হারুন সাহেব রিভলভিং চেয়ারে বসে আছেন। গোলগাল ফর্সা চেহারার পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষটার চেহারায় চিন্তার রেখা। চোখ দুটো বন্ধ করে দোল খাচ্ছেন।
-স্যার, আসি। দবির। পুরোনাম দবির উদ্দিন। হারুন সাহেবের ধার না, প্রতিষ্ঠানের সব চেয়ে বাজে লোকটাকেই তাকে দেওয়া হয়েছে। এক সপ্তাহ উইদাউট পারমিশনে ছুটি ভোগ করে অফিসে এসেছে। এ লোকটা অফিসে না এলেই ভালো হয়।
-হ্যাপি নিউইয়র্ক স্যার।
-হোয়াট!
-সরি স্যার, হ্যাপি নিউ ইয়ার।
-কিসের হ্যাপি? হ্যাপি কী! নিউ ইয়ারের সাত দিন পরে হ্যাপি থাকে?
-স্যার আমি আইসিটি ডিভিশনের হ্যাপি মেয়েটার কথা বলছি না।
-ননসেন্স।
-পুরা না স্যার, কিছু সেন্স আছে।
-দবির।
-জি স্যার।
-আমি চিন্তিত, আজকের দিন যদি আমার জন্য হ্যাপি হয়, তবে আনহ্যাপি কবে হবে আর কাকে বলে! তার বিরাট একটা ব্যাখ্যা দরকার হবে।
-চিন্তা করেন কেন স্যার? কী ব্যাখ্যা বলেন।
-আমার মেয়েটাকে খুঁজে পাচ্ছি না, ব্যাখ্যা কর-
দবির তো তো করে, কোন ক্লাসে যেন ব্যাখ্যা পড়েছিলাম!
হারুন সাহেব রেগে ওঠেন, তুমি কেন এসেছ তাই বল।
-স্যার নতুন বছরের সপ্তম দিন। হ্যাপি নিউ ইয়ার দিতে এলাম।
-আচ্ছা যাও। দবির মুখে একরাশ হাসি নিয়ে বেরিয়ে যায়। লজ্জা বলতে কোনো জিনিস লোকটার ভেতর নেই। দবির বেরিয়ে যেতেই হ্যাপি মেয়েটা হাজির।
স্যার আমাকে ডেকেছেন?
-না তো। কে বলল?
-আমার নাম বলাবলি হচ্ছে শুনে ছুটে এলাম।
হারুন সাহেব কাঁদবেন না হাসবেন বুঝে উঠতে পারেন না। খুশির দিনও কেন যেন সব মানুষ সব সময় খুশি হতে পারে না। খুশির দিনেও কেউ কেউ মুখ ভার করে বসে থাকে। কেউ আনমনা হয়ে বসে বসে দূর আকাশে উড়ে যাওয়া চিল কিংবা শকুন দেখে। শকুনের কাজ কী! হারুন সাহেব শকুন বিশেষজ্ঞ নন। তবে শকুনকে পানিতে ভাসা মরা মড়ি খেতে দেখেছে। দুঃখ নিয়ে খুশির দিনে মানুষ শকুন দেখে কেন! শকুনই-বা আকাশে ওড়ে কেন! অনেক কথা। কিছু শকুন আকাশে, কিছু শকুন মাটিতে! কিছু শকুন ওড়ে, কিছু শকুন হাঁটে। কিছু শকুন শকুনের মতো আর কিছু শকুন দেখতে মানুষের মতো! মোবাইল বেজে ওঠে। শব্দগুলো কান্নার মতো মনে হয়। হ্যালো বলতেই ওপাশে হাসির কণ্ঠ। নাম হাসি। হারুন সাহেবের সাতাশ বছরের স্ত্রী। বয়স সাতাশ নয়। তার সাথে সংসার জীবনের বয়স সাতাশ। নাম হাসি হলেও জীবনে কবে যে হাসিমুখ দেখা গেছে মনে করতে পারেন না হারুন সাহেব। নিতুর কোনো খোঁজ পেলে?
-কিসের নিতু?
-নিতু। আমাদের একমাত্র মেয়ে…
-নিতু নামে আমার কোনো মেয়ে নেই।
-কী যা তা বলছো।
-যে মেয়ে বছরের প্রথম দিন বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যায়, সে আমার মেয়ে হতে পারে না।
টিপ দিয়ে কল কেটে দেন। মোবাইলের গলা থাকলে টিপে ধরতেন। চিন্তায়-দুশ্চিন্তায় অফিস টাইম পেরিয়ে যায়। সন্ধ্যা নামে। বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে। একসময় শীত মজার ছিল। বয়সের সাথে সাথে শীত এখন এক আতঙ্ক। নিজে তিন-চারটা মোটা সোয়েটার গায়ে দিলেও খোলা আকাশের নিচে বহু শীতার্ত মানুষ। একটাও গরম কাপড় নেই। নিচে নেমে অফিসের সামনেই দেখেন দবির উদ্দিন উচ্চকণ্ঠে বুলি আওড়াচ্ছে। সাথে বিপল্গব বাবু। জানতে চান- এক সপ্তাহ অফিসে আসেনি কেন। কী অবস্থা? দবির খেপে ওঠে, রাখেন তো ভাই অবস্থা। অবস্থা অবস্থায় বন্দি।
-মানে!
-মানে আর কী! অবস্থা কাহিল হয়ে পড়ছে। তিনটা জ্যাকেটে বিভিন্ন রকম অবস্থা চেইন দিয়ে আটকায় রাখছি কিন্তু…
-কী?
-দুর ভাই, আপনি কথা বোঝেন না। শীতে অবস্থা কাহিল। হারুন সাহেব পাশ কাটিয়ে রাস্তায় নামেন। ঠাণ্ডা কনকনে বাতাস কান-মুখ ছুঁয়ে যায়। মোবাইলটা বেজে ওঠে। হাসি। রিসিভ করতেই প্রশ্ন করে, কোনো খবর পেলে? এক সপ্তাহ ধরে মহিলাটা কান ঝালাপালা করে ফেলছে।
-কীসের খবর?
-তুমি তো পিতা না, পিতা নামের কলঙ্ক। খেঁকিয়ে ওঠে হাসি। হারুন সাহেব কেন যেন ফিক করে হেসে ওঠেন।
‘চিন্তা কোরো না হাসি বেগম। তোমার মেয়ে খুব সম্ভব কারও হাত ধরে ভেগেছে। ভাগার জন্য হয়তো নতুন বছরটা বেছে নিয়েছে। হ্যাপি ইয়ার, হ্যাপি পেয়ার, হ্যাপি লাইফ, হ্যাপি…’
-ছিঃ, তোমার কথা শুনে আমার ঘেন্না লাগছে।
-কবেই বা মধুর লাগল! ওপাশ থেকে লাইন কেটে দেয় হাসি বেগম। শীতের রাতে চা খেলে মন্দ হয় না। রাস্তার পাশে চায়ের স্টলে গিয়ে বসে। সাধারণত রাস্তার পাশের চা দোকানগুলোতে গবেষক, রাজনীতিবিদ, জ্ঞানী, দেশপ্রেমিক, বুদ্ধিজীবীদের ভিড় থাকে। হারুন সাহেবের মন্দ লাগে না। ঢুকতেই শোনেন একজন বলছে, নিউ ইয়ারের রাতে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে এক মেয়ে। এগুলো মানুষ না। হারুন সাহেবের বুকের ভেতর খাঁ খাঁ করে ওঠে। তার নিতুর এমন কোনো বিপদ…! বিড়বিড় করে বলেন, হ্যাপির ঘাড়ে আনহ্যাপি চেপে বসল না তো!
( ০৭ই জানুয়ারী দৈনিক সমকালে প্রকাশিত )
loading...
loading...
আকর্ষণীয় শিরোনামের লিখাটি শব্দনীড় পাঠকের সাথে শেয়ার করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। অনেক অনেক শুভেচ্ছা মি. অয়েজুল হক।
loading...
শুভেচ্ছা প্রিয় মুরুব্বী। শব্দনীড় হোক আমাদের ভালোবাসার ।
loading...
সুন্দর একটি অণুগল্প পড়লাম গল্পকার অয়েজুল ভাই।
loading...
ভালোবাসা প্রিয় সৌমিত্র দা। শুভকামনা ।
loading...
ভাল লেখা।
loading...
ধন্যবাদ রিয়া।
loading...
দারুণ লেখা। সুন্দর পোস্ট। অনেকক্ষণ সময় নিয়ে পড়েছি। ভালো লাগলো । লেখককে ধন্যবাদ ।
loading...
ধন্যবাদ নিতাই দাদা । শুভকামনা ।
loading...
চমৎকার লেগেছে। ভালো থাকুন।
loading...
ধন্যবাদ , শুভকামনা ।
loading...