লীলাবালি!
প্রায় ১৯ বছর আগের কথা, মেলবোর্নে ছিলাম, দারুণ সুন্দরী নাহার আপার সাথে পরিচয় হয়। নাহার আপা আমার চেয়ে অনেক সিনিয়র ছিলেন। শুনেছি আপা ছাত্রজীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসাইটে সুন্দরী এবং মেধাবী ছাত্রী ছিল। অস্ট্রেলিয়া এসে মাস্টার্স করে আপা তখন ভাল চাকরি করছে।
নাহার আপার একমাত্র মেয়ে জুমানা ছিল মায়ের চেয়েও দুই ডিগ্রি বেশী সুন্দর। গালে টোকা দিলে আবির ঝরে, নাহার আপা এমন ধরণের সুন্দরী। আপার মেয়ে জুমানাও তাই।
নাচ-গান নিয়ে লাফানি ঝাঁপানি করতাম বলে নাহার আপা আমাকে খুব পছন্দ করত, বয়সে আমার চেয়ে বড় হলেও যেহেতু উত্তমকে ঢাবিতে সিনিয়র ভাই এবং পরবর্তিতে লেকচারার হিসেবে দেখেছে, সেই সূত্রে আমাকে ‘বৌদি’ ডাকতো।
তখন বাংলাদেশ সমিতির ব্যানারে কোন একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মহড়া চলছিল। শনিবার আর রবিবারে প্র্যাকটিস চলতো। বাংলাদেশীদের প্রায় সকলেই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করেছিল, দুই কন্যা মৌটুসী, মিশাকে নিয়ে আমি তো অংশ নিয়েছিলামই, একমাত্র কন্যা জুমানাকে নিয়ে নাহার আপাও অংশ নিয়েছিল।
কোন এক রবিবারে প্র্যাকটিসে যাওয়ার আগে এক দুপুরে আমাদের বাসায় এলো, আমি নাহার আপার জন্য খাওয়ার আয়োজন করছি আর কলবল কলবল করেই যাচ্ছি। হঠাৎ খেয়াল হলো নাহার আপার গলায় দুলতে থাকা ক্রিস্টালের মালার প্রতি, আমি ” ওহ মাগো, কী সুন্দর মালা, নাহার আপা, এই মালা আপনার জন্যই তৈরী হয়েছে” বলে হই হই করে উঠলাম।
নাহার আপা জানতে চাইলো, “বৌদি, আপনি কি বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে?”
বলেছি, “হ্যাঁ, কেন বলেন তো”।
নাহার আপা বলল, “একমাত্র মেয়েরা কখনও বড় হয়না, কথায়, চলনে সব সময় আহ্লাদী ভাব একটা থেকেই যায়। লীলাবালি লীলাবালি গানের লীলাবালির সাথে আপনার মিল আছে”।
বললাম, “আমাকে লীলাবালি মনে হয়? মালা সুন্দর বলার সাথে লীলাবালির কি মিল পেলেন”?
নাহার আপা বলে, “আহ্লাদী বলেই সাধারণ ক্রিস্টালের মালা দেখেও এত খুশী, লীলাবালিরা এমনই আহ্লাদি হয়, দাঁড়ান আমি আপনাকে মালাটা দিয়ে দিচ্ছি”।
আমি নাহার আপাকে বললাম, “আমাকে মালা দিলে লাভ নেই, এই মালা তো মালাকার ‘নাহারবালি’র জন্য বানিয়েছে, লীলাবালির জন্য বানায়নি”।
নাহার আপা বলল, “এই যে দেখেন, আহ্লাদিরাই এমন সুন্দর করে কথা বলতে পারে। স্যার মনে হয় আপনার আহ্লাদীপনা খুব এনজয় করে, তাইনা বৌদি?”
বললাম, “আমি যে আহ্লাদী, তাইতো জানলাম এখন”।
-বৌদি, আপনার এই ছটফটে ভাব আমার খুব ভালো লাগে, আমারও ইচ্ছে করে এমন চঞ্চল হতে, কিন্তু আমি চঞ্চল হতে পারিনা।”
আমি মালাটি নাহার আপার গলা থেকে খুলতেই দেইনি, কারণ সুন্দর জিনিস দেখাতেই আমার আনন্দ, হাতে পেয়ে গেলে আনন্দটা আর থাকেনা।
সোনার গহনার প্রতি আমার কোন ইন্টারেস্ট নেই, নারী আড্ডায় সোনার গহনা নিয়ে গল্প হবেই, সেই গল্পে আমি নীরব থাকি। কিন্তু রঙ বেরঙের পাথর, মুক্তো, ডায়মন্ড, ক্রিস্টাল বসানো অলঙ্কারের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকতে পারি। তবে ঐ তাকিয়ে থাকা পর্যন্তই আমার আনন্দ, হাতে পেলে আর তাকিয়ে দেখিনা।
ওয়ালমার্টে অনেক ধনী-গরীব মেমসাহেব আসে, আমেরিকার মেমসাহেবরা বাঙ্গালী নারীর মতই অলঙ্কার পছন্দ করে, তাদের অলঙ্কারে সোনা-রূপার চকচকানির চেয়েও বেশী জ্বলজ্বল করে নানা বর্ণের পাথর, হীরে, চুনী, পান্না। আমি চাকরি করি এমনই এক ডিপার্টমেন্টে যেখানে ধনী-দরিদ্র সকলেই আসে, আমেরিকার মানুষ ক্ষিদে পেলে পেটে পাথর বেঁধে থাকতে পারবে কিন্তু মোবাইল ফোন ছাড়া বাঁচবেনা।
মেম সাহেবদের মধ্যে যারা সাদা মেমসাহেব, তাদের গহনাগুলোর দিকে আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি, গহনার প্রশংসা করি, গহনার গল্প শুনতে চাই। তাদের সকলেই খুব খুশী হয় গহনার প্রশংসা শুনে, যতটুকু জানতে চেয়েছি, তার চেয়েও অনেক বেশী গল্প বলে ফেলে। আর কালো
মেমসাহেবদের গহনার প্রতি আমার কোন আগ্রহ থাকেনা। কালো মেমসাহেবদের গহনা মানেই ‘গোবদা গাবদা’ ডিজাইনে, কটকটে রঙের সমাহার, একটুক্ষণ তাকালেই আমার মাথা ব্যথা করে।
আজ এক কালো মেমসাহেবকে মোবাইল ফোন পছন্দ করতে সাহায্য করছিলাম, মেমসাহেব আমার মাথাটা খারাপ করে দিচ্ছিলো, মন ঠিক করতে পারছিলনা কোন ফোন নিবে। বার বার কেইস খোলায়, ফোন দেখে, এরপর বলে, ” সরি, এটা না, ওই কেইসের ভেতর থাকা ওই ফোনটা একটু দেখাও”। শেষ পর্যন্ত একটা ফোন নিলো, এরপর শুরু হলো ফোনের জন্য ফোন কেইস খোঁজার পালা। এটা দেখে, ওটা দেখে, আমাকে জিজ্ঞেস করে, ঐ সময় আরেকজন কালো মেমসাহেব মোবাইল কার্টে চড়ে আমাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো।
গাড়িতে চড়া মেমসাহেব বিশাল দেহের অধিকারি, আজ রবিবার, চার্চ থেকে ফিরেছে তা সাজগোজ দেখেই বুঝা যায়। রবিবারের গল্প আমি অনেকবার করেছি, রবিবারে আমার মন প্রফুল্ল থাকে, কারণ এই বারে সকলেই সাজগোজ করে চার্চে যায়, চার্চ থেকে ফেরার পথে ওয়ালমার্ট ঘুরে যায়। ওদের সাজগোজ দেখানোর জায়গা এই ওয়ালমার্ট, প্রেমে পড়ার জায়গা ওয়ালমার্ট, এক পৃথিবীর ভেতর আরেক পৃথিবী।
কালো মেমসাহেব গাড়ি চালিয়ে আমার কাছাকাছি হতে চোখাচোখি হলো, মুখটা চেনা চেনা লাগছে। অনেক সাজু করলেও খুব মার্জিত সাজ করেছে, গলায় সাদা মুক্তো পুঁতি আর রঙিন পুঁতিতে গাঁথা মালা, হাতে সাদা মুক্তোপুঁতির চার লহরে গাঁথা ব্রেসলেট, আঙ্গুলে বড় সাদা পাথরের আংটি। পরণে সাদা স্কার্ট, নীল-সবুজ-সাদা প্রিন্টের ঢোলাঢালা শার্ট। সব মিলিয়ে স্নিগ্ধ সাজ।
মেমসাহেব আমার দিকে তাকিয়ে পরিচিতের হাসি হেসে বললেন, ” হাই, হাউ আর ইউ সুইট লেডি”
আমিও হেসে প্রতিউত্তর দিলাম, ” হাই! কেমন আছো? বাহ, কী সুন্দর তোমার গলার মালাটা”।
মেমসাহেব বলে, “মালাটা সুন্দর? সত্যি বলছো?”
-বললাম, সত্যি বলছি, খুব সুন্দর।
মেমসাহেব গলা থেকে মালাটা খুলে ফেললো, আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো, “মালাটা তুমি নাও”।
আমি অপ্রস্তুত, বলি, “একী, মালা আমায় দিচ্ছো কেন?”
মেমসাহেব বলে, “তোমাকে আমার খুব ভাল লাগে, তুমি ভুলে গেছো হয়তো, আমি একদিন টিভি কিনতে এসেছিলাম, ইলেকট্রনিকস ডিপার্টমেন্টে এত্তগুলো অপদার্থ থাকার পরেও কেউ আসেনি আমাকে হেল্প করতে। তুমি এসেছিলে এবং আমাকে অনেক সাহায্য করেছিলে। আমার এত ভালো লেগেছিল তোমার ব্যবহার। তোমার এত ধৈর্য্য, খুব বড় গুণ।”
বললাম, “কী জানি, আমার মনে পড়ছেনা।”
-আমার মনে আছে, আমার তখনই মনে হয়েছিল তোমাকে কিছু একটা উপহার দেই। আজ তুমি নিজেই মালাটি সুন্দর বলে আমাকে উপহার দিতে হেল্প করলে, এটা তোমার প্রাপ্য”।
আমার তখন অস্বস্তি লাগছে, এভাবে কারো কাছ থেকে কিছু নিতে অস্বস্তি হয়, মনে মনে ভাবছিলাম, “নাহার আপার কথাই ঠিক, আমি বড় হইনি, পুঁতির মালা দেখলে এখনও মন টলমল করে উঠে।
কালো মেমসাহেব বলল, “মালাটা তুমি এনজয় করবে, আমাকে মানাচ্ছেওনা, দেখো পরণের এই জামার সাথেও যাচ্ছেনা। তুমি নাও, আমি খুশী হবো।”
মালা হাতে নিলাম, খুব আন্তরিকভাবেই বললাম, “তোমার দেয়া উপহার আমি খুব যত্ন করে রেখে দিব, অনেক ধন্যবাদ তোমায়”।
মালা বাম হাতে পেঁচিয়ে রেখেও মনে শান্তি পাচ্ছিলাম না। চারদিকে সিসিটিভি ক্যামেরা ফিট করা আছে, পান থেকে চুন খসলে চাকরি নট হয়ে যাবে। চাকরি নট হলে আমি আর্থিক সমস্যায় পড়বোনা, কিন্তু লজ্জায় মরে যাব। আমি নিজে থেকে দশবার চাকরি ছাড়তে পারি, কিন্তু আমাকে চাকরি থেকে একবার নট করে দিলে মরে যাব, কারো সামনে দাঁড়াতে পারবোনা। আত্মসম্মানবোধ খুব বেশী টনটনা আমার। জব পলিসিতে আছে, কাস্টমারদের কাছ থেকে কোনরকম উপঢৌকন নেয়া যাবেনা।
মালা হাতে পেঁচিয়ে গেলাম ম্যানেজার স্টেশানে, একজনকে পেলাম। তাকে বললাম সংক্ষেপে যা বলার, ম্যানেজার বলল, “তুমি রাখতে পারো। কেউ ডলার দিতে চাইলে নিওনা”।
শেষে বললাম, মালাটির মূল্য আমার কাছে পয়সায় নয়, আজ রবিবার, ভদ্রমহিলা চার্চ থেকে ফিরেছেন, এক কথায় গলা থেকে মালা খুলে আমাকে যখন দিলেন, আমার মনে হল, মালাটির সাথে স্পিরিচুয়াল ফিলিং জড়িয়ে আছে। ওয়ালমার্টের জব পলিসিতে যদি এই উপহার গ্রহণ অপরাধ বলে ধরা হতো, আমি জানিনা কী করতাম। চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে যেতাম, তবুও একজনের ভালোবাসাকে অগ্রাহ্য করতে পারতামনা।
ম্যানেজার হাসি দিয়ে বলল, এটা তো ভালো ইউ ডিড গুড জব, কাস্টমার খুশী হওয়া মানেই আমাদের খুশী। ডলার বাদে যে কোন উপহার নির্দ্বিধায় গ্রহণ করতে পারো।
ম্যানেজারের রুম থেকে বেরিয়ে এলাম ফুরফুরে মন নিয়ে, মনে পড়ে গেলো, ঊনিশ বছর আগের এক দুপুরের কথা, নাহার আপা বলেছিল, “লীলাবালি লীলাবালি, কি দিয়া সাজাইমু তোরে” গান শুনলেই আমার কথা মনে হয়। আহলাদী লীলাবালি আমি।
৩০ শে আগস্ট, ২০১৫
loading...
loading...
লীলাবালি !! লীলাবালি !! ছোট অথচ দীর্ঘ অনুরণন বেজে গেলো মনের মধ্যে।
… জীবন এমনই।
loading...
জীবন এমনই আজাদ ভাই।
loading...
এক দমে পড়ে ফেললাম, প্রাঞ্জল বর্ণ্না
loading...
bornona…..
loading...
ভালো করেছেন রোমেল আজিজ ভাই। ধন্যবাদ।
loading...
দারুণ লেখা
loading...
ধন্যবাদ ভাই।
loading...
অপূর্ব এবং অসাধারণ আপনার প্রকাশ দিদি।
loading...
আনন্দিত হলাম রিয়া।
loading...
চমতকার অনুভুতি এবং তার সাথে মনে রাখার মত বর্ননা। আশা করছি
এই ঘটনা আমার অনেকদিন মনে থাকবে!
loading...
ধন্যবাদ খালিদ ভাই। শুভেচ্ছা রেখে গেলাম আপনার জন্য।
loading...
অসাধারণ স্মৃতিকথা। মুগ্ধ না হয়ে কি পারা যায়?
loading...
ধন্যবাদ সৌমিত্র ভাই।
loading...
মুগ্ধ।
loading...
ধন্যবাদ শাকিলা তুবা ভাই।
loading...
* উপস্থাপনার ধরণ বেশ চমৎকার হয়েছে…..
loading...
"নাহার আপা বলল, “একমাত্র মেয়েরা কখনও বড় হয়না, কথায়, চলনে সব সময় আহ্লাদী ভাব একটা থেকেই যায়। লীলাবালি লীলাবালি গানের লীলাবালির সাথে আপনার মিল আছে”।"
নাহার আপা সম্ভবত জেনেই বলেছেন। শিশুর সাথে বাবা মা এবং পরিবারের অন্যান্যদের আচরণ তার ব্যাক্তিত্বের ওপর শক্ত ছাপ রেখে দেয়। শিশুর পারসোনালিটি ডেভেলপমেন্ট থিয়োরিগুলিতে তাই লিখা আছে।
এক নিঃশ্বাসে পড়ে নিলাম। মুগ্ধ !
loading...
চমৎকার লেখা। বেশ ঝরঝরে —
মুরুব্বী : ০৪-০৯-২০১৮ | ১৭:৫৯ |
লীলাবালি !! লীলাবালি !! ছোট অথচ দীর্ঘ অনুরণন বেজে গেলো মনের মধ্যে।
… জীবন এমনই। সুন্দর বলেছেন
loading...