শান্তার যখন থেকে জ্ঞান বুদ্ধি হয় তখন থেকেই শুনে এসেছে – বাহ! কি মিষ্টি মেয়ে।
মিষ্টি মেয়েদের কি জ্বালা তা শান্তাই ভালো জানে। সময়ের সাথে সাথে শান্তা বড় হচ্ছিলো আর মিষ্টি মিষ্টি শুনতে শুনতে কেমন যেন মিষ্টির প্রতি বিতৃষ্ণা জেগে উঠছিলো। যখন বয়স ছ সাত হলো তখন থেকেই মনে আছে চাচাতো খালাতো ফুফাতো মামাতো ভাইয়েরা মিষ্টি মেয়ে মিষ্টি মেয়ে বলে ছুতোনাতায় শান্তাকে ছুঁয়ে দিতো; এই ছোঁয়াটা শান্তার মনে যেন কেমন অস্বস্তির জন্ম দিতো। তখন শান্ত ঠিক বুঝতো না তবুও এটুকু বুঝতে পারতো ছোঁয়াগুলোতে কেমন যেন একটা অন্যরকম অনুভূতি, শরীর গুলানো অনুভূতি। কই বাবা মা আদর করলে, ছুঁয়ে দিলে, কোলে নিলে তো এমন অনুভূতি হয় না! অন্যরকম এক অস্বস্তিকর অনুভূতি নিয়ে শান্তা বেড়ে উঠতে থাকে।
শান্তার বয়স যখন দশ এগারো তখন এই সব ভাইদের সাথে সাথে যেন বাসায় বেড়াতে আসা বাবার কিছু কিছু বন্ধুরাও বাহ! আমাদের মিষ্টি মেয়ে বলে আদরের ছুঁতোয় শান্তার শরীর ছুঁয়ে দিতো। শান্তা কিছু বলতে পারতো না, কেমন এক ঘিন্না মেশানো অনুভূতিতে তার শরীর গুলিয়ে উঠতো। সে পারতপক্ষে এর পর থেকে আর বাবার বন্ধুদের সামনে যেতে চাইতো না।
একদিন শান্তার চাচ্চু বাসায় এলো, সেদিন বাবা-মা নেই; শান্তা একা। চাচ্চু বললেন শান্তা মা একটু পানি দে তো! শান্তা পানির গ্লাস হাতে ড্রইংরুমে এলো। চাচ্চুকে পানি দিয়ে অন্যদিকের সোফায় বসলো। চাচ্চু পানি খেয়ে শান্তার সাথে টুকটাক গল্প করতে করতে উঠে এসে শান্তার পাশে বসলো। শান্তা কিছু মনে করে নি, আপন চাচ্চুই তো! আস্তে আস্তে মামনি মামনি বলে এটা ওটা গল্প করতে করতে চাচ্চুর হাত শান্তার মাথা বেয়ে পিঠে হাত বুলাতে লাগলো, শান্তা চমকে উঠলো; তার গা ঘিনঘিনে অনুভূতিটা প্রবল হয়ে উঠলো। সে চাচ্চুর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখে সেখানে কেমন যেন এক গা ঘিনঘিনে চকচকে অপরিচিত দৃষ্টি। কোথায় জানি! কোথায় জানি! এ দৃষ্টি দেখেছে সে কিছুতেই মনে করতে পারছে না। তারপর চট করেই মনে পড়লো ‘দি ডেভিল’ সিনেমায় হায়েনার চোখের সাথে যেন চাচ্চুর এ দৃষ্টি পুরোপুরি মিলে যাচ্ছে। কথা বলতে বলতেই একবার যখন মাথা থেকে হাত পিঠে না গিয়ে সামনে থেকে বুক বেয়ে পেটে নেমে এলো তখনই শান্তার প্রবল বমির বেগ পেয়ে গেলো, সে দৌড়ে গিয়ে বাথরুমে ওয়াক ওয়াক করতে লাগলো। শান্তার চাচ্চু কি হয়েছে! কি হয়েছে! বলে তার সাথে সাথে বাথরুমের দরজার পাশে এসে দাঁড়ালো। আরেকবার কি হয়েছে মামনি বলতেই শান্তা তীব্র চোখে তার চাচ্চুর দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। চাচ্চু চোখ নামিয়ে নিলেন, ধীর পায়ে হেঁটে বাসা থেকে বের হয়ে গেলেন। শান্তা এ কথা কোনদিন কাওকে বলতে পারে নি, তবে সে তার চাচ্চুর সামনে একা আর কখনোই যায় নি।
শান্তার ফুপু থাকেন লন্ডনে, ফুপা রেস্টুরেন্ট ব্যবসা করে প্রচুর টাকার মালিক। ওনারা দুই এক বছর পর পর দেশে আসেন। প্রত্যেকবারই ফুপু শান্তাদের জন্য অনেক অনেক গিফট নিয়ে আসেন, আসল শান্তাদের বাড়িতেই ওঠেন। এবার ফুপুরা এলেন প্রায় দুই বছর পর। এই ফুপুকে শান্তা অনেক পছন্দ করে, ফুপুও শান্তাকে মেয়ের মতই দেখেন। ফুপাও খুবই ভালো আচরণ করেন। ওনারা আসার প্রথম দুইদিন হৈ চৈ করে খুব ভালোভাবেই কেটেছে। শান্তা লক্ষ্য করেছে এবার ফুপার আচরণে কেমন যেন একটু পরিবর্তন এসেছে, আড়ে আড়ে কেমন চোখে যেন শান্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। সবার সামনে মা মা করে অথচ ওনার চোখে শান্তা যেন চাচ্চুর ছায়া দেখতে পায়। তৃতীয়দিন বিকেলে শান্তা ড্রইংরুমে বসে একমনে টিভি দেখছিলো, ফুপা ফুপু দুপুরে লাঞ্চের পর বেডরুমে শুয়ে রেস্ট নিচ্ছিলেন। হঠাত করেই শান্তা লক্ষ্য করলো ফুপা এসে তার পাশে বসেছেন। কি দেখছিস রে মা, বলে একদম কাছ ঘেঁষে বসলেন। শান্তার মনে হঠাত করেই পুরনো অস্বস্তিকর অনুভূতিটা ফিরে আসলো, খালুর রান শান্তার রানে ঘষা খাচ্ছে, খালু কথা বলতে বলতেই শান্তার মাথায় হাত দিয়ে আদর করতে করতে পিঠে নামাতে লাগলো; তারপর খুব হঠাৎই মাথা থেকে শান্তার বুকে হাত চলে আসলো। ঝট করে শান্তা খালুর চোখে তাকাতেই হায়েনার চোখ দেখতে পারলেন, মুখে নেকড়ের হাসি। হতভম্ব শান্তার বুঝতে দেরি হয়ে গেলো মা মা ডাকতে ডাকতে কিভাবে একটা লোক অবলীলায় তার বুক ছানছে। শান্তা লাফ দিয়ে উঠে দৌড়ে তার রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে হাঁপাতে লাগলো। সারা শরীর ঘৃণায় রি রি করছে, শান্তা বাথরুমে ঢুকে শাওয়ারের নীচে ভিজতে লাগলো, যেন ফুপার নোংরা হাতের স্পর্শ ধুয়ে ফেলতে চাচ্ছে।
এবার শান্তা আর চুপ থাকতে পারলো না, রাতের ডিনারের শেষে শান্তা তার ফুপুকে তার রুমে ডেকে নিয়ে আসলো। ফুপু এসে বললো কিছু বলবি? শান্তা অনেকক্ষণ আমতা আমতা করে কাঁদতে কাঁদতে দুপুরের ঘটনা ফুপুকে খুলে বললো। ফুপু কতক্ষণ হতভম্ব চোখে শান্তার দিকে চেয়ে থেকে তার গালে সজোরে থাপ্পড় মেরে বসলেন। ছিঃ শান্তা ছিঃ! এই বয়সেই তোর মনে এইগুলো! তোর ফুপার মত এমন সুফি মানুষের নামে তুই এই কথা বলতে পারলি? তার থেকে বেশি হতভম্ব হয়ে গেলো শান্তা, যেন বলে বিশাল এক অন্যায় করে ফেলেছে। পরদিনই ফুপুরা বোঁচকা বুঁচকি নিয়ে ফুপাদের বাড়ি চলে গেলো। সেই শেষ, ফুপুরা আর কখনো শান্তাদের বাড়ি আসে নি।
শান্তা এখন বড় হয়েছে, কলেজে পড়ে। সে ছেলেদের দৃষ্টি কোনটা কি, ছেলেদের ছোঁয়া কোনটা কি খুব ভালোই বুঝতে পারে। বন্ধুদের মধ্যে অনেক ভালো বন্ধুই আছে যাদের সামনে সে কোন অস্বস্তি অনুভব করে না, আবার কিছু বন্ধু আছে যারা সামনে এলে যেন চোখ দিয়ে চাটে। খালাতো, চাচাতো, মামাতো, ফুপাতো ভাইদের মধ্যেও কয়েকজন খুবই আন্তরিক যাদের দৃষ্টির মাঝেই বোন সুলভ এক মায়া অনুভব করে, তাদের সাথে শান্তা খুব স্বাচ্ছন্দ্য; আর কয়েকটা আছে যারা থাকলে পারতপক্ষে শান্তা ভাইবোনদের আড্ডাতেও বসে না, ঐ গা গুলানো বিবমিষা। আর এখন শান্তার চেহারা যতই মধু হোক না কেন, সময় আর পরিস্থিতি তাকে আমূলে বদলে দিয়েছে; ছোঁয়াছুঁয়ি তো অনেক দূরে তার কথাতেই অনেকে এখন বিষ অনুভব করে। এই বয়সেই শান্তা খুব ভালো বুঝে গেছে কার সাথে কেমন ব্যবহার করতে হবে। শান্তার চাচ্চু আজকাল খুব কমই বাসায় আসে, আসলেও শান্তা এমনভাবে তীব্র এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে! যেন উনি পালিয়ে যেতে পারলে বাঁচেন।
ইদানীং মহল্লার ছেলেপেলেগুলি শান্তাদের বাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করে, মিষ্টির গন্ধ দূর দূর বোধহয় ছড়িয়ে পড়েছে। শান্তা বাড়ি থেকে বের হলেই পেছনে অনেকগুলো দৃষ্টি অনুভব করে। শান্তার এগুলো সয়ে গেছে, পুরুষমানুষ মাত্রই সুন্দর দেখবে এ আর এমন নতুন কি! তবে আজকাল ছেলেগুলো যেন একটু বেশীই ডেয়ারিং হয়ে গেছে, প্রায়ই এটা ওটা মন্তব্য ছুঁড়ে দেয় শান্তার আসা যাওয়ার পথে, শান্তা না শোনার ভান করে রিক্সায় উঠে যায়। বাড়ি থেকে কলেজ আরা কলেজ থেকে বাড়ি, এর বাইরে সাধারণত শান্তা একা আর কোথাও যায় না। এর মধ্যে একদিন দুজন খুব সাহস দেখিয়ে রাস্তায় শান্তার রিক্সা থামিয়েছিলো, সেই পুরনো কথা – বাহ! কি মিষ্টি! কি মিষ্টি! মনে হয় খেয়ে ফেলি! শান্তা তীব্র দৃষ্টিতে তাদের দিকে চেয়ে থাকে, কিন্তু ওদের মধ্যে এ দৃষ্টির কোন আছর পড়ে না। একজন রিক্সায় উঠতে গেলে শান্তা ধাক্কা মেরে তাকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে চেঁচামেচি শুরু করে দেয়। আশেপাশে থেকে মানুষজন জড়ো হয়ে যায়, ছেলেগুলো দেখে নেব বলে শাসিয়ে চলে যায়। বাসায় এসে এ কথা বলতেই এরপর থেকে মা শান্তাকে সাথে করে কলেজে দিয়ে আসে, কলেজ থেকে নিয়ে আসে; মহল্লার বখে যাওয়া ছেলেপেলেগুলো দূরে সরে থাকে। এভাবেই কাটছিলো শান্তার দিন।
একদিন মা অসুস্থ, শান্তা গায়ে হাত দিয়ে দেখে বেশ জ্বর; তাই কলেজে যাওয়ার সময় সাথে যেতে পারেন নি। কেও কি লক্ষ্য করেছে? শান্তা কলেজে গেলো ভয়ে ভয়ে, নাহ! কেও বোধহয় লক্ষ্য করে নি; কেও সামনেও আসে নি। বিকেলে কলেজ থেকে বের হয়ে দেখে মা আসেন নি; শান্তা ভাবছিলো – তবে কি মায়ের জ্বর বেড়ে গেলো? শান্তা তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরার তাগিদ অনুভব করে। রিক্সাওয়ালাকে বলে, মামা একটু জোরে টানো, তাড়াতাড়ি পৌঁছতে হবে। কলেজ থেকে মহল্লায় ঢোকার মুখে কয়েকটা খালি প্লট, এখনো এখানে বিল্ডিং ওঠে নি; জায়গাটা খানিকটা নির্জন। হঠাত করেই যেন প্লটের ভেতর থেকে ছজন একসাথে বের হয়ে আসলো, সামনে থেকে এসে রিক্সার পথরোধ করে দাঁড়ালো। ওদের মধ্যেই একজনকে শান্তা ঐদিন রিক্সা থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলো; শান্তা ভয়ে কুঁকড়ে গেলো। আজ আর রিক্সায় ওঠার চেষ্টা না করে শান্তাকে জোর করে টেনে হিঁচড়ে রিক্সা থেকে নামিয়ে নিলো, একা শান্তা এতজন ছেলের সাথে জোড়ে পেরে উঠবে কি করে? রিক্সাওয়ালাকে দুইটা ঘুষি মেরে তাকে রাস্তায় ফেলে ওরা রিক্সার মধ্যেই ঝাঁপিয়ে পড়লো শান্তার ওপর। চার পাঁচ জনার একসাথে বুকে পেটে পাছায় থাবা চালাচ্ছে। শান্তার মনে হলো বিষপিঁপড়া কামড়াচ্ছে। কেও কাপড় খোলার চেষ্টা করছে কেও বা কাপড়ের ওপর দিয়ে শরীর ছানছে। রিক্সাওয়ালাটা সেদিন খুব বুদ্ধিমানের কাজ করেছিলো, সে মাটি থেকে উঠেই চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে, একজনকে এর মধ্যে ধরে মাটিতে শুইয়ে ফেলেছে। আশেপাশের কিছু মানুষেরও ততক্ষণে এইদিকে নজর পরেছে তারা দলবেঁধে ছুটে আসতে শুরু করতেই বখাটেরা চম্পট দিলো। তারপর এ নিয়ে থানা পুলিশ অনেক কিছু হয়েছিলো, দুজনকে পুলিশ ধরে আনতে পেরেছিলো আর বাঁকি চারজনকে খুঁজে পেতে প্রায় মাস খানেক লেগেছিলো। শেষ পর্যন্ত ধরা তারা পড়েছিলো সকলেই। মেয়েদের বোধহয় এটাও এক জীবন, রাস্তাঘাটে সাবধানে চলতে হয় কুকুর দেখে, কে জানে! কখন যে কুকুরগুলো কামড়ে দেবে পেছন থেকে। মহল্লায় এ ঘটনার রেশ থেকেছে অনেকদিন ধরে।
শান্তা এতদিনে বুঝে গেছে – আসলে মিষ্টি তার চেহারা না, মিষ্টি তার শরীরটা; আর তার চারপাশে ঘুরঘুর করছে হাজারে হাজারে বিষপিঁপড়া।
২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২০
#গল্প
বিষপিঁপড়া
– যাযাবর জীবন
ছবিঃ নেট থেকে সংগৃহীত ।
loading...
loading...
অসাধারণ প্রকাশ।à
loading...
পড়লাম কবি।
loading...
বাস্তবতা।
loading...