লাশের যোগবিয়োগ

শেখ রহিম বারান্দার এককোণায় বসে থাকেন। গদি-আঁটা চেয়ার। আয়েশ করে বসেন। রাস্তার পাশে বাড়ি। অগ্নিকোণ-মুখি বারান্দা। সারাদিন বাস-রিকশা-অটো কত যানবাহন চলছে। তিনি কখনো মনোযোগে কখনো আনমনে দেখেন। মানুষজনের যাওয়া-আসা, ব্যস্ততা আর চেহারা দেখেন। মানুষের মুখ ভারি অদ্ভুত! একজনের সঙ্গে অন্যজনের কোনো মিল নেই। কারও চেহারা-ছবি অচেনা-অজানা। কাউকে দেখায় একরকম…আসলে সে অন্য। তিনি কেমন? তার চেহারায় কী আসল ভাব ফুটে ওঠে? তিনি জানেন কিংবা জানেন না। তিনি শুধু চেয়ারে বসে মানুষ দেখেন। কারও চেহারা হয়তো দেখেন না। কেননা এখন তিনি মাঝে মধ্যে নিজের চেহারা নিজের মধ্যে দেখতে পান।
কেউ কেউ তাকে দেখে। তার চেহারায় কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না। তিনি নির্বিকার ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে থাকেন। নাকি পেছনে ফিরে তাকান? দিনে দিনে অনেকদিন পেরিয়ে গেল। এখন শুধু অপেক্ষা। অপেক্ষা লাশ হওয়ার। একদিন তিনি লাশ হবেন। তারপর…তখন তাদের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে, যাদের নিয়ে তিনি ব্যবসা করেছেন, রাজনীতির কৌটিল্য চাল চেলেছেন; তারা তার সঙ্গে কী করবে? চিমটি কাটবে? কামড়াবে? তখন তার কোনো শরীর থাকলে তো! তিনি নিশ্চিত কেউ কামড়াতে পারবে না। কেননা তিনি সেখানেও দাপটের সঙ্গে রাজনীতি করবেন। যারা ইহকালে দাপট দেখাতে পারে, পরকালেও দক্ষ আর ডাকসাইটে। এটিই পুণ্য। এটিই কাজ। এটিই সফলতা। তিনি একজন সফল মানুষ।
আজ তার মন কেন জানি বিক্ষিপ্ত-বিচলিত। পরশুদিন সেই মানুষের সঙ্গে সরাসরি দৃষ্টি সংযোগ ঘটে গেছে। সেই চোখে কী ছিল, তিনি ভাষা বুঝতে পারেন নাই; কিংবা বুঝতে পেরে আত্মভর্ৎসনা দেখা দেয়। বিবেক বেলুনের মতো ফুলেফেঁপে জেগে উঠতে চায়। যে তিনি চিরকাল আত্মশ্লাঘার প্রসাদ গুনেছেন, তখন প্রশ্ন জেগে ওঠে; তিনি কী করেছেন জীবনে?
এখন এই মানুষকে প্রায়শ দেখেন। প্রায় প্রতিদিন সকালে সামনে দিয়ে অল্প বয়সে ন্যুব্জ বৃদ্ধের মতো হেঁটে চলে যায়। দু-এক বছর থেকে দেখছেন। সেই মানুষ কোনোদিন মাথা উঁচু বারান্দার দিকে তাকায় না। তিনিও তেমন করে দেখেন না। কত মানুষ হেঁটে চলে যায়। তার দু-চোখের সামনে দিয়ে নিরিবিলি-নির্জন-নিশ্চুপ। কেউ শহরে আসে। কেউ শহর ছেড়ে বাইরে যায়। কে কার খোঁজ রাখে? আঠারো কোটি জনসংখ্যার দেশে গিজগিজ মানুষ। পোকার মতো কিলবিল করে। কে কোথায় হাসে, কে কোথায় কাঁদে; কে খবর রাখে? তিনি কারও কোনো খবর রাখেন না। কোনোদিন রাখেননি। যতদিন রেখেছিলেন, যতটুকু পেছনে; অন্যকোনো কারণ। সেটি রাজনীতি হতে পারে। মানসম্মান চরম স্বার্থ কিংবা…। রাজনীতি হল ক্ষমতা। স্বার্থ উদ্ধারের কৌশল মাত্র। তিনি কৌশলী মানুষ। তাই শহরের মধ্যখানে চমৎকার জেঁকে বসেছেন। তিল তিল শ্রম আর অধ্যবসায়ে বসতে পেরেছেন। সাদ্দাতের বেহেস্তের মতো রত্ন-পাথরের কারুকাজ অট্টালিকা সাজিয়েছেন। তার বিশাল বাড়ি এক প্রাসাদ ছাড়া কী?

সামনে বাসস্ট্যান্ড। পঁচিশ মিনিট পর পর বাস যাত্রা করে। কত মিনিট গ্যাপে আসে তার ঠিক নেই। তারপর চোখের সামনে কাহারোল-সেতাবগঞ্জের বাস আচমকা হুমড়ি খেয়ে থামে। বাসগুলো মানুষ নামায়, মানুষ ওঠায়; কনডাকটর-হেল্‌পারের হাঁকের মধ্য দিয়ে আবার ছুটে চলে যায়। ফেলে রাখে ডিজেল পোড়া একরাশ কালো ধোঁয়া। শেখ রহিম ভাবেন। পৃথিবী বাসস্ট্যান্ডের মতো। তিনি এক বাস। তার মাথার মধ্যে মনকির-নাকিরের মতো কনডাকটর-হেল্‌পার আছে। তিনি তার বাসের নিজে ড্রাইভার। তিনি বাস হয়ে কেমন চলেছেন কিংবা চলছেন? আর কত দূর যাবেন? ফিটনিস কেমন? সময় শেষ হয়ে আসছে বুঝতে পারেন। ইঞ্জিন কিছুদিন পর রিজেক্ট হয়ে যাবে। তখন একমুঠো ধোঁয়া ফেলে রেখে যাত্রার ইতি। সেই ধোঁয়া ধূসর-সাদা নাকি ডিজেল পোড়া গাঢ়-কালো? মানুষের কতটুকু যন্ত্রণা জাগায়? যতটুকু হোক সব তার স্মরণের শোকসভায় স্তুতিপাঠ আর মজাদার প্যাকেটে বাতাসে মিলিয়ে যাবে।
সেই মানুষের চেহারা আবার দু-চোখে ভেসে ওঠে। ভেসে উঠবার দরকার কি? কিছুক্ষণ পর তো চোখের সামনে দিয়ে হেঁটে যাবে। তিনি তাকে চেনেন। একটু একটু মনে করতে পারেন। তখন যেমন দেখেছেন মানুষটি তারচেয়ে অনেক বুড়ো হয়ে গেছে। মানুষটির সঙ্গে লাশের এক গল্প আছে। রাজনীতির খেলা। রাজনীতি মানেই তো লাশ এবং ক্ষমতা। কেউ লাশ না হলে অন্যেরা ভালোভাবে খেতে-পরতে-আরাম করতে পারবে কেন? কীভাবে পথ বের করতে পারে? তিনি পথ খুঁজে খুঁজে রাজনীতি করেন। যখন যেমন তখন তেমন কৌশল ধরেন। লাশের রাজনীতি নিয়ে লাশ লাশ খেলেন। এই খেলা বেশ মজার। দাবার চৌষট্টি ঘর-ছকের মতো। সেখানে রাজা-মন্ত্রী-সৈন্য। যার যতটুকু ক্ষমতা। তিনি খেলায় পরিপক্ব। তেমন নেতিবাচক হিসেবে না দেখে বলা দরকার তিনি সময়-সুযোগ-সুবিধার সঙ্গে কৌশলের সমন্বয় এবং প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। এতে কাঁধের উপর কোন্‌ অশরীরি সত্ত্বা বসে বসে হিসাব লিখছে নাকি গালমন্দ করছে, দেখার বা শোনার কী আছে?
তিনি নিজেকে প্রবোধ দেন। সকাল সাড়ে নয় বেজে আসছে। মানুষটি এখনই মুখের সামনে দিয়ে হেঁটে যাবে। তার দু-চোখ সেই লাশের চোখের মতো। রাইফেলের গুলিতে অনেক রক্ত ঝরে ঝরে রক্তশূন্য। পাঁশুটে হলুদ। পাণ্ডুর বিষাদ। শঠতার এই সময়ে প্রতারিত মানুষের ক্লান্তির মতো। কখনো কখনো তিনি ভুল করে বসেন। আসলে সে কি জীবিত নাকি সেই লাশ যাকে তিনি দেখেছেন আর…। আহ্‌ আজ আবার সেই কথা কেন? সেই ঘটনা তো শেষ হয়ে গেছে। সেই লাশ ভূত হয়ে বায়ুমণ্ডল-নভোমণ্ডল ভেসে বেড়ায়। মানুষের পৃথিবীতে ফিরে আসার কোনো ক্ষমতা নেই তার। অবশ্য এটি এখন মানুষের কি না কে জানে। মাত্র কি একটি লাশ নাকি আর একটি, আরও একটি; আরও আরও…? তিনি হিসাব মেলাতে পারেন না। হিসাব করেই বা কী?

যখন এসআই স্বপন কুমার ভরদুপুরে আপত্তি-গুঞ্জন সত্ত্বেও মেয়েটির লাশ পরখ করেন, একে একে খুলে ফেলেন পরনের কাপড়; প্রায় ফেলেছেন আর জনতার কেউ কেউ মজা পেতে থাকে। আগ্রহ-কৌতূহলে চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসে। মেয়েমানুষের লাশ, যার দেখার মতো সবকিছু ভেতরে এবং সুড়সুড়ি মজা। বেআবরু করার মজাও আলাদা। সেটি লাশ কিংবা জীবিত মানুষ। মানুষজন বিড়বিড় করে। এই মেয়েটি পাশবিক নির্যাতনের শিকার। তিনি জানেন, এই অপরিপক্ব মৃত শরীর শহরের আগুন জ্বালিয়ে দিতে পারে। সাংবাদিকেরা ছবি তোলে। উত্তর-পূর্ব-পশ্চিম-দক্ষিণ বিবিধ অ্যাঙ্গেল থেকে ক্লিক ক্লিক। ফ্লাশের ঝলকানি। বিশাল আট কলাম খবর তৈরি হয়। খবর নিয়ে দরদাম চলে। আগুন চেপে রাখতে হবে। আগুন তো নয়, গোপন অপরাধ; অনেক মূল্য। তিনি সব দেখেছেন। হিসাব কষে মূল্য অনুমান। আর সত্যি সত্যি আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল। কেননা তা না হলে রাজনীতির পাশা খেলা কী করে হবে? কোনো কোনো মৃত্যু দিয়েই তো দুর্যোধনের চাল চালতে হয়। সেখানে শকুনি থাকে। প্রমুখ সভাসদ। গোপন বৈঠক। পরামর্শ-পরিকল্পনা। উপরের নির্দেশ।
তাকে কোনো সলতেয় আগুন জ্বালাতে হয়নি। যারা জ্বালাবার, সময়মতো ঠিক কাজ করেছে। জ্বালিয়ে দিয়েছে আগুন। মল্লিকপুরের শুকনো মাঠ মানুষের রুদ্ররোষে ঘেমে ভিজে যায়। দাউদাউ আগুন জ্বলে ওঠে। তারপর শহরের রাস্তায় রাস্তায় মোড়ে মোড়ে গলিপথে ইটপাটকেল। জবাবে টিয়ার শেল। মানুষের চোখ-মুখ জ্বলে যায়। অবশেষে পাখি শিকারের গুলি। একটি লাশের জায়গায় আরও লাশ। মানুষ লাশ ছিনিয়ে নেয়। আকাশ-দিগন্তে প্রতিবাদ ধ্বনি-প্রতিধ্বনি। লাশের মিছিল। কোনো কোনো লাশ বেমালুম গায়েব। মানুষটি তেমনই লুকোন এক লাশ বের করতে তার কাছে এসেছিল। তিনি মনে করতে পারেন না। কে সেই মানুষ? তার দু-চোখ রক্তজবার মতো লাল। পাণ্ডুর বিকেলের মতো ফ্যাকাশে উদাস। কে…কে? পরিশেষে চিনতে পারেন। সেদিন…যেদিন চোখের উপর চোখ পড়ে যায়, তিনি কি কেঁপে উঠেছিলেন? এই ভেবে যে ক্ষমতার লক্ষ্যে লাশ ফেলেছেন আর দেশে এসবই রাজনীতি, কখনো ভাবেননি, আশঙ্কা ছিল না; একদিন তিনিও লাশ হবেন। অবশ্য তেমন লাশের প্রকাশ্য বাহারি জানাজা হয়। অথচ কফিনে কোনো মানুষ থাকে না। কুকুর কিংবা বীভৎস খবিশ। তিনি তো সেদিন থেকে এক লাশ। প্রমাণ হয়ে গেছে।

মানুষটি দু-চোখের অশ্রু শুকিয়ে ফেলে। মরুভূমি বিশুষ্ক বাতাস। কেননা যা হওয়ার নয় তেমন কোনো ঘটনা মানুষের সবকিছুকে অলীক করে তোলে। অবিশ্বাস্য হয়ে যায় বেঁচে থাকা। সে বলে, –
‘আপনি আকাশ থেকে তারা খসে পড়ার ঘটনাকে কীভাবে দেখেন?’
‘মানে?’
‘আমার মা অর্থাৎ সেই লাশেরও মা বলতেন, আকাশ হতে তারা খসে পড়া খুব অশুভ। নিজেদের মধ্যে কেউ মারা যায়। আমি পীরগঞ্জে কাজ শেষে যখন ফিরে আসি, মধ্য-দুপুর, প্রচণ্ড রোদ; গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরে ঘুরে অসম্ভব ক্লান্ত। অফিসে যেতে হবে। ফিল্ড রিপোর্ট লেখা দরকার। আমার সামনে ওই এলাকার ম্যানেজার। আমি দক্ষিণের আকাশে একটি উজ্জ্বল তারা খসে পড়তে দেখলাম।’
‘দিনের বেলা…দুপুরে? যতসব আজগুবি।’
‘তারাটি ছিল দিনের চেয়েও উজ্জ্বল। তীব্র আলোকচ্ছটা। সাধারণত এমন হয় না।’
‘তারপর?’
তিনি জিজ্ঞেস করেন। তবে বিন্দুমাত্র কৌতূহল ছিল না। সেই মহূর্তে তেমন রূপকথার গল্পইবা কেন? অসহায় বিভ্রান্ত সময়ে এমন কাহিনির পথরেখায় হেঁটে চলা মানুষ আরও নিঃসঙ্গ-দুর্বল-অবলম্বনহীন হতে থাকে। দীর্ঘশ্বাস-নিয়তির স্মরণ করে। আকাশের প্রান্তসীমায় কোণায় কোণায় আকুল দৃষ্টিতে খুঁজে নেয় কোনো ফরিয়াদ। অভিযোগের জলছবি আঁকে। আনুপূর্বিক ঘটনা সামান্য কৌতূহলজনক মনে হলেও মজা করতে ইচ্ছে জাগে না। কেননা এই মৃত্যুকে করুণায় ডোবাতে মন চায়। মানুষটি অস্থির-ব্যাকুল দু-একটি কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলে। কাঁদতে থাকে। সেই নিশ্চুপ-নিথর প্রলম্বিত অশ্রুধারা নদীর মতো বয়ে চলে। সময় থমকে দাঁড়ায়। মনে হয় গাছের পাতা শুকিয়ে গেছে, আকাশপথে ভেসে বেড়ানো পাখি ভুলে গেছে গান; প্রাণ আকুল বজ্র-নিনাদ শোকধ্বনি বাতাসে ধীরলয় ঢেউ তুলে ভেসে ভেসে যায়। সময় ধারহীন ছুরির ফলায় খুঁচিয়ে তুলতে থাকে। মানুষটির মলিন মুখছবি। গাল টসকানো চোয়ালের উঁচুতে দু-চোখ টকটকে লাল। কোনোদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। একসময় স্তিমিত হয়ে অসম্ভব ক্লান্তির ছড় টেনে নেয়। অথবা বিরতি। তখন ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনার মতো আকুল আবেদন।
‘আমার ভায়ের লাশ বের করে দিন। দাফন করব। ভাইটা আমার না খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল।’
‘আচ্ছা তুমি ভোরবেলা লাশকাটা ঘরে আসো। আশা করি কার্ফুতে শহরের অবস্থা ঝিমিয়ে যাবে। পুলিশ লুকিয়ে রাখা লাশ বের করে দেবে। এরপর লাশের সুরতহাল। তারপর।’
মানুষটি তারপরও পায়ের কাছে কুকুরের মতো বসে থাকে। এদিক-ওদিক অর্থহীন ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি ফেলে যায়। সে আসলে কী দেখছিল? কোনো স্মৃতি? সুখ-দুঃখের ইতিকথা স্মরণ? অথবা অপরিণত বয়সে মৃত ছোটভাইয়ের লাশ। তার কাঁধে ভারী পাথর। ঘোরের মতো বসতে চায়। তিনি তখন সে-সব দেখে অন্যকিছু ভাবেন। আজও মনে আছে। আসলে সবকিছু ক্যারামবোর্ড খেলার নিয়ম-ছক বেঁধে চলে না। কাজ এগোয়। ক্ষমতা কাঠামোর পরিবর্তনে অনেককিছু করতে হয়। এরজন্য দু-একটি লাশ পড়তেই পারে। কিন্তু এই লাশ…না না হিসাব মেলে না। লুকিয়ে থাকা মানুষের লাশ বের করে আনা অনেক শক্ত। তিনি নিজেও জানেন না আসলে সেটি হবে কি না, পারবেন কি না; জানা নেই।
পরদিন সেই মানুষ সূর্যের জন্য অপেক্ষা করতে করতে শেষে প্রায় বেভুল-দিশেহারা-অর্ধনগ্ন লাশকাটা ঘরে পৌঁছে যায়। না লাশকাটা ঘর মর্গ চেনা নাই। সে এসে পড়ে খালপাড়া-মেথরপট্টি। বিশুষ্ক মাঠে কয়েকটি শূকর ইতস্তত ঘুরে বেড়ায়। সেখানে হোলি উৎসব। মানুষ এত কান্নার মধ্যেও আনন্দে মেতে উঠতে পারে! সে হত-বিহ্বল। কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। একমুহূর্ত নিশ্চল দাঁড়িয়ে সেখান থেকে দৌড়ে পালায়। এখানে-ওখানে। স্খলিত পদ শোকাকুল উন্মাদনায়। কোনো লাশ আসেনি। কোতয়ালির পরিত্যক্ত ল্যাট্রিনের অন্ধকার দেয়ালে দাঁড়িয়ে থাকা এক মৃতদেহ বাইরের ফাঁকফোকরে তাকিয়ে থাকে। বের হতে পারে না।

এর দু-দিনপর গভীর ভোররাত। শহর নিশ্চুপ-নিথর ঘুমিয়ে আছে। প্রতিবাদের দাউদাউ আগুন নিভে গেছে প্রায়। সবকিছু নিয়ন্ত্রণ। শান্ত-স্বাভাবিক। তখন খুব গোপনে লাশ দাফন হয়ে গেল। পুলিশের গুলিতে প্রতিবাদী মানুষের মরে যাওয়া অনন্ত পাপ। সার্থক চতুর মানুষের কৌশল। লাশ লাশ খেলার রাজনীতি অনেক পবিত্র কর্ম। শেখ রহিম দুপুরে দেখেন, মানুষটি নতুন এক কবরের পাশে পাথর-মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। জনতার বিচ্ছিন্ন কথাবার্তা-চিৎকার-হুংকারের মধ্যে দু-চোখ অসম্ভব ঘোলাটে। পশ্চিম দিগন্তে নির্নিমেষ ধূসর দৃষ্টি প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে সেঁটে আছে। সেখানে কি ঈশ্বর? তিনি দেখতে পান? কোন্‌ তামাশার নেশায় মানুষ সৃজন করেছেন? অথবা তিনি কোনো লাশ খুঁজে চলেন? কেননা তখন কয়েকটি জটলা গোরস্থানের ভেতরে এবং বাহিরে বড় অস্থির-বেপরোয়া। তারা কবরের ভেতরে আরও লাশ আছে অবিশ্বাস সন্দেহে খুঁড়ে দেখতে জোরজারি করে। সময় কেমন বদলে যায়, বদলে দেয় সবকিছু; কেননা তাদের আক্রোশ উলটোদিকে ঘুরে গেছে। সেই মানুষ গোররক্ষকের ভূমিকায় নিশ্চল অসহায়ের মতো লাশের ঘুম ভাঙাতে চাইছে না। শেখ রহিম রাস্তায়। টয়োটার হিম-শীতলে বসে থাকেন। অনেক হালকা সুরে রবি ঠাকুরের গান বাজে। তিনি ড্রাইভারকে ক্যাসেট বন্ধ করতে বলেন। জনরোষ সাংঘাতিক। কবর খুলে দেখানো হোক। তিনি সবকিছু দেখেন। এখানে থাকা নিরাপদ নয়। সহসা পাঞ্জাবির পকেট থেকে প্রচণ্ড সাদা রুমাল বের করে মুখ মুছে সরে গেলেন। এখন দাবার পরবর্তী চাল। নতুন হিসাবনিকাশ।

শেখ রহিম পরে এমপি হলেন। আইনসভায় বসে কত আইন তৈরি হল। টাকা-সম্মান-সমৃদ্ধি কামালেন। এখন আলিশান প্রাসাদে থাকেন। আরামের পালঙ্কে স্বর্গের ঘুম। সকাল-বিকাল নিয়মমতো বারান্দায় বসেন। গদি-আঁটা চেয়ার। অবসর জীবনে আনন্দ-ফুর্তির সঙ্গে সকাল-দুপুর-সন্ধ্যায় মানুষ দেখেন। তিনি দেখেন মানুষ। তারা দেখে কৌশলী-সফল-সার্থক-সুখী এক মহামানুষ। নাকি তারা লাশ দেখে? তিনি যেমন ওই মানুষটিকে দেখেন, কখনো চিনে নেন; পোড়-খাওয়া ন্যুব্জ বৃদ্ধের মতো অসহায় ব্যক্তি, যার দু-চোখে মৃত মানুষের ফ্যাকাশে হলুদ।

সেও তো আসলে এক লাশ!

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৯ টি মন্তব্য (লেখকের ৪টি) | ৪ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ২০-১১-২০১৮ | ১৮:৩৩ |

    ঘোর গোধুলির ম্রিয়মাণ আলোয় বসে; ফেলে আসা জীবনের স্মৃতি। নাহ্ স্মৃতি বলা ঠিক হবে না। বলতে হবে তাবৎ কর্মের আত্মসমালোচনা। যে ব্যক্তি নিজের কাছে নিজের প্রশ্ন রাখতে জানেন সম্ভবত তিনি ভুল করতে পারেন না। বিবেক তাকে পাহারায় রাখে।

    জীবিত লাশের যে গল্প পড়লাম … বাস্তবে এমনটা হয়। আমি বেশ কিছু জনকে দেখেছি … জীবনের শেষ বেলায় নিজের সাথে নিজের কথা বলতে শুনেছি। কষ্ট পেয়েছি।
    জীবন একটাই হে ভদ্দরলোক !!

    GD Star Rating
    loading...
    • মাহবুব আলী : ২৩-১১-২০১৮ | ৮:০৪ |

      ধন্যবাদ মুরুব্বীভাই। গল্পটি ১৯৯৫ সালে ইয়াসমিন ধর্ষণ এবং তার প্রতিবাদে নিহত কোনো মানুষের লাশ খুজেঁ পাওয়া এবং রাজনীতির কুটকৌশল নিয়ে লেখা।

      GD Star Rating
      loading...
      • মুরুব্বী : ২৩-১১-২০১৮ | ৯:০৯ |

        আমি অনুমান করেছিলাম মাহবুব ভাই।

        GD Star Rating
        loading...
  2. রিয়া রিয়া : ২০-১১-২০১৮ | ১৯:১৭ |

    অদ্ভুত এই ঘোর লাগা আবেশীয় লেখা। যদিও সিরিয়াস তারপরও অসাধারণ।

    GD Star Rating
    loading...
  3. সৌমিত্র চক্রবর্তী : ২০-১১-২০১৮ | ১৯:৪০ |

    মনোজগতের সাথে গল্পকারের লাশের যোগবিয়োগ। (গল্পনায়কের)

    কী দুর্বিষহই না সমগ্র জীবন। করুণা হলো। Frown

    GD Star Rating
    loading...
  4. মুহাম্মদ দিলওয়ার হুসাইন : ২০-১১-২০১৮ | ২২:০১ |

    সেও তো আসলে এক লাশ!

     

    * লেখকের জন্য শুভ কামনা সবসময়… 

    GD Star Rating
    loading...