স্মৃতিকাতরতায় কাটে পরবাসে আমার ঈদ আনন্দ


১১ আগষ্ট ভোর ৫ টা ৪৪।

আসসালামু আলাইকুম,
আজ আমাদের পরবাসে ঈদ তাই সবাইকে ঈদ মোবারক।

নিশ্চয় সবার জানতে ইচ্ছে করছে আমি কতটা খুশি, তাই ঈদগাহে ঈদের নামায শেষ করে বসে পরলাম মোবাইলের কি বোর্ড নিয়ে। ভাবছি কি লিখবো? অনেক আবেগপ্রবণ হওয়ার পর মন বললো, এতো ভাবাভাবির কি আছে বাঁকাচাঁদ? মন যা বলে তাই লিখে ফেল অভদ্র নগরের আনাড়ী লেখক। হয়তো সবার কাছে তোমার লিখা ভালো নাও লাগতে পারে হে লেখক।

সারাদিন যুদ্ধরত জীবন, কর্মস্থলে কাটে ব্যস্ত সময়। সকালের সূর্য পূর্ব দিগন্তে উদিত হয়ে পশ্চিমে অস্ত যায়। সূর্যের এই ওঠা-ডোবা জানার সুযোগ কম পরবাসে।
পরবাসে অর্থ আছে, স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনার কায়দা আছে, কিন্তু নেই আনন্দ, উল্লাসের নিশ্চয়তা। আমার দেশ সবুজ শ্যামলে বাংলাদেশ। সেই ভরাট যৌবনের রূপ দেখার সাধ আর মেটে কই দূর পরবাসে।

আমরা দেশে থেকে পরবাস বলতে বুঝি অনেক টাকা, সুখ,আরাম, ভোগ-বিলাসের জায়গা। সেখানে নিরবিচ্ছিন্ন বিদু্ৎ, লোডশোডিং নেই, নেই যানজট। রাস্তা-ঘাট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। দেখার মত সুন্দর পরবাস, যেখানে অগোছালো জীবন নামক শব্দের পরিবর্তন হয়। ঠিক এই রকম চিন্তাই থাকে আমাদের বাঙালীদের মনে। তবে বর্তমানে এই ব্যাপারটা নতুনদের মনে এতো স্বপ্নের বেড়াজাল সৃষ্টি করে না।

পরবাস মানে কি?
জানতে হলে চলুন ঘুরে আসি দূরের পরবাস থেকে। অনেক টাকা রোজগার করার একটি প্ল্যাটফর্ম। যেখানে লাখ লাখ টাকা রোজগার করা যায়। রাজার হালে জীবন চলে আরো কত কি? কিন্তু হাজার মিথ্যাকে পিছনে ফেলে সত্য কি জানেন? কিভাবে কাটে তাদের ঈদ অথবা তাদের ঈদের আনন্দের মুহূর্তগুলি কি? বছরের পর বছর আপন পরিজনদের কাছ থেকে সুদূর শহরে দাবদগ্ধ গরম ও হাড়জমাট শীতের মধ্য অবর্ণনীয় পরিশ্রম করে যাই শুধু দেশের রক্তের বাঁধনে বন্দি আপনজনদের মুখে একটু হাসি ফোটানোর জন্য। নিজের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময় যৌবনকাল উৎসর্গ করে দেই আপনজনদের জন্য। দূর দেশে থেকেও মন পড়ে থাকে সেই মাতৃভূমিতে, যেখানে রয়েছে আমার জান্নাত আমার মা, আমার মাথার তাজ আমার বাবা, প্রবাহিত রক্তরসে বন্ধনে বন্দি আমার ভাই-বোন।

প্রতি মুহূর্তে মনে পড়ে তাদের কথা। কোন সন তারিখে দুটা টাকা নিয়ে দেশে গিয়ে আপনজনদের মুখের হাসি দেখবো সেই অপেক্ষায় কাটে দিন মাস বছর। প্রতিটি সেকেন্ড কাটে ঘন্টার মত, প্রতিটি ঘন্টা কাটে দিনের মত আর প্রতিটি দিন কাটে যেন দীর্ঘ একেকটা সালের মত।

দিনের কাঠফাটা গরমে হাড়ভাঙা পরিশ্রম শেষে যখন রাতে নিজ বেডে ঘুমাতে যাই তখন অক্ষির পাতায় জীবন্ত হয়ে ভেসে উঠে আত্মীয়স্বজনের বিভিন্ন মায়ামুখ। কখন দেশে যাবো,বাবা মার চরণে লুটে পড়বো এই ভাবনায় একসময় ঘুমিয়ে পড়া আমার প্রতিদিনের রুটিন। এখানে জীবন মানে রাত দিনের নিরানন্দ চক্রের জাল। যেখানে হাসি-খুশির কোনো স্থান নেই। একই রকম কাজ আর একই রকমের নিয়মে ধরাবাঁধা জীবনচক্র যেন শেষ হয়েই হচ্ছেনা। এক ঘেঁয়েমী থেকে বের হওয়ার জন্য কোথাও বেড়াতে যাওয়ার সুযোগ নেই। এখানে ঈদের দিনে কোন ছুটি থাকেনা বিভিন্ন কর্মস্থলে।

বাৎসরিক আনন্দ উৎসব ঈদ, দেশের মানুষ যতটা আনন্দ উপভোগ করে সেই পরিমাণে পরবাসে মনের কোনায় সামান্যতম আনন্দের দোলাও দিতে পারে না বাৎসরিক ঈদ। এখানে ঈদ, পহেলা বৈশাখ, মধুর মাস জৈষ্ঠ্য, বিজয়ের মাস জানুয়ারী, ফেব্রুয়ারী সব উৎসবের দিন অন্য সব প্রতিদিনের মতই। বরং এখানে ঈদ আনন্দ আসে বেদনার ক্ষত চিহ্নতে নতুন করে লবণের ছিটা দেয়ার জন্য। এই দিনগুলোতে মনের ভিতরের জমাট কষ্টগুলো আবার জীবিত হয়ে ফিরে আসে। এখানে ঈদ মানে চোখের পানি। ঈদ মানে বেদনার ক্ষত নতুন করে তাজা হয়ে জাগ্রত হওয়া।

দেশের আত্মীয়স্বজন বন্ধু-বান্ধবরা জানতে চায় তোদের ঈদ কেমন কাটে? তোরা কি চাঁদরাতে বা তার আগে থেকেই ঈদের মার্কেট করতে যাস? ঈদের দিন ঘুরতে যাওয়া হয় দলবেঁধে? এইসব বিষয়ে জানার আগ্রহ থাকে দেশের অনেক আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে।

তাই আমার ঈদ কেমন আনন্দে কাটে তার সামান্য ইংগিত দেয়ার চেষ্টা করছি। দূর পরবাসে ঈদটা একেক জনের জন্য একেকরকম। অল্প কিছু মানুষের কাছে এখানে ঈদ আনন্দের হলেও অধিকাংশ প্রবাসীর কাছে ঈদ মানেই স্মৃতিবিজড়িত কান্নার দিন। সারা বছরের জমিয়ে রাখা কান্নার বাঁধভাঙা স্রোত যেন ঈদের দিন আর কোনো বাঁধা মানতে চায় না। দু চোখ বেয়ে ঝরে পড়ে বিরহের পবিত্র অশ্রু। বুকে চাপ পড়ে কষ্টের হিমালয়। কান্নার গতি যেন থামতেই চায় না। জোর করে থামাতে চাইলেও কি যেন এসে গলায় আঁটকে থাকে। খাবার খেতে বসলে লবণের কাজ করে দেয় চোখের পানি, ঝরে পড়ে ভাতের উপর। কোথায় চলে গেলো সেই ঈদ, যে ঈদে আম্মু আমার জন্য সেমাইয়ের পরিবর্তে তৈরি করতো ফিরনি।

কোথায় বাবা মা ভাই বোন? তারা কি নতুন জামা কাপড় কিনেছে? ফিরনি সেমাই রান্না করেছে? আজ ঈদের দিনে আমার শূন্যতা কি তারা অনুভব করছে? আমার অনুপস্থিতি তাদের কাছেও না জানি কত বেদনার। আম্মু মনে হয় ফিরনির কাপ হাতে নিয়ে আমাকে স্মরণ করে ঝুম বৃষ্টির মত চোখের পানি ফেলছে? এইসব ভাবতে ভাবতে ভেজা চোখেই ঈদের দিনটা শেষ হয় আমাদের। পরেরদিন থেকে আবার শুরু হয় হাড়ভাঙা পরিশ্রম। উদ্দেশ্য আমার একটাই নিজের কষ্টকে মাটিতে চাপা দিয়ে আত্মীয় স্বজনরা যেন একটু সুখের ছায়া পায়। বাবা যেন প্রতিমাসে শ্বাস কষ্টের ঔষধে খেতে পারে। আম্মু যেন চিন্তামুক্ত থাকে।

কয়েক বছর পর বাড়ীতে এসে যেন সবাইকে নিয়ে একটু সুখে থাকতে পারি। নিজের সুখ ত্যাগ করলাম স্বজনদের সুখের জন্য। এটাই প্রবাস, এটাই নিয়তি। এখানে ঈদের আগের দিনগুলোতে বাজার সদায় করার কোন ধুম পড়েনা। এখানে এদেশের মানুষদের কাছেই শুধু ঈদ আসে। আমাদের কাছে স্বাভাবিকভাবে নিজের অজান্তেই ঈদের তারিখটা আসে শুধু। যারা বাহিরে কাজ করে তাদের জন্য চাঁদ রাতে একটু বাড়তি পরিশ্রম করতে হয়। আর না ঘুমিয়ে সকালে ঈদের জামাতে নামাজ পড়তে হয়। এ ছাড়া অন্য কোনোভাবেই ঈদের লক্ষণ তাদের কাছে পরিলক্ষিত হয়না। নামায শেষে রুমে এসে ঘুমাব বলে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। কম্বল মুড়ি দিয়ে ভাবতে লাগলাম আগে একটু দেশে কথা বলে নেই। যেহেতু আজ আমার এখানে ঈদ।

মোবাইল হাতে তুলে নিয়ে যোগাযোগের জন্য কয়েকবার চেষ্টা করে লাইন পেলাম।
আসসালামু আলাইকুম। আম্মা কেমন আছো?
ওয়ালাইকুমুস সালাম ভালো আছি যাদু, তুমি কেমন আছো বাবা?
ভাল আছি আম্মা, তোমাদের দোয়াই খুব ভাল আছি।
ঈদে নতুন জামা কাপড় পরেছিস তো বাবা?
সেমাই খেয়েছিস তো?
না আম্মা, আমি তো সেমাই খাই না, তুমি জানোনা?
আরে হো … ভুলেই গিয়েছি, তো ফিরনি রান্না করেছো?
না মা, এতো ভেজাল কে করে?
এখন কি করছিস বাঁকা চাঁদ আমার?
বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে ঘুরতে যাবি না?
জ্বী আম্মা। এখন বন্ধু বান্ধবদের সাথেই আছি। ওরা অনেক কিছুই রান্না করেছে। আমার ভারি কণ্ঠ মায়ের আদালতে সব সত্য প্রকাশ পেয়ে যায়, তিনি বললেন কি হয়েছে বাবা তোমার? তোমার গলার আওয়াজ ভারি শোনাচ্ছে? বাঁকা চাঁদ, তোমার অনুপস্থিতি রোজ আমায় ভাবায়, সকাল থেকেই তোমার কথা ভাবছি। মানিক আমার যোজন-যোজন দূরে? যার জন্য ফিরনি বানানো হয়, সে তো ঘরে নেই।

আম্মু আজ আমার এখানে ঈদের দিন, আর তুমি কান্না করতেছো?
আম্মু বলে না বাবা, কাঁদছি না।
আম্মু তোমরা ঈদের জামা কাপড় কিনেছো?
হ্যাঁ, কিনেছি।
বাজার সদায় করতে কোন কমতি করোনি তো?
না বাবা… যা দরকার তার চাইতে একটু আধটু বেশিই কিনেছি।
তুমি চিন্তা করোনা।
ঠিক আছে মা, এখন রাখি আমি, বিকাল করে ফোন দেব। আমি একটু ঘুমাবো।
ঠিক আছে বাবা, তবে বিকালে কিন্তু অবশ্যই ফোন দিও।

মোবাইলটা রেখে কম্বলের ভিতরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে নিঃশব্দের চোরা কান্না কাঁদলাম কিছুক্ষণ। সারা বছরের জমানো কান্না আজকের দিনে ভীড় করেছে। আমি আজ কোথায় পড়ে আছি? এরকম ঈদের দিনে যদি দেশে থাকতে পারতাম, নামায পড়ে মাকে সালাম দিতাম, আম্মু কপালে চুমু খেয়ে বলতো আমার বাঁকা চাঁদ তুমি দীর্ঘজীবি হও, আর বাঁকা চাঁদ পুরো আকাশ জুড়ে একটিই। এভাবে তিনি আমার জন্য দোয়া করতেন। আহ্ আজ আমি পড়ে আছি অনেক দূরে।

এভাবেই পরবাসে একেকজনের কাছে একেক রকমভাবে ঈদ আসে নিরানন্দ হয়ে আবার চলেও যায়। কেও কেও শুধু ঈদের দিনটাই ছুটি পায়, আবার কেউ কেউ ঈদের দিনটিতেও ছুটি পায়না। আবার শুরু হয় সেই কাঠফাঁটা গরমে হাড়ভাঙা পরিশ্রম। দেশের আত্মীয়-স্বজনদের কাছে যাবার দীর্ঘ অপেক্ষা আর নিয়তির ডিউটি।
প্রতিদিনের একই রকমের কাজ আর একই রকমের নিয়মে সময় পার করা। হাসি-খুশি আনন্দবিহীন জলসমুদ্রে ভাসমান জীবন। জীবন এখানে শুধু রাত দিনের নিরামিষে একটি ডাকাত চক্র। শুধু বাড়ীতে ফিরে যাওয়ার একটি প্রবল অপেক্ষা আছে বলেই হয়ত এখনো এই জীবনের প্রতি কিছুটা মোহ আছে।

তা না হলে এই জীবন আর জড়পর্দাথের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকতো না। এখানে পার্থক্য শুধু এতটুকুই দেশে গিয়ে প্রিয়জনের মুখ দেখার আশাটা অন্তরে পেরেক-কাঠের গাঁথুনী। আর এভাবেই কেটে যায় আমার এবং আমার রুম মেটদের ঈদ আনন্দ। তবুও আমরা হাসি, কারণ পরবাসে এসে আমরা ঝর্ণার মতো কান্নাকে ভিতরে লুকিয়ে কিভাবে হাসতে হয় সেই কৌশল শিখে গেছি। ঈদে সবার স্বপ্ন বাড়ী যায় না, যায় শুধু বেতন বোনাস।

যাই হোক আগামীকাল বাংলাদেশে তোমাদের ঈদ, তোমাদের ঈদ আনন্দ যেন প্রবাহিত ঝর্ণার পানির মত পবিত্র হয় সে আশা রাখছি বিধাতার কাছে। তাই সবাইকে অগ্রিম ঈদ মোবারক।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১২ টি মন্তব্য (লেখকের ৬টি) | ৬ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ১১-০৮-২০১৯ | ১১:৩২ |

    পবিত্র ঈদের শুভেচ্ছা মি. শাহাদাত হোসাইন। ভালো থাকুন প্রবাসে। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • শাহাদাত হোসাইন : ১১-০৮-২০১৯ | ১১:৪৫ |

      হাজার হাজার মাইল কিলেমিটার পথ দূর হতে আপনাকেও পবিত্র ঈদের শুভেচ্ছা,ঈদ মোবারক।

      GD Star Rating
      loading...
  2. সৌমিত্র চক্রবর্তী : ১১-০৮-২০১৯ | ১২:৩৫ |

    ঈদ মুবারক শাহাদাত হোসাইন ভাই। ভালোবাসা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

    GD Star Rating
    loading...
  3. রিয়া রিয়া : ১১-০৮-২০১৯ | ১৩:১৯ |

    লেখাটি পড়ে মন উদাস হয়ে গেলো। সমব্যথী হলাম কবি দা। ঈদ মোবারক। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    GD Star Rating
    loading...
  4. সুমন আহমেদ : ১১-০৮-২০১৯ | ১৫:২২ |

    তারপরও ঈদের আনন্দ হোক অমলিন। শুভেচ্ছা। Smile

    GD Star Rating
    loading...
  5. আবু সাঈদ আহমেদ : ১১-০৮-২০১৯ | ২৩:২৩ |

    ঈদ মোবারক!

    GD Star Rating
    loading...
  6. শাকিলা তুবা : ১১-০৮-২০১৯ | ২৩:৪১ |

    পবিত্র ঈদ-উল-আজহার শুভেচ্ছা।

    GD Star Rating
    loading...