৮৬।
রাশেদ সাহেব অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। আস্তে আস্তে তার অজান্তে দুচোখ টলমল করে উঠল। এইটুকু ছেলে বলে কি? তার কণ্ঠ চেপে আসল। মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না। মনি দেখ, এইটুক ছেলে বলে কি? মনে মনে মনিকে ডেকে এনে দেখিয়ে বললো দেখ এই ছেলে আমাকে কিভাবে সান্ত্বনা দিচ্ছে, আশার আলো দেখাচ্ছে, কি সব কথা বলছে! তার চেতনার মনি তার সাধনার মনি তার হৃদয়ের মনি। যে মনি বুক ভরা প্রশান্ত মহাসাগরের সমান নিস্তব্ধ ভালোবাসা নিয়ে তার পথ চেয়ে আছে। দেখ মনি এই এতটুকু ছেলে যখন বলছে তখন নিশ্চয়ই আমাদের একদিন এই অন্ধকার শেষ হয়ে আলোয় ভরা দিন আসবে। আমাদের সব কিছু শেষ হয়ে যায়নি।
-কিছু মনে করবেন না, আপকা আসু দেখকে মালুম হোতায় আপ ভাবীজীকো বহোত পিয়ার করতায়।
-চোখের পানি যে সেই জন্যে তা কি করে বুঝলে?
-কেন বুঝব না? যখনই ভাবীজীর কথা বলেছি তখনই আপনার চোখে পানি চলে এসেছে। রাশেদ সাহেব একটু লজ্জা পেয়ে ঘটনা আড়াল করার জন্যে বললেন-
-আরে না চোখে পানি এসেছে তোমার জ্ঞানের কথা ভেবে। দেখ প্রবীণ তুমি আমার সন্তানের চেয়েও বয়সে ছোট হবে তোমার মত এতটুকু ছেলের মুখে আমাকে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা শুনে আমি অবাক হয়েছি। তোমার প্রতি আমার মন ভীষণ রকম আবেগময় হয়েছে তাই চোখে পানি এসেছে। অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত তোমার দৃষ্টি, তুমি অনেক বড় হবে, তুমি মানুষের ভালোবাসা পাবে তোমার ঈশ্বর তোমাকে অনেক দূর নিয়ে যাবেন।
-আপনি এতো সুন্দর করে কথা বলেন এই জন্যে আপনাকে আমার খুব ভালো লাগে, আপনার এই চাওয়ার জন্যে অনেক ধন্যবাদ। আচ্ছা আমি যদি আপনার সাথে একটু কথা বলি আপনি কি বিরক্ত হবেন?
-আরে না না কি যে বল! বল কি বলবে।
-না তেমন কিছু না এই প্রেজেন্ট ওয়ার্ল্ড সিচুএশন নিয়ে একটু আলাপ করতাম।
-হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই।
-এই যে দেখেন আমাদের দেশে বলেন আর আপনাদের দেশে বলেন অর্থাৎ সারা পৃথিবীতেই আজকাল সবাই কেমন আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে কেও নিজের কথা ছাড়া অন্যের কথা ভাবে না।
-তুমি যে আজকালের কথা বলছ, তুমি কি আগের দিন দেখেছ? তুমি তার সাথে তুলনা করছ কি ভাবে?
-না দেখিনি, তবে এটা তো অনুমান করতে পারি যে আগে এরকম ছিলো না। আমি রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, পড়েছি, কৃষণ চন্দ্র পড়েছি। আমাদের সাহিত্য পড়েছি। বাবা মার কাছে শুনেছি, দাদার কাছে শুনেছি সেই যুগ আর এই যুগের ব্যবধান। সাহিত্য তো সবসময় সেই সময়ের বর্তমানের প্রেক্ষাপটে রচিত হয় কাজেই এই ডিফারেন্স থেকেই অনুমান করা যায়। তাই না?
-হ্যাঁ তা যায় কিন্তু তুমি যাদের কথা বলছ তারা কেও বাঙ্গালি, কেও পাঞ্জাবি, কেও তামিল। তুমি কিভাবে পড়েছ?
-কেন হিন্দি, নেপালি।
-ও আচ্ছা।
-হ্যাঁ যা বলছিলাম, আজকাল প্রতিযোগিতা এতো বেশি যে কেও কারো দিকে তাকাবার সুযোগ পায়না। জনসংখ্যা বেশি হয়েছে, সেই সাথে চাহিদা বেশি হয়েছে। চাহিদার ধরন, মাত্রা, প্রকার সবই বেশি হয়েছে। এমনকি বাবা মাও তার নিজের সন্তানের চাহিদা বুঝতে পারে না। যেমন আজকাল বাবা মা তাদের সন্তানকে নিজের কাছে রাখতে পারছে না। সে শিক্ষার জন্যেই হোক বা রোজগারের জন্যেই হোক, তাকে বিদেশে নয়তো দূরে কোথাও পাঠাতে হচ্ছে। সেখানে যাবার পর সে জায়গায় থাকতে থাকতে সেখানকার আবহাওয়া পরিবেশ, সে দেশের রীতিনীতি, সমাজ ব্যবস্থা ইত্যাদি বিভিন্ন কিছুর প্রেক্ষাপটে তার রুচির পরিবর্তন হচ্ছে, দৃষ্টি ভঙ্গির পরিবর্তন হচ্ছে, ছেলের চাওয়া পাওয়ার ধরন বদলে যাচ্ছে, বিরাট ব্যবধান তৈরি হচ্ছে যা তার বাবা মা কিছু জানতে এমনকি কিছু বুঝতেও পারছে না। এই ছেলে যখন তার মায়ের কাছে ফিরে যাবে তখন মা তার চেনা ছেলেকে ফেরত পায়না। যা পায় তা হলো এক নতুন ছেলে। কয়েক বছর আগে যে ছেলে মায়ের চেনা ছিলো সে এখন অচেনা মনে হয়। এ তো গেলো মা আর বাবা। তারা একে জন্ম দিয়েছে কাজেই তারা মেনে নেবার চেষ্টা করবে। কিন্তু বাইরের মানুষ? তারা এটা কেন মেনে নিবে? তৈরি হবে দ্বন্দ্ব, সংঘাত আর প্রতিযোগিতা। শুধু এই না, আরও অনেক কারণ আছে এরকম।
এই পর্যন্ত বলে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে আবার শুরু করল-
-একটু দেখেন চারিদিকে, কারণগুলি খুঁজে পাবেন। এইযে দেখেন আমি যখন নেপালে ছিলাম তখন কিন্তু আমি ড্রিঙ্ক করতাম না। কিন্তু এখন সপ্তাহে অন্তত একদিন ড্রিঙ্ক করতেই হয়। পাবে যাই, ড্রিঙ্ক করি নাচি। ভালো লাগে, বাবা মার কথা মনে হয়না, দেশের কথা মনে হয়না বেশ ভালো আছি। যখন দেশে যাব একদিন ড্রিঙ্ক করে এলেই মা কি সেটা মেনে নিবে? কিংবা ধরেন বিয়ে হলে আমাদের দেশের আলো বাতাসে বেড়ে ওঠা বৌ কি সেটা মানতে পারবে? অথচ দেখেন এখানে স্বামী স্ত্রী একসাথে পাবে যাচ্ছে, ড্রিঙ্ক করছে, নাচছে তারপর ট্যাক্সি করে বাড়ি ফিরছে। আবার মদের ঘোড়ে ঝগড়াঝাঁটি করে দুই জনে দুই দিকেও চলে যাচ্ছে।
-না আমাদের দেশের কোন মেয়ে এটা মেনে নিতে পারবে না।
-এইতো অবস্থা তখন আমি কি করবো? এই যে দেখেন আপনি আপনার বাবা মাকে যা দিচ্ছিলেন তাতে আপনি সুখী ছিলেন। ভাবছিলেন আপনার সামর্থ্য অনুযায়ী কর্তব্য ঠিক ভাবে পালন করে যাচ্ছেন কিন্তু তারা আপনার কাছে যেভাবে যা চাচ্ছিলেন তা তারা পাননি বলেই সংঘাতের সৃষ্টি এবং আপনার বিপদের দিনে তারা আপনাকে সাহায্য করেনি। এই যে আপনি আপনার স্ত্রী সন্তানদের ছেড়ে এখানে থাকছেন এজন্যে কি তারা কেও দায়ী নয় ভেবেছেন? এতে যে আপনার কত ক্ষতি হচ্ছে তা কি তারা জানে না? আপনার সন্তানদের মধ্যে এর প্রতিক্রিয়া কিভাবে পড়বে তা কি লক্ষ করেছেন? আজকাল বাবা কাছে থেকেও সন্তান মানুষ করতে পারে না, সেখানে আপনি কি ভাবে আশা করেন আপনার সন্তানেরা আপনার অবর্তমানে ঠিক ভাবে মানুষ হবে? আমি অবশ্য জানি না আপনি কোথায় কি ভাবে কি করেছেন বা এখানে কেন এসেছেন এটা আমার অনুমান থেকে বলছি।
-প্রবীণ তুমি যখন এত কথা বলেই ফেললে তাহলে শোন আমি সংক্ষেপে বলছি।
আমার বাবা চাচা যখন খুবই ছোট তখন আমার দাদা হঠাৎ করে মারা যান এবং খুবই স্বাভাবিক ভাবে আমার দাদি আধা ডোবা নৌকার মত দিশা হারা হয়ে পরেন। আর তখন আমার দাদার অন্য ভাইয়েরা আমার দাদিকে তাদের ইচ্ছা মত সামান্য কিছু দিয়ে বুঝিয়ে দেন। আমার দাদি ছিলেন খুবই উচ্চ বংশের মেয়ে তাই সে এভাবে ঘটনার শিকার হওয়া মেনে নিতে পারেনি। তার দুই ছেলেকে যেমন তেমন করে বড় করতে পারেননি। তিনি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিলেন। তিনি দেখলেন তার কাছে রেখে ছেলেদের মানুষ করতে পারবেনা। তাই তার ছেলেরা একটু বড় হলে তার দূরে দূরে থাকা দুই বোনের কাছে পাঠিয়ে দেন। এতিম অনাথ দুটি ছেলে অবহেলা অনাদরে অনেক কষ্ট সহ্য করে সেখানে বেড়ে উঠে এবং লেখা পড়া শিখে। এই জন্যে আমি চেয়েছিলাম এমন কিছু করবো এমন একটা অবস্থানে যাবো যেখানে আমার বাবা এবং চাচা তাদের হারান গৌরব ফিরে পান। তারা তাদের মুখের নিভে যাওয়া হাসি ফিরে পান। মানে আমার সম্পূর্ণ পরিবারটাকে তার হারান সম্মান ফিরিয়ে এনে একটা গুরুত্ব পূর্ণ অবস্থানে দাঁড় করাতে এবং তা যেন কোন অবস্থাতেই অন্যের গ্রাস কেড়ে নিয়ে না হয় সেই ভাবে। যেটা আমার, আমি যেটুক করেছি শুধু সেইটাই আমার হবে, আমারটাই যেন চারিদিকে ছড়িয়ে দিতে পারি। আশেপাশে সবাইকে নিয়ে চলতে পারি, পরিবারের সবাই মিলে সুখে শান্তিতে সম্মান নিয়ে, গৌরবজনক পরিচয় নিয়ে বসবাস করি, এই ছিলো আমার ইচ্ছা। এজন্যে চেষ্টা বল আর পরিশ্রম বল কোনটাই কম করিনি। ধৈর্যও আমার কম ছিলোনা।
কিন্তু আমার জন্মের সময় যে অগ্নিবীণা তার মধুর সুর ঝরিয়ে আমার আগমন বার্তা ঘোষণা করতে চাইছিলো কেমন করে যেন সেই তার ছিঁড়ে গিয়েছিলো। সেই ছেড়া তারের সুর আমার ভাগ্যের রিমোট কন্ট্রোল অপারেটরের রেজিস্টারে এন্ট্রি হয়নি। সে সংবাদ আমি জানতে পারিনি। ছেড়া তার দিয়ে কি করে আমি রাগিণীর সুর তুলি বল? শুধু বৃথা চেষ্টা করে গেছি। প্রচণ্ড ঝড়ে বিক্ষুব্ধ নদীর বুকে টলমল ভাসমান নৌকা যেমন তীরে ভিড়তে পারেনা বারবার ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে ঠিক তেমন করে আমিও ফিরে ফিরে এসেছি। যখন ধরে দাঁড়াবার মত কোন আশ্রয় অবশিষ্ট ছিলো না, আমার সব থাকতেও আমার দিকে আমার মত করে কেও তাকায়নি তখন এই যে আমি আজ তোমার সামনে বসে আছি।
রাসেদ সাহেব অনেকক্ষণ এক নাগারে কথা বলে একটু থামলেন।
-তুমি বস আমি একটু চা নিয়ে আসি।
-চলেন আমিও আসছি।
নিচে এসে দুই কাপ চা নিয়ে আবার উপরে আসলেন।
-এবার বল তুমি কি বলতে চাইছিলে।
-তাহলে দেখেন আমি যেরকম ভেবেছিলাম প্রায় সেরকম, আপনি এতদিন বাড়ির বাইরে থেকে কিংবা দেশের বাইরে থেকে যে অভিজ্ঞতা পেয়েছেন যা শিখেছেন যা দেখেছেন আপনার জীবনে তাই কাজে লাগাতে চেয়েছেন। আপনার ভিতরে হারানোর গ্লানি আপনাকে শান্তি দেয়নি, অস্থির করে রেখেছিলো। এটা আপনি ইচ্ছা করে না করতে চাইলেও আপনার অবচেতন মন থেকে আপনাকে সেই ভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে। ঠিক সেই রকম করে সাজাতে চেয়েছে। আপনার স্ত্রীকে যেরকম করে পেতে চেয়েছেন, আপনার সন্তানদেরকে যে ভাবে গড়ে তুলতে চেয়েছেন, আপনার পরিবারের জন্য হারান গৌরব উদ্ধার করতে চেয়েছেন। এটা আপনি ইচ্ছা করে করেননি। এটা আপনার দৃষ্টি ভঙ্গি পরিবর্তনের সাথে সাথে এধরনের মানসিকতা তৈরি হয়েছে। আপনার বাবা আপনার মাকে নিয়ে যেভাবে চলেছেন তিনি ভেবেছিলেন আপনিও সেইরকম হবেন। আপনার বাবা আপনাকে যেভাবে বড় করেছেন তিনি চাচ্ছিলেন আপনিও আপনার সন্তানকে সেইভাবে বড় করবেন। তিনি যেভাবে এতকাল চলে এসেছেন যা দেখে এসেছেন তার ধারনা ছিলো আপনিও সেইরকম হবেন। তার মনে হারানোর কোন গ্লানি জমেনি। সেদিকটা তিনি চোখ মেলে দেখেননি। তিনি অনেক অযত্ন অবহেলা বিড়ম্বনা পেয়েছেন। তিনি স্বাভাবিক জীবন পাননি। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার শক্তি সে পায়নি। কারণ তার মনে সেটা কোন দাগ কাটেনি। এসব কারণে তার মানসিকতা সঙ্কুচিত হয়ে গেছে, দৃষ্টি ভঙ্গি প্রসারিত হয়নি অথচ তিনি কিন্তু তা টের পাননি। অর্থাৎ এগুলি সব তার অজান্তে হয়ে গেছে। তাকে টিকে থাকার জন্যে অনেক যুদ্ধ করতে হয়েছে তাই জীবনে টিকে থাকাই তার কাছে কঠিন মনে হয়েছে। দেখেন পৃথিবী এর মধ্যে অনেক বয়স বাড়িয়ে ফেলেছে এবং ক্রমে ক্রমে তা বেড়েই চলেছে।
পৃথিবী সূর্য থেকে অনেক তাপ গ্রহণ করেছে। তার পেটের ভিতরে অনেক আগুন জ্বলেছে। কত বৃষ্টিতে ভিজেছে, কত বজ্রপাতে বিদ্ধ হয়েছে আবার কত তুষারপাতে জমেছে। তার বুকের উপর দিয়ে কত নদী সাগরে গিয়ে মিশেছে, সে কারো জন্যে থেমে নেই। তার উপরে এই যে মানব সন্তানেরা রয়েছে তারা অনেক কিছু আবিষ্কার করেছে। কত মারামারি, কাটাকাটি, রক্তারক্তি করেছে। কত উড়ো জাহাজ উড়েছে, কত রেল গাড়ি পৃথিবীর বুকের উপর দিয়ে ঘরঘর করে মাটি কাঁপিয়ে চলে গেছে, কত তেল জ্বলেছে, তেলের খনি গুলি শেষ হবার পথে। তেল ফুরিয়ে গেলে কিভাবে চলবে তাই নিয়ে গবেষণা চলছে, কত রেডিয়েশন হয়েছে, কত ঝড় বয়ে গেছে। গ্রিন হাউজ এফেক্টের ফলে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ফুটো হয়ে গেছে, সেখান দিয়ে সূর্য থেকে বিপদজনক রশ্মি আসছে। দয়া মায়া স্নেহ মমতা ভালোবাসা সূক্ষ্ম আবেগ অনুভূতি হাজার হাজার কোটি ভাগ হয়ে এখন প্রায় শেষ হবার পথে। যারা এই পৃথিবীতে নতুন আসছে তাদের ভাগে এগুলি ক্রমেই কমে আসছে। আবার ওদিকে অহংকার, হিংসা, ক্রোধ, লোভ এগুলি চক্রবৃদ্ধি হারে বৃদ্ধি পেয়েছে কারণ এগুলি হলো কালো শক্তি। মানুষ ক্রমেই কালো শক্তির ভক্ত হয়ে উঠছে, এর চর্চা চলছে বলে উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সহজেই মানুষের মাথার ভিতরে ঢুকে পড়ছে। কোটি কোটি মানুষ জায়গা বদল করেছে সে হিসাব কিন্তু তিনি মিলিয়ে দেখেননি। তার বাস্তব তার মনোমত হয়নি কারণ সে এগুলি বিবেচনা করেনি।
এইযে পার্থক্য, এই দূরত্বটাই সংঘাতের সৃষ্টি করেছে। আপনি হলেন পরিস্থিতির শিকার। আপনি বিদ্রোহের আগুন জ্বেলেছেন কিন্তু সে আগুনে আপনি নিজেই পুরেছেন। আপনার সঙ্গতি নেই, আপনি দুর্বল। সমস্ত দায়ভার আপনাকেই বহন করতে হবে। আপনার হৃদয়ে ভাঙ্গাচুরা যাই হোক তাতে কারো কিছু আসে যায়না, আপনার বাবা মারও না। আপনার সন্তানেরা গোল্লায় যাক তাতে তাদের কিছু যায় আসে না। তারা তাদের অহংকার, জেদ আর তাদের চির চেনার কালো চশমা পরে বসে আছে এবং থাকবে। তারা এক জায়গায় এসে থেমে গেছে। সেখান থেকে তাদের বেরিয়ে আসা কঠিন, তা তারা চাইবেও না। তারা চাইবে আপনাকে সেখানে নিয়ে যেতে কিন্তু আপনি তা পারবেন না। এখন কি হবে? সংঘাত আরও জোরদার হবে যার পরিণতি ভয়াবহ। এখন আপনি যা করছেন এটা কিন্তু এই সংঘাতের জের। আপনি কষ্ট পাচ্ছেন, আপনার স্ত্রী কষ্ট পাচ্ছে, সে আপনার ভালোবাসা পাচ্ছেনা আপনাকেও তার ভালোবাসা দিতে পারছেনা। আপনার সন্তানেরা কষ্ট পাচ্ছে, তারা বাবার আদর সোহাগ শাসন সব কিছু থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাতে কার কি হচ্ছে? এই বিশাল পৃথিবীর কে কার কি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সে খবর কে রাখে? আপনার নিজের আপন জনেরাই যখন তা দেখছে না আর কে দেখবে?
-আচ্ছা, তুমি যে বললে নেপালে থাকতে ড্রিঙ্ক করতে না তো এখন কর কেন? কি এমন প্রয়োজন?
-বুঝেন না? এটা হলো এদেশের পরিবেশ। পাবে না গেলে মেয়ে বন্ধু পাওয়া যায়না আর ড্রিঙ্ক না করলে পাবে গেলে কেমন দেখায়? এদিকে আবার মেয়ে বন্ধু না থাকলে মানুষে অন্যরকম ভাবে। কিছুদিন থাকেন এদেশে বুঝতে পারবেন। এ ব্যাপারে আমি আপনাকে কিভাবে বোঝাব আপনি আমার বাবার বয়সী কাজেই বাদ দেন এসব। চা খাবেন? চলেন আর একটু চা নিয়ে আসি।
-হ্যাঁ।
-তাহলে চলেন নীচে যাই।
সুইট্যাক্সের টিউবটা নিয়ে রাশেদ সাহেব বললেন-
-চলো। হ্যাঁ প্রবীণ, তুমি যা বললে এতক্ষণ সে সব কথাই সঠিক।
কথা বলতে বলতে নিচে নেমে আসছিলো। দোতলায় পৌঁছেই নুরুল ইসলামের সাথে দেখা।
-কি খবর ভাই সাব নতুন দোস্ত পাইছেন?
-না নতুন আর কি, আপনি চলে গেলেন।
-কোথায় যান, নিচে?
-হ্যাঁ একটু চা খেতে চাই আপনি খাবেন চলেন একসাথে খাই।
-না আপনারা খান।
নিচে এসে ইলেকট্রিক জগে পানি গরম দিল প্রবীণ। রাশেদ সাহেব দুইটা কাপ আর চা পাতা বের করে ওপাশের ফ্রিজ থেকে দুধের কন্টেইনার বের করে এনে টেবিলের উপরে রেখে আবার শুরু করলেন।
-হ্যাঁ প্রবীণ দেখ আমি তোমার কথার সাথে একমত। এই যে আমরা সিনেমা নাটক কিংবা উপন্যাসে দেখি নায়ক নায়িকার সমস্যা যেভাবে সমাধান হয় বাস্তবে যদি সেভাবে হোত তাহলে কিন্তু আমাদের জীবন অন্যরকম হোত।
-হ্যাঁ সেতো ঠিকই।
-কারণ এইসব ঘটনা লেখক বা পরিচালক কিংবা প্রযোজক এরা যেভাবে চায় সেই ভাবে হয় এবং তারা এই সব সমস্যার সমাধান আগে থেকে বের করে পরে সমস্যা তৈরি করে, কিন্তু আমাদের জীবন এদের দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয় না। আমাদের জীবনের লেখক বা পরিচালক তো ভিন্ন। সে যে ভাবে চায় আমাদের তাই হয়। সিনেমার চরিত্রের সংলাপ গুলি কেমন হবে লেখক দীর্ঘ দিন সে কথা ভাবে। সে ভাবার সুযোগ পায়। ভেবে ভেবে সে এগুলি সাজিয়ে নেয় যার জন্যে আমরা মনে করি বাহ! সুন্দর কথা বলেছে! কিন্তু বাস্তবে কি আমরা সেরকম সুযোগ বা সময় পাই? সেখানে আমরা পাই সামান্য কয়েক মুহূর্ত। তারপরে দেখ সিনেমাতে চরিত্রগুলি যে ধরনের সমস্যায় পড়ে সেগুলিও সেই ভাবেই সমাধান হয়। হয়তো দেখা যাবে নায়কের চাকরি চলে গিয়েছিলো কিছুদিন পরে আবার সে একটা ভালো চাকরি পেয়ে যায়। নয়তো বস তার ভুল বুঝতে পেরে তাকে আবার পুনর্বহাল করে নেয়। নয়ত সে একটা লটারি পেয়ে যায়। নয়তো কোথাও থেকে একটা সুযোগ পেয়ে যায়, বাস্তব কি এমন হয়? বাস্তবে আমাদের নিয়তি যেমন করে সাজিয়ে রেখেছেন তেমনটাই হয়।
-হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন। দেখেন এই যে আপনার জীবনে যা ঘটেছে সেটা যদি উপন্যাস হোত তাহলে আপনি যা ভাবছেন তাই হোত।
-মানে?
-মানে বুঝলেন না, হ্যাঁ আমি বলছি যে এখন আপনি সমস্যায় পরে আপনার স্ত্রী সন্তান সংসার ছেড়ে নিজের দেশ ছেড়ে এখানে এসেছেন। এখানে আসার আগে কি আপনি কম চেষ্টা করেছেন টিকে থাকার জন্যে? হয়তো আপনার বাবা কিংবা ভাই নয়তো অন্য কোন আত্মীয়ের কাছে সাহায্য চেয়েছেন কিন্তু পাননি। সিনেমা হলে এমন হোত না, কোন না কোন ভাবে কেও না কেও আপনাকে সাহায্যের হাত বারিয়ে দিত। হয়তো বা কোন শর্ত থাকতে পারতো। তবে যাই হোক আপনার কাজ চলে যেত। ঠিক এরকমই আপনি ভাবছিলেন কিন্তু তা পাননি। ফলে একান্ত নিরুপায় হয়ে এখানে আসতে বাধ্য হয়েছেন। এখানে আপনি কত দিন থাকবেন বা থাকতে হবে তার কোন সীমানা আপনার জানা নেই। এর ফল কি হবে? আপনার সন্তানেরা ঠিক ভাবে আপনার আদর্শ মত বড় হবে না, এর থেকে বঞ্চিত হতে থাকবে। আপনার আর তাদের মধ্যে দূরত্ব বেড়ে যাবে যা আপনি ধরে রাখতে পারবেন না। নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। তারা আপনার সম্পূর্ণ স্নেহ মমতা পাবে না। আপনার কাছে আবদার আহ্লাদ করতে পাবে না আপনার হাতের স্পর্শ পাবেনা। সারা জীবনে তাদের মনে একটা অতৃপ্তি, একটা অভাব থেকেই যাবে যা কেওই আর কোন দিন পূরণ করতে পারবে না। ঠিক এর বিপরীতে আপনিও তাদের এভাবে পাবেন না। আপনার মনেও একটা হাহাকার থেকে যাবে যা আর কোন অবস্থায় ফিরে পাবেন না। যেমন আপনি এইযে এখন চা খেতে এখানে এসেছেন, এখন যদি আপনার সন্তানেরা বা ভাবীজী থাকতো তাহলে কি আপনি এখানে এসে চা বানাতেন? না তা বানাতে হোত না। নেক্সট ফেস্টিভ্যালের সময় কি আপনার সন্তানেরা আপনাকে বলবে পিতাজী আমাকে এইরকম ড্রেস বানিয়ে দিতে হবে? আপনি কি তাদের সাথে নিয়ে ফেস্টিভ্যাল শপিং করতে যেতে পারবেন? পারবেন না। ফেস্টিভ্যালের সময় আপন জনের হাতে তার পছন্দের জিনিষ তুলে দেবার পর তার হাসিমুখ দেখে যে আনন্দ হয় সেটা আপনি পাবেন না। আপনি নিজে এবং আপনার স্ত্রী একটা হতাশা আর অস্থিরতায় ভুগতে থাকবেন। আপনারা উভয়েই উভয়ের অভাব ফিল করবেন। কোন কিছু ভালো লাগবে না। নিজেকে একটা মেশিনের মত মনে হবে, সব কিছু অসহ্য মনে হবে। এখানে কাজে মন বসাতে পারবেন না, মনের মধ্যে একটা ছটফট ভাব অনুভব করবেন, কোথাও স্থির হতে পারবেন না। আমিতো ছোট মানুষ যখন যেখানে খুশী চলে যেতে পারি এখানে ভালো লাগে না চলে গেলাম অন্য কোথাও। অফের দিনে পাবে যাই ড্রিঙ্ক করি নাচি গাই হৈচৈ করি ভুলে থাকার চেষ্টা করি। না পারলেও অভিনয় করি, না আমি ভালো আছি কিন্তু আপনি আমার মত এখান থেকে ওখানে যেতে পারবেন না। পাবেও যেতে পারবেন না। কি ভয়ানক কষ্ট ভেবেছেন? যত দিন থাকবেন এই কষ্ট, যন্ত্রণা বয়ে বেড়াতে হবে। কাউকে মন খুলে কিছু বলে হালকা হতে পারবেন না, নিজেও সইতে পারবেন না। কারণ এখানে আপনার মাপের মনের মত মানুষ পাবেন না যার সাথে মন খুলে কথা বলতে পারবেন। ভুল বললাম কিছু?
-না ঠিক বলেছ, তবে তোমার আবার কিসের কষ্ট তোমার ছেলে মেয়ে নেই তাদের উপর কোন দায় দায়িত্বও নেই, কোন দেনাও নেই, তাহলে?
-আছে আছে, সবার দায় কি এক রকম? একেক জনের একেক রকম।
-সেটা কি রকম বলা যাবে আমাকে? তবে তুমি বলতে না চাইলে শুনতে চাই না।
-বলা যাবে তবে চলেন উপরে যাই,
-হাতের খালি কাপটা ধুয়ে রেখে বললো চলেন রাত অনেক হয়েছে শুয়ে পরি। কাল আবার কথা হবে,
-হ্যাঁ চলো।
loading...
loading...
নক্ষত্রের গোধূলি'র জন্য এক বুক ভালোবাসা। শব্দনীড়ে যোগ হওয়ায় অভিনন্দন বন্ধু।
loading...
শুভেচ্ছা জানবেন কবি খালিদ ভাই।
loading...
পর্বটি বেশ বড় মনে হলো সমসাময়িক পর্ব গুলোর চাইতে। ধন্যবাদ ভাই।
loading...
ভালোবাসাময় ভালোবাসা কবি খালিদ ভাই।
loading...
অনেক অনেক শুভেচ্ছা প্রিয় কবি দা।
loading...