জীবনের যত জঞ্জাল

বুড়ো মানুষ এত মতলববাজ! শ্যামলের জানা ছিল না। তার বয়স আঠাশ। দুনিয়াদারির অনেককিছু দেখার-জানার বাকি। সে দু-চোখের পাতা ছোট করে সামনে পিটপিট দৃষ্টি রাখে। রোদের তাপ বাড়ছে। তীব্র আলোয় সবকিছু কেমন বিদগ্ধ…ঝাঁ-ঝাঁ। এসবের মধ্যে জব্বার মিয়ার অনেক ধৈর্য। মানুষটি একটুও ঘামে না। শীতল মেজাজে জাল বোনে। বাঁশের খুঁটির উপর থেকে ঝুলে আছে বর্ণিল সুতোর কারুকাজ। নকশি জাল। তার মনে কোন্ কল্পনার বুনন কে জানে। শ্যামলের স্বপ্ন বোনা। অনেক আশা নিয়ে এসেছে। বরষার আগে আগে সব কাজ গুছিয়ে নিতে পারলে একটু নিশ্চিত হতে পারে। হাতে দুটো পয়সা থাকে। এদিকে লক্ষ্মীর সময় নেই। কোন্দিন যে ব্যথা ওঠে। আধো ঘুম-জাগরণে স্বপ্ন-দুঃস্বপ্ন ভাবনা-চিন্তায় কেটে যায় রাত।
রাস্তার ওপারে স’ মিল। অনেকদিন ধরে মেশিন বন্ধ। পরিত্যক্ত। চালু আছে জ্বালানি খড়ির দোকান। চারপাশে খড়ির স্তূপ। বাতাসে কাঁচা আমকাঠের শুকনো গন্ধ। কয়েকটি কাঠের গুঁড়ি এলোমেলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। সে-সবের পেছনে চা-বিস্কুটের টং-দোকান। মুড়ি-ঘুগনিও পাওয়া যায়। দোকানের কোনো ফাঁকফোকর গলিয়ে আসা পানি ভেসে ভেসে কাদাজল। কচুর দু-একটি লতা গজিয়ে উঠেছে। কখনো বাতাসে দোল খায়। আরও দক্ষিণে দেয়ালঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা ইপিল-ইপিল গাছের ছায়া। তীব্র রোদে ম্লান। সেখানে একপাশে দু-একটি টাঙা। ঘোড়াদুটোকে বড় অসহায় লাগে। চোখে চামড়ার মোটা ঠুলি অন্ধপ্রায়। অন্যের বোঝা টানাই জীবনের ভাগ্যলিপি। এই বেঁচে থাকা। শ্যামলের দু-চোখ কখনো ঝাপসা। সেও সারাজীবন জীবনের বোঝা টেনে বেড়ায়। শান্তি পেল না। এদিক-ওদিক ছুটোছুটি ব্যস্ততা অস্থির পথরেখা ধরে হেঁটে যায়। দু-দ- বিশ্রাম নেই। এখন বসে আছে বুড়োর দোকানে। কেনাবেচা দরদাম শেষে যা হয় এক সমাধান হলে স্বস্তি আসে। গুমট গরমে ভালো লাগে না।

‘না ভাতিজা, ছেইদিন আর লাইখো। নদি শুকায়ে ছিল তখুন পেতি। এখুন বান-বন্যা সব ভেইসে লিয়েছে। যাওবা পাওয়া যায়, ছালার সাপখোপ-কাঁকড়া-বিছে কি কুন্ঠে ঘাপটি মেইরে আছে; বিপদ মানে মহাবিপদ। তার উপহ্র আবার শেয়াল-কুকুর হেইগে…কি বুলব? দুর্গন্ধ-দুর্গন্ধ। ওয়াক্ থুহ্! কি বলে কাপুড়ে গায়ে মাখামাখি। না না দুইশর কমে পারব লাখো।’
‘বড় বিপদ হলি গো চাচা। বাজার মন্দা। হাতে তেমন ট্যাকাও নাই।’
‘পরে দিবি। এখুন না থাকলে পরে দিবি। এক সপ্তাহ দু-সপ্তাহ। আমি কি ধারবাকি দিই না?…তো কী কহছিস, মাল টানমো?

বুড়ো কাঁচাপাকা-ধূসর-ঝাঁকড়া চুলে হাত বুলোয়। অন্য জেলার মানুষ। কথায় অদ্ভুত টান। শ্যামলের বুঝতে অসুবিধা হয় না। সাড়ে ছয়-সাত ক্রোশ রাস্তা পেরিয়ে এখানে আসে। প্রয়োজনীয় মালামাল কেনে। তারপর ফিরে যায়। এই কয়েক মাসে একটু ঘনিষ্ঠতাও হয়ে গেছে। সে অপলক তাকায়। বুড়ো মাথা ডানে-বামে দুলিয়ে নেতিবাচক মুখখানায় হাসি তোলে। শ্যামলের একচিলতে নীরব হাসি। তার ঠোঁটে সবসময় আনন্দ। জীবনের সকল হাসিখুশি ধরে রাখতে চায়। সেই আনন্দ কতটুকু সত্য কিংবা মিথ্যের জগাখিচুরি জানে না। বুঝতে পারে না। মনকে যে সবসময় বোঝানো যায় না। মন বড় উন্মন। নির্বোধ-দুর্বোধ্য। কারও কথা শোনে না। নিজের কথাও। সে বিড়িতে শেষ-সুখটান মেরে বুড়োর হাতে গুঁজে দেয়। দু-জনে মুখোমুখি বসে থাকে। আকাশে চনচনে রোদ। রাস্তায় তীব্র আলো। এখানে একচালার নিচে হালকা রোদছায়া। পশ্চিমে আশপাশ জুড়ে বনপাকুড়-শ্যাওড়া আর অচেনা গাছগাছালির ঘন জঙ্গল। কখনো ফ্যাকাশে ছায়া প্রগাঢ় অন্ধকার লাগে। চোখে-মুখে এনে দেয় হিম হিম তৃষ্ণা। তারপর আচমকা গরম বাতাসের উৎকট ঢেউ। তপ্ত ভাপ। বুড়ো দু-তিন ফুট উঁচু মাঁচায় বসে থাকে। শ্যামল নিচে পা ছড়িয়ে দড়ির পিঁড়িতে। নিঃশ্বাসে শুকনো মাটির আঁশটে গন্ধ।
ঘোড়াদুটো খয়েরি-কালো আর ধূসর-সাদা। নিস্তব্ধ দুপুরের মতো একমনে ঘাস চিবোয়। উজ্জ্বল রোদে নেপিয়ার ঘাসে সবুজ ঝিকমিক প্রভা। ঘোড়া ধীরস্থির মুখে টেনে নেয়। প্রগাঢ় শ্বাসে নিশ্চুপ ভোজন। ঠোঁটের কষ বেয়ে সাদা ফেনা নামে। কখনো থমকে নিঃসাড়। সহসা সামনে দৃষ্টি ছুড়ে দেয়। চোখের উপর ঠুলির শক্ত দেয়াল। কিঞ্চিৎ ফাঁক দিয়ে সামনের অংশ দেখা। পেছনে তাকাতে পারে কি? পারে না। পেছন বা অতীত বলে কোনোকিছু নেই। তেমনকিছু মনে পড়ে কি না…দৃশ্যছবি? কে জানে। শ্যামলের অনেক কথা অনেক ছবি দোলা দেয়। মন-ভাবনার নদীতে ঢেউ জাগে। অস্থির তরঙ্গ…প্রবাহ খেলা। তার দু-চোখে অতীতের সুখস্বপ্ন ঠুলি। সামনের দিনকাল তেমন স্বচ্ছ কোথায়? গোলকধাঁধা সুড়ঙ্গ মায়াঘোর। তেমন করে দেখতে পায় না অথবা কী এমন দেখে যায়, দেখার মতো দেখা হয়, হয় না; সব দেখা দেখা নয়। দুনিয়ার অনেককিছু দেখা হলো না। কিছু তার দেখা। যতটুকু হলো সবটুকু কেমন জানে অথবা জানে না। জানা যায় না। বোঝা যায় না। এ হলো জানা-অজানা জীবন-সংসার কাহিনি। দেখা হয়-দেখা হয় না, জানা-অজানা থেকে যায়; শত মানুষের বর্ণিল চেহারা। বুকের আড়ালে সেঁটে থাকা হাজার বিবিধ মুখছবি। মুখোশ।
জীবন আর জীবিকা নিয়েও কতটুকু ধারণা তার? যতটুকু জানা হলো বা বোঝার, সে শুধু বিমূর্ত জলছবি। দুপুরের রোদ-আকাশে স্বপ্নদোলার মতো দু-একটি মেঘ ভেসে যায়। উড়ে যায় দূর দিগন্তে। মানুষ-সমাজ থেকে অনেক দূর। দূর…বহুদূর। গন্তব্যহীন পথ চলা। ভেসে বেড়ানো জীবন। অথবা কোনোকিছু নয়। জীবনপ্রবাহে সততার কোনো কমতি নেই শ্যামলের। কারও মন্দ চিন্তা কেন, কোনো মনোযোগ নেই; সে থাকে নিজের মধ্যে। একলা ভুবন। একা একা অনবদ্য বেঁচে থাকা। প্রবীণ মানুষের কথা। পুঁথিপাঠ নিয়মনীতি গুরুজনের উপদেশ পরামর্শ পাথেয়। অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণের চেষ্টা। কাউকে ঠকিয়ে দু-আনা বেশি উপার্জন করে, এমন কাজে নেই। তাই বুড়োর দু-চোখে জলতরঙ্গ মতলব দেখে মন-ভাবনায় উন্মন-উদ্ভ্রান্ত আজ। শ্যামল অনেকক্ষণ অপলক-নিষ্পলক। বুঝতে পারে কি পারে না, কোনো গুমট তন্দ্রাঘোর দুপুরের মধ্য দিয়ে ভেসে যায়। তারপর সহসা চমকে দু-চোখ সরিয়ে রাখে। রাস্তা ছাড়িয়ে আকাশের নিঃসীম দিগন্তে দৃষ্টি চলে যায়। মানুষ কত মতলববাজ! এসবের মধ্য দিয়েই এগিয়ে যেতে হবে তাকে। এগিয়ে যেতে হয়। বেঁচে থাকতে হয়। এরই নাম বেঁচে থাকা। অস্তিত্ব জীবন।

মানুষের সঙ্গে পেরে ওঠা বড় শক্ত। এই তো সেদিনের কথা। বাবার সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে যায় শ্যামল। আজিজার ম-লের আঙিনা অনেক দিঘল। তখনো সন্ধের আলোছায়া নিশ্চুপ বসে আছে। অন্ধকার গাঢ় হয়নি। দু-চারজন মানুষ বেঞ্চের উপর। দক্ষিণে দুটো আমগাছ। আম্রপালি। বড় বড় আমের ভারে নুয়ে পড়েছে। ম-ল ফাযিল মাদরাসার প্রভাষক। আরবি পড়ায়। হাদিস-তাফসিরের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। ফারায়েজের কঠিন-জটিল অঙ্ক। শ্যামলের এসব জানার কথা নয়। লোকমুখে শোনা। সে সদ্য-কৈশোর উতরানো তরুণ। চোখে-মুখে নিষ্পাপ স্বপ্নমায়া। গোধুলির লালিমা আর রাতের ঘুমে শুধু লক্ষ্মীর মুখছবি। পাশের বাড়ির কিশোরী-তন্বী। শ্যামলের নিজ দেয়ালের ও-পাশে অন্য বাড়ির ঘর। কখনো রাতের স্থির-নিশ্চুপ প্রহরে কানপেতে শোনে নিঃশ্বাসের ঢেউ। তার উঠে দাঁড়ানো। চৌকিতে এপাশ-ওপাশ। কয়েক বছর হলো এখানে বসত গেড়েছে ওরা। পশ্চিমে পুবমুখি দুটো ঘর। পুবের দেয়াল ঘেষে হেঁসেল। তার পেছনে পুকুরপাড়ের কোণায় বিশাল কদম গাছ। বর্ষায় আকাশ আলো করে রাখে। নীল কিংবা ধূসর-সাদা পটভূমিকায় অদ্ভুত মায়া-জলছবি। কোনো কোনো দিন দুপুর-শেষ বিকেলে লক্ষ্মী এসে দাঁড়ায়। ছোটভাই সঙ্গে। কিছুক্ষণ স্থির-নীরব দূরের দৃশ্যে তাকিয়ে থাকে। কখনো খুনসুটি দৌড়োদৌড়ি। তখন দুটো কথা হয়। বাবা-মা দুই ভাইবোন। আঙিনার শেষে দেয়াল। ও-প্রান্তে যেমন লতিয়ে ওঠা দু-একটি জবা এ-প্রান্তের সীমানার বাতাসে দোল খায়, খেতে থাকে, তার দু-চোখে স্বপ্ন-আবাহন। শ্যামলের বুকে অচেনা ডাক…বিমূর্ত আহ্বান। লক্ষ্মী…লক্ষ্মী। মন হারালো…হারালো। একদিন ঘর আলো করে বুকে স্থায়ী ঠাঁই। শ্যামলের মায়াবী জীবন-সংসার। লক্ষ্মী মা হতে চলেছে। প্রথমবার। তাই শ্যামলের বুকে অস্থির উত্তেজনা। থিরথির অস্থির কাঁপন।
সেদিনের কথা মনে পড়ে। অনেকক্ষণ পর অন্দর থেকে বের হয় আজিজার ম-ল। ঘি-হলুদ রং পাঞ্জাবি। বাতাসে ছড়িয়ে যায় অচেনা আতরের সুবাস। মন হালকা লাগে। কোনো স্বপ্নঘোর মায়াজাল। বেঞ্চের উপর বসে থাকা মানুষজন উঠে দাঁড়ায়। তারা কী-সব কথা বলে বোঝা যায়…বোঝা যায় না। শোনা না শোনা ফিসফাস। এভাবে অন্ধকার ধীরে ধীরে হাত-পা ছড়িয়ে নেমে আসে। আসতে থাকে। টিউবওয়েলের ওদিকে লেবুতলায় ঘোর আঁধার। তারা সেখানের কোনো এক দূর কোণায় বসে থাকে। ছোট জাত। বেঞ্চে বসার অনুমতি নেই। মানুষজন চলে গেলে সময় হয় তাদের।

‘তো বাহে নীলকান্ত, কি তনে আইছি?’
‘বাবু ওই ভুঁইকোনা…।’
‘ওইটা তো জাকির নিছে। এই বছর তো হইল না, সামনের বছর নিবু।’
‘বাবু ভুঁইকোনা মোর বাপ দিয়া গেইছে। ম্ইু কিছু জাননু না…দেখনু না মাঁইষে হাল দিলি। আইজ রোপা গাঁড়োছে। কেমন কাথা?’
‘দুর ব্যাটা! তোর আর জমি আছে? খাস ভুঁই। তিন-চার মাস ধরি জরিপ হইল। তখন কুনঠে ছিলু? খাজনা নাই…খারিজ নাই…মালিক নাই। ওই জমি মোক দিছে সরকার। মোর জমি। এ্যালা তোর কেমন করি হইল? যা এই বছর জাকির আবাদ করুক। সামনের বছর তুই করিবু। তিন ফসলি জমি। বছরে ত্রিশ হাজার দিবু।’
‘মোর জমি…ফির ট্যাকা ক্যানে?’
‘আচ্ছা পাগল তো তুই নীলকান্ত। তুই এক কাম কর। সাদেক মেম্বারের ঠে যায়া ভালো করি শোনেক। জমিজমার হিসাব-কিতাব তো বুঝিবু না।’
‘এইটা ক্যাংকরি হইল বাবু? মোর জমি। বাপের আমল থাকি হাল-আবাদ করো। কাঁহো কিছু কইল্ না। এ্যালা মুই হাল জুড়িম। যায়া দেঁখ তোমার লোকজন হাল দিছে। মোরে জমি কিন্তু মুই ফিরি আনু। কেমন কাথা?’
‘ম্যালা কাথা কই না নীলকান্ত। ওই জমিত হাল জুড়িছে জাকির মাস্টার। মোর জমি, যাক খুশি তাক দিবার পাঁরো। যাঁয় টাকা দিবি, আবাদ করিবি। তুই দিবু আবাদ করিবু। যা হউক, তোর মনোত্ সন্দেহ থাকিলে মেম্বার-চেয়ারম্যানের ঠে যা। ওমাক ক। কোট-কাচারি আছে। মামলা করিবার পারিস। এইলা খাস জমি, সরকার নতুন করি দেছে। এ্যালা মুই মালিক। ভাল্ করি খবর নি। যাউক কাথা কওয়ার সমায় নাই। এ্যালা তোমরা যাও। নামাজের অক্ত চলি যাছে।’

শ্যামল ফিরে আসে। বাবার সঙ্গে হেঁটে যায়। বাইরে আলো-অন্ধকার ছায়া। রাস্তার ধারে মাটির তলায় ঝোপঝাড়ে উচ্চিংড়ে-ঘুগরের চিৎকার ঘনঘটা। মাথা ঝিমঝিম বিবশ প্রায়। রাস্তার পাশে পাশে ডিপ-টিউবওয়েলের নালায় সেচ পানির গতিপথ। চাঁদের আলোয় ঝকঝকে কুলুকুলু শব্দঢেউ। শ্যামলের বুকে অবরুদ্ধ চিৎকার। আর্তনাদ। বাবার পরাজিত অসহায় মুখছবি বার বার বাতাস ঝাপটার মতো জেগে ওঠে। কি করবে সে? কি করতে পারে? মনের কোণায় ফুঁসে ওঠা আগুনের দপদপ শিখা কান্না হয়ে যায়। মন পোড়ে। বিষাদ বেদনায় বাতাস ফিসফিস কথা কয়। কী বলে? সে জানে না। তার দৃষ্টি ঝাপসা হতে হতে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। দৃষ্টির সামনে পড়ে থাকে সেই জমি। শুক্লা নবমীর মৃদু আলোয় ধীর বাতাসে ধানের চারাগাছ দোল খায়।

আজ মন দোলায়মান। কয়েকদিন ধরে দোলাচল ঢেউ। কেন এমন হলো? কেন এমন হয়? এসব কাজ ভালো লাগে না। আগে যেমন ক্ষেতের জলে পা ভিজিয়ে ধানচারা রোপণ করে, রোদছায়া বিকেলে গাছের ডগায় আলোর নৃত্য দোলা; মন ফিরে পেতে ব্যাকুল। ক্ষেতের টলটলে জলের মধ্যে সাঁতার কাটে পোনামাছ, ছোট ছোট ঠোঁট খুলে বাতাসের বুদবুদ ঢেউ; খুব মনে পড়ে যায়। কোনোদিন পদ্মদিঘির পুবালি জঙ্গলে অনেক উঁচু গাছের শিখরদেশ দৃষ্টির গভীরে রহস্য তুলে ধরে। বাঁশবনের অচেনা কোনো গোপন খোপ থেকে দু-চারটি কানিবকের ছা টেনে নামায়। সন্ধের টিপটিপ আঁধারে ঝোপের ছায়ায় দিঘির পাড়ে বড়শি গেঁথে রাখে। তখনো সাঁতার কেটে চলে পুঁটি-সাঁটি কিংবা কই। তারপর রাত পাহারা চোখে অপেক্ষার ভোর হামলে পড়ে। ভাগ্য ভালো হলে শোল-রুই-কালবাউশ জুটে যায়। জঙ্গলের প্রগাঢ় অন্ধকারে পেতে রাখা ফাঁদেও জড়িয়ে যায় দু-একটি বনবেড়াল বা ধেড়ে ইঁদুর। আকাশ থেকে নেমে আসা কোনো রাতচরা পাখি। কি তার ওজন! কি আনন্দ মনে! উচ্ছল সেইসব দিন ঢেউ জাগায়। এখন কী করে সে? পানসে নিরানন্দ পা-ুর ঘর-সংসার। কষ্টের মধ্যে বেঁচে থাকা।
যেদিন কোনো বড় শিকার হাতে এসে পড়ে, তার মতো বাবার দু-চোখেও আনন্দ ঝলমল খুশি। মা আঙিনার উনুনে দুপুর রোদে রাঁধতে বসে। বাতাসে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে যায় স্বাদু গন্ধের ঘ্রাণ। বাবা একচালার ছায়ায় বসে ভাত খায়। শ্যামল তার পাশে। চৈতালি বাতাসে কোনোদিন দূর মাঠে রাস্তায় আচমকা ধুলো ওড়ে। তাদের চালাঘরের পেছনে বড় দিঘিতে ছেলেমেয়েরা ধুপধাপ ঝাঁপায়। বাবার মুখে কুরকুরে শব্দ। শ্যামলের চোখে-মুখে উদার-তৃপ্তি। হাসি মুখছবি।

‘সুমতি আডি সেবেলাকানা য়া…আর মিত্ কুটি ইমাঞমে।’
(সুমতি বড় স্বাদ হয়েছে রে…আরেকটা টুকরা দে।)
‘হাপোই এমামকানাঞ।’
(হাঁ হাঁ দিই দিই।)
‘শ্যামলা এমায়মে…হোপনিঞ আডিতেত্ এ কামিয়া। আম লাগিত দোহোজংমে। মেনাক্গেয়া থ?’
(শ্যামলাকে দে…ব্যাটা আমার কাজ করে খুব। তোর জন্য রাখিস। আছে তো?)
‘মেনাক্ গেয়া।’
(আছে… আছে।)

বাবার সুখ-তৃপ্তি বুকে আনন্দ ঢেউ তোলে তার। মা-বাবা দু-জনের মধ্যে ভারি মিল। ভালবাসার এমন ছায়াছবি আর কোথায়? শ্যামল আবার ফাঁদ পেতে রাখে। ফাঁদের জীবন-সংসার। আজ সে নিজেই ফাঁদের মধ্যে ঘুরপাক খায়। সে এক বনবেড়াল কিংবা ধেড়ে ইঁদুর। দিঘির জলে ছায়া-অন্ধকারে পেতে রাখা আকশিতে তড়পানো ছোটমাছ। তার মন পোড়ে। মা চলে গেছে কত দিন। চোদ্দো বছরের শোককাল মিলিয়ে গেল…বিষণ্ন দৃষ্টি মুছে যায় না। সেই যুগকাল শেষ হয় না। এখন বাবার চলে যাওয়ার সময়। মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি। অনন্ত প্রতীক্ষা। একচালার দূর ছায়ায় শোয়া-আধশোয়া নির্বাক মানুষটির দিকে তাকালে অচিন রূপকথা-কান্নাঢেউ বুকে আছড়ে পড়ে। ‘মা…মা তুই কেনে চলে গেলি? বাবার একলা থাকা সহ্য হয় না।’ মানুষ কেন চলে যায়? বাবার দু-চোখে তেমন জিজ্ঞাসা ঢেউ তোলে কি? কে জানে।
শ্যামল একলাফে সময়ের রোদে নেমে আসে। পশ্চিম আকাশে কয়েকটি চিল ওড়ে। শ্লথ-ক্লান্ত চক্রাকার ঘুরে ঘুরে দূর হাওয়ায় ভেসে যায়। আহা! এমন জীবন হয় না কেন তার? সে বুড়োর দিকে দৃষ্টি রেখে হয়তো কিছু ভেবে নেয়। যেভাবে হোক কোনোমতো কেনাবেচা শেষে ফিরতে হবে। তারপর কাজ আর কাজ।
(চলমান)

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

২৩ টি মন্তব্য (লেখকের ১০টি) | ৯ জন মন্তব্যকারী

  1. সৌমিত্র চক্রবর্তী : ০৯-০৭-২০১৯ | ১৮:৫৯ |

    গল্পটি পড়ার পর হুঁশ করে করে কয়েকটা বড় সাইজের নিঃশ্বাস বেড়িয়ে এলো নাক থেকে গল্পকার মাহবুব ভাই। আজকাল বয়সও হয়েছে। মোবাইলের মনিটরে চোখ রেখে গল্প পড়তে গেলে বিপত্তি বাঁধে। পরিশেষে এই এপিসোড পড়ে শেষ করতে পেরেছি। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_yahoo.gif  চলমান থাকায় আশ্বস্ত হলাম। বাঁচা গেলো। আবারও এই রেশ ধরে পড়া যাবে। শুভেচ্ছা জানবেন। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • মাহবুব আলী : ১০-০৭-২০১৯ | ৯:৩৯ |

      বেশ বড় গল্প। শুভেচ্ছা রইল।

      GD Star Rating
      loading...
  2. সুমন আহমেদ : ০৯-০৭-২০১৯ | ১৯:০১ |

    জীবনের যত জঞ্জাল বোধকরি শুরুবাদ হলো। দেখা যাক কোথায় নিয়ে নৌকা ভেরান। অনেকদিন পর আপনার লিখা। ভালো লাগছে নিজের কাছে। জগত সংসার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি আমি। কারু সাথে সাথে যোগাযোগ বলতে এই শব্দনীড়। স্বাগতম মাহবুব আলী ভাই। Smile

    GD Star Rating
    loading...
    • মাহবুব আলী : ১০-০৭-২০১৯ | ৯:৪০ |

      এভাবে নিজেকে গুটিয়ে রাখছেন কেন কবি? জীবন তো ফ্যানটাসি নয়। মন শক্ত করুন। শুভকামনা।

      GD Star Rating
      loading...
    • সুমন আহমেদ : ১০-০৭-২০১৯ | ১১:৩৬ |

      অনেক দুঃখ পেয়েছি মাহবুব আলী ভাই। আর ফিরবো না হয়তো মানুষের কোলাহলে। Frown

      GD Star Rating
      loading...
  3. রিয়া রিয়া : ০৯-০৭-২০১৯ | ১৯:০৭ |

    অফলাইনে দেখলাম আপনার গল্পটি। চলমান শব্দ থাকায় আশাবাদী হলাম। কৃকেট ম্যাচ চলছে। চোখ বাঁচিয়ে পড়ে নিলাম। Smile

    GD Star Rating
    loading...
    • মাহবুব আলী : ১০-০৭-২০১৯ | ৯:৪১ |

      ধন্যবাদ কবি। শুভকামনা

      GD Star Rating
      loading...
  4. শাকিলা তুবা : ০৯-০৭-২০১৯ | ১৯:৫৫ |

    জব্বার মিয়া, শ্যামল এবং বাবা। আপাতত এদের পর্যন্ত পড়লাম। অপেক্ষা আগামীকালের।

    GD Star Rating
    loading...
    • মাহবুব আলী : ১০-০৭-২০১৯ | ৯:৪২ |

      আজিাজার মণ্ডল এবং লক্ষ্মীর কথাও এসেছে।

      GD Star Rating
      loading...
  5. আবু সাঈদ আহমেদ : ০৯-০৭-২০১৯ | ২০:৩০ |

    বিষাদ বেদনায় বাতাস ফিসফিস কথা কয়। কী বলে? সে জানে না। পরের পর্বেও থাকবো। 

    GD Star Rating
    loading...
    • মাহবুব আলী : ১০-০৭-২০১৯ | ৯:৪৩ |

      ধন্যবাদ আবু সাঈদ আহমেদ, ছোটভাই। আপনার অণুগল্প মন স্পর্শ করে।

      GD Star Rating
      loading...
  6. সাজিয়া আফরিন : ০৯-০৭-২০১৯ | ২১:৪১ |

    প্রিন্ট নিলাম ভাই। 

    GD Star Rating
    loading...
    • মাহবুব আলী : ১০-০৭-২০১৯ | ৯:৪৫ |

      আবার প্রিন্ট নিতে হবে। তবে বিজয়-এ লেখা কনভার্ট করা হয়েছে, তাই অনেক বানান ভেঙে গেছে। বিশেষ করে সাঁওতালি ডায়লগ। বুঝে নিয়ে পড়িয়েন। এবং ফিডব্যাক দিয়েন। শুভকামনা।

      GD Star Rating
      loading...
  7. মুরুব্বী : ০৯-০৭-২০১৯ | ২২:০৮ |

    পাঠক হয়ে রইলাম প্রিয় মাহবুব ভাই। এই মন্তব্যটি করছি ঠিকই তবে পরে এসে আবার পড়ে যাবো। ধন্যবাদ আপনাকে। Smile

    GD Star Rating
    loading...
    • মাহবুব আলী : ১০-০৭-২০১৯ | ৯:৪৭ |

      চেষ্টা করছি নিয়মিত হওয়ার। জানি না পারব কি না। ধন্যবাদ মুরুব্বীভাই, আপনার আন্তরিক সহযোগিতা এবং ভালোবাসায় এত অনিয়মিত হওয়া সত্বেও ব্লক করেন নাই। এজন্যে কৃতজ্ঞতা।

      GD Star Rating
      loading...
  8. আদেল পারভেজ : ০৯-০৭-২০১৯ | ২২:১৪ |

    গল্পটা শেষ করতে পারলাম না। আশা রাখছি পড়ে মন্তব্য দিবো। শুভ রাত্রি।

    GD Star Rating
    loading...
    • মাহবুব আলী : ১০-০৭-২০১৯ | ৯:৪৮ |

      অনেক আশাবাদী হলাম।https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

      GD Star Rating
      loading...
  9. মেঘ প্রিয় বালক : ১০-০৭-২০১৯ | ৬:৪২ |

    এখন কাজে যাচ্ছি। পরে এসে পড়তে হবে। পড়বো।

    GD Star Rating
    loading...
    • মাহবুব আলী : ১০-০৭-২০১৯ | ৯:৪৮ |

      অবশ্যই আগে কাজ, পরে অন্যকিছু। শুভেচ্ছা।

      GD Star Rating
      loading...
    • শাহাদাত হোসাইন : ১০-০৭-২০১৯ | ১০:৫৫ |

      প্রবাসে কাজে না গেলে মালিক পয়সা দেবে না। পেটের টানে ছুটছি। Frown

      GD Star Rating
      loading...
  10. আদেল পারভেজ : ১০-০৭-২০১৯ | ৭:১৭ |

    সকাল শুরু হলো হল। মাহবুব আলী ভাইয়ের – জীবনের যত জঞ্জাল, গল্পটি পড়েই। প্রতিটি লাইন ২ বার করে পড়েছি খুব মনযোগ দিয়ে পড়েছি। আজ সারাটাদিন এই গল্পটার রেশ রয়ে যাবে মনের ভেতর। শুভ কামনা জানাই।

    GD Star Rating
    loading...
    • মাহবুব আলী : ১০-০৭-২০১৯ | ৯:৫১ |

      গল্প সম্পূর্ণ হতে সময় নেবে। প্রায় সাড়ে ছয় হাজার শব্দ। সাধারণত ট্রাডিশনাল প্লট, সিনেমেটিক কাহিনি, একটু আশাবাদী এনডোমেন্ট। শুভকামনা।

      GD Star Rating
      loading...