একঃ
দরজা খুলে পূর্ণিমাকে দেখেই জামিল প্রাণ খুলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে লাগলো,
-আমাকে উইশ কর, ডিয়ার
-কেন? পূর্ণিমা জানতে চাইলো
-আজ বিশ্ব সুখী দিবস, তাই। জামিল জবাব দিল
-এই দিনের কথা তো কোনদিন শুনিনাই !
-তোমাকে দেখে আমার মনে হল তোমার এই আগমনের চেয়ে ভালো কোন ঘটনা এই দুনিয়ায় ঘটে নাই; তাই আজ ওয়ার্ল্ড হেপিয়েস্ট ডে আমার কাছে।
-বিশ্ব সুখী দিবস জামিল
-থ্যাঙ্ক্যু পূর্ণিমা
বহু বছর পর জামিল ঢাকা থেকে তার গ্রামের বাংলো বাড়িতে এসেছে। ডিমলার নাওতারা গ্রামে কুড়ি বিঘা জমির ওপর বাড়িটা। পূর্ণিমা কানাডার একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতো। দেড় বছর আগে রিটায়ার করে সে দেশে ফিরে এসেছে। ডিমলা প্রোপারেই তার বাপদাদার বাড়ি। স্বামীর সাথে তার কোনদিন বনিবনা হয় নাই। বিয়ের শুরুর দিকে তাদের প্রায় ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল। পরে ওদের সামাজিক মিটমাট হয়ে গেলে সপরিবারে কানাডা চলে যায়। এখন সে দেশে একলা থাকে।
-বিশ্ব সুখী দিবস উপলক্ষ্যে কী খাওয়াবে? পূর্ণিমা মুচকি হেসে জানতে চায়
-পান্তা শুটকি দেই? জামিল জবাব দেয়
-পান্তা শুটকি কেন?
– এদেশের অনেক মনোবিজ্ঞানী মনে করেন, ওটা সুখী মানুষের সবচে প্রিয় মেনু
– তাইলে দাও
-না, শুটকি করতে সময় লাগবে। তারচে বরং ডিম ভাজি করি, কী বল? জামিল মত বদলাতে চায়
-ওটাও পান্তার সাথে ভালো যাবে। পূর্ণিমা সায় দেয়।
একটা ছোটগল্পের খসড়া পূর্ণিমার হাতে দিয়ে জামিল কিচেনে ঢুকে।
.
দুইঃ
(গল্পের খাতাটা হাতে নিয়ে পূর্ণিমা পড়তে থাকে। মূল চরিত্রের নাম হাওয়া বেওয়া।)
.
হাওয়া বেওয়া বারবার আকাশের দিকে তাকায়। যদি বৃষ্টি নামে এই আশায় ! কারণ তাতে তিস্তার চরে তার নৌকা চলার সহজতর একটা পথ হবে! জায়গায় জায়গায় আধাজাগা চর থাকায় লাগা তিনদিন নৌকাটা ঠেলে সে এই পর্যন্ত এসেছে।
-হাওয়া, ওওও হাওয়া !
মাজেদা বেওয়ার আচমকা ডাকেও হাওয়ার কোন ভাবান্তর হয়না। চরে সে যেমন বসে ছিল তেমনি বসে থাকে।
হাওয়ার মা মাজেদা বেওয়া। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর আড়াই বছর আগে মাজেদার বিয়ে হয়। সেই হিসেবে তার বয়স এখনও সত্তর হয় নাই। কিন্তু চলৎশক্তিহীন হয়ে পড়েছে। স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে সে তার একমাত্র সন্তান হাওয়ার সংসারেই থাকে। তারও একসময় নৌকায় সংসার ছিল। বিয়ের দেড় বছরের মাথায় তার এক ছেলে হয়। মাজেদা বেওয়ার মনে আছে, যেদিন দেশ স্বাধীন হয় সেদিন তিস্তার দুইপাড়ে কী যে আনন্দ হয়েছিল! টানা কয়েকদিন সেই আনন্দ উল্লাস চলে। কিন্তু তৃতীয় দিনে মাজেদার ঘরে গজব নেমে আসে। একমাত্র ছেলেটা কখন তিস্তায় পড়ে হারিয়ে যায় তা কেউ টেরই পায়নি।
ছেলের মৃত্যুর পাক্কা এগার বছর পর মাজেদার পেটে এই হাওয়া বেওয়া আসে। সেজন্য অবশ্য মাজেদাকে কম চেষ্টা তদবির করতে হয় নাই! হাওয়া যখন হামাগুড়ি দেয়া শেখে তখন মাজেদা আর ভুল করে নাই। হাওয়ার কোমরে একটা রঙ্গিন দড়ি বেধে দিয়েছিল। সাঁতার শেখা অবধি দড়িটা কোমরেই বাধা ছিল।
-ওওও হাওয়া; হাওয়া বেওয়া।
মাজেদা আবার ডাক দেয়। হাওয়া এবারও মায়ের ডাকে সাড়া দেয় না।
হাওয়ার চার বছরের শিশুকন্যা একবাটি পানি তার নানীকে এগিয়ে দেয়। শিশু মেয়েটির কোমরেও দড়ি বাঁধা; সাত আট মাস বয়স থেকেই। তাও প্রায় সাড়ে তিন বছর হতে চলল। মেয়েটা যখন পেটে ছিল তখন হাওয়ার স্বামী প্রায় অর্ধেক বয়সের এক কিশোরীকে নিয়ে পালিয়ে যায়। মাস ছয় সাত পর তার স্বামী ফিরে আসতে চাইলেও হাওয়া আর রাজি হয়নি।
হঠাৎ ঢোলের আওয়াজে হাওয়ার ভাবনায় ছেদ ঘটে। সে সামনের দিকে তাকায়। নানান রঙের নানান ঢঙ্গের পোশাক পরে একদল নারী পুরুষ নেচে গেয়ে আসছে। যাত্রার দল। পায়ে হেঁটে নদী পার হবে। হাওয়া প্রশ্ন করায় একজন জানায়, তারা প্রথমে ডিমলা এবং পরে জলঢাকা শহরে যাত্রা পালা করবে।
-যাত্রায় পাঠ করবা গো সুন্দরী?
হাওয়ার খোলা পেটে হাত দিয়ে যাত্রাদলের বুড়ো মতোন একজন ফিসফিস করে বলে।
শুধু বুড়োরা নয়। হাওয়ার শরীরের বাঁক, ঢেউ দেখে অর্ধেক বয়সের ছেলেরাও যেন তাকে গিলে খায়। রোদে গায়ের রঙ বসে গেলেও ভারী মিষ্টি চেহারা তার।
-ওওও হাওয়া; খিদা লাগছে রে মা !
এবার হাওয়া তার মায়ের দিকে তাকায়। দড়িতে বাঁধা শিশু কন্যার দিকেও চোখ পড়ে। তার বুকটা হুহু করে ওঠে। হাওয়া শুনেছে, তিস্তার উজানে খাস জমিতে সরকার ভূমিহীনদেরকে ঘর তোলার জন্য জায়গা দিচ্ছে। সেইজন্যই সে এভাবে নৌকা ঠেলে যাচ্ছে। একটা ঘর ওঠাতে পারলেই সে তার মাকে একটা লাঠি জোগাড় করে দিবে। তখন সে একটু আধটু হাঁটবে। শিশু কন্যার কোমরের দড়িটাও সে খুলে দেবে। হাওয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। অল্প পানিতে হাত পা ধুয়ে নৌকায় ওঠে বসে। তিনজন মিলে পান্তা ভাত খায়। তারপর সন্ধ্যার আগে আগে চরে নেমে সে খুন্তি চালিয়ে নৌকা যাওয়ার একটা চ্যানেল তৈরি করে।
নৌকায় ওঠে হাওয়া আবার একটু জিরিয়ে নেয়। এক ঢোক জল পান করে সে পেছনের গলুইয়ে যায়। তারপর নিচে নামে। আকাশে ভরা চাঁদ। কালো মেঘের আড়াল থেকে চাঁদটা মাঝে মধ্যে উঁকি দিচ্ছিল। সেই আলোতে হাওয়া চ্যানেল বরাবর নৌকা ঠেলতে থাকে। একটু জিরায়; আবার ঠেলে। আবার জিরায়। হঠাৎ দেখে, মানুষের একটা ছায়া তার দিকে এগিয়ে আসছে। ছায়াটা হাওয়া বেওয়ার ডানপাশে এসে খাঁড়ায়।
আধাঢাকা চাঁদের আলোয় হাওয়া আগুন্তকের মুখ দেখতে পায়। তিরিশ পয়ত্রিশ বছরের একজন পুরুষ। তিস্তার ডালিয়া পয়েন্ট অতিক্রম করার সময় হাওয়াকে দেখে সে মুচকি হেসেছিল। গতকালও নৌকার কাছে এসে সে ভাব জমানোর চেষ্টা করে এবং হাওয়ার হাতে তিনটা পেয়ারা দিয়ে বলে;
-সুন্দরী কৈন্যা পাইলে বিবাহ করিতাম।
তখন লোকটাকে হাওয়ার অল্প অল্প মনে ধরে। ঠোঁটের কোণে হাসি টেনে সে জবাব দেয়,
-তো মুই কী কোরিম?
আজ সন্ধ্যায়ও সে এসেছিল। খুন্তি চালিয়ে হাওয়া যখন তার নৌকা চলার পথ তৈরি করছিল তখন সে বলে,
-তিস্তার পাড়ের সবাই জানে দেবতা সন্তুষ্ট না হইলে মরা তিস্তায় জল আসিবেনা। ভোগ লাগিবে গো, দেবতার জন্য ভোগ।
-তা কী ভোগ লাগিবে?
হাওয়া বেওয়া জানতে চায়।
লোকটা মিটমিট করে হাসে। কোন জবাব না দিয়ে চলে যায়। তারপর এইতো এখন এই রাতের অন্ধকারে পা টিপে টিপে সে আবার এলো।
– তোমার নাম কি বাহে?
হাওয়া জানতে চায়।
লোকটা হাওয়ার হাত তার নিজের মুঠোয় নেয়। তারপর মৃদু চাপ দিয়ে ফিস ফিস করে জবাব দেয়,
-মুই আদম আলী।
কিছুক্ষণ পর হাওয়া কিছু পুরুষ কন্ঠ শুনতে পায়। তাদের কথা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হওয়ায় সে ধারণা করে তিন চার জন পুরুষ তার নৌকার দিকে আসছে। মিনিট কয়েক পর লোকগুলি ধারে কাছে কোথাও থেমে যায় মনে হয়। একটা মেয়ে কণ্ঠও শোনা যায়। একসময় মেয়েটা চিৎকার করে ওঠে। ভয়ে হাওয়া কাঁপতে থাকে। হাওয়াকে তখন আদম আলী কাছে টেনে নেয়। এইভাবে মিনিট কুড়ি। সেই লোকগুলির আর কোন আওয়াজ শোনা যায়না। কিন্তু তবুও হাওয়ার কাঁপন বাড়ে। সাথে আদমেরও।
এরই মধ্যে এক সময় নৌকাটা সামনে নেয়ার জন্য আদম ও হাওয়া এক হয়ে জোরে একটা ধাক্কা দেয়। সাথে সাথে তিস্তার বুক জুড়ে ঝমঝম করে বৃষ্টি নামে!
.
তিনঃ
কিচেন থেকে এক বাটি পান্তা ভাত, নুন, পেয়াজ, কাঁচা মরিচ এবং ডিম ভাজি নিয়ে জামিল হাজির হয়।
-পান্তা মাখি? জামিল জানতে চায়
-সমস্যা নাই। পূর্ণিমা জবাব দেয়।
একটা সময় ছিল ওরা প্রতিদিন দুজন দুজনকে চিঠি লিখতো। একদিন চিঠি না পেলে খুব অস্থির হতো।
-গল্প পড়া শেষ করেছ? জামিল জানতে চায়
-হ্যাঁ। পূর্ণিমা জবাব দেয়।
-গল্পটা ওখানেই শেষ নয়। শেষ অধ্যায় লিখা হয় নাই। তুমি চাইলে না লিখা অংশটুকু আমি শোনাতে পারি।
.
চারঃ
(জামিল অসমাপ্ত গল্পটুকু বলতে শুরু করে)
সপ্তাহ খানেক পর এক ভোর বেলা।
তিস্তা তখন জলে টইটুম্বুর। দলে দলে লোক নদীর দিকে যাচ্ছে। কারণ ভাটির জলে এক নারীর লাশ ভেসে ওঠেছে। তার বয়স ঠিক বোঝা যায়না। কেউ কেউ বলছে, পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ হবে।
যারা লাশটা দেখে বাড়ি ফিরছিল তাদের কেউ কেউ বলছিল, “ওটা কোন সাধারণ মরা না; সাক্ষাৎ জলদেবতার ভোগ। তার অঙ্গজুড়ে কেমন রঙ্গিন দড়ি গো!”
.
-স্কিউজ মি।
গল্প বলা শেষ হওয়ার আগেই পূর্ণিমা তার মোবাইল নিয়ে ঘরের বাইরে গেল। মিনিট কয়েক কথা বলে সে ফিরে এলো।
-সরি জামিল, আমাকে এখনই যেতে হবে
-খাবেনা?
-কানাডা থেকে মোবাইল স্ক্রিণে “সে” আমার গাড়ির অবস্থান দেখছে।
পূর্ণিমার চলে যাওয়া দেখতে দেখতে জামিল তীব্রভাবে অনুভব করে, আজ আসলে তার জীবনের সেডেষ্ট ডে।
“দড়ি জীবন” গল্পটা জামিল নতুন করে লিখবে বলে সিদ্ধান্ত নিলো।
loading...
loading...
দুটি গল্পের এক হয়ে যাওয়ার গল্পাংশ পড়লাম ডেজারট ভাই। একক সুন্দর পরিবেশনা।
loading...
অশেষ ধন্যবাদ সুকবি !
loading...
আখ্যান অথবা ঘটনার সরল বর্ণনা প্রিয় মিড দা। জানিন কোন সে গল্প তবে একটি গল্প পড়ে দুটি ভাবের আদান প্রদান সার্থক ভাবেই এসেছে। শুভেচ্ছা র'লো আপনার জন্য।
loading...
অশেষ ধন্যবাদ দিদি।
শুভেচ্ছা জানবেন !
loading...
পড়লাম ভাই। হাওয়া আদমের অংশ বিশেষ ভালো এঁকেছেন।
loading...
অশেষ ধন্যবাদ !
loading...
সার্থক দড়ি জীবন। মন বিষণ্ন হলো। তারপরও।
loading...
মন্তব্যে খুব খুশি হয়েছি।
অশেষ ধন্যবাদ !
loading...
শুভেচ্ছা মি. মিড ডে ডেজারট। অগুন্তি কবিতার ভীড়ে আপনার লিখায় শ্বাস নিলাম।
শুভ সকাল। এবং ধন্যবাদ।
loading...
মন্তব্যে খুব খুশি হয়েছি মিঃ মুরুব্বী।
আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ !
loading...
গল্পটি পড়লাম ভাই।
loading...
অশেষ ধন্যবাদ !
loading...
অভূতপূর্ব।
loading...
মন্তব্যে খুব খুশি হলাম কবি।
অশেষ ধন্যবাদ !
loading...
প্রিয় লেখক,অনেকদিন পর একটি সুন্দর গল্প পড়লাম। এক নিমেষেই শেষ করেছি গভীর থেকে গভীরে জানার জন্য। শেষ দিকে বেদনার আঘাতে জর্জরিত হয়েছি। দুটি গল্পের বলার ধরন খুবি ভালো লেগেছে। একি দড়ি দিয়ে বাঁধা দুটি গল্প।
loading...
একজাক্টলি, "একি দড়ি দিয়ে বাঁধা দুটি গল্প"। গল্পের থিমটাই আপনি মন্তব্যে বলে ফেলেছেন। দড়ি জীবন ক্লাস বুঝে হয়না; বেদে হাওয়া কিংবা উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের রিটায়রড অধ্যাপিকা !
আপনার মন্তব্যে ভীষণ মুগ্ধ হয়েছি! অশেষ ধন্যবাদ !
loading...
জামিলের জন্য শুভকামনা।
loading...
আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ !
loading...