ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল ১২মে ১৮২০ সালে ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মদিনকে সারা পৃথিবীতে আন্তর্জাতিক নার্স দিবস হিসেবে পালন করা হয়। তিনি জাতিতে ব্রিটিশ ছিলেন। জন্মের সময় পরিবার ইতালির ফ্লোরেন্সে অবস্থান করছিল, তাই ওই শহরের নাম অনুসারে নামকরণ করা হয়েছিল তার। পিতা উইলিয়াম এডওয়ার্ড নাইটিঙ্গেল একজন প্রচন্ড বিদ্যানুরাগী মানুষ ছিলেন। ভিক্টোরিয়ান রক্ষণশীলতার যুগেও তিনি মেয়েদের গণিত, দর্শন, ক্ল্যাসিকাল সাহিত্য এবং বিভিন্ন ভাষা শেখার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। মা ফ্রান্সিস নাইটিঙ্গেল অভিজাত পরিবারের মানুষ ছিলেন।
ছোটবেলা থেকেই ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় পরিবারের সাথে ঘোরার সুযোগ হয়েছিল তার। এরকম এক ভ্রমণের সময় প্যারিসে পরিচিত হয়েছিলেন ম্যারী এলিজাবেথ ক্লার্ক এর সঙ্গে। নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ম্যারী প্যারিসের বুদ্ধিজীবিদের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। ম্যারী বিশ্বাস করতেন নারীরা পুরুষের সমকক্ষ। প্রকৃতপক্ষে তিনি ব্রিটিশ অভিজাত পরিবারের মেয়েদের এড়িয়ে চলতেন। ঘটনাক্রমে ফ্লোরেন্সের সাথে তার বন্ধুত্ব হয়েছিল। এই বন্ধুত্বের সম্পর্ক টিকে ছিল প্রায় চল্লিশ বছর। ধারণা করা হয় ম্যারীর ব্যক্তিত্ব ও আদর্শ নাইটিঙ্গেলকে খুব বেশি অণুপ্রাণিত করেছিল। এরপর নাইটিঙ্গেল গ্রীস ও মিশর ভ্রমণে যান। এথেন্সে অবস্থান কালে একটি ছোট ঘটনা তার মনকে খুব নাড়া দেয়। কিছু বাচ্চা দুষ্টুমির ছলে একটা ছোট প্যাঁচাকে নিষ্ঠুর ভাবে কষ্ট দিচ্ছিল। নাইটিঙ্গেল পাখিটিকে উদ্ধার করে তার কাছে রেখে নাম দিয়েছিলেন এথেনা। এরপর ১৮৩৭ সালে মিশরের থিবেসে ভ্রমণের সময় তার অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়- মনে হতে থাকে সৃষ্টিকর্তা যেন তাকে ডাকছেন! তার নিজের ভাষায়-“God called me in the morning and asked me would I do good for him alone without reputation.”।
একজন অভিজাত পরিবারের মেয়ে কিভাবে এই সিদ্ধান্তে আসলেন তা নিয়ে আরো অনেক গল্প আছে। ফ্লোরেন্সে জন্মালেও বেড়ে উঠেছিলেন লন্ডনের নিকটবর্তী ডার্বিশায়ারের গ্রামাঞ্চলে। ওই এলাকায় রজার নামে এক দরিদ্র রাখাল ভেড়ার পাল নিয়ে বসবাস করত। ভেড়ার পাল পাহারা দেয়ার জন্য ছিল পালিত কুকুর ক্যাপ। একদিন গ্রামের ডানপিটে ছেলের দল পাথর ছুড়লে ক্যাপের এক পা আঘাতপ্রাপ্ত হয়। রজারের পক্ষে একটি অকর্মণ্য আহত কুকুরকে পালার মতো আর্থিক সক্ষমতা ছিলো না। সে কুকুরটিকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়! অন্যদিকে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল কুকুরটিকে খুব ভালোবাসতেন। মাঝে মাঝে বাইরে বের হলে ক্যাপের সাথে খেলতেন। সেদিন রাস্তায় বের হয়ে রজারের কাছে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন সব ঘটনা। মর্মাহত হয়ে স্থানীয় এক পাদ্রীকে সাথে নিয়ে ক্যাপকে দেখতে গিয়ে আবিষ্কার করলেন, ক্যাপের হাড় ভাঙ্গেনি! স্রেফ জখম হয়েছে চামড়ায় কিছুটা। পাদ্রীর নির্দেশনায় গরম পানি, ব্যান্ডেজ দিয়ে তার শুশ্রূষা করলেন দুইদিন। এরপর কুকুরটি ভালো হয়ে যায়। পরদিন রাতে ৭ ফেব্রুয়ারী, ১৮৩৭ সালে স্বপ্ন দেখলেন অথবা এটা তার নিজস্ব অন্তর্দৃষ্টি ছিল যে- যেন তিনি ঈশ্বরের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন। তিনি দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করা শুরু করলেন তার জীবনের বিশেষ লক্ষ্য রয়েছে। সৃষ্টিকর্তার তরফ থেকে এসবই তার জন্য ইশারা! হয়তো সেবা দিয়ে একজন মৃত্যু পথযাত্রীকে ফিরিয়ে আনা যায়, এই ঘটনায় এই বিশ্বাস তার মনে গড়ে উঠেছিল।
১৮৪৪ সালে তিনি যখন প্রথম প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন নার্সিংকে পেশা হিসেবে নিবেন, পরিবারের তরফ থেকে তীব্র আপত্তি ছিল। বিশেষ করে তার মা অভিজাত ব্রিটিশ হওয়ায় বিষয়টা মেনে নিতে পারছিলেন না। কিন্তু নাইটিঙ্গেল সেই সময়ের নারীদের মতো কারো স্ত্রী বা কার মা হয়ে কাটাতে রাজী ছিলেন না। এটা সুস্পষ্ট বিদ্রোহ ছিল এবং তিনি প্রত্যয়ী ছিলেন! সোশ্যাল কগনিটিভ থিওরী তে ভাবলে বোঝা যায়, সেই সময়ের নারীদের জন্য রক্ষণশীল পরিবেশে তার এই আচরণের কারণ ছিল তার বাবার দেওয়া উন্মুক্ত জ্ঞান চর্চার পরিবেশ এবং বাবার সাথে মেয়ের সম্পর্ক। কারণ পরিবেশ মানুষের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে, বদলাতেও পারে। এরিকসনের সাইকোসোশ্যাল থিওরী মতে মানুষের ব্যক্তিত্ব গঠনে বড় নিয়ামক হলো তার শৈশব, পিতা মাতার ভূমিকা, আর সমাজ। এক্ষেত্রে ধারণা করা যেতে পারে নাইটিঙ্গেলের এই সিদ্ধান্তের পিছনে হয়তো ছিল সেই সময়ের সামাজিক রীতি নীতি, নারীর প্রতি রক্ষণশীলতা ও উচ্চবিত্তের জীবনাচরণের প্রতি প্রতিবাদ।
এরপর ১৮৫০ সালে জার্মানিতে প্রটেস্টান্ট ধর্মযাজক থিওডর ফ্লেডনারের হাসপাতালে অসুস্থ ও বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তার সেবামূলক কাজ দেখার সুযোগ পান। এই অভিজ্ঞতা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। তিনি সমস্ত সংশয় ঝেড়ে ফেলে মানুষের সেবায় জীবন উৎসর্গের ব্রত নিলেন। এখানেই চার মাস নার্সিং ও মেডিকেল ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন যা তার পরবর্তী জীবনের বুনিয়াদ হিসেবে কাজ করেছিল।
ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের সবথেকে বড় অবদান ছিল ক্রিমিয়ার যুদ্ধে আহতদের সেবায় আত্মনিয়োগ করা। ১৮৫৪ সালে সাথে আঠারো জন স্বেচ্ছাসেবী তৎকালীন অটোমান সাম্রাজ্যের কৃষ্ণসাগরের নিকটবর্তী একটি অংশে কাজ করা শুরু করলেন। সেখানে তখন ভয়াবহ ঝুঁকি পূর্ণ স্বাস্থ্যব্যবস্থা বিরাজমান ছিল! যতো রুগী যুদ্ধে আহত হয়ে মারা যাচ্ছিল তার চেয়ে দশ গুণ বেশি মারা যাচ্ছিল কলেরা, টাইফয়েড, টাইফাস এইসব রোগে। না ছিল পর্যাপ্ত ঔষধ, পরিচ্ছন্ন গজ ব্যান্ডেজ, সর্বোপরি ড্রেইনেজ বা সুয়ারেজের কোন ব্যবস্থাপনাই ছিলনা। ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি বিষয়ে কারো কোন ধারণা ছিলনা। আনুমানিক দুই হাজার সৈনিকের জন্য ছিল মাত্র চোদ্দটি গোসলখানা! মানুষের শরীরে উকুন, চারপাশে মাছিদের বাজার! আবর্জনায় পরিপূর্ণ ছিল চারিপাশ!
নাইটিঙ্গেল সব দেখে এইসব দেখে সিদ্ধান্তে পৌছালেন সমস্যা মূলত তিনটি জায়গায়- খাবারে, আবর্জনা ও ড্রেইনেজ ব্যবস্থাপনায়। তিনি ব্রিটিশ সরকারকে অনুরোধ করে এইসবে আমূল পরিবর্তন আনেন। তার সব থেকে বড় অবদান এটা যে তিনি পরিচ্ছন্নতা ও মৃত্যহারের মধ্যে সম্পর্ক বুঝতে পেরেছিলেন। দিন রাত অবিশ্রান্ত খেটে গভীর রাতে মেডিকেল অফিসাররা চলে যাওয়ার পর হাতে আলো নিয়ে ঘুরতেন এক ওয়ার্ড থেকে আরেক ওয়ার্ডে! কোন আহত সৈনিক কষ্ট পাচ্ছে কিনা নিজে গিয়ে শুনতেন। আর এই মানুষ গুলো তাকে নাম দিয়েছিল- “the Lady with the Lamp”!
ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল ছিলেন একজন সুলেখিকা ও পরিসংখ্যানবিদ। ছোটবেলা থেকেই প্রচন্ড ধর্মভীরু ছিলেন। এই যে জীবন ব্যাপী কর্মযজ্ঞ- নার্সিং কে আধুনিকীকরণ, সমাজ সংস্কার, পরিচ্ছন্নতার ধারণা পরিবর্তন, যাকে অনেকে বলেন নাইটিঙ্গেল পাওয়ার। একে বুঝতে হলে তার নিজস্ব বিশ্বাসকে বোঝা প্রয়োজন। তিনি আধ্যাত্মিক মানুষ ছিলেন। চিরাচরিত আধ্যাত্মিকতার কিছু মত মানুষকে সমাজ সংসার থেকে একদম দূরে নিয়ে আত্মমুক্তির কথা বলে। আবার কিছু মত আধ্যাত্মিকতায় উদ্বুদ্ধ মানুষকে প্রেরণা দেয় তাদের আত্মোপলব্ধি সমগ্র মানব জাতির মধ্যে ছড়িয়ে দিতে। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল অনেক লেখা লিখেছেন আধ্যাত্মিকতার উপর। লিখেছেন- “Where shall I find God? In myself”। অতিন্দ্রীয়বাদ, সুফিবাদের মতো শোনায় কথাগুলো। এইযে পরার্থপরতার উদাহরণ নাইটিঙ্গেল দেখিয়েছিলেন তার উদাহরণ আগে থেকেই খ্রিস্টিয়ান মিস্টিকদের মধ্যে ছিল। ক্যাথেরিন অফ সিয়েনা, ক্যাথেরিন অফ জেনোয়ার নাম বলা যায় উদাহরণ হিসেবে। এই সেবা করার তাড়না, মানুষের ভালোর জন্য কিছু করার আগ্রহ ও মানসিক শক্তির পিছনে হয়তো কাজ করে তাদের বিশ্বাস। হয়তো তাদের উপলব্ধি এমন যে এই শক্তি চলে আসে অলৌকিক উৎস থেকে, যার জন্য তাদের কোন প্রচেষ্টার প্রয়োজন পড়েনা, স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে আসে! হয়তো এরকম বিশ্বাসই নাইটিংগেলকে অনুপ্রাণিত করেছিল কিশোরী বেলা থেকেই।
তবে এক্ষেত্রে উল্লেখ্য তার বিশ্বাস কে মাদার তেরেসার মানব সেবার বিশ্বাসের সাথে মিলানো যাবেনা। মাদার তেরেসা ভাবতেন যন্ত্রণা, দুঃখ মানুষের প্রতি সৃষ্টিকর্তার সুন্দর দান, যাতে তারা যীশুর যন্ত্রণাকে বুঝতে পারে, সমব্যাথী হতে পারে। কিন্তু নাইটিঙ্গেল ভাবতেন উপশমের কথা। ভাবতেন কিভাবে মানুষের যন্ত্রণা কমে, কিভাবে তার রোগ হচ্ছে, আর তা ঠেকানোর উপায় কি! তিনি ছিলেন আধ্যাত্মিকতায় উদ্বুদ্ধ বিজ্ঞানমনস্ক সংস্কারক!
তৎকালীন সময়ে নাইটিঙ্গেলের জন্য অনেকে অনুরক্ত থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র তার মানব সেবা বাঁধাগ্রস্ত হতে পারে এই আশংকায় আজীবন অবিবাহিতই ছিলেন। এই যে অদৃশ্য মানসিক শান্তি, তৃপ্তি যার জন্য অনেকেই বেছে নেয় এই জীবন, এই যে তাড়না তৈরী হয় মানুষের মনে অন্যের প্রতি সহমর্মিতা, করুণা ও ভালোবাসা দিয়ে সেবা দিয়ে যাওয়ার, তাকে আলবার্ট ফিনি ১৯৮২ সালে উল্লেখ করেছিলেন ‘ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল সিন্ড্রোম’ নামে। অনেকে আবার বলেন ‘নাইটিঙ্গেল এফেক্ট’! তবে সুস্পষ্ট ভাবেই এটা কোন রোমান্সের উপর গড়ে উঠেনা। এই সম্পর্কের ভিত্তি হচ্ছে মানুষের প্রতি মানুষের সহমর্মিতা, দয়াশীলতা এবং পেশাদার ইতিবাচক মনোভাব। এই সবগুলোই অসুস্থ মানুষের সেরে উঠার জন্য খুব জরুরী। তবে এখানে পেশাদারিত্বের সীমারেখা থাকে। যার ভিতরে থেকে একজন মানুষ আরেকজন মানুষের দুঃখ দুর্দশা কমানোর জন্য সর্বোচ্চটা করতে পারেন। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল নিজে নার্সিং বিষয়ে পেশাদারিত্বের চরম উৎকর্ষতা দেখিয়েছিলেন।
দায়িত্বের প্রতি ছিলেন অত্যন্ত যত্নশীল। সার্বিক পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় তখনকার দিনের পুরুষদের সমকক্ষ ছিলেন। এই গুণ তাকে সবকিছু বদলাতে আর পরিবর্তন আনতে সাহায্য করেছিল। অনেকের মতে জনসাধারণ তাকে নিয়ে ভাবত- “woman with a strong “man’s” character”।
পরবর্তী জীবনের পুরোটা সময় নার্সিং পেশার উন্নয়নে, প্রশিক্ষণ প্রদানে পার করেছেন। তিনি ১৮৬০ সালে প্রথম সেইন্ট থমাস হাসপাতালে নার্সিং স্কুল উদ্বোধন করেন। এছাড়া তিনি আমেরিকার প্রথম প্রশিক্ষিত নার্স লিন্ডা রিচার্ডস এর প্রশিক্ষক ছিলেন। ১৮৫৭ সালের পর থেকে মাঝেমাঝেই শয্যাশায়ী থাকতেন। অনেকে মনে করেন ব্রুসেলোসিস আর স্পন্ডাইলিটিসে আক্রান্ত হয়ে পরেছিলেন তখন। ডিপ্রেশন ও আসতো মাঝে মাঝে। ১৩ আগস্ট, ১৯১০ সালে লন্ডনে ঘুমের মধ্যে শান্তিতে মৃত্যুবরণ করেন আজীবন মানুষের যন্ত্রণা লাঘবের জন্য কাজ করে আসা এই মহীয়সী নারী।
ছবি ও লেখা কৃতজ্ঞতাঃ ইন্টারনেট।
loading...
loading...
ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল। মহিয়সী এই নারীর জীবন বৃত্তান্ত জেনে ভালো লাগলো।
শেয়ার করার জন্য অনেক অনেক শুভেচ্ছা প্রিয় কবি সৌবর্ণ বাঁধন। ধন্যবাদ।
loading...