নক্ষত্রে গোধূলি-৬৩/২৫০

৮৩।
পরের অফ ডেতে সকালে উঠে নাস্তা সেরে দেরি না করে বেরিয়ে পরলেন অক্সফোর্ডের উদ্দেশ্যে। চেনা পথ, সেদিন যেখান থেকে গিয়েছিলেন সেই ভাবে এসে অক্সফোর্ড থেকে লন্ডনের রিটার্ন টিকেট কিনলেন। ফিরবেন আগামীকাল। গত সপ্তাহে ফিরোজের সাথে কথা হয়েছে। ও বলেছে সরাসরি ব্রিকলেন যেতে। ওখান থেকে কাজ সেরে তারপর বাসায় আসবে। রাতে ওখানে থাকবে পরদিন সকালে অক্সফোর্ড চলে আসবেন।
বেকার স্ট্রিটে নেমে গেলেন কোচ থেকে। টিউব স্টেশন খুঁজে পাচ্ছিলেন না। এদিক ওদিক তাকিয়ে কূল কিনারা না পেয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করলে সে দেখিয়ে দিল। ঐ যে সামনে দেখা যাচ্ছে, ডানদিকে রাস্তার ওই পাশে। টিউব স্টেশনে পৌঁছে প্রথমে একটা ম্যাপ নিয়ে দেখে নিলেন ব্রিকলেন যেতে হলে এখান থেকে হ্যামারস্মিথ লাইন ধরে অল্ডগেট ইস্টে নামলেই হবে। হিসেব করে জোন এক এবং দুই এর একটা ডে টিকেট নিয়ে নিলেন।
ব্রিকলেন পৌঁছেই সোজা চলে গেলেন চেনা সেই জব সেন্টারের কাছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলেন আরও কয়েকটা জব সেন্টার আছে। তার কাছে সবই সমান। এর আগে যেটায় গিয়েছিলেন সেখানে গেলেন না। অন্য আর একটায় ঢুকলেন। সামনে কয়েকজন দাঁড়ানো। একটু পরেই টেবিলে বসে যে এতক্ষণ অন্যদের সাথে কথা বলছিলো, সে এবারে তাকে বললো-
-বলেন ভাই কি করতে পারি।
-একটা কাজ দরকার।
-সামনে না পিছনে?
-সামনে।
-আগে করেছেন কখনো?
একটু থতমত খেয়ে গেলেন হঠাৎ করে ডাহা একটা মিথ্যা মুখ দিয়ে বের হতে চাইল না। জীবনে যা কখনও করেননি যা তিনি মনে প্রাণে ঘৃণা করেন আজ তাই বলতে হবে। সারা জীবন ভরে ন্যায় নীতির বোঝা মাথায় নিয়ে বেড়িয়েছেন। মিথ্যাই যদি বলতে হবে তাহলে এদেশে কেন এলাম? নিজের দেশে যেখানে ছিলাম সেখানে প্রমোশন হোত, বেতনের বাইরেও বেশ কিছু পেতে পারতাম। না, যা চাওয়া যায় তা পাওয়া যায় না। সবাই যেভাবে চলতে চায় সেভাবে চলতে পারে না। এজন্যে চেষ্টার সাথে আরও কিছু প্রয়োজন আর সম্ভবত তা হচ্ছে সাহস, এমন সাহস রাশেদ সাহেবের নেই। দেরি হয়ে যাচ্ছে। প্রবীণের কথা মনে পরে গেলো। মিথ্যা কথা চকচকে হয় তাই সবাই পছন্দ করে। হ্যাঁ, সে তো একথা মেনে নিয়েই এসেছে। মিথ্যা কথা বলবে।
এখন দ্বিধা করার কি দরকার?
-হ্যাঁ করেছি দুই মাস।
-আচ্ছা একটু বসেন।
আশে পাশে দেখলেন বসার কোন জায়গা নেই, একটু সরে দাঁড়ালেন। এবারে অন্যদের কথাবার্তা শুনতে লাগলেন কে কিভাবে কি বলছে। তিন চার জনের সাথে আলাপ সেরে টেবিলের ওপাশে বসা লোকটা এবারে টেলিফোন ধরে কার সাথে যেন আলাপ শুরু করলো। মাঝে মাঝে রাশেদ সাহেবের দিকে তাকাচ্ছে। এবারে তাকেই উদ্দেশ্য করে বললো-
-এই যে ভাই স্কটল্যান্ডে যাবেন?
রাশেদ সাহেব বুঝতে পারলেন না। পাশে দাঁড়ানো এক জন জিজ্ঞেস করলেন আপনার ফ্যামিলি কি এখানে, মানে লন্ডনে?
-না এখানে আমার কেও নেই।
-তাহলে আপনার জন্য কাছে আর দূরের মধ্যে কোন তফাত নেই রাজী হয়ে যান, ওখানে ভালো পয়সা দেয় তবে শীত বেশী।
টেবিলের ওপাশের লোক আবার বললেন -কি বলেন ভাই, যাবেন?
-হ্যাঁ যেতে পারি।
-তাহলে এই যে নেন মালিকের সাথে কথা বলেন।
টেলিফোনের রিসিভার এগিয়ে দিল।
-হ্যালো,
ওপাশ থেকে প্রশ্ন, -আপনি কতদিন এই কাজ করেছেন?
-বেশি দিন না মাত্র দুই মাস।
-আচ্ছা, কবে আসতে পারবেন?
-আমি অক্সফোর্ডে এক জায়গায় কাজ করছি তাদেরকে তো এক সপ্তাহ সময় দিতে হবে, আগামী মঙ্গল বারের আগে পারা যাবে না।
-আচ্ছা ঠিক আছে আপনি মঙ্গলবারেই আসেন।
-ঠিক আছে আসতে পারব।
এমন সময় টেবিলের ওপাশের লোকটা বলে দিল বেতনের কথা জিজ্ঞেস করেন।
-আচ্ছা বেতনের ব্যাপারটা বলা যাবে?
-হ্যাঁ, দেখেন আপনি নতুন মানুষই বলা যায়, কাজেই আমি একশ চল্লিশ পাউন্ডের বেশি দিতে পারব না আপাতত।
-আচ্ছা ঠিক আছে।
-তাহলে এই কথাই রইলো আগামী মঙ্গল বারে আসবেন।
-হ্যাঁ ঠিক আছে, তবে কি ভাবে যাবো ওখানে?
-ভিক্টোরিয়া থেকে ওবান এর টিকেট করবেন। দশ বারো ঘণ্টা লাগবে। সন্ধ্যায় যাত্রা করলে সকালে এসে পৌঁছবেন। এখানে এসে ফোন দিবেন। ঠিকানা ফোন নম্বর সামাদ ভাইয়ের কাছ থেকে নিয়ে নিবেন, আচ্ছা সামাদ ভাইকে দেন একটু আমি বলে দেই।
-এই যে নেন
বলে রিসিভারটা লোকটার হাতে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। সামাদ ভাই কথা শেষ করে রাশেদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললো-
-এই যে ঠিকানা আর ফোন নম্বর লিখে নেন।
এক টুকরো কাগজ আর কলম এগিয়ে দিল। ওগুলি লেখা হলে বললো দেন বিশ পাউন্ড দেন। রাশেদ সাহেব ঠিকানা লেখা কাগজ পকেটে রেখে ওয়ালেট বের করে দশ পাউন্ডের দুইটা নোট বের করে এগিয়ে দিয়ে বের হয়ে এলেন। বাইরে এসে মনে হলো মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছেন। একটা তৃপ্তির নিশ্বাস ফেললেন। দেলু মিয়ার গালাগালির হাত থেকে মনে হচ্ছে এবারে রেহাই পাবেন। কোন রকমে এই কয়টা দিন কাটাতে পারলেই হলো। হাড় কাঁপানো শীতের মধ্যে অফিসের নিচে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট বানিয়ে আরাম করে টানলেন। তারপরেও অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েই রইলেন। মুক্তির আনন্দে যেন শীত লাগছে না তবে মনে হচ্ছে ক্ষুধা লেগেছে। হা্তের ঘড়ি দেখে ভাবল ক্ষুধা লাগবেই অন্ধকার হয়ে গেছে, চারটা বাজে। এতক্ষণ নিষ্কৃতির একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিলাম বলে বুঝতে পারিনি। কি খাবো, কি পাওয়া যায় এখানে? এইবার দেখতে পেলেন আশেপাশে অনেক রেস্তোরা আর ফাস্টফুডের দোকান। আগেও ছিলো তখন চোখে পড়েনি। মেইন রোডের দিকে এগিয়ে গেলেন। এবারে হাতের ডানে একটা ফাস্টফুডের দোকানের সামনে এসে একটা চিকেন এন্ড চিপস আর এক ক্যান ডায়েট কোক নিয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে আরাম করে নিশ্চিন্তায় আস্তে আস্তে খেলেন। কোন তারা হুড়ো নেই। খেতে খেতে মনে হলো বাসায় যাবার আগে ফিরোজকে একটা ফোন করে যাই যদি আরও কিছু করতে বলে। খাওয়া শেষ হলো। কোকের ক্যানে শেষ চুমুক দিয়ে বিনে ফেলে দিয়ে আবার একটা সিগারেট বানালেন। রাস্তার পাশে একটা ভাঙ্গা বেঞ্চের পাশে বসলেন। মনের আনন্দে অনেকক্ষণ ভরে সিগারেট টানলেন।

৮৪।
এদেশের প্রথম কর্মজীবনে রেস্টুরেন্টের বিভীষিকাময় দিন গুলো থেকে মুক্তির উল্লাস। প্রাচীন যুগের ক্রীতদাসদের কথা মনে হলো। অনেক দূরে চলে গেলেন, অনেক দূরে! ক্রমে মনটা আনন্দ থেকে আবার বিষাদে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো। ওহ! ফোন করা হয়নি এখনও। উঠে ফোন বুথ খুঁজে পেলেন।
-হ্যালো,
-ভাবী, আমি এখন ব্রিকলেনে একটু পরেই আসছি। ফিরোজ কোথায়?
-এইতো, বাসায় আছে দিচ্ছি, আপনি চলে আসেন তাড়াতাড়ি।
-হ্যাঁ ফিরোজ, তোমার কথা মত আজ সকালে এসেছি।
-কাজ পেয়েছ?
-হ্যাঁ।
-কোথায়?
-স্কটল্যান্ডে।
-বেশ ভালো, তুমি কোথায় এখন?
-ব্রিকলেনেই আছি।
-চলে আস।
-আসছিলাম, হঠাৎ মনে হলো তুমি যদি আর কিছু করতে বল তাই জানার জন্যে ফোন করে নিলাম।
-না আর কিছু করতে হবে না, তুমি চলে আস আমি বাসায় আছি।
বাসায় আসতে আসতে মনে হলো রাত গভীর হয়ে গেছে অথচ রাত এখন মাত্র ছয়টা। প্রচণ্ড শীত। ফিরোজ বসেই ছিলো, সব কিছু শুনে বললো –
-তুমি আজ এখনই ফোন করে নোটিস দিয়ে দাও।
-হ্যালো, ওসমান ভাই, আমি রাশেদ বলছি।
-হ্যাঁ ভাই, বলেন কি খবর?
-ভাই আমি আগামী রবিবারের পর আর কাজ করব না আপনারা মানুষ দেখেন।
-কেন কি ব্যাপার, কি হয়েছে?
-না কিছু হয়নি এমনিই আমার ভালো লাগছে না তাই।
-আপনি কবে আসবেন?
-কাল বিকেলে।
-ঠিক আছে আসেন তারপর দেখা যাবে।
-তাহলে তুমি সামনের সোম বারে আসছ?
-হ্যাঁ, তাই আসছি তবে ঐ দিনেই আমাকে রওয়ানা হতে হবে।
-হ্যাঁ তাই কর।

রেস্টুরেন্টে ফিরে এসে সন্ধ্যায় যথারীতি কাজের জন্যে নিচে নেমে এলেন। হাতের কাজ গুছিয়ে নেবার আগেই লন্ডন থেকে সেফ এসে কিচেনে ঢুকেই সরাসরি রাশেদ সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো-
-কি ব্যাপার বেয়াই, আপনে নাকি চলে যাবেন?
-হ্যাঁ ভাই।
-কেন কি হয়েছে, আমরা কি করেছি, কেন যাবেন?
-না কিছুই হয়নি এমনিই আমার ভালো লাগছে না তাই, অন্য কিছু না।
-না আপনাকে তো আমরা যেতে দিব না, কেন যাবেন, সামনে কাজ করবেন, কিচেনে কষ্ট হচ্ছে? তাহলে বলেন কাল থেকেই আপনাকে সামনে পাঠিয়ে দিব।
এমন সময় আনোয়ার এসে হাজির।
-কি ব্যাপার কি হয়েছে?
-আরে দেখেন না বেয়াই সাহেব থাকবে না চলে যাবে।
-কেন, কি ব্যাপার ভাইসাব কি হইছে যাইবেন কেন?
-না ভাই তেমন কিছু না উনাকে বলেছি আমার ভালো লাগছে না তাই।
-আরে না, বললেই হইলো আপনাকে ছাড়া হবেনা, কি ভাবে যাইবেন?
-না ভাই একথা বলবেন না, আমি কাজ কর্ম পারছি না। আমারও কষ্ট হচ্ছে আপনাদেরও অসুবিধা হচ্ছে। আমি চলে গেলে ভালো লোক পাবেন।
-না তা হবে না, আমাদের তো ভালো লোকের দরকার নেই, আমাদের চাই আপনাকে।
-না ভাই আমি পারছি না।
-তাইলে যাইবেনই?
-জি ভাই।
-কবে যাইবেন?
-এইতো সামনের রবিবার পর্যন্ত আছি।
-আচ্ছা, এর মধ্যে দেখেন যদি মনের পরিবর্তন করতে পারেন তাইলে এইখানেই থাইকেন, আসলে আপনারে আমাদের ভালো লাগছে তাই ছাড়তে চাইনা।
রাশেদ সাহেব মনে মনে ভাবলেন এই কথাটা আগে থেকে ভাবলেই হোত। তাহলে এত গালাগালি কেন? এখন আর সম্ভব নয়, আমি যে ওখানে কথা দিয়েছি ওই লোক অপেক্ষা করবে।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৬ টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ৬ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ০১-০১-২০২০ | ১১:০৯ |

    GD Star Rating
    loading...
  2. সৌমিত্র চক্রবর্তী : ০১-০১-২০২০ | ১২:০৬ |

    নতুন বছরের শুভকামনায় ভালোবাসা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

    GD Star Rating
    loading...
  3. সাজিয়া আফরিন : ০১-০১-২০২০ | ১৩:২২ |

    অনেক অনেক শুভেচ্ছা খালিদ ভাই। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    GD Star Rating
    loading...
  4. রিয়া রিয়া : ০১-০১-২০২০ | ১৬:৫৫ |

    অনেক অনেক শুভেচ্ছা প্রিয় কবি দা। শুভ নববর্ষ। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    GD Star Rating
    loading...
  5. সুমন আহমেদ : ০১-০১-২০২০ | ১৭:৩৬ |

    Happy New Year 2020. Congratulations. https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gif​​​​​​​

    GD Star Rating
    loading...
  6. আনু আনোয়ার : ০১-০১-২০২০ | ১৯:০৫ |

    হ্যাপী নিউ ইয়ার ২০২০। 

    GD Star Rating
    loading...