জেরুজালেম হয়ে রামাল্লা... ঘুরে এলাম পশ্চিমে তীরের প্যালেস্টাইন পর্ব ৫

27299

সান ফ্রানসিসকো। অদ্ভুত সুন্দর একটা শহর। ঘন কুয়াশা, মৃদু শীতের বসন্ত, গোল্ডেন গেইট ব্রিজ আর নটরিয়াস আলকাট্রাস জেলখানার এই শহরে বছর-জুড়ে লেগে থাকে টুরিস্টদের ভিড়। গোটা শহরের একটা স্ন্যাপ শট পেতে উঁচু হতে দেখার কোন বিকল্প নেই। ক্ষণিকের জন্যে হলেও থমকে যেতে হয়। প্রকৃতি ও মানুষের আজন্ম ভালবাসার এই শহরকে প্রথম দেখায় ভাল না লেগে উপায় নেই। ল্যান্ড করতে চাইলে সব ফ্লাইটকেই সানফ্রানসিসকো বে’র খুব নিচু দিয়ে উড়ে যেতে হয়।

ভাল লাগার এসব খণ্ড খণ্ড মুহূর্তগুলোর সবটা ক্যামেরায় ধরা যায়না, বরং হ্রদয় খুলে উজাড় করে নিতে হয়। এবং এ ধরে রাখা ক্ষণিকের জন্য নয়, বেঁচে থাকার বাকি দিনগুলোর জন্যে। উপরে পরিষ্কার নীল আকাশ, নীচে বে’র পানিতে মৃদু-মন্দ ঢেউ; সবমিলিয়ে উপভোগ করার মত একটা বিকেল।

272831

সূর্য পরে আসছিল। নির্ধারিত সময়ের একমিনিট হেরফের না করে ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট আলতো করে ছুঁয়ে ফেললো সান ফ্রানসিস্কোর মাটি।

তেল আভিভের কানেন্টিং ফ্লাইট রাত ১১টায়। নষ্ট করার মত হাতে যথেষ্ট সময় ছিল। ভাবছিলাম এদিক ওদিক ঘুরে তারপরই কেবল চেক-ইন করবো।

27291

অতীত অভিজ্ঞতার শিক্ষা, এয়ারপোর্টের সময়কে বিশ্বাস করতে নেই। নিমিষেই বদলে যেতে পারে সবকিছু। তার উপর ইমিগ্রেশন পার হয়ে লম্বা লাইন ধরে ভেতরে ঢুকার ভেতরও ছিল অনিশ্চয়তা। কোথায় কখন সমস্যার জন্ম হয় পূর্বাভাষ করার কোন উপায় ছিলনা। তাছাড়া আমি যাচ্ছি এমন একটা দেশে, যেখানে প্রতিদিনের জীবন ডুবে থাকে সমস্যার অথৈ সাগরে। একদিকে প্যালেষ্টাইনিদের প্রতিরোধ, পাশাপাশি ইসরায়েলি সৈন্যদের নির্মমতা। সবমিলিয়ে ইসরায়েল নামের দেশটায় যাওয়া যেমন কঠিন, বেরিয়ে আসাও খুব একটা সহজ না। বিশেষকরে আমার মত জন্মগত মুসলমানের জন্যে।

বিশেষ কোন ঝামেলা ছাড়াই ইমিগ্রেশন ও স্ক্যানিং পার হয়ে ঢুকে গেলাম ভেতরে।

দেখলে মনে হবে আলোর হাঁট জমেছে টার্মিনালে। সাথে মানুষের স্রোত। হরেক রকম মানুষ। যেন সাদা, কালো, বাদামি, এশিয়ান সহ গোটা বিশ্বের খণ্ড একটা মানচিত্র এখানে। এলোমেলো হাঁটছে সবাই। কেউ হাতে টিকেট নিয়ে দৌড়চ্ছে নিজ গেটের দিকে। আমার মত যাদের হাতে অফুরন্ত সময় তারা পথভ্রষ্ট পথিকের মত এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। কেউ কেউ ঢুকে পরছে ট্যাক্স ফ্রি দোকানগুলোতে। শেষ মিনিটের কেনাকাটা সেরে অনেকে তৈরি হচ্ছে লম্বা জার্নির। সে জার্নির দূরত্ব অনেকের জন্য হয়ত আফ্রিকার গহীন জঙ্গল অথবা ব্রাজিলের আমাজন নদী পর্যন্ত।

টুকটাক কেনাকটি আমিও সেরে নিলাম। যদিও ডিনারের সময় অনেকটা বাকি, তবু ম্যাকডোনাল্ড রেস্টুরেন্টে আগাম কিছু খেয়ে নিলাম। সব প্রয়োজনীয়তা শেষ করে ফ্লাইট যখন আকাশে উড়বে রাতের খাবার পরিবেশনে তখনো অনেক দেরী। অতীতে কলোম্বিয়ার বগোটা হতে নিউ ইয়র্ক ফেরার পথে তিক্ত এক অভিজ্ঞতা এড়াতেই অসময়ের এ ডিনার।

27279

ইউনাইটেডের ৯৫৪নং ফ্লাইট জি৯৬ গেইট হতে ছেড়ে যাবে। হাতে তখনো নষ্ট করার মত ২ ঘণ্টা সময় আছে। হাতের ছোট ব্যাগ আর কাঁধের ঝুলন্ত ল্যাপটপটা শেষবারের মত চেক হাঁটা দিলাম নির্দিষ্ট গেইটের দিকে। কাছাকাছি আসতেই বিস্মিত হলাম। বেইসমেন্টে মূল ফটক। পাশাপাশি অন্যান্য ফ্লাইটে ঢুকার চাইতে তেল আভিভ গামী ফ্লাইটে ঢুকার ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। পাসপোর্ট চেক, তার উপর নতুন করে স্ক্যানিং। গায়ের শেষ তুলাটা পর্যন্ত খুলে রাখতে হল স্ক্যানিং মেশিনের বেল্টে।

সান ফ্রানসিস্কো শহরে জানতাম চীনাদের ঘনবসতি। এই প্রথম খুব কাছ হতে অনুভব করলাম এর সত্যতা। ইমিগ্রেশন ও স্ক্যানিং মেশিন অপারেটরদের সবাই চীনা। মাঝে মধ্যে বিনা কারণে এশিয়ান ব্যাকগ্রাউন্ডের ইমগ্রেশন অফিসাররা ঝামেলা বাধায়। সামান্য ত্রুটিকে বিশাল কোন কিছুতে রান্না করতে ভালবাসে। এ দৌড়ে চীনারা সবসময় এগিয়ে। তারপর দাঁড় করানো যাবে ভারতীয়দের। এসব ব্যপারে আমার অভিজ্ঞতার ঝাঁপি অনেক ভারী। তাই কিছুটা হলেও জানা ছিল কি করলে ঝামেলা এড়ানো যায়।

ওরা কিছু বলার আগেই আমি পরনের কাপড় ছাড়া বাকিসব বেল্টে রেখে দিলাম। অফিসার অন ডিউটিকে খুব সন্তুষ্ট দেখাল। প্রয়োজনের চাইতে একমিনিটও দেরী হবোনা ঝামেলা শেষ করতে। বেল্ট হতে সবকিছু কুড়িয়ে আসল জায়গায় ফিরিয়ে নিতে বেশকিছুটা সময় পার হয়ে গেল। খুব সাবধানে গুনে গুনে সবকিছু যত্ন করে প্যাক করলাম। বিশেষ চোখ রাখলাম পাসপোর্ট ও বোর্ডিং পাসের দিকে।

এক মিনিটের জন্যেও ভুলে গেলাম না আমি কোথায় যাচ্ছি। ভাল করে জানা ছিল কথা ও কাজে সামান্য হেরফের হলেই আমাকে কাঞ্চনজঙ্ঘা পাহাড় ডিঙ্গাতে হবে। আমি আমার ইসরায়েল যাওয়ার উদ্দেশ্য ও বিধয়ের স্টোরি সোজা করে নিলাম। মনে বিশ্বাস ছিল, সত্য বললে কোথাও কোন সমস্যা হবেনা।

বোয়িং’এর বিশাল এক ফ্লাইট। শত শত যাত্রী। সবাই নিজ দেশে যাচ্ছে। তিন ধর্মের দেশ ইসরায়েল। যাত্রীদের পরনের পোশাক দেখেই বুঝা যায় কে কোন ধর্মের। ইহুদিদের মাথার টুপি জাতীয় টেফিল্লিন নামে পরিচিত বস্তুটা বলে দেয় ওদের পরিচয়। মুসলমান বলতে যে দু’চারজন ছিল তাদের সবার পরনে ট্রাডিশনাল আরবি পোশাক। দু’চারজন ভারতীয় পোশাকেও তাদের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। সাদা আমেরিকানদের কেউ ভ্রমণ করছে বলে মনে হলনা।

চলবে

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
জেরুজালেম হয়ে রামাল্লা... ঘুরে এলাম পশ্চিমে তীরের প্যালেস্টাইন পর্ব ৫, 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ১ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ৩০-০৩-২০২২ | ২০:৩২ |

    এই পর্বটি অন্যান্য পর্বের মতোই বেশ ডিটেইলে এসেছে। অশেষ শুভ কামনা স্যার। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...