অভিশপ্ত বছর ২০২০... হেথা হতে যাও পুরাতন এসো এসো হে নতুন বছর ২০২১ (...

অভিশপ্ত বছর ২০২০… হেথা হতে যাও পুরাতন
এসো এসো হে নতুন বছর ২০২১ (পঞ্চম পর্ব )
তথ্যসংগ্রহ ও কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

6

ভারতীয় অর্থনীতি অবশ্য করোনার আগে থেকেই ধুঁকছিল। জিডিপি ঋণাত্মক বা সঙ্কোচন অর্থাৎ মন্দা না হলেও নিম্নগতিতে ছিল। বেকারত্বের হার নেমে গিয়েছিল ৪৫ বছরের সর্বনিম্ন হারে। ধুঁকছিল উৎপাদন ক্ষেত্র। আর্থিক বিশেষজ্ঞরা বলছিলেন ‘ঝিমুনি’। করোনা এসে মরার উপর খাঁড়ার ঘা দিয়েছে। যেন খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে থাকা কাউকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল কয়েক হাজার ফুট নীচের গিরিখাতে। মৃত্যু হয়নি। প্রাণটা কোনওরকমে ছিল। মাস তিনেক প্রায় সংজ্ঞাহীন থাকার পর কিছুটা সুস্থ হয়ে পাহাড়ি চড়াই-উতরাই বেয়ে উপরে উঠে আসার চেষ্টা। তবে আবার কবে আগের অবস্থা ফিরে আসবে, তা নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করতেও ভয় পাচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা।

এই ধরনের বিপর্যয় এবং তা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোকে চারটি ইংরেজি বর্ণ দিয়ে ভাগ করেন অর্থনীতিবিদরা— ভি (V), ইউ (U), ডব্লিউ (W) এবং এল (L)। অক্ষরগুলির আকৃতি দেখেই অর্থনীতির উত্থান-পতন বোঝা যায়। ভি-এর ক্ষেত্রে কিছুটা ধীরে পতন এবং একই গতিতে উত্থান। ইউ-এর অর্থ দ্রুত পতনের পর দীর্ঘদিন সেই অবস্থায় থাকা এবং দ্রুত ঊর্ধ্বমুখী। ডব্লিউ অর্থাৎ গ্রাফ একই ভাবে বারবার ওঠানামা এবং এল-এর ক্ষেত্রে দ্রুত পতন এবং তা দীর্ঘস্থায়ী হওয়া। ২০২০-র ডিসেম্বর পর্যন্ত আর্থিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে ভারত এবং গোটা বিশ্বের অর্থনীতির এই উত্থান-পতনকে ‘ভি’-এর আকারের বলে ব্যাখ্যা করছেন অর্থনীতিবিদরা। তবে ভারত-সহ বেশ কিছু দেশে বৃদ্ধির গ্রাফ কিন্তু ডব্লিউ-এর আকারও হতে পারে। অর্থাৎ দ্বিতীয়বার ফের বড়সড় নিম্নগতি আসতে পারে। ভারতের ক্ষেত্রে সম্ভাবনা বেশি। কারণ, করোনা সংক্রমণের আগে থেকেই ছিল অর্থনীতির ঝিমুনি।

বাজার বিশেষজ্ঞরা বলেন, অর্থনীতির ওঠাপড়া আগেভাগে আঁচ করতে পারে শেয়ার বাজার। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে যখন ব্রিটেন, ফ্রান্স একের পর এক দেশ লকডাউন ঘোষণা করছিল, শেয়ারবাজারে ধস নামতে শুরু করেছিল তখন থেকেই। সারা বিশ্বের সূচকের গড় পতন ছিল ২০ শতাংশের মতো। ভারতের ক্ষেত্রে তা ছিল ৩৫ শতাংশেরও বেশি। আন্তর্জাতিক বাজারে সর্বকালীন পতন হয়েছিল অপরিশোধিত তেলের দামে। লকডাউনের এক একটা দিন লগ্নিকারীদের পুঁজি যেন হাওয়ায় উবে যাচ্ছিল।

তবে শেয়ার বাজার আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। নিতান্ত সাদামাটা জীবনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা ভারতবাসীই লকডাউনের শেষে আবার বাজারমুখী। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ছে। মানুষের হাতে টাকা আসতে শুরু করেছে। ভিড় বাড়ছে শপিং মল, দোকানে। চাহিদা বাড়ছে, বাড়ছে উৎপাদন। অতএব অর্থনীতি ঊর্ধ্বমুখী। এপ্রিল-জুন প্রথম ত্রৈমাসিকে যেখানে জিডিপি সঙ্কুচিত হয়েছিল মাইনাস ২৩.৯ শতাংশ। দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে সেই সঙ্কোচন অনেকটাই কমেছে (মাইনাস ৭.৫%)। পরের ত্রৈমাসিকে এই হার আরও ভাল জায়গায় থাকবে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর শক্তিকান্ত দাস বলেছেন, যা আশা করা গিয়েছিল, তার চেয়েও দ্রুতগতিতে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে অর্থনীতি। আইএমএফ পূর্বাভাস দিয়েছিল, ২০২০-২১অর্থবর্ষে ভারতের জিডিপি সঙ্কোচনের হার বা মন্দা হতে পারে ৯.৫ শতাংশ। দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের পর এই পূর্বাভাস কমিয়ে করেছে মাইনাস ৭.৫। সেনসেক্স-নিফটিও কোভিডের আগের জায়গায় তো ফিরেছেই, তার চেয়ে অনেক উপরে উঠে প্রায় প্রতিদিন নতুন নতুন উচ্চতায় পৌঁছে যাচ্ছে।

তবে কি কোভিডের ধাক্কা শুধু ২০২০-র কয়েকটা মাসেই সীমাবদ্ধ? কোভিডোত্তর যুগে প্রবেশ করে গিয়েছি আমরা? অন্তত অর্থনীতির দিক থেকে? অর্থনীতিবিদরা কিন্তু এখনই নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। তাঁদের মতে, অর্থনীতিতে কোভিডের এই ক্ষত কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী এবং গভীর। সেখান থেকে সহজে পরিত্রাণের উপায় নেই। জেল থেকে ছাড়া পেলে যেমন মুক্তির প্রকৃত স্বাদ বা তাৎপর্য বোঝা যায়, তেমনই দীর্ঘ লকডাউনের পর তাৎক্ষণিক কিছু চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাতে কিছুটা গতি এসেছে বটে, কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী মেয়াদে সেটা ধরে রাখাই চ্যালেঞ্জ।

আমরা চাইলেও ইতিহাস ভুলতে পারবে না ‘অর্থহীন’ ২০২০। যখনই অর্থনীতিতে ধাক্কা আসবে, তুলনা আসবে এই বছরের। শেয়ার মার্কেটে কয়েক দিনে কার কত টাকা উবে গিয়েছিল, রাতারাতি উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কোন শিল্পে লোকসানের বহর কত বেড়েছিল— সব উঠে আসবে আলোচনায়। ইতিহাস ভুলতে পারবে না, রাজপথে পরিযায়ীর পদযাত্রা, রেললাইনে ঘুমিয়ে থাকা শ্রমিকদের পিষে দিয়ে মালগাড়ি চলে যাওয়া। সরকার হিসেব রাখুক না রাখুক, ইতিহাসবিদের কলম এড়াতে পারবে না কয়েকশো কিলোমিটার পথ হেঁটে পাড়ি দিয়ে বাড়ির কাছে এসে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া সেই ছেলেটার কথা।

ছর বারোর মেয়েটি লকডাউনের মধ্যে তেলঙ্গানা থেকে হেঁটে ছত্তীসগঢ়ের বিজাপুর সংলগ্ন গ্রামের বাড়িতে ফিরতে চেয়েছিল। কিন্তু গ্রাম থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার আগেই সে ঢলে পড়ে মৃত্যুর কবলে।

ওই কিশোরীর মৃত্যুর খবর প্রকাশ্যে আসতেই দেশ জুড়ে করোনা-আবহে পরিযায়ী শ্রমিকদের এ ভাবে নিজের রাজ্যে ফেরা নিয়ে বিতর্ক দানা বাঁধে। তড়িঘড়ি তদন্তে নামে বিজাপুর পুলিশ। তদন্তে নেমে তারা জানতে পারে, ওই কিশোরীকে তেলঙ্গানার কান্নাইগুড়ায় লঙ্কা তোলার কাজে লাগিয়ে দিতে নিয়ে গিয়েছিলেন গ্রামেরই এক মহিলা। বুধবার পুলিশ কোতোয়ালি থানায় কিশোরীর গ্রামের দু’জনের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭০ নম্বর ধারায় মেয়েটিকে পাচারের অভিযোগ দায়ের করেছে।

বিজাপুরের কালেক্টর কেডি কুঞ্জম শুক্রবার এফআইআরের কথা স্বীকার করে জানান, ফেব্রুয়ারিতে আডেড গ্রামের সুনীতা মারকামি এবং তেলঙ্গানার ঠিকাদার সন্তোষ মাঞ্চল ওই কিশোরীর সঙ্গে আরও কয়েক জনকে তেলঙ্গানার পেরুরুতে নিয়ে যান শ্রমিক হিসেবে কাজ করানোর জন্য। সেখানে শিশু শ্রমিক হিসেবে লঙ্কা তুলতে হত ওই কিশোরীকে। পুলিশ তার বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছে, না-জানিয়েই মেয়েটিকে নিয়ে গিয়েছিল সুনীতা।

কিন্তু লকডাউন ঘোষণার পরে কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ওই শ্রমিকদের কোনও দায়িত্বই নিতে চায়নি ঠিকাদার বা কারখানার মালিক। ফলে খাবার না-পেয়ে অন্য কয়েক জনের সঙ্গে ১৫ এপ্রিল পেরুরু থেকে হাঁটতে শুরু করে ওই কিশোরী। তিন দিন হাঁটার পরে বাড়িতে পৌঁছনোর আগেই অভুক্ত, ক্লান্ত মেয়েটি ১৮ তারিখে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে, শরীরে জলের অভাবে অসুস্থ হয়ে পড়াতেই মৃত্যু হয় মেয়েটির। বিজাপুরের কালেক্টর অবশ্য এ দিন তা অস্বীকার করে জানান, পড়ে গিয়ে চোট লাগাতেই ওই কিশোরীর মৃত্যু হয়।

তেলঙ্গানার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ওই শিশু শ্রমিকের মৃত্যুর বিষয়টি জানার পরেই ২০ এপ্রিল তেলঙ্গানা মানবাধিকার কমিশনের কাছে আবেদন জানিয়েছে, সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনের কাছে জানতে চাওয়া হোক, লকডাউনের মধ্যে ওই কিশোরী এবং তার সঙ্গীদের রাজ্যের সীমানা পেরোতে দেওয়া হল কী ভাবে? ১২ বছরের একটি মেয়েকে দিয়ে লঙ্কা তোলার কাজ করানোই বা হচ্ছিল কেন? পুলিশ-প্রশাসনের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ তুলে যথাযথ তদন্তের আবেদন জানান স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রতিনিধি অচ্যুত রাও। তাঁদের দাবি, মৃত কিশোরীর পরিবার যাতে অবিলম্বে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পান, প্রশাসনকে সেই ব্যবস্থা করতে হবে।

কিন্তু তবুও মানুষ নতুন আশার আলো দেখার প্রহর গুনছে। আসছে নতুন বছর ২০২১ । কান পেতে শুনি তাই নতুনের আহ্বান! নতুনকে স্বাগত জানানোর গান, কোটি কোটি কণ্ঠে উদাত্ত আহ্বান….
এসো হে নববর্ষ ২০২১ এসো এসো!

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ১ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ০১-০১-২০২১ | ১০:৩৬ |

    অভিশপ্ত বছর ২০২০… হেথা হতে যাও পুরাতন এসো এসো হে নতুন বছর ২০২১। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

    GD Star Rating
    loading...