ট্রেনটা যখন জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে থামলো তখন মধ্যরাত। আসিফের মনে হল, কেউ একজন তাকে ট্রেন থেকে টেনে নামাচ্ছে। বাস্তবে ছেলেবেলায় একবার ঘোড়ার গাড়ি থেকে তাকে টেনে নামানোর ঘটনা ঘটেছিল। পাশের গ্রামে এক আত্মীয়ের বাড়ি যাচ্ছিলো; নায়লা তাকে হাত ধরে টেনে নামিয়ে বলেছিল, “এই, তুমি আমার সাথে খেলতে চাওনা কেন?” দুজন তখন একই স্কুলে পড়তো। নায়লা উপরের ক্লাসে হলেও আসিফ তাকে তুই সম্বোধন করতো। নায়লার বউ-জামাই খেলার আবদারে সে সব সময় লজ্জা পেতো।
জগন্নাথগঞ্জ ঘাটই শেষ স্টেশন। ট্রেনটা ফিরে যাবে। কিন্তু আসিফ দেখলো, কেবল সেই ই নেমেছে। তাইলে ট্রেনে কী আর কোন যাত্রি নাই? নাকি এই রকম রাতে আর কেউ নামার সাহস পাচ্ছেনা? এক দৌড়ে সে একটা গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ালো। ঝিরঝির বৃষ্টি হচ্ছিল। সে আবার তাকালো। নাহ, আসলেই কেউ নামছেনা। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আসিফ বৃষ্টির মধ্যেই হাটা শুরু করলো। কয়েক কদম হাঁটার পর দেখলো, রাস্তাটা তিনদিকে গেছে। সে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। যদি তেমন কাউকে পায় পথ চিনে নিবে। মিনিট পাঁচেক পর অদ্ভুত পোশাকে এক জটাধারী লোককে আসতে দেখলো। তার হাতের লাঠি পা ফেলার সাথে তাল মিলিয়ে ঝুনঝুন বাজছিলো।
-মাহীপুর কোন পথে?
লোকটা কাত হয়ে আসিফের দিকে তাকিয়ে বললো,
-হকক মওলা
শব্দটার আকস্মিকতায় আসিফ চমকে ওঠলো।
লোকটা আর কিছুই না বলে চলে গেলো। আসিফ ভেবে পাচ্ছিলোনা এখন সে কী করবে? তার মনে পড়লো, লোকটা তার হাতের লাঠি অল্প উত্তরমুখি করেছিলো। আসিফ উত্তরের পথটাই বেছে নিলো।
বেশ কিছুক্ষণ যাবার পর বামে একটা নদি পড়লো। এমনি হবার কথা। নায়লা চিঠিতে একবার নদির কথা বলেছিল। অল্প দূরে একটা নৌকায় পিদিমের আলো দেখা যাচ্ছে। আসিফের বুকটা হুহু করে ওঠলো। নায়লা তার চেয়ে আগে শরীরে কৈশরের চিহ্ন পেয়েছিলো। তখন সে নিজে থেকেই বউ-জামাই খেলা বাদ দিলেও আড়ালে আবডালে আসিফকে কাছে টেনে নিয়ে বলতো, “বিয়ে হলে আমরা মধ্য নদিতে পিদিমের আলো জ্বালিয়ে বাসর করবো। করবেনা?” এর মাস কয়েক পর আসিফ তাঁকে একটা পিতলের পিদিম উপহার দিয়েছিল; নামের প্রথম অক্ষর খোঁদাই করে।
আরেকটু পর একটা বাঁশবন পড়লো। বেশ অন্ধকার। সে দ্রুত পা চালালো। বনটা পেরোনোর পর পরই মাথার ওপর দিয়ে কিছু একটা শব্দ করে উড়ে গেলো। আসিফ ভাবলো, কোন পাখি হয়তো পথ হারিয়েছে। আরো দশ পনের মিনিট পর একটা বাড়ির মতো কিছু একটা তার চোখে পড়ল। আরো কাছাকাছি হবার পর স্পষ্ট হলো, আশপাশে কোথাও কিছু নাই; কেবল ওই বাড়িটাই। ভিতরে আলো জ্বলছে। একটু অদ্ভুত লাগলেও আসিফ বাড়িটাতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। আরো কতো পথ যেতে হবে কে জানে? ভারি পানি পিপাসা লেগেছে।
-কেউ আছেন?
আসিফ কোন উত্তর পেলোনা।
আবার ডাকলো,
-বাড়িতে কেউ আছেন?
এবারও সে কোন উত্তর পেলোনা।
অতঃপর যেই সে হাটা শুরু করলো- দেখে সম্মুখে সেই জটাধারী লোকটি; অকস্মাৎ উপস্থিত হয়েছে!
লোকটা এবার পথ চিনিয়ে যাচ্ছে।
তার হাতে ঝুনঝুন লাঠির বদলে নাম খোঁদাই করা একটা খোলা পিদিম; এতো বাতাসেও নিভছেনা!
প্রেমের পিদিম বাতাসে নিভেনা!
loading...
loading...
অনেকদিন পর আপনার লিখা শব্দনীড়ের পাতায় ভেসে উঠলো।
গল্পটি পড়লাম। আপনার প্রতিটি লিখাই শৈল্পিক এক সৌন্দর্যে মানানসই থাকে।
loading...
মনোলোভা কথার চয়ন।
loading...