অনেক রাতে যেখানে সেটি রাখে, হাতড়িয়ে দেখল; নাই। ওই-সময় কাকে ডেকে জিজ্ঞেস করে? মন মুহূর্তে খারাপ হয়ে গেল। সে ঘুলঘুলি জানালা দিয়ে আলোছায়া অন্ধকারে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করে কিছুক্ষণ। গোরস্তানের বুকে চঞ্চল হয়ে উঠেছে জোনাকিরা। ঝোপঝাড়ের মধ্যখানে ডোবায় দু-চারটি শাপলা গোলাপি-লাল বা শ্বেতশুভ্র জেগে থাকে অথবা ক্লান্ত ঘুমিয়ে পড়েছে। আজ পূর্ণিমা। চাঁদের উজ্জ্বল আলোয় ঝকঝক বাঁধানো কয়েকটি সাদা কবর। কোনো নামফলক বা এপিটাফ ছায়া ছায়া আবছা দেখা যায়। অর্থশালী সক্ষম মানুষেরা মৃত শরীরের জন্য জায়গাটুকু কিনে নিতে পারে, গরিব মানুষ অসহায়; শেষ শয়ানেও করুণা কাঙাল। এদিক-ওদিক পরিত্যক্ত কোনো কোণায় আশ্রয় নেয়। সে গরিব। একদিন তারও মৃত্যু হবে। অবধারিত সত্য। পালানোর পথ নেই। সুতরাং সেও একদিন ভঙুর মাটির তলায় চলে যাবে। অপর জগতের জন্য কারও দু-চারটি দোয়া-দরূদ। বুকের উপর কয়েকটি খেঁজুর কাটা। শেয়াল-কুকুরে যাতে তুলে ফেলে খুবলে নিতে না পারে। তারপর একদিন মাটির স্তরের পর স্তর জমে উঠবে। সে ধীরে ধীরে আরও নিচে নেমে যাবে। কবরের দৃশ্যমান উপরে কোনো ইট-বাঁধানো নামফলক কিংবা এপিটাফ থাকবে না। সে অবশ্য অনেক পরের কথা। আয়ু গড়পরতা ষাট বছর হলে এখনো সাঁইত্রিশ বছর দেরি। জীবনের এই সময়ে বিষাদ ঘেটে মন খারাপ করতে চায় না, কিন’ মন খারাপ হয়ে গেছে; কী করে ভালো হবে? বিছানায় তোষকের নিচে যা রেখেছিল, যত্নে তুলে রাখে; আতিপাতি খুঁজে পাওয়া গেল না। নাই। একেবারে গায়েব। এখন কী করে? তবে কি চোকির নিচে পড়ে গেছে?
সে শুয়ে শুয়ে আকাশ-পাতাল ভাবনায় ডুবে যেতে যেতে কী ভেবে একবার নেমে আসে। মেঝের উপর দাঁড়িয়ে দূর ভাবনায় ভেসে যায়। আরও একবার দেখা দরকার। কোথাও গড়িয়ে গেছে কি না? দিয়াশলাই জ্বালিয়ে বেশ ধীরস্থির চোকির নিচে দৃষ্টি ছড়িয়ে দেখতে থাকে। ডেকচি-হাঁড়ি-পাতিল-দুটো টিনের বাক্স আর বিবিধ জঞ্জালের ভেতর জমাট অন্ধকার। এরমধ্যে কোথায় তার তেল চকচকে বাঁশের বাঁশি? নিশ্চয় কেউ সরিয়েছে। কে হতে পারে? বাবা…অবশ্যই বাবা। বুড়ো বাঁশি বাজাতে দেয় না। সেদিন মা বেশ আদুরে গলায় আবারও আপত্তি তোলে, –
‘ফয়জুল এইলা ছাড়ি দি বা।’
‘কী ছাড়ি দিম?’
সে মনে মনে চমকে ওঠে। ইদানীং সিগারেট বেশি হয়ে যাচ্ছে। শফিক-বাবুলের পাল্লায় পড়ে কলকিতেও দু-চারবার টান দেয়া হলো। এসব আর করা যাবে না। মায়ের নাকে নিশ্চয় ভুরভুর গন্ধ পৌঁছে গেছে। তখন প্রায় মধ্যরাত। সাড়ে বারো পৌনে এক। সেকেন্ড শো সিনেমা দেখে ঘরে ফেরা। রাত নটায় আঙিনার পুবে ইট-প্রাচীরের দেয়ালের মধ্যখানে টিনের দরজা বন্ধ। বাবা চারিদিক দেখেশুনে তালা মেরে দেয়। তারপর শুয়ে পড়ে। সেই রাতে খোলা ছিল। মা জেগে অপেক্ষায়। তার সাড়া পেয়ে আলগোছে দরজা খুলে দেয়। তার মা, আদরের মা; জগতের সেরা বন্ধু। মা ফিসফিস করে কী বলে ঠিকমতো শুনতে না পেলেও সব বুঝে নেয়। মনজুড়ে ফুরফুরে ফুর্তি। চোখের মণিতে দোল দোল নাচের দৃশ্য। নিষিদ্ধ দোল। সে চমকে-থমকে ইশারা বুঝে নিজের ঘরে খেতে বসে। মা তরকারি গরম করে দেয়, কিন্তু ভাত ঠান্ডা হয়ে গেছে; তপ্ত ঝোল প্লেটে পড়ে চর্বি হয়ে নেতিয়ে পড়ে। গরুর মাংস হয়তো দু-দিন আগের। বাসি। বাবা সহজ-সরল মানুষ। বাজারে প্রায়শ ঠকে আসে। তাকে বাজার করতে দেয় না। আসলে বিশ্বাস করে না। বাজারে দু-চার টাকা এদিক-ওদিক হলে সে তো নিজের ছেলেই নেবে নাকি? অথচ মোক্ষম যুক্তি সিগারেট খাওয়ার টাকা দিতে রাজী নয়। সে নাহয় না দিক, কিন’ সামান্য শখ, মনের আনন্দ, একটু বাঁশির সুর তোলা; সেও বন্ধ করতে হবে? সে তা পারবে না। আঙুলের ফাঁকে কমলা রং চর্বি জমে গেছে। দুপুরের লালশাক ঘাসের মতো লাগে। উপায় নেই। সে খেতে থাকে। কি যে ভেবে চলে, নাকি সে-সব দৃশ্যছবি; আকস্মিক নির্দেশে চমকে ওঠে। দু-চোখে প্রশ্ন।
‘ওই বাঁশি। তোর বাপ পছন্দ করে না।’
‘বুড়ার সামনে তো বাজাই না।’
‘হ্যাঁ রে বাপকে বুড়া কয় কেউ? কষ্ট পাইবে না?…তুই বাজাবু, শাখের জিনিস, মোর আপত্তি নাই; কিন্তুক বাপের সামনে নাহায়। গোরস্তানত্ যায়া ন। কত বাও-বাতাস, ভূত-প্রেত-অপদেবতা ঘুরি বেড়ায়।’
‘পরিও তো থাকে। ডুমুর গাছোত বসি বাঁশি শোনে।’
‘হুহ্ পরি নামিবি! তোক বিয়া করিবি। বায়ও!’
‘ক্যান একটা পরি যদু তোর বউ হয়া আইসে, মন্দ কি! ধন-দৌলত উথিলি পড়িবি না? হারার কুনো কষ্ট থাকিবি না।’
‘স্বপন দেখেছু ন?’
মা হাসে। সেই হাসি ভারি অদ্ভুত মায়াময়। মা খুব ভালবাসে তাকে। রাত জেগে সামলায়। আঙিনা পেরিয়ে শজনে গাছের বাঁ-ধারে টিনের দরজা। সেখানে কাঠের রড লাগানো হয়। একটি তালা। বাবার রোজকার কাজ। ফয়জুল যেদিন রাতে দেরি করে ফেলে, দেরি হয়; তালা লাগানোর ডিউটি মায়ের। পৃথিবীর সকল মা বুঝি এরকম। চকিতে কত ভাবনা-দৃশ্যছবি ভেসে যায়। সে বিয়ে করেছে। অত্যন্ত সুন্দর চেহারার এক মেয়ে, তার বউ, মায়ের কাছে বসে থাকে। সেবা যত্ন করে। অলস দুপুরে দু-জনের গল্প-আলাপ-হাসি-আনন্দ বাতাসে ধীরলয়ে ভেসে যায়। সেই মুহূর্তে ছায়াছবিতে দেখা পরির মুখছবি ভেসে উঠে। তার উজ্জ্বল সফেদ দুটো পালক ডানা। আলো ঝলমল বর্ণিল পোশাক। সোনালি রং জাদুর কাঠি হাতে। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি। চোখের দৃষ্টিতে সলাজ আহবান। ফয়জুল কি করে! সেই পরির চেহারা কখনো তীব্র স্ফুলিঙ্গ-আলো কখনো অস্বচ্ছ প্রচ্ছায়া। সে ধাঁধায় পড়ে যায়। কে সেই পরি? পাশের বাড়ির বুশরা নাকি সত্যি সত্যি সেলুলয়েডের ফিতেয় জমে থাকা রূপসী? সে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। শ্রুতিতে কখনো বেজে ওঠে গানের কলি। নদীতে পালতোলা নৌকোয় নায়িকার আদুরে ঢং-এ শরীর হেলিয়ে গান গাওয়া। ঠোঁটের আলতো প্রসারে রহস্যময় হাসি। এসবের কোনোকিছুই কপালে নেই তার। গরিব মানুষের দুঃসাধ্য স্বপ্ন। অলীক এসব দৃশ্যছবি কল্পনায় বেঁচে থাকা। সে এমন স্বপ্নবিলাসী থাকতে চায় না। পরি নামাতে হবে। গোরস্তানে জ্বিন-ভূত-পরি সব আছে। বাঁশির সুরে সুরে তাদের টেনে এনে চেয়ে নেবে কোনো বর। সে চাইবে টাকা। টাকাই একমাত্র ঈশ্বর। অশেষ ক্ষমতা। টাকা দিয়ে সাজিয়ে নেবে জীবন…বেঁচে থাকা। পূরণ করবে সকল স্বপ্নসাধ। মায়ের মুখে হাসি। বাবার বিষণ্ন মুখ মুছে দেবে। কিন্তু পরি নামছে কই? আর বাঁশি…সেটি গেল কোথায়?
শেষ দুটো কাঠি জ্বালিয়ে খুঁজতে শুরু করে পুনরায়। এবার মনোযোগি দৃষ্টি খুব ধীরস্থির রাখার চেষ্টা নেয়। একপাশ থেকে অন্যপাশে স্ক্যানিং চলে। কিন’…না নেই। কে করল নিষ্ঠুর এই কাজ? বাবা নয়…অন্য কেউ। কে কে? সে মনে করার চেষ্টা করে। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত কে কে তার ঘরে এসেছে? ঘর তো নয়, বৈঠকখানা, যে কেউ এলে এখানে বসে; তাকে সরে যেতে হয়। রাস্তায় নেমে দাঁড়িয়ে থাকে। গলির মাথায় পান-সিগারেট আর পটেটো চিপস দোকান। কয়েকজন মানুষ বসে কিংবা দাঁড়িয়ে থাকে। ইদানীং রায়হান মিয়া ফ্লাক্সে চা বসিয়েছে। সেই চা তৈরি করে মলি। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়ার পর সমুদয় পাঠ শেষ। কলেজের কোন্ ছোকরার হাত ধরে নাকি পালিয়ে থেকেছিল প্রায় এক মাস। পাড়ায় দু-এক সপ্তাহ জোর ফিসফাস চলে। তারপর সব শেষ। সব মিথ্যে রটনা। মলি আসলে মামার বাড়িতে ছিল। সেখানে তো যেতেই পারে নাকি? ফয়জুলের এসব বিষয়-ঘটনাপ্রবাহ মনে কোনো ঢেউ তোলে না। সে আপনমনে নিজের পৃথিবীতে ঘুরপাক খায়। তবে তখন থেকে বেশ চেনা হয় মলিকে। চোখের দেখায় মন্দ লাগে না। ফরসা মুখছবি, টিকালো নাক, তার ডান অথবা বাঁ-পাশে সাদা পাথরের বড় নাকফুল, কখনো রোদের আলোয় ঝলমল করে। মাথায় একরাশ চুল। চোখের দৃষ্টিতে কোনো রহস্যময় হাসি অথবা কৌতুক। সেই তুলনায় অনেক শান্ত-নির্জীব বুশরা। কখনো দশটি বাক্যের বিপরীতে একটি একমাত্রার জবাব। তবে তার কোনো রটনা নেই। কোনো ঘটনা নেই। সুন্দর ধৈর্যশীল দৃঢ় সংযম। আনটাচ্ড। কে না চায় অনাঘ্রাত পুষ্প শুকে নিতে। মলি? কে জানে কি? তবে যতটুকু রটনা কিছু তো ঘটনা বটে। কে জানে কোথায় কোন্ জায়গায় কী করেছে। তাকে নিয়ে প্রেম প্রেম গেম চলে জীবন-পাথার যাত্রা চলে না। এসব অবশ্য তেমন ভাবনার নয়। অলস দুপুরে ঘুম ঘুম অবসরে দু-একটি মাছির সুড়সুড়ি বিরক্তি মাত্র। এলোমেলো নিষ্পাপ ভাবনা অথবা নিষিদ্ধ লুকোচুরি খেলা। ফয়জুলের কিছু হলো না। একজন বান্ধবী, যার সঙ্গে কলেজ কিংবা ক্যাফেটারিয়ার নিরিবিলি ছায়ান্ধকার কোণায় আইসক্রিমে চুমুক দেয়। পার্কের জেসমিন ঝাড়ের নির্জন লাজুক সময়ে কোনো অচেনা চুম্বন। দিন যায় একা একা ছায়াছবির দৃশ্যছবি কল্পনায়। ববিতার নাটুকে সংলাপ। শাবানার স্বামীভক্তির শক্তি দেখে। আহা বুশরা কবে যে তোমায় একবার জড়িয়ে ধরতে পারব! অথচ সেদিন বিকেলে কলাভবনের একপাশে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষ্ণচূড়ার নিচে কত কথা বলে যায় বুশরা। কোনো অস্থির চাপল্য নয়। যেনবা শাসন। কেন এমন করে বলে সে? নির্মোহ আবেগহীন বৈষয়িক। কে জানে তার মনে কোনো ভালবাসা বা প্রেম আছে কি না, অথবা সবকিছুই একতরফা ফয়জুলের? বিকেল কেমন অদ্ভুত অসহনীয় আর লাজুক-মূঢ় হয়ে ওঠে। ফয়জুল কথামতো ঠিক ঠিক আগামী একমাস বুশরার সঙ্গে দেখা করবে না। সে পরীক্ষা দিক। ভালোভাবে পাশ করুক। ফয়জুল তার সবকথা মেনে নেবে। কে জানে একদিন ধাক্কা মেরে ছ্যাঁকা দিলেও কিছু মনে করবে না। তার মনের দরজা খোলা…উন্মুক্ত রেখে দেবে। সে যে গোলাপ, সুগন্ধি বিলিয়েই সার্থক জীবন; তার মন খারাপ হয়ে যায়। সন্ধের সময় এদিক-ওদিক সাইকেল চালিয়ে অকারণ ঘোরে। গোপালগঞ্জ বাজারে মানুষের হই-হুল্লোড় আর চেঁচামেচি শোনে। রাত নেমে আসে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে অনেক দেরি। কোন্ফাঁকে বাঁশের একটি বাঁশি কিনে নেয়। এই তো সেদিনের কথা। এবার বাঁশি বাজিয়ে সময় পার।
(চলমান)
(গল্পটি ‘শব্দঘর’ এপ্রিল ২০১৯ ইস্যুতে প্রকাশিত।)
loading...
loading...
সিরিজ লিখা উপহার পেয়ে ভরসা পেলাম প্রিয় মাহবুব আলী ভাই। আপাতত পড়লাম। তেমন কিছু বলার মতো সময় বোধকরি এখনও আসে নি। ধন্যবাদ আপনাকে।
loading...
ওহোহো মাহবুব ভাই। গরীবের ছোট্ট মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ রাখতে রাখতে চোখের সর্বোনাশ। অসুবিধা নাই। পরের পর্ব পড়বো নিশ্চিত।
loading...
বংশীবাদক ও আকাশপরি উপাখ্যানকে কপি করে নিয়ে গেলাম মাহবুব ভাই। সামান্য ফ্রি হয়ে পড়তে চাই। ধন্যবাদ।
loading...
চেয়েছিলাম অণুগল্প পেয়ে গেলাম ধারাবাহিক উপন্যাস। বাহ্। পড়ে নিচ্ছি। আগের পোস্টে আপনার মন্তব্য পাইনি দাদা।
loading...
আপাতত ভালো লাগা মন্দ লাগা বিষয় মন্তব্যে আনতে চাচ্ছি না। আগে পড়ে নেই।
loading...