অণুগল্প: চোর ১৩৮

প্রতিদিনের মতো অফিস ফেরত একজন বাবার ভূমিকায় শিহাব। ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘর থেকে ঘুরে এসে নিজের বেডরুমে। কণা কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। ঘুমিয়ে গেছে। স্বাভাবিক নি:শ্বাস পতনের শব্দ এবং কিছু অংগের উত্থানপতনে বুঝা যায় সে গভীর ঘুমে।

ঘুমের ভান নয়।
ভান শব্দটা এজন্যই শিহাবের মনে এসেছিলো রুমে প্রবেশের মুখে। কণা প্রায়ই এমন দুষ্টুমি করে ওদের ছোট বাবুটাকে সাথে নিয়ে। হঠাৎ করে নৈশব্দের নিঝুম নিমগ্ন ক্ষণে, একাকী বিচরণরত শিহাবকে চমকে দেয় কণা। কখনো ছোট বাবুটা। এভাবেই চলে নাগরিক জীবনে বেমানান কিছু বাবাদের সংসার সংসার খেলার মাঝে, কিছু আনন্দঘণ মুহুর্ত! কাছের মানুষদের থেকে পাওয়া। রিফ্রেশমেন্ট?
কণা ইচ্ছাকৃত করে?

সম্পর্কগুলি নিত্য নতুন টানাপোড়ণে ভোগে। দগ্ধ হয়। ক্ষয় হয়। তাই অনবরত এর পরিচর্যার প্রয়োজন হয়। কণা বুঝে? তাই সহজ করতে এমন করে? বিবাহিত জীবনের কুড়ি বছর পার করে এসে ও কি সেই প্রথম দিকের অনুভবকে জাগিয়ে তুলতে চায়?

শিহাব কি বুঝে?
কখনো কি নিজে কণার মতো সম্পর্কগুলির ক্ষতের মলম হতে চেয়েছে? সম্পর্কের মাঝের ক্ষয় রোধে তুমি নিজে কি ভূমিকা নিয়েছো? আদৌ নিয়েছো কি?

নিজের কাছ থেকে এমন প্রশ্নে বিব্রত শিহাব হাসে। নি:শব্দে। এটা নিজের মনে হাসা। ইদানিং এভাবেই হাসে অনেকে। নিজের থেকে লুকোতেই অনেক বাবারা ও এমন করেন।

ছোট্ট বাবুটা ঘুমন্ত মায়ের পাশে বসে হোমওয়ার্ক করছে। শিহাব নিরবে পাশে বসে। একটু দেখে। এটা মেয়ে বাবু। তবে পুরোদস্তুর ছেলেদের পোশাক পরে আছে। কান টুপি ও পরেছে একটা। দুষ্ট এক ছেলের পোশাকে দুষ্টু মেয়েটি স্কুলের কাজে মগ্ন। তার ভিতরেও বাবার পাশে বসাটা অনুভব করে। সে ও বাবার দিকে না তাকিয়ে নিজের মনে হাসে। ওর হাসি নিজের থেকে নিজেকে লুকোতে নয়। নিজেকে জাহির করতে। বাবার অনুপ্রবেশ তার ব্যস্ততার ভিতরেও অনুভবের ‘নোটিফিকেশনে এক্সিকিউট’ হয়েছে, ধরা দিয়েছে ঐ নিরব হাসির দ্বারা।

শিহাব মোবাইলে পাওয়ার ব্যাংকের সংযোগ দিতে দিতে স্বগতোক্তি করে,
– তরকারি চুরি করে খেয়ে এলাম।
বাবুটা এবার বাবার দিকে তাকায়। তবে তার হাত কাজ করে চলে। ইরেজার দিয়ে পেন্সিলের লেখা মুছছে। সে প্রশ্ন করে,
– তুমি তো এমনিতেই খেতে পারো। চুরি করা লাগে কেনো?

মোবাইলে চোখ, কী’র উপর আংগুল, শিহাব প্রশ্নের উত্তর দেয়,
– আমার চুরি করে খেতেই ভালো লাগে। আমার ভিতরের চোরটা এই কাজ করে।

পাশের রুমে বড় কন্যাকে হাউস টিউটর পড়াচ্ছে। ইউনিভার্সিটির ছাত্র। ছোট বাবুটা হেসে হেসে অল্প আওয়াজে বাবাকে বলে,
– আস্তে বলো পাপা, স্যার শুনবে।
– শুনুক। সবার ভিতরেই একটা করে চোর থাকে।
– সবার ভিতরে? স্যারের ভিতরে ও চোর আছে?

ছোট বাবুটার প্রশ্নের উত্তরে শিহাব একটু থামে। ভাবে? শেষে উত্তর দেয়,
– হ্যা। আছে।
– সে কি চুরি করে?
– ধরো, সে নিজের পাপাকে ফোন করে বললো যে বই কিনতে হবে, হাজারখানিক টাকা পাঠাও। তার বাবা টাকা পাঠিয়ে দিবে। সে আড়াইশো টাকা বইয়ের পিছনে খরচ করলে বাকী সাড়ে সাতশো’ টাকা বন্ধুদের কে নিয়ে বিড়ি ফুঁকে শেষ করবে। এটা তার ভিতরের চোরটা করে।
– এটা তো স্যারের বাবাকে মিথ্যে বলা হলো, তাই না পাপা? এই চোরটা তোমার চোরের চেয়েও খারাপ।
– হ্যা বাবা।

বাবুটার পরবর্তী প্রশ্নে শিহাব বিব্রত হয়,
– পাপা, তুমি কি কখনো দাদা ভাইয়ের সাথে এমন করেছো?
কি উত্তর দেবে ভাবতে সময় নেয় শিহাব। তবে বাবুটাই ওকে উদ্ধার করে। সে হোমওয়ার্ক করা অবস্থায় লজ্জিত হেসে বলে,
– আমার ভিতরেও একটা চোর আছে পাপা! 🙂

– হ্যা আছে। 🙂 তোমার চোরটা কি করে?
– আমার চোরটা অনেক কিছু করে। তুমি ঘুমিয়ে গেলে তোমার মোবাইল দিয়ে গেমস ডাউনলোড করে। আপুর ভিতরের চোরটা ও আম্মুর মোবাইল দিয়ে ফেসবুকে ঢুকে ঘুরে ফিরে আবার তার একাউন্ট ডি-এক্টিভেট করে রাখে। ও মাই গড! আমি তো অনেকের ভিতরের চোরকে দেখতে পাচ্ছি পাপা! জান্নাতি, আমেনা, মিতু- ওদের ভিতরের চোরগুলি ক্লাসে কি করে আমি এখন জানি পাপা 🙂
শিহাব ছোট বাবুটার উচ্ছ্বাসিত অনুভবে ধীরে ধীরে ভালোলাগায় কোমল হতে থাকে। সময় বয়ে চলে। নিরুদ্বেগ সময়। আবারো প্রশ্ন বাবুটার,
– পাপা, সব চেয়ে বড় চোর কাদের ভিতরে থাকে?

উত্তর দিতে গিয়ে থামতে হয়। বাবাদের কখনো কখনো ভেবে চিন্তেও উত্তর দিতে হয়। শিহাবও দেয়,
– যারা একসাথে অনেক মানুষকে মিথ্যে বলে, কথা দিয়ে কথা রাখে না-তাদের ভিতরের চোরগুলি সবচেয়ে বড়।
– তারা কারা? আমি কি চিনি তাদের?

ছোট্ট বাবুটার মাথার চুল নেড়ে আদর করে শিহাব। মুখে বলে,
– আরেকটু বড় হলে তুমি নিজেই তাদেরকে চিনে নেবে। এটা মনে করো তোমার একটা এসাইনমেন্ট।

শিহাবের মন তখন নিরবে ভাবে, ওর বসবাসের ভূ-খন্ডে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে, নির্দিষ্ট কিছু মানুষ, একসাথে অনেক মানুষকে মিথ্যে বলে, সময় হলে কথা দিয়ে কথা রাখে না। এখন এটা একটা ‘ট্রেন্ডে’ পরিণত হয়েছে। এই নির্দিষ্ট মানুষগুলিকে ‘রাণী মৌমাছি’র মতো ঘিরে আমজনতার প্রদক্ষিণ, এই ‘ট্রেন্ড’কে ‘সিস্টেমে’ পরিণত করেছে।

সিস্টেমেটিক পদ্ধতিতে নিত্য নতুন বড় চোরেরা শূণ্য জায়গাগুলি দ্রুত দখল করে নিচ্ছে ভেবে ব্যথিত হন একজন বাবা। উত্তরপুরুষের জন্য এমন চোরসমৃদ্ধ একটি ভূ-খন্ড রেখে যেতে হচ্ছে!

আচ্ছা, সিস্টেম পাল্টানো যায় না? শুরুর শুরুটা তো অন্ততো করে যাই আসুন..

#চোর_অণুগল্প_১৩৮

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
অণুগল্প: চোর ১৩৮, 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

২ টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ২ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ১৯-০১-২০২২ | ১৯:৫০ |

    অনেকদিন পর সেই পরিচিত চরিত্র সমূহের দেখা পেলাম। অসাধারণ। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    GD Star Rating
    loading...
  2. ফয়জুল মহী : ২০-০১-২০২২ | ২:৩৯ |

    অসাধারণ
    পাঠে মুগ্ধ হলাম খুব,

    GD Star Rating
    loading...