দূর পরবাসে রোযা মুখে নিয়ে তোমায় লিখছি মমতাময়ী মা

তারিখ: ০৩ রমযান ১৪৪০ হিজরি

প্রিয় মমতাময়ী মা

গ্রীষ্মের কাঠফাটা গরমে আমার কর্মব্যস্ততায় শরীর নিংড়ানো মুক্তঝরা ঘাম জড়ানো শুভেচ্ছা।

কেমন আছো রণাঙ্গনের জননী সাহসিনী। রমযানের তৃতীয় রোজা মুখে নিয়ে মাগরিবের ঠিক আগ মূহুর্তে সামান্য কিছু ইফতারী সামনে নিয়ে হাজার হাজার মাইল দূর প্রবাস সৌদি আরব থেকে তোমায় লিখছি।

দূর পরবাসে বসে জীবনে প্রথমবারের মতো তোমাকে চিঠি লিখছি। কেমন আছো জীবন যুদ্ধের জয়ী সংগ্রামী মা। আমি অালহামদুলিল্লাহ তোমার দোয়ার বদৌলতে অনেক ভালো আছি। আমার হৃদয়ের অলিগলিতে অসংখ্য অব্যক্ত অক্ষরগুলো প্রতীক্ষার প্রহর গুনছে তোমার কাছে পৌঁছাবে বলে। কতগুলো বছর পার হয়ে গেল তোমাকে স্পর্শ করি না, তোমার ঐ মায়াভরা চাঁদ মুখ দেখিনা। রোযা রাখার অভ্যাসটা যদি তুমি না গড়ে দিতে, তাহলে হয়তো রোযার ফযিলত হতে বঞ্চিত হতাম। কোন ডাক্তারী পড়ালেখা ছাড়াই তুমি হলে পৃথিবীর একমাত্র জগত শীর্ষ ডাক্তার যার তুলনা হয়না। কিছুক্ষণ পরেই মাগরিবের আযান শুরু হবে,সামনে বাহারি রকমের ইফতার নিয়ে বসে আছি এমন মিথ্যা বাক্য বললেও চিঠির কথামালায় তুমি নিশ্চই সত্য উদঘাটন করবে তোমার পবিত্র চিত্তপটে বা অন্থঃকরণে, গুটি কয়েকটি খেজুর আর পানি দিয়ে আজ আমার রোযা খোলা হচ্ছে। কিন্তু এই ইফতারে আমি ঐ স্বাদ পাই না, যে স্বাদ তোমার নিজ হাতের বানানো আলুরচপে, বেগুনি, ছোলা বুট, নিমকি, ডালের বড়াতে আমি পেয়েছিলাম। হয়তো দুনিয়া থেকে পরলোক গমণের আগ সময় পর্যন্ত সে স্বাদ আমার মুখে লেগে থাকবে।

জানো আম্মা, আমার এই পরবাস দুনিয়াটা ভীষণ সুন্দর। তবুও কেন জানি এ সুন্দরের ভীড়ে তোমার অমন সুন্দর মুখ আমি খুজে পাই না। আমার এ পৃথিবীটা ধূসর লাগে তুমি নেই বলে। জীবনটা দুর্বিসহ মনে হয় তুমি দূরে বলে। তোমার কাছে আমার অনেক অনেক অভিযোগ,কেন এত আদর, স্নেহে বড় করলে আমায়। রোজ ইফতারের সময়ে আমি তোমাকে মনে করি, আর দু চোখের পানি আমার মুখের গাল বেয়ে পড়ে তোমার তরে। তুমিও নিশ্চই আমায় স্মরণ কর ইফতারের আগ মূর্হতে, আর চোখের পানি ফেল জায়নামাজের প্রার্থনায়। ভাগ্য বিধাতা যখন আমাকে তোমার থেকে যোজন যোজন দূরে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন,তখন কেন তোমাকে নির্দয় পাষণ্ড করে সৃষ্টি করেননি। তাহলে অন্তত এ দূর পরবাসে ইফতারের আগ সময়ে আমার দূর পৃথিবীর কাচের দেয়ালের ওপাশে বসে আমার নিথর নিষ্প্রাণ আত্মাটা তোমার জন্য ডুকরে কেদে মরত না!

জান, আমার সব আছে, শুধু তোমার স্নেহটুকু নেই। উন্নত প্রযুক্তির দেশে এখন আর কেউ আমাকে খাইয়ে দেয় না। হাজার দিন হয়ে গেলো তোমার হাতের রান্না করা খাবার খাওয়া হয়না। তোমাকে ঘিরে সব ভালবাসারা হারিয়েছে স্মৃতির মণিকোঠায়। আমার নির্ঘুম রাত্রিগুলো কাটে অসহনীয় মন ব্যাথার ক্ষতবিক্ষত আঘাতে। কষ্টে ভেজা বালিশটা নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রতিটি প্রহরে। মমতাময়ী মা কী? মাতৃত্ব কী আমি বুঝেছিলাম সেদিন,যেদিন আমি তোমার ভালবাসার ছায়া হতে দূর হচ্ছিলাম। তোমার কি মনে আছে আম্মা বিমানবন্দরে আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরে অঝোর ধারায় কেঁদেছিলাম বিদায়কালে, ঐ দিন সবাই আমাদেরকে দেখে ভিতরে ভিতরে তারাও কান্না করতেছিলো হয়তো। সেদিন আমি তোমাকে ছেড়ে যতই সামনে অগ্রসর হচ্ছিলাম,আমার বুকপট ততই ভারী হচ্ছিলো হৃদকম্পনে।

মনে হচ্ছিলো কেউ আমার বক্ষ বিদীর্ণ করে তার ভিতর তোমার সব মায়া ঢালাও করেছে, সেদিন আমার বুকটা অনেক ভারী মনে হচ্ছিলো, যে ভার সহ্য করা অনেক কষ্টকর ছিলো। আমার এই দু বছরের যাত্রাপথে আমি একটু একটু করে তোমাকে আবিস্কার করেছি দ্বিতীয়বারের মত। অবলোকন করেছি তোমার ভালবাসা, দূর পরবাসে এসে বুঝতে পেরেছি মা তুমি কি মানবী? তোমাকে ঐ উপরওয়ালা যে মাটি দিয়ে তোমাকে সৃষ্টি করেছে সে মাটি হয়তো আলাদা। তোমার ধৈর্য্য ক্ষমতা সীমাহীন। কত কষ্ট আর ত্যাগের মধ্য দিয়ে তুমি আমাকে বড় করেছিলে। তোমার কি মনে আছে আম্মা, আমার সেই নয় মাসের যাত্রাপথে আমি তোমাকে কতই না ব্যাথা দিয়েছি, আমার জন্মের পর থেকেই তুমি আনারস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলে ভয়ে, ভয়ের কারন জানতে গিয়ে শুনতে পারলাম আমি যখন ছয় মাসের গর্ভে ছিলাম, তখন তুমি অানারস খাওয়ার কারনে অনেক ব্যাথা অনুভব করেছিলে পেটে। সেই ভয়ে তুমি নাকি আজও আনারস খাও না। আমাদেরকে অবশ্য তুমি আনারস কেটে দিতে, নিজে খেতে না সেই ভয়ে। কতইনা যত্নে আগলে রেখেছিলে আমায় তা আজ অনুভব করি আমি।

মা তুমিহীনা আমি আমার বিবর্ণ পৃথিবীতে ভীষণ ক্লান্ত। কত বছর তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমাই না। কতদিন প্রাণখুলে হাসি না,কতদিন চিৎকার করে কাঁদি না। তোমার মতো করে কেউ যে আমায় বোঝে না মা। আমার অভিমান গুলোকে সবাই অভিমান ভাবলেও তুমি কিন্তু আমার অভিমানের আড়ালে ভালবাসাটাই বোঝতে। আমার চোখের ভাষা কেবল তুমিই পড়তে পারতে এ ধরায়।আমি প্রতিদিনের প্রার্থনায় বিধাতার কাছে কেবল একটা আকুতি রাখি,আমার সবটুকু আয়ু দিয়ে তিনি যেন তোমায় দীর্ঘায়ু করেন ভালো রাখেন। আমার দীর্ঘ প্রতীক্ষার স্বপ্নরা একদিন বাড়ি ফিরবে। তোমার নীড়ে ফেরার আশায় পথ চেয়ে বসে আছি। আমি ফিরে আসতে চাই আমার সেই মমতার বন্ধনের আবদ্ধ করা স্নেহের নীড়ে।

মমতাময়ী তোমার কোলে মাথা রেখে একটু শান্তিতে ঘুমাতে চাই। সেই দিনটির জন্য সুস্থ দেহে অপেক্ষা করিও মা। এক জীবনের যাবতীয় অপরাধের জন্য ক্ষমা চাই মা। বিধাতার দেওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার তুমি। অনেক ভালো থেকো। আমার জন্য শুধু এটুকু দোয়া করো, জীবনযুদ্ধে যেন আমি জয়ী হতে পারি। সব বাঁধা বিপদ উত্তাল ঢেউ অতিক্রম করে যেন তোমার আঁচলে মুখের ঘাম মুছতে পারি।

ইতি,
তোমার স্নেহের ছোট ছেলে।
শাহাদাত হোসাইন।

নোট:-চিরকুটটি গত হয়ে যাওয়া ৩য় রমযানে লিখেছিলাম। ৪ রমযান সেহরীর সময় জানতে পারি আমার প্রিয় মমতাময়ী মা চিরকুট বারবার পাঠ করে অঝোর ধারায় কেঁদেছেন। সকালে বিকাল শুধু চিরকুট পড়ে কাঁদে আর ঘন্টার পর ঘন্টা আমার সাথে কথা বলে। চিরকুটের প্রতিটি লাইনে লাইনে শব্দে শব্দে আমার সহোদর ভাইও কেঁদেছেন।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১৬ টি মন্তব্য (লেখকের ৮টি) | ৮ জন মন্তব্যকারী

  1. শান্ত চৌধুরী : ২১-০৭-২০১৯ | ১৩:০১ |

    শুভ কামনা ভাই।

    সকল মা বেঁচে থাকুক শ্রদ্ধা ভালোবাসায়।  

    GD Star Rating
    loading...
    • শাহাদাত হোসাইন : ২১-০৭-২০১৯ | ১৭:৫৪ |

      ধন্যবাদ প্রিয় শান্ত চৌধুরী। চিরকুট পাঠে ও মন্তব্য কৃতজ্ঞ থাকিলাম। ভালবাসা জানিবেন অফুরন্ত। 

      GD Star Rating
      loading...
  2. রুকশানা হক : ২১-০৭-২০১৯ | ১৩:২৪ |

    আমিও একজন মা —- মায়ের কাছে লিখা এ চিঠি আমার অন্তর সিক্ত করলো। জানিনা আমার সন্তান কেমন   আছে দূর পরবাসে ।প্রতিদিনই কথা বলি, তবু মন ভরে না। আমার মেয়ে ইউনিভার্সিটি অফ  সেন্ট্রাল ফ্লোরিডায় পিএইচডি করছে ।     

    GD Star Rating
    loading...
    • শাহাদাত হোসাইন : ২১-০৭-২০১৯ | ১৭:৫৮ |

      ধন্যবাদ শ্রদ্ধেয় লেখিকা,পরবাসে সব আছে,নেই শুধু মায়ের মমতা। নেই মায়ের হাতের রান্না করা খাবার। সারাদিন অফিস করে বাসায় এসে আবার নিজেই রান্না করে খেতে হয়। পরবাসে অর্থ আছে,নেই ফ্যামিলির ভালবাসা। আপনার মেয়েকে আল্লাহ তায়ালা পূরিপূর্ন কামিয়াবী দান করুক। আমিন।

      GD Star Rating
      loading...
  3. মুরুব্বী : ২১-০৭-২০১৯ | ১৪:৫৮ |

    ফেলে আসা জীবনের অনেক কথা মনে পড়ে গেলো। আল্লাহ্তাআলা আমাকে আপনার মতো শব্দ বাক্য গঠন করার তৌফিক দেননি, তারপরও আপনার আকুল করা কথা গুলোন আমার হৃদয়ে যে নাড়া দিলো তাও বোধকরি প্রকাশ করতে পারবো না। যেখানে আছেন ভালো থাকুন সুখে থাকুন।

    GD Star Rating
    loading...
    • শাহাদাত হোসাইন : ২১-০৭-২০১৯ | ১৮:০২ |

      ধন্যবাদ প্রিয় শ্রদ্ধাভাজন। আপনার মন্তব্য পড়ে সহজেই অনুধাবন করতে পারছি,আপনার হৃদয়ে কি পরিমান ব্যাথা বা বেদনার ঢেউ বইছে। পরবাসে জীবনটাই এমন। অর্থ আছে নেই ফ্যামিলির ভালবাসা। এ ব্যাপারে আপনি হয়তো আমার চাইতে ভালো জানেন। আপনি একজন সুইজারল্যান্ড পরবাসী।

      GD Star Rating
      loading...
  4. আদেল পারভেজ : ২১-০৭-২০১৯ | ১৮:২৬ |

    এই চিঠি পড়ে অনেক বেশি চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে মা আমি ভালো নেই। সে কবে তোমার কোলে মাথা রেখেছি সত্যি মনে নেই। অনেক ইচ্ছে করছে একটু জড়িয়ে ধরতে । কিন্তু উপায় নেই আমি যে অনেক দূরে। লোহালক্করের এই দেশে
    আমিও মা কেমন যেন লৌহ মানব হয়ে গেছি৷

    অনেক শুভকামনা প্রিয় শাহাদাত হোসাইন ভাই , মায়ের জন্য রইলো অনেক দোয়া ও ভালবাসা।

    GD Star Rating
    loading...
    • শাহাদাত হোসাইন : ২১-০৭-২০১৯ | ২২:৩৬ |

      মা ছেলের বিচ্ছেদ যেন বক্ষ বিদীর্ণ করে। সমুদ্রের বুকে চির ধরায়। মা যে মা।  তার নেই তুলনা। সে একজন মমতার দরিয়া। সব ভালবাসা তার জন্যই হোক। ধন্যবাদ প্রিয়। কৃতজ্ঞতা জানিবেন মন্তব্য ও পাঠে। আল্লাহ আপনার মায়ের হায়াতে বরকত দান করুক আমিন। মাকে আমার সালাম জানাইবেন।

      GD Star Rating
      loading...
  5. সৌমিত্র চক্রবর্তী : ২১-০৭-২০১৯ | ২০:০০ |

    হৃদয় নাড়িয়ে দিলেন ভাই শাহাদাত হোসাইন। আপনি অসাধারণ লিখেন। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • শাহাদাত হোসাইন : ২১-০৭-২০১৯ | ২২:৪০ |

      ধন্যবাদ প্রিয় সৌমিত্র,ভালবাসা জানিবেন।  আপনার মন্তব্য লিখার প্রতি উৎসাহ বাড়িয়ে দিলো আরো। 

      GD Star Rating
      loading...
  6. সুমন আহমেদ : ২১-০৭-২০১৯ | ২১:১১ |

    মায়ের কাছে পুত্রের টিঠি। ভীষণ ফীল করলাম আপনার লেখাটিকে। জীবন। 

    GD Star Rating
    loading...
    • শাহাদাত হোসাইন : ২১-০৭-২০১৯ | ২২:৪২ |

      প্রিয় সুমন ভাই,ধন্যবাদ জানিবেন মন্তব্য ও চিরকুট পাঠে। ভালবাসা বহমান। 

      GD Star Rating
      loading...
  7. সাজিয়া আফরিন : ২১-০৭-২০১৯ | ২১:৩৩ |

    বক্ষ বিদীর্ণ করে দেয়ার মতো আজকের চিরকূট। Frown

    GD Star Rating
    loading...
    • শাহাদাত হোসাইন : ২১-০৭-২০১৯ | ২২:৪৫ |

      ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা আপনার তরে,চিরকুট লেখক নিজেই কেঁদেছেন চিরকুটের বাকশৈলীতে। সাগরে চির ধরায় মাকে নিয়ে ভাবনারা। মায়ের মমতা কারো সাথে নেই তুলনা। ভালো থাকুক পৃথিবীর সকল মমতাময়ী মায়েরা।

      GD Star Rating
      loading...
  8. রিয়া রিয়া : ২১-০৭-২০১৯ | ২১:৪৮ |

    মনটা আর্দ্র হয়ে এলো। Frown

    GD Star Rating
    loading...
    • শাহাদাত হোসাইন : ২১-০৭-২০১৯ | ২২:৪৮ |

      মায়ের মমতা পাহাড়ের চেয়েও বিশাল। মমতাময়ী মা কে নিয়ে চিরকুট লিখলে কলমের কালি শেষ হয়ে যাবে,তারপরেও মমতাময়ী মায়ের মমতার কথা শেষ হবেনা। ধন্যবাদ জানিবেন ওহে প্রিয়। দোয়ার দরখাস্ত রহিলো আমার মায়ের জন্য।

      GD Star Rating
      loading...