ছোটগল্পঃ ও কেনো এতো সুন্দরী হলো?

20595_n

একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য স্নাতকোত্তর করে বাবা-মার সাথে ছিলাম। দেশের অন্যতম এক সমৃদ্ধ বিভাগীয় শহরে পরিপূর্ণ জীবন আমলা বাবার নিয়ন্ত্রণে বেশ আনন্দময়। ইচ্ছেঘুড়ির নাটাই বাবার হাতে থাকলেও যথেচ্ছা উড়াবার স্বাধীনতা ছিল আমার। উড়াচ্ছিলাম। বাউরি বাতাসে নিজেও ভেসে যাচ্ছিলাম।

এ অবস্থায় বর্ডার সংলগ্ন একটি স্কুল ও কলেজের দায়িত্ব চাপলো আমার ঘাড়ে। দায়িত্ব নিলাম। সুন্দরভাবে পালন করলাম। উপভোগও করলাম সেই সময়টুকু।

পরিবারের বড় ছেলে। লেখাপড়া শেষ। সুন্দর চাকরি। বিয়ের জন্য আদর্শ বয়স। বাবা-মা বিয়ের জন্য অত্যন্ত তৎপর। বাবা সরকারি চাকুরীজীবি হবার কারণে, আমাদের বেড়ে ওঠা এবং মেলামেশা ছিল বাবার কলিগ পরিবারগুলোর সাথেই। সবার ভিতরে থেকেও, এই বিশেষ সার্কেলটি ছিল ক্ষমতার দম্ভে পরিপূর্ণ প্রাচুর্যের অধিকারী এক আলাদা শ্রেণি। যেখানে অন্য শ্রেণির সাথে শ্রেণি সংঘাত ওভাবে না থাকলেও এক আলাদা সমীহ জাগানিয়া অনুভবে তাড়িত হত অন্যরা।

যাইহোক, মা-বাবা থেকে আলাদা আরেক শহরে চাকুরির কল্যাণে নির্বাসিত একাকি জীবন কাটাই সপ্তাহের ছয় দিন। আর আর্কের টুলুর গান শুনি, ‘এই একেলা জীবন, ভালো লাগে না আমার…’। নিজের ভিতরেও একজন প্রিয়দর্শিনীর অভাব অনুভব করছিলাম।

একদিন মায়ের ফোন। তখন গ্রামীন ফোনের পোষ্ট পেইড যুগ। আমার বর্ডার সংলগ্ন কলেজের আবাসিক ভবনে আ্যান্টেনা দিয়ে কোনমতে নেটওয়ার্ক পাই। মা আমাকে শহরের বাসায় চলে আসতে বললেন। খুবই নাকি ‘আর্জেন্ট’।

বাসায় পৌঁছাতেই আমাকে বলা হলো, ‘আমরা মেয়ে পছন্দ করেছি, আজ অমুক আংকেলের বাসায় তোমাকে দেখবেন মেয়ে পক্ষ।’ আমাকে স্রেফ জানানো হলো। এক মুহুর্তে নিজেকে কোরবানির পশুর মত মনে হলো। একটু গাইগুঁই করার চেষ্টা করলেও লাভ হলো না। বাবার সামনে ‘না’ বলার মত সক্ষমতা তখনও অর্জন করিনি।

খুব কাছের ক’জন বন্ধু ছিল আমার। মনের কষ্টটা ওদেরকে শেয়ার করতে চাইলাম। আমাদের আবাসিক এলাকা থেকে একটু দূরে অন্য আরেক এলাকায় থাকতো তারা। এটাও এক সরকারি কলোনি। বাবার কলিগদের বাসস্থান।

এক ভরা দুপুরে গেলাম ওদের কাছে। সিগ্রেটের ধোঁয়ায় নিজেদেরকে ঝাঁপসা করে দিয়ে আমার টেনশনের কথাটা উপস্থাপন করলাম। বাবা মেয়ে পছন্দ করে ফেলেছেন। এখন মেয়েপক্ষ আমাকে পছন্দ করলেই গেছি।
বন্ধুরা আমাকে টিপ্পনি কাটার পাশাপাশি হইহই করে আমাকে নিয়ে পড়লো। আমার অবস্থা কেন জানি ওদের আনন্দের খোরাক হলো। হয়ত এমনই হয় বন্ধুর বিয়ে সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে।

আমরা আড্ডা দিচ্ছিলাম ডি-টাইপের বিল্ডিং এর সামনের এক চিলতে সবুজের ওপর বসে। এল-টাইপের পিচের রাস্তা মাঠটাকে আবাসিক ভবনগুলির থেকে আলাদা করেছে। ফাগুনের পাতা ঝরার দিন। রাস্তার দু’পাশের প্রাচীন বৃক্ষগুলি এলোমেলো বাতাসে নিরবচ্ছিন্ন পাতা ঝরিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় তাকে দেখলাম!

ছেলেবেলা থেকেই সুন্দরের প্রতি আমার তীব্র আকর্ষণ। নারীর সুন্দর মুখশ্রী এবং রঙ তাদের ফিগারকে উহ্য রেখেই আমার অনুভবে দোলা দিয়ে যেত। ‘দুধে আলতা গাত্রবর্ণ ‘ কিংবা টোকা দিলে যেসব নারীর শরীরে রক্ত জমে যায়, এমন লাল-সাদা বর্ণ আমার ভিতরে আলাদা আবেদন জাগাতো (আমাকে বর্ণবিদ্বেষী ভাবাটাও কিন্তু ভুল হবে)। আমার ভিতরের ভালোলাগাটা ওভাবেই প্রকৃতিগতভাবে জন্মেছে, সেখানে আমার দায় কোথায়?
ডি-টাইপের এক তলা থেকে যখন সে বের হলো, প্রথম দর্শণেই আমার ভিতরের আমি নিজেকে জানালাম, ‘আমার পাঁজরের হাড় থেকেই একে বানানো হয়েছে! ওকে ছাড়া আমি সম্পূর্ণ অসম্পূর্ন।’

পিচের রাস্তা দিয়ে গ্রীবা উঁচু করে উদ্ধত এবং নমনীয়’র মাঝামাঝি এক ভংগীতে সে হেঁটে যাচ্ছিলো। রাস্তার অপর পাশ দিয়ে আমাদের পাশ কাটানোর সময় সে আমাদের দিকে ফিরে তাকালো। ওর দৃষ্টিতে কি ছিল জানি না, আমি লুটপাট হয়ে গেলাম!

আমার ভিতরে কোথায় যেন বেজে চলছিল, ‘ও কেন এত সুন্দরী হলো’!

বাবার পছন্দের মেয়েকে দেখতে যেতে হবে, সে কেমন হবে, আমার তাকে কতটুকু ভালো লাগবে, তাদের আমাকে পছন্দ হবে কিনা ইত্যকার ভাবনা-চিন্তায় বিব্রত মন আমার। মনের আকাশ জুড়ে মেঘ জমেছে। ঝড় না উঠেও বাতাসটাতে ঘোর লেগেছে। ঠিক এমন এলোমেলো সময়ে আঁচল উড়িয়ে সে খোলা চুলে আমার সামনে এলো! আমি মুগ্ধ হলাম। ভালোলাগা ভালোবাসার আগুনে পুড়ে প্রেমে পরিণত হলো!

আমার ভাবনার চোয়াল শক্ত হতে থাকলো। জীবনে এই প্রথম ‘পছন্দের মেয়ে দেখা’ বিষয়ে বাবাকে ‘না’ বলার মানসিক প্রস্তুতি নিতে থাকলাম।

সেদিন। আসরের নামাজের পর। আমাদের পুরা পরিবার সেই ‘অমুক’ আংকেল’ এর বাসায়। বাবাকে না বলা হয়নি আমার। যেতেই হলো।

বসার ঘর। ভাইদের সহ বাবা-মা ভিতরে সবে আসন গ্রহন করেছেন। দরজার মুখে দাঁড়ানো আমি। নিজেকে নিয়ে প্রবেশ করব। ভিতরে একবার অলস দৃষ্টি বোলালাম। আবারও মুগ্ধতা!

তবে এবার আমি অবাক হলাম! দুপুরের বাউরি বাতাসে আমাকে লুটপাট করা হেঁটে যাওয়া এলোকেশী সেই মেয়েটি মাথায় সবুজ একটি ব্যান্ড পরে বসে আছে। আমাদের চার চোখের মিলন হলো ‘আনুষ্ঠানিকভাবে’!

মুহুর্তে প্রাণে আমার মন জেগে ওঠে। এতদিনের পরিচিত পৃথিবীটা একটুখানি বদলে যায় ‘ওকে’ অপ্রত্যাশিত ভাবে হঠাৎ সামনে পেয়ে। অপুর হৈমন্তিকে ‘পাবার’ মত আমিও ‘পাইলাম’ অনুভবে তাড়িত হলাম!

এরপর.. অনেকগুলি বসন্ত কেটে গেলো পাওয়া-না পাওয়ার গোলকধাঁধার ধোঁয়াশা ভূবনে। তবে ভালোবাসা আর প্রেম আমাদের ছেড়ে যায়নি কখনো। আমরা মানে আমি আর আমার লাল বউ, জীবনের প্রতিটি কঠিন সময়ে, স্রেফ ভালোবাসায় মেখে মেখে- হৃদয়ের এপিঠ ওপিঠ তন্নতন্ন করে সুখ খুঁজেছি। কখনও হতাশ হইনি। সে আমাকে আগলে রেখেছে। মায়ায়, ভালোলাগায় আর মুগ্ধতায় যে নিরন্তর প্রেমময় আবহ তৈরী করে রেখেছে সে, যার বাইরে আমার কখনোই যাবার প্রয়োজন পড়েনি। অচল আমার থেকে সকলেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, সে আমাকে আরো কাছে টেনে ওর বুকে ছোট্ট চড়ুই বাবুর মত আগলে রেখেছে।

এখনো সে আমার ভালোলাগার প্রথম প্রহর! এখনও সে শীতের নরম রোদের মত মায়াবী কোমল! সে উষ্ণতায় চোখ মুদে যাওয়া এক শীতের সকালে রোদ আর সাদা মেঘের ভিতরের মৃদু খুনসুটি। এরকম আরও অনেক অনেক বহু অনেক কিছুই সে!’

‘ওকে ছাড়া আমি সম্পূর্ণ অসম্পূর্ণ ‘- হাসপাতালটির সামনে বাস থেকে নামার সময় ভাবে শিহাব। ভাবনার ভ্রান্তিবিলাসে ধীর পায়ে এলোমেলো শিহাব কখন যে বিশেষায়িত এই হাসপাতালের দেড় তলার ‘টেস্ট রিপোর্ট ‘ নেবার কিউতে দাঁড়িয়েছে.. ধীরে ধীরে পেছন থেকে কিউতে সবার সামনে এসেছে, বলতে পারবে না। সময় ছিল স্থির.. মনের ভিতর ঝড় উঠেছে। গভীর সমুদ্রে ডুবে যাবার প্রচন্ড ‘সাইনাস পেইন’ অনুভবের প্রখর সীমায়। কিন্তু খড়কুটো ধরে ভেসে থাকার মত কিছুই নেই। অন্য সব কিছুর মত শিহাবের লাল বউ-ই ওর জন্য আঁকড়ে ধরার একমাত্র খড়কুটো। সে-ই যখন ডুবে যাচ্ছে, কাকে আঁকড়ে ধরবে শিহাব?

বায়োপ্সি রিপোর্ট হাতে ভাঙ্গাচুরা একজন শিহাব হৃদয়ের গভীরতম জায়গা থেকে নিজের ইশ্বরের কাছে মিনতি জানায়, ‘ওকে ছাড়া আমি একমুহুর্তও থাকতে পারব না, আমাকে একা করো না!’

এক বিশেষায়িত হাসপাতালের দেড় তলা একটি কক্ষে ইশ্বর নিজের আলো এবং আঁধার দিয়ে একজন শিহাবকে জড়িয়ে রাখে। বাইরে সুর্য ডুবন্ত প্রায়। চলে আলো-আঁধারের মাঝে নিরন্তর দখল নেবার অন্তহীন খেলা।।

.
#মামুনের_ছোটগল্প

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
ছোটগল্পঃ ও কেনো এতো সুন্দরী হলো?, 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

২ টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ২ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ১৮-০৭-২০২১ | ৯:৪৭ |

    মামুনের অসাধারণ একটি অণুগল্প। প্রিয় সেই চরিত্র শিহাব। মুগ্ধ হলাম। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...
  2. নিতাই বাবু : ১৮-০৭-২০২১ | ১১:৩৭ |

    অনেক সুন্দর করে লিখেছেন, শ্রদ্ধেয় লেখক। এভাবে সাজিয়ে-গুছিয়ে লেখা আমার দ্বারা অসম্ভব। তবুও আপনাদের লেখা পড়ে নিজে একটু-আধটু লেখার চেষ্টা করি।
    আপনার জন্য নিরন্তর শুভকামনা।

    GD Star Rating
    loading...