আকাশের তারা সবসময় সুন্দর দেখায় [Halo Effect]

সিলিকন ভ্যালীর একটা ফার্ম, সিস্কো, একসময় ছিল নতুন অর্থনীতির বরপুত্র। সাংবাদিকরা এর সর্বসাফল্য নিয়ে অকুণ্ঠ প্রশংসা করতঃ এর চমৎকার গ্রাহক সেবা, নির্ভুল কৌশল, দক্ষ অধিগ্রহণ, অদ্বিতীয় কারবারী সংস্কৃতি, সহজাত দক্ষ ক্যারিশমাটিক সিইও। দুই হাজার সালের মার্চমাসে এইটা ছিল দুনিয়ার সবচেয়ে দামী কোম্পানী।

পরের বছর সিস্কোর শেয়ারের দাম ৮০% পড়ে গেলে, সাংবাদিকরা সুর পালটানো শুরু করে। হঠাৎ করে কোম্পানীর প্রতিযোগীতামূলক সুবিধাগুলোকে ধ্বংসাত্মক ত্রুটি হিসেবে চিহ্নিত করা হলঃ বাজে গ্রাহক সেবা, ধূমায়িত কৌশল, বেকুবমার্কা অধিগ্রহণ, পঁচা কর্পোরেট সংস্কৃতি এবং একজন বেকুব সিইও। এসব যখন বলা হচ্ছে, তখন কিন্তু কোম্পানীর না কোন কৌশল বদলানো হয়েছে, না সিইও পালটানো হয়েছে। যা পাল্টেছে তা হল কোম্পানীর চাহিদা, সেটা হয়েছে ডটকম ক্রাশের ফলশ্রুতিতে, তা কিন্তু কোম্পানীর কোন ভুল-ত্রুটির জন্য নয়।

যখন কোন বিষয়ের কোন একটা দিক আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দেয় আর সেটা পুরো বিষয়টার প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রভাবিত করে সেটাকেই আমরা বলি হেয়লো এফেক্ট (Halo effect) বা জ্যোতিষ চক্কর বলতে পারি। সিস্কোর ক্ষেত্রে এই জ্যোতিশ্চক্র বিশেষভাবে উজ্জ্বল ছিল। সাংবাদিকরা সিস্কোর শেয়ার মূল্য দেখে টাস্কি খেয়েছে আর কোন ভেতরের কোন খবর না নিয়েই ভেবেছে পুরো বিজনেসটা নিশ্চয়ই চকচকে আর টকটকে।

হেয়লো এফেক্ট সব সময় একইভাবে কাজ করে, আমরা কোন সহজলভ্য বা উল্লেখযোগ্য কোন তথ্য বা বিবরণ নিয়েই পুরো ব্যাপারটা সম্পর্কে ধারনা করে ফেলি। যেমন কোন কোম্পানীর আর্থিক অবস্থা থেকে বাড়তি যাচাই বাচাই ছাড়াই আমরা খুব সহজে কোম্পানীর ব্যাবস্থাপকদের পরিচালনা ক্ষমতা বা এর কোম্পানির বিজনেস কৌশলের সম্ভাব্যতা নিয়ে উপসংহারে চলে যাই। আমরা প্রায়শই সফলতা বা শ্রেষ্ঠত্ব আরোপ করি যেখানে এগুলো খুব সামান্যই আছে, যেমন, আমরা যখন শুধু খ্যাতির উপর ভিত্তি করেই কোন ম্যানুফ্যাকচারার থেকে পন্য কিনি। . হেলো এফেক্টের আরো একটা উদাহরণ হল, আমরা ধরে নিই এক ধরনের ব্যবসায়ে সফল সিইওরা অন্য যেকোনে ব্যবসায়েও সফল হবে, এবং আরেকটা বিষয় হল, তারা তাদের ব্যক্তি জীবনেও নায়ক বনে যায়।

মনোবিজ্ঞানী এডওয়ার্ড লী থর্নডাইক প্রায় শত বছর আগে, এই হেলো এফেক্ট আবিষকার করেন। তাঁর উপসংহার ছিল, যে কোন একটি গুণ ( উদাহরণস্বরূপঃ সৌন্দর্য, সামাজিক অবস্থা, বয়স) ইতিবাচক বা নেতিবাচক ধারণা তৈরি করে এবং তা পুরো ব্যাপারটাতে এর একটা অসমান প্রভাব থাকে। সৌন্দর্য হল সবচেয়ে বেশি গবেষনা করা উদাহরণ। ডজন ডজন গবেষণা দেখিয়েছে যে, আমরা দেখতে ভাল লোকদেরকে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই/ এমনি এমনিই ধরে নিই যে তারা সুপ্রিয়, সৎ এবং বুদ্ধিমান। আকর্ষনীয় লোকজন তাদের পেশাগত জীবনে সহজেই এই সুবিধা পেয়ে থাকে এমনকি স্কুলেও এই হেলো এফেক্ট দেখা যায় যেখানে শিক্ষকরা অসচেতনভাবেই দেখতে ভাল বাচ্চাদেরকে বেশি মার্ক দিয়ে থাকে।

বিজ্ঞাপনের সাথে এই হেলো এফেক্টের এর দারুন সংযোগ আছেঃ টিভিতে, বিলবোর্ডে, ম্যাগাজিনে যেসব সেলিব্রেটিরা আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসে তাদের দিকে একবারটি দেখুন। কিভাবে রজার ফেদেরারের মত একজন পেশাদার টেনিস খেলোয়াড় কিভাবে একজন কফি মেশিন বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেন, তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, যদিও সেটা সফল বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে কোন বাধা নয়। আমরা সেলিব্রেট্রিদেরকে এতবেশি বিজ্ঞাপনে দেখি যে, আমরা কখনো চিন্তাও করি না কেন এটা-সেটার বিজ্ঞাপনে তাঁদেরকে দেখানোটা আদৌ আমাদের জন্য কোন গুরুত্ব বহন করে কিনা। কিন্তু এটাই হল হেলো এফেক্টের সবচেয়ে সেয়ানা পার্টঃ এটা আমাদের অবচেতন মনে কাজ করে। যা কিছু রেকর্ড করা দরকার তা হল, আকর্ষণীয় মুখ, আকর্ষনীয় জীবনধারা (লাইফস্টাইল) এবং ঐ নির্দিষ্ট পণ্য।

জোরালো নেতিবাচক প্রভাবের সাথে সাথে হেলো এফেক্ট বড় ধরনের অবিচারের দিকে নিয়ে যেতে পারে এবং এমনকি যখন জাতীয়তা, লিঙ্গ, অথবা বর্ণ সবকিছুর ব্যাপারে বাঁধাধরা চিন্তার দিকে নিয়ে যেতে পারে। কেউ বর্ণবাদী কিংবা লিঙ্গ-বিদ্বেষী না হয়েও এসবের স্বীকার হতে পারে। হেয়লো এফেক্ট আমাদের দৃষ্টি মেঘাচ্ছন্ন করে দেয় যেমনটা দেয় সাংবাদিক, শিক্ষক এবং ভোক্তাদের।

কদাচিৎ এই প্রভাবের নির্মল দিক দেখা যায় – হতে পারে সেটা স্বল্পমেয়াদী, আপনি কখনো প্রেমের সাগরে ভেসেছেন? If so, যদি তাই হয়, তাহলে আপনি জানেন, কতটা নিখুঁত মনে হতে পারে একজন কে। আপনার মনের মানুষকে মনে হবে পুরো একটা প্যাকেজ, আকর্ষণীয়, বুদ্ধিমান, পছন্দনীয় এবং উষ্ণ। এমনকি আপনার বন্ধুরা অনেক কিছু নেতিবাচক দিক পয়েন্ট আউট করতে পারে, আপনি এর কোন কিছুই দেখেন না, বরং মনে হয় সেগুলোও কত সুন্দর!

প্রকৃত বৈশিষ্ট বুঝতে হেয়লো এফেক্ট আমাদেরকে বাধা দেয়। এটা কাটাতে হলে আপনাকে ফেসভ্যালু বাদ দিয়ে চিন্তা করতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্টগুলো সামনে নিয়ে আসতে হবে। বিশ্বমানের অর্কেস্ট্রাওগুলোতে বাছাইয়ের সময় পর্দার আড়ালে ক্যান্ডিডেটদেরকে পারফর্ম করতে হয় যাতে লিঙ্গ, বর্ণ, বয়স এবং চেহারা কোন ভূমিকা রাখতে না পারে। সবচেয়ে বড় কথা হল আপনার, যথাযথ তথ্য নেয়ার ও বুঝার মত ধৈর্য্য থাকতে হবে।

[রলফ ডবেলি থেকে অনূদিত]

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১১ টি মন্তব্য (লেখকের ৫টি) | ৫ জন মন্তব্যকারী

  1. রিয়া রিয়া : ১৮-০৩-২০১৯ | ২২:১৮ |

    প্রবন্ধটি পড়লাম আনু দা। অভিনন্দন তো জানাবোই তার আগে অভিযোগ আপনাকে পাই না কেন !! https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Frown.gif.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • আনু আনোয়ার : ১৯-০৩-২০১৯ | ৯:১৭ |

       

      অনেক ধন্যবাদ প্রিয় রিয়াপু। আসলে খুব একটা ব্যস্ত সময় গেছে। এখন থেকে নিয়মিত হওয়ার চেষ্টা করব।

      ভাল থাকবেন আপু।       

      GD Star Rating
      loading...
  2. সৌমিত্র চক্রবর্তী : ১৮-০৩-২০১৯ | ২৩:১২ |

     If so, যদি তাই হয়, তাহলে আপনি জানেন, কতটা নিখুঁত মনে হতে পারে একজন কে। আপনার মনের মানুষকে মনে হবে পুরো একটা প্যাকেজ, আকর্ষণীয়, বুদ্ধিমান, পছন্দনীয় এবং উষ্ণ।

    পরিশ্রমী পোস্ট। অভিনন্দন আনু আনোয়ার ভাই। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • আনু আনোয়ার : ১৯-০৩-২০১৯ | ৯:২২ |

      সত্যি দাদা, এটা পরিশ্রমী পোস্ট। এই পোস্ট যদি আমাদের সামান্য হলেও কাজে লাগে, তবে আমার শ্রম সার্থক।   

      আপনাকেঅনেক ধন্যবাদ জানাই।      

      GD Star Rating
      loading...
  3. মুরুব্বী : ১৮-০৩-২০১৯ | ২৩:১৪ |

    অনুবাদ একটি কঠিন কাজ। একসময় অসাধারণ সব সৃষ্টি আপনার হাতে দেখেছি। ইদানিং বিষয়টি শব্দনীড়ে আসে না বললেই চলে। স্লোগানটিকে যদি স্মরণ করি … আমার মনে আছে … কবিতার কোমলতা শুধু নয় ….. স্বতন্ত্র এবং ভিন্নতায় গড়ে উঠুক শব্দনীড়।

    সতত ব্যস্ততার ভীড়েও শব্দনীড়ের বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে আপনার উপস্থিতি নিয়মিত হোক।

    GD Star Rating
    loading...
    • আনু আনোয়ার : ১৯-০৩-২০১৯ | ৯:৩১ |

      আপনাকে অনেক ধন্যবাদ জানাই। ইদানিং অফিস-ঘর-সংসার মিলিয়ে বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। তবু শব্দনীড়কে ভুলতে পারি না। তাই মাঝে মাঝে অন লাইনে অফ লাইনে এসে জানান দিই। চেষ্টা থাকবে  নিয়মিত হবার। 

      GD Star Rating
      loading...
      • মুরুব্বী : ১৯-০৩-২০১৯ | ৯:৪০ |

        ইনশাল্লাহ। শুভ সকাল মি. আনু আনোয়ার।

        GD Star Rating
        loading...
  4. শাকিলা তুবা : ১৮-০৩-২০১৯ | ২৩:২৫ |

    কিছুকাল আগে শব্দনীড়েই রলফ ডবেলি’র লিখা একটি অনুবাদ আপনার পড়েছিলাম। বেশ ভালো এবং স্বচ্ছ ভাবে আপনি লিখতে পারেন।

    GD Star Rating
    loading...
    • আনু আনোয়ার : ১৯-০৩-২০১৯ | ৯:৩৪ |

      আসলে, রলফ ডবেলি'র বইটা আমি পড়ছি। পড়তে পিড়ি মাঝে মাঝে অনুবাদ করে আপনাদের সাথে শেয়ার করছি। 

      আপনাদের অনুপ্রেরণা আমাকে পুরো বইটি অনুবাদে সাহায্য করবে। ভাল থাকবেন আপু।    

      GD Star Rating
      loading...
  5. সুমন আহমেদ : ১৮-০৩-২০১৯ | ২৩:৩২ |

    আপনিও আমার মতো হয়ে গেছেন। শব্দনীড়ে থেকেও আমরা নেই। 

    অনবাদের কঠিন আলোচনায় গেলাম না আজ আনোয়ার ভাই। ভিন্ন আরেক দিন।  Smile

    GD Star Rating
    loading...
    • আনু আনোয়ার : ১৯-০৩-২০১৯ | ৯:৩৭ |

      ধন্যবাদ সুমন ভাই। দেখা পেয়ে ভাল লাগল। চেষ্টা করব  নিয়মিত হবার। আবার নিশ্চয়ই কথা হবে। ভাল থাকবেন।   

        

      GD Star Rating
      loading...