জীবনের যত জঞ্জাল ৪

বাবার স্মৃতিভ্রংশ। কাউকে চিনতে পারে, কারও দিকে ফ্যাল ফ্যাল উদাস দৃষ্টি। সেই চোখ কী বলে অথবা বলতে চায় সবটুকু হোক বা না হোক কিছু তার বোঝা যায়, বোঝা যায় না; কে জানে বুঝতে চায় না শ্যামল। কবিরাজের কাছে যায়। অনেক আশা-প্রত্যাশা। আবার যদি উঠে দাঁড়ায় বাবা।

‘আমাদের ওষুধে চিনি-গুড়-মধু, তোমার বাপের চলবে না। সদরে হাসপাতাল নিয়া যাও। ডাকতার দেখুক। মধুমেহ। হিসাব করি খাওয়া-দাওয়া, যত্ন-আত্তি দরকার। তারপর সব উপরঅলার ইচ্ছা।’
‘দেখেন কাকা দেখেন। মানুষটা উঠি দাঁড়াক। বাঁচি থাকুক।’
‘পরে কিছু কইতে পারবা না আবার, যে কবিরাজ অসুখ বাড়াই দিছে। একটা প্রলেপ দি। এইটা বাঁ-হাত কবজি থাকি গোড়া, বাঁ-পা উরু পর্যন্ত ল্যাপ দিবা। সারাদিন রাখবা। সকালে আবার ল্যাপ। আকন্দপাতার সেক। গরম পাইলে রগ ছাড়ি দিবে। তোমার বাপের বয়াস কত?’
‘কত আর…চল্লিশ-পঞ্চাশ।’
‘দুর ব্যাটা! সত্তর-বাহাত্তর মনে হয়। এখন তো যাওয়ার সময়। মন শক্ত করি রাখো।’

শ্যামল মুখের উপর থেকে গামছা সরিয়ে নিলে উজ্জ্বল-উদোম আকাশ দৃষ্টিতে হামলে পড়ে। আজকেও তেমন তাপদাহ। ধাঁ-ধাঁ চোখ ঝলসানো রোদ। তীব্র আলোর ঝলকানিতে কত কথা মনে পড়ে যায়। পশ্চিম আকাশের দূর কোণায় স্বপ্ন-মায়া-মরীচিকা। হালকা সাদা মেঘ ফুলরেণুর মতো জমা হয়। বৃষ্টি হবে কি হবে না কে জানে। আকাশ জীবন দেখে যায়…জীবন ডাকে।

‘কতদূর এয়েচি গো মোজাফর ভাই?’
‘এই তো মাঝাডাঙ্গা হাট পেরিয়ে এলাম।’
‘টের পানু না।’
‘তুমি ঘুমিয়ে পড়েছিলে।’
‘হাট-বাজারের শোরে তো…।’
‘আজ হাটবার নয়।’
‘ও মঙ্গলবার তো হাট বসে না।’

টাঙা চলে। নেমে আসে সময়ের প্রান্তসীমা। শ্যামলের দিনকাল ছায়াছবি। সকালে বাবাকে নিমগাছের ছায়ায় রেখে এসেছে। লক্ষ্মী পোয়াতি মানুষ। ভারী পেট ঝুলে পড়েছে প্রায়। ঠিকমতো হাঁটতে পারে না। সেও খাটে হাত দেয়। সেখানেই শুয়ে থাকে বাবা। তাকে পরিষ্কার করা, কাপড় ঠিক করে দেয়া, মুখে তুলে খাওয়ানো; লক্ষ্মী ধীরলয়ে সবটুকু করে। আজ নিমছায়ায় কাত হয়ে অদ্ভুত হাসে বাবা। নিশ্চুপ রহস্যময়। শ্যামল অনেকদিন পর তেমন মুখছবি দেখে। অথবা কে জানে চোয়ালভাঙা বাঁকামুখ মানুষ আনন্দ ধরে আনতে পারে কি না। তবু ভালো লাগে। বাবা আনন্দে থাক। মানুষ আপনমনে কত কথা বলে যায়, কেউ বোঝে কেউ বোঝে না; কেউ বলে বদ্ধ- পাগল। উন্মাদ। আপনমনে হাসে, কখনো কাঁদে; কখনো অন্যজগতের মানুষ। বাবা কোন্ পৃথিবীতে থাকে? তার স্মরণশক্তি নেই। আনন্দময় কথকথার মানুষ নিশ্চুপ নীরব আজ। প্রসারিত সম্মুখে ভাষাহীন চোখ ছড়িয়ে কী কথা যে বলতে চায় বোঝা যায় না। অথবা জেনে নিতে কাঙাল। শ্যামল কী বলে? বাবার স্মৃতিতে নির্জন-নিস্তব্ধ দুপুরে জল গড়িয়ে চলার শব্দ। বাতাসের কানে কানে ধানশিষের গান। বাবা সহজে খুঁজে পায়। শ্যামল কোনোদিন শোনেনি। কান পেতেও না।

সেই কথা দেড়-দুই মাস পর না বললে কি এমন ক্ষতি হতো কিংবা লাভ কী, কেউ ভেবে দেখে না; অন্তত লক্ষ্মী জানে না। বোঝার মতো মন নেই। আনমনা। অগ্রহায়ণের দিনশেষে সন্ধের আলোয় হিমবাতাসের নিশ্চুপ দোলা। তখনো পশ্চিম আকাশে গোধূলির রক্তিম আভা। শ্যামল চোখ তুলে তাকায়। মন হতচকিত-বিহ্বল। আকস্মিক নিষ্কম্প স্থির। লক্ষ্মী আবার বলে, –

‘বাপু দ মেনখান এনহিলোক কাথায় রড়লেদা। পুসটাউতেঞ আমজমকেদা।’
(বাপু কিন্তুক সেদিন কথা কয়ে উঠেছিল। মুই পষ্ট শুনিছু।)
‘চেত্! বার সেরমা অকয় হড় গুংড়া লেকায় তাহেকেনা, উনি দ চেকাতে কাথায় রড়া?’
(দূর! দু-বছর যে মানুষ বোবা হয়ে রইল, তার মুখে ক্যাংকরি কথা আসে?)
‘পুসটাউতেঞ আনজমা আকাদা। মেনখান আম দ বাঞ লাই আকাও আতমেয়া।’
(মুই পষ্ট শুনিছু। তুমাক কই নাই।)

শ্যামল তাকিয়ে থাকে। সম্মুখ দৃশ্যপট নাকি কোনো সুদূর অতীত থমকে দাঁড়ায়, রাতের ছায়া ধীরে ধীরে নেমে আসে; আঙিনায় জবাঝাড়ে মিইয়ে পড়ে দু-চারটি ফুল। এ কেমন কথা? পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় কথা কয় মানুষ? তখন দমকা বাতাসে কেঁপে ওঠে খড়ের গাদা শিখরদেশ। স্তূপ থেকে গড়িয়ে নেমে যায় দু-একটি ঝাড়ু।

‘লাহাতে দ বাঞ লাইয়াতমেয়া।’
(আগোত কইন্নাই তো।)
‘চমকাওলেন তাঁহেঁয়াঞ। পাতি আউগে বাং হেচলেনা। বাপু দ আর হোয়ে মেনকাদা। নংকাগে মিত্ধাও…বারধাও। ইনকাতে…।’
(মুই চমকি উঠিছিনু। বিশ্বাস হয় নাই। বাপু ফির কইলে। একবার…দুইবার। তারপর…।)

লক্ষ্মীর চোখ ছায়াম্লান। শ্যামল আলোছায়ায় তাকিয়ে অলৌকিক কোনো হদিশ হাতড়ায়। শেষযাত্রার সময় কথা বলে উঠেছিল বাবা। কী কথা? সেদিন টাঙা বিকেলের প্রান্তসীমায় বাঁশঝাড় পেরিয়ে আঙিনায় আসতে না আসতে দেখে মানুষজনের ভিড়। বাতাসে ভেসে থাকে চরম সত্য। পরম পূজ্য পিতা কিছুক্ষণ আগে চলে গেছে। কেউ মুখে জল দেয়ার সময় ধারেকাছে ছিল না। সেই কাহিনি জেগে থাকে। চোখে ভাসে। ভেসে ভেসে আবছা করে রাখে দৃষ্টি।
সেদিন নিমগাছের ছায়া-অন্ধকারে পড়ে থাকল খাট। কাঁথা-বালিশ। পুকুরপাড়ে কদমগাছের নিচে মানুষটিকে শোয়ানো হলো। পৃথিবীর সকল কাজ-কমর্, আনন্দ-বেদনা-হাসিকান্না, মান-অভিমান, অভিযোগ-দুর্যোগ সব জল ঢেলে ঢেলে ধুয়ে দিল কেউ। শ্যামল কী করে? মন হত-বিহ্বল বিবশ। বাবা তো মরেই গিয়েছিল। যে অশত্থ ছায়া তবু মাথার উপর, আলগোছে নির্মম সরে যায়। মধ্যরাতের আগে আগুন দেয়া হলো। এই তো জীবন। তারপর বেঁচে থাকা দিনকাল, অস্তিত্বের খেয়াপার; পুরোনো সবকিছু ফিকে হয়ে যায়। ফ্যাকাশে হতে থাকে। জীবনের একমাত্রা থেকে অন্যমাত্রায় যাত্রা করে। পথে নেমে যায়। তাই সেদিন যে কথা না উঠলেও কোনো ক্ষতি হতো না, কিংবা কী লাভ; কৌতূহল চমকে অপলক জেগে থাকে সে।

‘বাপু চেত্ কাথায় রড়লেত্ তাহেয়া লক্ষ্মী?’
(বাপু কী কথা কয়েছিল লক্ষ্মী?)
‘অহঞ মেনকায়া। বাঞ দিশায়েদা।’
(জানি না। মনে নাই কো।)
‘আম দ বাম লাই আ।’
(তুই আর কবিনে।)
‘রাংগাক্ আম নাহাক। নোয়া ঘাটা নিনদা নোয়াকো কাথা দ তাহে আচোয়ান। গাপা সেতাক্ ইঞ মেনা।’
(তুমি রাগ করবা। ভরা সন্ধ্যায় ইসব থাক। কাল বিহানে কবো।)
‘চেদাক্ ভূতকো সাসাপ আ? ইঞ কানগেচুঞ মিত্চেন লাটু ভূত দ।’
(ক্যান ভূত ধরবি? মুই তো বড় একখান ভূত!)
‘আম দ ভূত দ বাং, রাক্ষস কানাম। ইঞেম জমেঞা আম দ। হি হি হি!’
(তুমি ভূত না, রাক্ষস। মোক মারি কাটি খাবি। হি হি হি!)

শ্যামল হাসতে পারে না। লক্ষ্মীর আর দেরি নাই। এই মাসের কয়েকটি দিন, পেরিয়ে যাবে কি যাবে না; এসে পড়বে সে। লক্ষ্মী কোনো কোনো রাত আচমকা ঘুম থেকে উঠে বসে। দু-হাতে আগলে রাখে পেট। শ্যামলের ঘুমঘোর, ডানহাত এগিয়ে দেয়; আগত শিশুকে স্পর্শে হাতড়ায়। লক্ষ্মী দু-হাতে সরিয়ে দেয় তাকে। একরকম ছুঁড়ে দেয় সকল আকাঙ্ক্ষা মনোযোগ। শ্যামল ক্লান্ত-বিবশ। সারাদিন হাট-বাজার। শহরের রাস্তা-অলিগলি-বাসাবাড়ি হাঁকডাক চিৎকার। সন্ধেরাতে ফিরে আসে। লক্ষ্মীকে দেখে বড় মায়া হয়। এমন ভারী শরীরে কীভাবে কাজ করে যায়? শ্যামল কিছু করতে পারে না। মানুষ কীভাবে বেঁচে থাকে? শ্যামলের দু-চোখে ঘুম নেই। ঘরের অন্ধকারে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে। ব্যস্তত্রস্ত উদ্ভ্রান্ত।

‘চেত্ চেকায়দা? দারগিন ইঞ হহওয়া আ?’
(কী হইছে? দাই ডাকাম?)
‘বাঞ বাডায়া। আডি হাসো কানা। বাপু লেকা।’
(জানি না কো। বড্ড জ্বালায়। তুমার বাপুর মতো।)
‘বাপুগে চং-এ হিসুক্কানয়া। আহ্ ইঞরেন বাপু…বাপু।’
(বাপুই তো আসছে গো। আহ্ মোর বাপু…বাপু!)

শ্যামল উঠে বসে উদ্বাহু ডানা মেলে দেয়। লক্ষ্মীকে একবার জড়িয়ে ধরার অনন্ত সাধ। তার অনেক আদরের বউ। ভালবাসা জীবন। মায়াডোর বাঁধা স্বর্ণলতা-অস্তিত্ব। আদর করতে ইচ্ছে জাগে।

‘অচগক্ মেসে। বাঞ সাহেত দাড়ে আক্কানা।’
(সরি যাও তো…দম বন্ধ হই আসে।)
‘দারগিন বুডহিঞ হহ আয়া বাংখান।’
(দাইমাক ডাক দাও না হয়।)
‘আমরেন বাপু নিত দ বায় হিজুক্ আয়া।’
(তুমার বাপু এ্যালায় আসিবার নহায় গো।)

তখন সন্ধের কথা মনে আসে। আলাপ-প্রলাপ। ঘরের উপরচালা দিয়ে ভোরের আলো হাত-পা ছড়িয়ে নেমে আসে। এখন…ঠিক এখন বলা যায়। যায় কি? মন যে বড়ই উন্মন। কী কথা বলেছিল বাবা?

‘বাপু চেত্ কাথায় মেনলেদা?’
(বাপু কী কথা কয়েছিল?)
‘অক কাথা? তিনরে?’
(কোন্ কথা? কখন?’)
‘হলা আয়ুপ্এম মেন্লেত্। বাপু চালাক্ অক্তে চেত্ বাং-এ মেন্লেত্।’
(কাইল সাঁঝোত্ যে কলু, বাপু চলি যাবার সমায় কী বা কথা কয়েছিল।)
‘ও।’
(ও।)

ঘরের আলোছায়া দেয়ালে চকচকে দুটো চোখ। সেই দৃষ্টি কার? লক্ষ্মী নাকি বাবার? শ্যামলের মন-উন্মন বিভোল। আকস্মিক সকল স্মৃতি দিনকাল মন-ভাবনায় উদ্ভ্রান্ত-উদ্বেল জেগে ওঠে। লক্ষ্মী কথা বলে না কেন? কোনো গুপ্তধনের কথা বলে যায়নি তো বাবা? সেই যে বাবা প্রায়শ গল্প করে। আঙিনায় বসে, কদমতলায় পুকুরের পাড়; ফিসফিস কাহিনি। স্বপ্নকথন। এক বিঘত সোনার পুতুল বারান্দায় হেঁটে যায়। চমকে থমকে পেছনে দৃষ্টি রেখে ইশারায় ডাকে। তারপর আঙিনা জবাঝাড় পেরিয়ে কোথায় কোনখানে অদৃশ্য হতে থাকে। বাবা স্বপ্ন দেখে। ঘুমঘোরে হেঁটে চলে। পুতুল ডাকে। ডেকে যায়। বাবা দু-ধাপ এগিয়ে দাঁড়ায়। হাত বাড়িয়ে ধরবে। স্পর্শ লাগে। ধরতে ধরতে ধরা হয় না। স্বপ্ন ভেঙে যায়। যদি একবার হাতের মুঠোয় ধরা দেয়, অনেক অনেক ভুঁই হতো; হিমশীতল জলের পদ্মদিঘি। সেখানে স্বচ্ছ জলে মাছ সাঁতার কাটে। জলের ভাঁজে ভাঁজে সূর্যের আলোকচ্ছটা। মানুষের কল্পনা জীবনের স্বপ্ন। একটিই তো জীবন। এই সীমিত সময়ের কাহিনিতে কত আশা-আকাক্সক্ষা। সুখশান্তি। দুঃখ-বেদনা-অপমান। কেউ ভোলে কেউ ভোলে না। বুকের পাঁজরে গেঁথে নিয়ে বেঁচে থাকে। অস্তিত্বের সকল দায় কষ্ট শেষ হয় নদীর ঘাটে। কারও মুক্তি মেলে কারও মেলে না। বাতাসের ভাঁজে ভাঁজে শোনা যায় কত কথা। কত কান্না দীর্ঘশ্বাস। বাবা কী বলেছিল? লক্ষ্মী এবার বলুক। মানুষ মৃত্যুর আগে আগে যা বলে যায়, সবটুকু তার সত্য; কখনো অবাস্তব কল্পনা নয়।

‘লক্ষ্মী বাপু চেত্-এ মেনলেদা?’
(লক্ষ্মী কী কয়েছিল বাপু?)

সময় নিশ্চুপ স্তব্ধ। অপেক্ষার নদী কুলকুল বয়ে চলে। জল গড়িয়ে যায়। শ্যামলের দৃষ্টি আকুল। বাবা…বাবা সারাজীবন অপমান সইলে, কষ্ট করলে; সেই দায়ভার দিয়ে গেলে আমাকেও।

‘বাপু দ বাড়গে রেড়াক্-এ মেনলেদা। ইঞাক্ বাড়গে…ইঞাক্ হাসা। ইনা তায়োসে জাপিত্কেদা। মেত্দাক্ জরয়েনতায়া। মোচারেঞ দাক্ আদেয়া। মেনখান বায় নু লেদা…একালতেসে বাং।’
(বাপু ভুঁইয়ের কথা কয়েছিল। মোর ভুঁই…মোর ভুঁই। তারপর দু-চোখ বুজল। চোখের কোণা দিয়ে জল গড়িয়ে গেল। মুই মুখোত জল দিলাম। নিলনি…একফোঁটা নিলনি।)

শ্যামল বজ্রাহত বসে থাকে। একদা তাদের একখণ্ড জমি ছিল। বাবা লাঙল দেয়। জমি চাষে। সারাদিন ধুলো-জল-কাদা মেখে ঝকঝকে করে রাখে সীমা-পরিসীমা। ধানের চারাগাছ মাথা উঁচু চোখ মেলে বাতাসে দোল খায়। বাবার মুখছবিতে আনন্দঢেউ। বাতাসে কানপেতে শোনে ধানশিষের নবান গান। বড় ভালো লাগে। তারপর হায়! কেন এমন হলো? কোন্ নষ্ট মানুষেরা দখল করে নেয় সুখশান্তি-আনন্দ-বেঁচে থাকার সকল অস্তিত্ব? এই জঞ্জাল সরাবে কী করে?

দিনের আলো ফুটতে ফুটতে আইলের সরুপথে হেঁটে যায় শ্যামল। চেনা পথ বড় অচেনা লাগে। অথবা অচেনা রাস্তা চেনা হয়ে যায়। অনেক সহজ কিংবা দুর্মর কঠিন। চারিদিকে নতুন ধানের মউ মউ সুঘ্রাণ। বাতাসে স্বপ্নদোলা নবান্ন সংগীত। সে এবার বোধহয় কোনো সুর শোনে। নিজের জমি। বাপ-দাদার সম্পদ। সে ধীরে ধীরে সেখানে উঠে আসে। আইলের কোণায় কাঁধের গামছা রেখে হাতে নেয় কাস্তে। সোনালি ধান। রোদের আলোয় ঝিকমিক। গামছার লালরং থেকে উঁকি মারে দা’এর প্রান্তসীমা ক্ষুরধার। রোদের আলো থমকে দাঁড়ায়।
শ্যামল ধান কাটে। জমে উঠে ফসলের স্তূপ। দুপুরে আচমকা মেঘ-গর্জন হুংকার। মটরসাইকেল দূরে রেখে ছুটে আসে মাওলানা আজিজার। জাকির মাস্টার। আর কে কে? বন্যমোষের ছায়া। ধূসর-কালো অন্ধকার মেঘ। শ্যামল চমকে ওঠে। হাত থমকে যায়। একমুহূর্ত। কী ভেবে আবার সচল। সে থেমে থাকে না। আপনমনে ধান কাটে। অদ্ভুত মায়ার বর্ণিল নেশা। কোথাও কোনো দৃষ্টি নেই। আকস্মিক কী হয়, বুঝতে পারে না; শ্যামল দূরে ছিটকে পড়ে। কে যে কখন পেছন থেকে ধাক্কা দেয়, নাকি রোদপোড়া শক্ত বাঁশের আঘাত; দু-চোখে অন্ধকার পরদা নেমে আসে। কতক্ষণ? একটু সময়-মুহূর্তকাল অথবা যুগের পর যুগ অনন্তকাল। শ্যামলের তন্দ্রাঘোর। আচ্ছন্ন টলায়মান পদক্ষেপ। সে কিছু দেখতে পায় না। ধূসর-কালো মেঘের পটভূমিকায় এক বন্যমোষ গর্জন করে। বাতাসে থরথর করে অদ্ভুত নিনাদ। তারপর কি হলো? আকাশ দেখে। মানুষ দেখে। সেই গর্জন থেমে গেছে। স্তম্ভিত বাতাস। শ্যামলের দা থেকে চুইয়ে পড়ে রক্ত। মাওলানার কালো বুনোমোষ শরীর বেয়ে রক্ত-হলাহল নেমে যায়। জমির বুকে। পাতালের গভীরে। রক্ত…রক্তের রং লাল। সেখানে কোনো জাতপাত বোঝা যায় না।
স্টেশন পুলিশ ফাঁড়ি থেকে গাড়ি আসে। তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। গ্রামের বাতাসে ঘটনা-দুর্ঘটনা খবর দুর্গন্ধের মতো ছড়িয়ে যায়। লক্ষ্মী আসতে পারেনি। পারে না। আঙিনায় ছুটে এসেছিল। কিন্তু যে জগতে আসে, আসছে; থামিয়ে রাখে। ধুলো-মাটিতে গড়াগড়ি। জবাঝাড়ে উজ্জ্বল বর্ণের ফুল ফুটেছে। কোত্থেকে দুটো চড়ুই এসে ডালে নাচতে থাকে। শ্যামল সড়কের উপর ধীরলয়ে হেঁটে যায়। অগ্রহায়ণের বাতাস বড় বর্ণচোরা। মৃদুমন্দ বয়ে চলে। কোথাও হয়তো বৃষ্টি হয়। কখনো হিম-হিম বাতাস স্পর্শ আবার তপ্তঢেউ। শ্যামল হেঁটে যায়। হাঁটতে থাকে। বটতলি মোড়ে পুলিশের গাড়ি। প্রগাঢ় নীলরং কালো দেখায়। লক্ষ্মী দূর থেকে তেমন দেখতে পায় কি না পায়, তার মাথা ঘোরে; দৃষ্টি ছলছল হত-বিহ্বল উদাস। পরনের শাড়ি-পেটিকোটে রক্তের ছোপ ছোপ লাল-কালশিটে দাগ। জীবন মানচিত্র ইতিহাস। অস্তিত্বের অধিকার। তার কোলে শিশু। সদ্যকাটা নাড়ি থেকে রক্ত চুইয়ে পড়ে। তার দু-চোখ আজব এই পৃথিবীকে অসীম কৌতূহলে চিনে নিতে চায়। বোধোদয়ের অনন্ত জিগীষা। এদিক-ওদিক ধ্যানগম্ভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ। তারপর সহসা আকাশ বিদীর্ণ করে চিৎকার ছুড়ে দেয়।

সেই মেঘ-গর্জন আকাশ দিগন্তরেখায় প্রতিধ্বনি স্ফুলিঙ্গ তুলতে থাকে।

(সমাপ্ত)

জীবনের যত জঞ্জাল ৩

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১৮ টি মন্তব্য (লেখকের ৯টি) | ৯ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ১২-০৭-২০১৯ | ৯:৫৬ |

    এই পর্বের বৃত্তান্ত শেষ করলাম। ..  সেই মেঘ-গর্জন আকাশ দিগন্তরেখায় প্রতিধ্বনি স্ফুলিঙ্গ তুলতে থাকে।' জীবনের ঘনঘটা খুব অপরিচিত নয়। লিখার সাঁওতালি সংলাপ অসাধারন। ভাষান্তর না হলে কষ্ট হতো। সার্থক উপহার। ধন্যবাদ মাহবুব আলী ভাই।

    GD Star Rating
    loading...
    • মাহবুব আলী : ১৩-০৭-২০১৯ | ১১:০০ |

      অশেষ কৃতজ্ঞতা।

      GD Star Rating
      loading...
  2. রুকশানা হক : ১২-০৭-২০১৯ | ১০:২১ |

    আগের পর্বগুলো মিস করেছি। দারুণ সাঁওতালি ভাষা। শুভকামনা    

    GD Star Rating
    loading...
    • মাহবুব আলী : ১৩-০৭-২০১৯ | ১১:০১ |

      এই ভাষান্তর করেছেন আমার কলিগ আল বিনুস হাঁসদা। সকল কৃতিত্ব তার নিকট গেল।

      GD Star Rating
      loading...
  3. শান্ত চৌধুরী : ১২-০৭-২০১৯ | ১৫:২৬ |

    স্টেশন পুলিশ ফাঁড়ি থেকে গাড়ি আসে। তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। গ্রামের বাতাসে ঘটনা-দুর্ঘটনা খবর দুর্গন্ধের মতো ছড়িয়ে যায়। লক্ষ্মী আসতে পারেনি। পারে না। আঙিনায় ছুটে এসেছিল। কিন্তু যে জগতে আসে, আসছে; থামিয়ে রাখে। ধুলো-মাটিতে গড়াগড়ি। জবাঝাড়ে উজ্জ্বল বর্ণের ফুল ফুটেছে। কোত্থেকে দুটো চড়ুই এসে ডালে নাচতে থাকে। শ্যামল সড়কের উপর ধীরলয়ে হেঁটে যায়। অগ্রহায়ণের বাতাস বড় বর্ণচোরা। মৃদুমন্দ বয়ে চলে। কোথাও হয়তো বৃষ্টি হয়। কখনো হিম-হিম বাতাস স্পর্শ আবার তপ্তঢেউ। শ্যামল হেঁটে যায়। হাঁটতে থাকে। বটতলি মোড়ে পুলিশের গাড়ি। প্রগাঢ় নীলরং কালো দেখায়। লক্ষ্মী দূর থেকে তেমন দেখতে পায় কি না পায়, তার মাথা ঘোরে; দৃষ্টি ছলছল হত-বিহ্বল উদাস। পরনের শাড়ি-পেটিকোটে রক্তের ছোপ ছোপ লাল-কালশিটে দাগ। জীবন মানচিত্র ইতিহাস। অস্তিত্বের অধিকার। তার কোলে শিশু। সদ্যকাটা নাড়ি থেকে রক্ত চুইয়ে পড়ে। তার দু-চোখ আজব এই পৃথিবীকে অসীম কৌতূহলে চিনে নিতে চায়। বোধোদয়ের অনন্ত জিগীষা। এদিক-ওদিক ধ্যানগম্ভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ। তারপর সহসা আকাশ বিদীর্ণ করে চিৎকার ছুড়ে দেয়।

    অসাধারণ কথামালা…
    শুভ কামনা সতত

    GD Star Rating
    loading...
  4. সুমন আহমেদ : ১২-০৭-২০১৯ | ১৯:৪৯ |

    নিমগ্ন পাঠ মাহবুব আলী ভাই। নতুন আশা আর ভাষায় শ্যামল জেগে থাক। 

    GD Star Rating
    loading...
    • মাহবুব আলী : ১৩-০৭-২০১৯ | ১১:০২ |

      ঠিক। আশা জাগানিয়া কিছু তো থাক আমাদের পোড়া জীবনে।

      GD Star Rating
      loading...
  5. সৌমিত্র চক্রবর্তী : ১২-০৭-২০১৯ | ২০:০৬ |

    ভাষার এই ঐতিহ্য কখনও কখনও আমার লেখাতেও আমি তুলে আনার চেষ্টা করেছি। এই গল্পের চিত্রপট গম্ভীর হলেও আপনার সুদক্ষ হাত লেখাটিকে সত্যরূপ দিয়েছে। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • মাহবুব আলী : ১৩-০৭-২০১৯ | ১১:০৩ |

      অনেক ধন্যবাদ কবি। একটু চেষ্টা করা আর কি!

      GD Star Rating
      loading...
  6. রিয়া রিয়া : ১২-০৭-২০১৯ | ২০:৩০ |

    গল্পটির পরিণতি একদম পারফেক্ট জায়গায় ঘটিয়েছেন। গল্পে যদিও আমার হাত নেই তারপরও পাঠক হিসেবে একেবারে মন্দ নই। লেখার মধ্যে ছোট ছোট শব্দানুভূতির কাজ অসাধারণ দেখিয়েছেন। মন বিষণ্ন হলেও গল্পকে গল্প হিসেবেই নিলাম। মনে ঠাঁই দিলে বরং কষ্টই বাড়বে। গুডলাক দাদা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • মাহবুব আলী : ১৩-০৭-২০১৯ | ১১:০৪ |

      গল্প গল্পই। ভালো লেগেছে জেনে আনন্দিত। শুভকামনা

      GD Star Rating
      loading...
  7. আবু সাঈদ আহমেদ : ১২-০৭-২০১৯ | ২১:০২ |

    হুম। তাহলে এই অবস্থায় ইতি টেনে দিলেন। ভালো লেগেছে বিত্তহীনের গল্প।

    GD Star Rating
    loading...
    • মাহবুব আলী : ১৩-০৭-২০১৯ | ১১:০৪ |

      ধন্যবাদ গল্পকার, অকবিতার সেরা কবি। শুভকামনা।

      GD Star Rating
      loading...
  8. সাজিয়া আফরিন : ১২-০৭-২০১৯ | ২৩:৪৫ |

    চতুর্থ এবং শেষ পর্বের প্রিন্ট নেয়া হয়ে গেলো। কৃতজ্ঞতা জানবেন ভাই। Smile

    GD Star Rating
    loading...
    • মাহবুব আলী : ১৩-০৭-২০১৯ | ১১:০৭ |

      আহা! এত কষ্ট করলেন? বইটি নিলেই তো হতো। 'অস্তিত্বের পলায়ন' বইয়ে আছে। তবে সেখানে সাঁওতালি কথোপকথন নেই। শুভকামনা।

      https://www.rokomari.com/book/178781/ostitter-polayon

      GD Star Rating
      loading...
  9. শাকিলা তুবা : ১৩-০৭-২০১৯ | ০:০৫ |

    পাঠক হিসেবে শেষ পর্বেরও স্বাক্ষী হয়ে রইলাম।

    GD Star Rating
    loading...
    • মাহবুব আলী : ১৩-০৭-২০১৯ | ১১:০৮ |

      অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

      GD Star Rating
      loading...