই বাচ্চা নিয়ে এক ইসরায়েলি পরিবার বসায় রাতের ঘুম কেমন হতে পারে কিছুটা আন্দাজ করে নিলাম।
সামনে পেছনে যতদূর তাকালাম কোথাও খালি কোন সীটের দেখা পেলাম না। মনে মনে কিছুটা হতাশ হলাম। খালি কোন সীট পেলে ওখানে ঘুমের আয়োজন করতে পারতাম। অতীতে অনেক ফ্লাইটে এ সুবিধা নিয়েছি। আমার চার সীটের লাইনটা তখনও খালি। মনে মনে দোয়া করলাম অন্তত একটা সীট যেন খালি যায়।
একদম শেষমুহূর্তে একজন এসে জানান দিল জানালার পাশের সীটটা তার। ২০-২৫ বছর বয়সী অনিত্য সুন্দরী এক ইহুদি মেয়ে। চমৎকার একটা হাসি দিয়ে গুছিয়ে নিলো নিজের সীট। কোন ভণিতা না করে নিজের পরিচয় দিল। সারাহ, জন্মগত ইসরায়েলি। সান ফ্রানসিস্কোর কোন এক ইউনিভার্সিটির সোশ্যাল সায়েন্সের ছাত্রী। ছুটিতে বাড়ি যাচ্ছে। জন্ম হাইফা শহরে হলেও তার মা-বাবা এখন তেল আভিভের বাসিন্দা। ওখানেই যাচ্ছে।
নিজেকে একজন টেলিকম প্রকৌশলী হিসাবে পরিচয় দিতে খুশি হয়ে জানালো তার এক ভাইও এই লাইনের প্রকৌশলী। ইসরায়েল প্রথম যাচ্ছি জানতে পেরে আমাকে জানালার পাশের সীটে বসার আহবান জানালো। ধন্যবাদ জানিয়ে নিজের অস্বীকৃতি জানালাম। লম্বা জার্নিতে আমি আইলসের সীটে বসতেই পছন্দ করি। তাতে মধ্যরাতে বাথরুম চাপলে আসা-যাওয়ায় অনেক সুবিধা। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম গোটা ফ্লাইটের দুটা সীটই কেবল ফাঁকা। এবং তা আমাদের সারিতে।*
ফ্লাইটের ঝামেলা শেষ করে আকাশে উঠতে উঠতে রাত প্রায় ১২টা বেজে গেল। ততক্ষণে নিকষ কালো অন্ধকার গ্রাস করে নিয়েছে বাইরের আকাশ। ইউনাইটেডের সুপরিসর বিমান রানওয়ে ছেড়ে আকাশে ডানা মেলতে কোন ঝামেলা হয়নি।
উড্ডয়নের মুহূর্তটা যেকোনো আকাশ জার্নির উৎকণ্ঠার সময়। ফ্লাইট ইতিহাসে যতো দুর্ঘটনা তার অধিকাংশই ঘটে হয় উঠা অথবা ল্যান্ড করার সময়। তাই আশংকা উৎকণ্ঠা ক্ষণিকের জন্যে হলেও মগজ চেপে ধরে। অতিরিক্ত ধাক্কা ধাক্কি ভয় ধরিয়ে দেয়। এ সময় কেবিন ক্রুরাও নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সব সংশয় সব ভয় নিমিষে উবে যায় যখন বিমান তার প্রয়োজনীয় উচ্চতায় পৌঁছে সোজা হয়ে চলতে শুরু করে।
এ যাত্রায়ও কোন ব্যতিক্রম হলোনা।
চারদিকে যাত্রীদের কোলাহল। হিব্রু ও আরবি ভাষায় নিচু স্বরে কথা বলছে সবাই। খুব কাছে বাচ্চাদের কেউ বিরামহীনভাবে কাঁদছে। মা চেষ্টা করছে সন্তানকে সান্ত্বনা দিতে। কথা বলছে আরবি ভাষায়। ভাষা বুঝা না গেলেও মা ও সন্তানের ভাষা বুঝতে অসুবিধা হলোনা। কারণ এ ভাষা চিরন্তন।
প্রচণ্ড খিদায় পেট চো চো করছিল। এয়ারপোর্ট লাউঞ্জে খাওয়া ম্যাকডোনাল্ডের বিগ ম্যাক ততক্ষণে হজম হয়ে গেছে। লম্বা জার্নি, তাই খাবার যাই হোক খেতেই হবে। অরুচি এখানে অপশন না। পরের খাবার কখন আসবে তারও কোন ঠিক নেই। কারণ বাইরে এখন রাত হলেও দূরত্ব অতিক্রম করার সাথে সময় বদলে যাবে। জীবন হতে হয়ত নীরবেই খসে যাবে একটা রাত অথবা দিন।
এক কাপ কফি দিয়ে শেষ হল ডিনার। প্রয়োজনের চাইতে একটু বেশিই খেলাম। সহযাত্রী সারাহ’র আহারে আছে অনেক রকম বিধিনিষেধ। তাই তার মেনুর বেশকিছু আইটেম জোর করে ধরিয়ে দিল আমার হাতে। ঘণ্টা দুয়েকের ভেতর গোটা কেবিন জুড়ে নেমে এলো পিনপতন নীরবতা। ফ্লাইটের মূল বাতি ততক্ষণে নিভে গেছে। কান্নারত শিশুর শেষ চীৎকারও মিহি হয়ে এসেছে। এবার ঘুমের পালা।
পার্সোনালাইড মনিটরে মুভি দেখার আয়োজন শেষ করে আমিও কম্বলের নীচে মুখ লুকালাম। এত সহজে ঘুম আসবেনা আমার। তাছাড়া এভাবে বসে ঘুমানোর সাথে আমার বৈরিতা অনেকদিনের।
হরেক রকম ভাষায় শতাধিক মুভি সেভ করা আছে ফ্লাইট নেটওয়ার্কে। রাতের জন্যে সংক্ষিপ্ত একটা তালিকা তৈরি করে নিলাম। এক চ্যানেলে ফ্লাইটের মতিগতি মনিটর করার ব্যবস্থা আছে। কানাডার নিউ ফাউন্ডল্যান্ড হয়ে নর্থ আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে পশ্চিম ইউরোপের স্পেনের উপর দিয়ে উড়ে যাবে আমাদের ফ্লাইট। ঘণ্টার হিসাবে প্রায় ১৬ ঘণ্টা বসে থাকতে হবে এখানটায়।
চলবে
loading...
loading...
ধারাবাহিকটিতে এমন সরল সাবলীল বর্ণনা থাকছে যে পড়লে মনে হয় আমিও সাথে আছি। চলুক স্যার।
loading...
আগের পর্বগুলো পড়া হয়নি। লেখা পড়ে সত্যি ঐসব জায়গায় ঘুরে আসতে মন চাচ্ছে।
পবিত্র মাহে রমজানের শুভেচ্ছা রইল।
loading...