ইফতির কাশিটা আগের থেকে বেড়েছে; রাতে ঘু্মোতে গেলে এপাশ ওপাশ করছে। যে কাতেই শোয় না কেনো শরীর যেন কোন ভাবেই স্বস্তি দিতে পারছিল না, মাঝে মাঝে উঠে বসে থাকতো। মাঝ রাত্তিরে মীরাকে ডেকে তুলবে সে সাহস হচ্ছে না কিছুতেই; মেয়েটা সারাদিন বাইরে কাজ করে বাড়ি ফিরে। এরপর বাচ্চা
সামলানো, রান্না করা, সব নিজের হাতেই করছে।
ইফতি নিজেই বুঝতে পারে, সে একটা বাড়তি বোঝা নিজের সংসারেই কিন্তু কোন ভাবেই নেশাটা ছাড়তে পারছে না। সেদিন অফিস থেকে ফেরার পথে জামালের দোকানে গিয়েছিল, বেশ পুরনো বন্ধু। খুব আবদার জুড়ে দিল, “এতোদিন পর আসছিস দোস্ত, একটু বাংলা খা।” ইফতি খানিক ইতস্তত করছিল, কারণ তখন অব্দি তার গাঁজার নেশা ছাড়েনি, তার মধ্যে বাংলা মদ পড়লে পেটের অবস্থা কী হবে তা নিয়ে খানিকক্ষণ চিন্তা করলো। আবার নিজেই নিজেকে শান্তনা দিয়ে বললো, – “কী আর হবে, গ্যাস্ট্রিকে আবার ব্যথা উঠলে অষুধ খেয়ে নেব।”
ডাক্তার বহু আগেই ইফতির আলসারের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে চিকিৎসা নিতে বলেছিলেন; কিন্তু অতো গুরুত্ব দেওয়া তার পক্ষে মোটেও সমীচিন মনে হয়নি। “ডাক্তারের কাছে গেলে এমন দুই চার খানা টেস্ট না দিলে তাদের ওয়েট থাকে না – “এই বলে সে দিনের মতো মীরাকে নিয়ে ফিরে এসেছিল। এক কাপ দুধ অব্দি যে ছেলের পেটে সয় না, সে প্রায়শই দেশি বিদেশি যখন যা পাচ্ছে কিনে গিলছে। এই দেখে দেখে মীরা এখন বিরক্ত; মেয়ে বড় হচ্ছে; সামনে অনেক টাকা কামাই করতে হবে। এই সব কথা এখন বাসী ভাতের মতো পঁচে গেছে।
জামালের আখড়া থেকে বেড়িয়ে বড় রাস্তাটা পার হবার সময় ঘটলো বিপত্তি, কোন কিছু বুঝে উঠবার আগেই মাথা ঘুরে পড়ে গেল ইফতি, তখন বেশ রাত হয়ে গেছে, কিন্তু শহরে দু’চারজন মানুষ জুটে গেল। তারাই ধরাধরি করে ভর্তি করে দিল এলাকার একটি হাসপাতালে। কিন্তু এমন রোগীতো আর অভিভাবক ছাড়া বেডে নেওয়া যায় না, পুলিশ কেস হতে পারে। ইফতির পকেট থেকে অফিসের আইডি কার্ড বের করে নিল নার্স; সোজা ফোন বেজে উঠলো ইফতির অফিসের টেবিলে। ব্যস যা হবার তাই, পরদিন অফিস শুদ্ধ এমপ্লয়ি জেনে গেল ইফতিকে মাতাল অবস্থায় পাওয়া গেছে রাস্তায়। এম ডি সাহেবের ফোন পেয়ে খুব অবাক হলো মীরা, এতো রাতে ভাই কী মনে করে কল দিয়েছেন। মনে মনে ভাবতে ভাবতে হ্যালো বলতেই ওপাশের কড়া কণ্ঠ, – “সরি ভাবি, আপনাকে এভাবে কল দিতে চাইনি; তবে এর আগেও ইফতি সম্পর্কে অনেক তথ্য পেয়েছি এবং তাকে বহুবার অফিসিয়ালি আমি ওয়ার্নিং দিয়েছিলাম। সে তার কথা রাখেনি; নিজের ইচ্ছে মতো অফিস থেকে বের হয়ে যায়, একাউন্টস থেকে মাস শেষ হবার আগেই টাকা নিয়ে যায়, আমি ভাবতাম বুঝি বাচ্চার জন্য, এখন দেখছি নেশার পেছনেই তার সব খরচ !”
মীরা চুপ করে শোনে; কারণ এটা তার জন্য নতুন কোন তথ্য নয়। বিয়ের দিন রাতে যখন ইফতি বাসর ঘরে প্রবেশ করছিল না, তখন উৎসুক ননদিনী এসে উঁকি
দিল, – “ভাইয়ার জন্য অপেক্ষা করছো ভাবি, কোন লাভ নাই।”
মীরা শুধু অবাক হয়ে তাকালো, “কেন, কী হয়েছে ?”
ভেংচি কাটার মতো মুখ করে মেয়েটি বলে গেল, – “ও, তুমি দেখছি কিছুই জানো না, ভাইয়া এই সময় ফুয়াং ক্লাবে থাকে। ফিরতে ফিরতে সকাল। তুমি ঘুমাও। কিছু লাগলে আমাকে ডাক দিও।” কথাগুলো ঈশিতা এমন ভাবে বলে গেল যেন ক্লাবে যাওয়া আর মসজিদে যাওয়া এক কথা। এই বাড়িতে ঢোকার পর সে প্রথম জানতে পারলো ইফতি শুধু নেশাই করে তা নয়, তার সাথে আনুসঙ্গিক অনেক নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি তার আসক্তি শুধুমাত্র নারী আসক্তি ছাড়া। আর এই নারী আসক্তি এতোই কম ছিল যে মীরার মতো একজন অপরূপা তরুণী ইফতির দৃষ্টি আকর্ষণে ব্যর্থ হলো।
ওয়্যারড্রবের ওপরের ড্রয়ারে কাগজের ভাঁজে যে গোলাপী বস্তুটি রাখা থাকে তাকে ইয়াবা বলা হয়, এই তথ্য মীরা প্রথম জানলো তার ছোট বোনের কাছ থেকে। বোনের বাড়িতে দু’দিনের জন্য বেড়াতে এসে মিমি দেখলো – দুলাভাই সারা রাত জেগে বই পড়ে। “এতো কি পড়েন দুলাভাই ?” – প্রশ্ন করলেও সঠিক উত্তর ঠিক মতো পাওয়া যায় না। ইফতির চেহারার মধ্যে দুলাভাই সূচক কোন আভাস নেই। সে কেবল আড় চোখে শালিকে দেখে নেয় ,তারপর বই বন্ধ করে চোখ বুজে থাকে। মিমি বোঝে, ইফতি মোটেও ঘুমায়নি, কারণ তার বাম পা অবিরত তখন নড়ছে। ইফতি আসলে এতো রাত জেগে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে কী করে, সেটাই তার জানার আগ্রহ ছিল। একটু হাতাহাতি করে মিমি পেয়েও গেল সেই বিষাক্ত দ্রব্য হাতের মুঠোয়।
মীরা কখনো ইয়াবা দেখেনি, খবরে মাঝে মাঝে ইয়াবা ব্যবসার প্রসার সম্পর্কে জেনেছে। তাই খুব অবাক হয়ে মিমিকে জিজ্ঞেস করল, “ইফতি বলে, এটা খেলে
নাকি তিন রাত ঘুম হবে না, ও যখন লম্বা জার্নি করে তখন খায়।” মীরার বোকামি দেখে খুব রাগ হয় মিমির, “কী পড়া লেখা করেছো তুমি, এটা ইয়াবা আপু। সর্বনাশা, মানুষকে শেষ করে দেয়। প্রথম প্রথম সবাই খায় রাত জেগে কাজ করবার জন্য, কিন্তু এটা আসলে ভয়াবহ নেশা। ধীরে ধীরে মানুষের শরীরকে গ্রাস করে ফেলে।” মীরা এতো কিছু বোঝে না। সেদিন হাসপাতাল থেকে ছাড়িয়ে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছিল মীরার। ডাক্তার বার বার বলছিলেন, – “আপা, আপনি চাইলে আপনার হাজবেন্ডকে রিহ্যাবে দিতে পারেন, আমার পরিচিত।”
কিন্তু ইফতির বাবা মা কিছুতেই ছেলেকে রিহ্যাবে পাঠাবে না, এক মাত্র ছেলের কোন অযত্ন তারা চায় না। উত্তরে বলে দেয়, – “আপনি রিলিজ দিয়ে দেন, বাড়ির ছেলে বাড়ি ফিরে যাক।” বাড়ির ছেলে বাড়ি ফিরলো ঠিকি, মাঝখান থেকে ভালো চাকরিটা খোয়ালো। সারারাত জেগে এই অস্বাভাবিক কাশি আর সারাদিন চোখ বুজে ঝিমানো ছাড়া আর কোন কাজ নেই। মীরা জব ছাড়েনি; সংসার তো চালাতে হবে। এখন এই সময়ে শ্বশুর শাশুড়ির ওপর পুরো নির্ভরশীল হয়ে গেলে তো চলবে না। তারা নিজের বাড়ি বরগুনা চলে গেছে, ওখান থেকেই ছেলের যখন যা লাগে দিচ্ছে; তাই বলে সংসারের খরচ কাওকে দিতে বলা ঠিক না।
মীরা ইচ্ছে করলে মেয়েকে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে যেতে পারে; কিন্তু ভাবীরা এই নিয়ে বাজে কথা শোনাবে তাই আর ও পথে যাওয়া হয় না। ইফতির শরীর দিন দিন খারাপ হচ্ছে, কিন্তু সন্ধ্যার আলো নামতেই সেই ধোঁয়া তোলা নেশার দ্রব্য নিয়ে বসা সে ছাড়তে পারেনি। মীরা প্রথমে ভেবেছিল, কন্যা সন্তান কোলে নিয়ে ইফতি সমস্ত নেশা ভুলে সংসারে মন দেবে কিন্তু তার এই যেচে পড়ে মা হবার প্রক্রিয়াও কোন কাজে আসেনি। বিয়ের প্রথম রাতেই যেমন নির্বিকার ছিল ইফতি, আজো তাই।
ছোট্ট অর্থিকে রাখবার জন্য একজন কিশোরীকে রাখা হলো বাসায়; সেই মেয়েকে গোসল করায় খাওয়ায়। মীরা অফিসে চলে গেলে তার মা রাহেলা বেগমের কাছে মেয়েকে দিয়ে যায়। অফিস থেকে ফেরার পর মা নিজ বাড়িতে ফিরে যান। এভাবে ভালোই চলছিল, কিন্তু একদিন হঠাৎ ইফতি শাশুড়িকে বলে, – “মা, অর্থিকে তৈরি করে দেন, আমি ওকে নিয়ে বোটানিক্যাল বেড়াতে যাব।”
রাহেলা প্রথমে ভীষন অবাক হন, – “এইটুকু বাচ্চা মেয়ে, গার্ডেনের কী বুঝবে ?”
ইফতি ভালোই জোর করে, – “সারাক্ষণ বাসায় বসে থাকতে ভালো লাগে না মা, যাই মেয়েকে নিয়ে ঘুরে আসি।” অনেকটা জবরদস্তি করেই দেড় বছরের অর্থিকে নিয়ে ইফতি বাইরে বেড়িয়ে আসে।
রাহেলা বেগম ঘরে গিয়ে দেখেন অর্থির কাপড় চোপড় কিছুই নাই, এমন কী ছোট ব্যাগটাও গায়েব। নেশাগ্রস্ত ছেলেটা এতোটুকু বাচ্চা নিয়ে কোথায় গেল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেন, পরে ভয়ে ফোন দেন মীরার মোবাইলে, – “মীরা, ইফতি অর্থিকে নিয়ে বাইরে গেছে।” মীরার স্বাভাবিক প্রশ্ন, – “দোকানে গেছে, চলে আসবে মা।”
রাহেলা থরথর করে কাঁপছেন, – “না, অর্থির কাপড় চোপড় নিয়ে গেছে।”
এবার গলা শুকোনোর পালা মীরার, – “কী বলছো মা ? ওরতো নেশা করলে কোন সেন্স থাকে না, শেষে আমার মেয়েটাকে যদি বিক্রি …”
কথাটা আর শেষ করতে পারে না মীরা, টেক্সি ডেকে সোজা বাড়িতে চলে আসে। কাকে ফোন দেবে, কোথায় খোঁজ নেবে ? পাগলের মতো এলোমেলো কল দিতে থাকে মীরা। ঢাকায় ইফতির সব আত্মীয়ের বাসায় দেয়, কিন্তু কেও কিচ্ছু বলতে পারে না। সে ভুলেও ভাবতে পারে নি ঢাকা থেকে ৫ ঘন্টার পথ পেরিয়ে ইফতি তার বুকের মানিককে নিয়ে তার গ্রামের বাড়ি চলে যাবে। সারাদিন উৎকণ্ঠার পর শেষে ফোনটি আসে, – “আমি অর্থিকে নিয়ে আব্বা আম্মার কাছে আছি।” এরপর সব চুপ, কথা কেটে যায়। ফোন হাতে নিয়ে বোবা মূর্তির মতো বসে থাকে মীরা।
ঢাকা থেকে ৫/৬ ঘন্টার পথ, বরগুনা। এতো অল্প সময়ের মধ্যে এসি গাড়ির টিকিট পাওয়া গেল না। ইফতির গ্রামের বাড়িতে যাব যাব করেও সময় করে যাওয়া হয়নি মীরার এর আগে। ঠিকানা কাকে জিজ্ঞেস করবে বুঝতে পারছে না, ওর খালাতো বোন– দুলাভাই, মামা মামীকে বেশ ক’বার ফোন দেওয়া শেষ।
তাদের একটাই উত্তর, – “দেখো, এগুলো তোমাদের পারিবারিক ব্যাপার, আমরা কথা বলতে গেলে ওরা রাগ করতে পারে।” – “মামী, ইফতি আমার এক বছরের বাচ্চাকে না বলে নিয়ে গেছে, মেয়ে আমার বুকের দুধ পাচ্ছে না, এটা ক্রাইম” – মীরা এক নিঃশ্বাসে বলে। মামী শাশুড়ির উত্তর, – “বাবা তার মেয়েকে ঘুরতে নিয়ে গেছে, একে ক্রাইম বলো কিভাবে ?” মীরা বুঝতে পারে এদের কাছ থেকে কোনই সহযোগিতা পাওয়া যাবে না। কিন্তু ইফতিতো তাকে বলে ছুটির সময় মা মেয়ে দু’জনকেই গ্রামে নিয়ে যেতে পারতো। তা না করে অর্থিকে লুকিয়ে নিল কেন !! তাদের মধ্যে এমন কোন বড় ঝগড়া হয় নি। নিশ্চই এর পেছনে অন্য কারণ আছে। কারণ পাওয়া গেল ইফতির কথার স্বরে। মীরা ফোনে অনুনয় করতে থাকে – “আমার মেয়েটাকে আমার বুকে ফিরিয়ে দাও ইফতি, বুকের দুধ গলে পড়ে যাচ্ছে, মেয়ে আমার খেতে পারছে না।” ইফতির মধ্যে এই নিয়ে কোন মাথা ব্যথা নেই, সে ঠান্ডা জবাব দিল – “তুমি সারাদিন কাজ করো, অর্থিকে রাখার সময় পাওনা, ও আব্বু আম্মুর কাছেই থাক। তুমি পারলে চলে আসো।”
মীরার কণ্ঠে বিরক্তি, – “এইগুলা কী বলো ইফতি, এতো ভালো বেতনের কাজ ছেড়ে আমি গ্রামে চলে আসবো ? ওখানে গিয়ে আমি কি করবো ? ইফতি রেগে যায়, – “এটা গ্রাম না, মফস্বল, অনেক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল আছে, বাচ্চাদের পড়াবা।” মীরা খুব বিরক্তি দেখায় – “আমি একটা ইন্টারন্যাশনাল ফার্মে কো-ওর্ডিনেটর হিসেবে আছি, তুমি জানো আমার মাসে বেতন কতো, এই দিয়েই আমাদের সংসার চলছে, তুমি কি বলছো বুঝতে পারছো ? আই ওয়ান্ট মাই চাইল্ড ব্যাক।” ইফতি ফোন রেখে দেয়। তারপর রাত্রি আরো ঘন হতে থাকে। অর্থি বুকের দুধ ছাড়া থাকবে কী করে, মীরা সারারাত বারান্দায় বসে কাটিয়ে দেয়।
.
আগামী পর্বে সমাপ্য।
loading...
loading...
জীবন। তিক্ততা। এই একটি জীবনে মানুষের কত কিছুরই না অভিজ্ঞতা সংগ্রহ হয়।
loading...
তিক্তময় জীবন এখানে কারো কারো। তাই নিয়েই আমার গল্প।
loading...
ইফতি ক্যারেক্টারটি দুঃখজনক পর্যায়ের। মীরাকে ভীষণ অসহায় লেগেছে। সামনে পড়তে চাই।
loading...
loading...
মীরার এই অসহায়ত্ব হৃদয়ে নাড়া দিলো। জীবনের মহাযুদ্ধে মীরা'কে জিততেই হবে।
loading...
জীবন গল্পটি পড়ে মন বিষণ্ন হলেও অপেক্ষায় রইলাম পরিণতি পড়বার জন্য দিদি।
loading...
আহা!! মীরার জীবন তো এমন হবার কথা ছিলো না।
loading...