সময় প্রতিটি মানুষের জীবনের সাথে নিবির ভাবে জড়িত। সময়ের ধারাবাহিকতায় জীবন একেক সময় একেক ভাবে তার গতি পাল্টায়। ব্যক্তি জীবনে প্রতিটি মানুষই বিপুল সাহস ও অটল ধৈর্য নিয়ে বাস্তব জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত, আশা-নিরাশা এবং আনন্দ-বেদনায় উত্তাল জীবন-সমুদ্র পাড়ি দেন সময়কে আশ্রয় করে। সময় প্রবাহিত হয় প্রবহমান জীবন-নদীর ধারার মতো। সময়কে কখনোই ধরে রাখা যায় না, এটা প্রবাহিত হয় তার আপন নিয়মে। একটা সময় ছিল তখন ভাবতাম সময়কে কিভাবে পার করব আর এখন সময়ই পাই না পার করার মতো। বর্তমান যাপিত কর্মজীবনের সময়কে পার করার কোন মাধ্যমই পাই না। সকাল থেকে রাত কিভাবে সময় শেষ হয়ে যায় তার স্থির ব্যাখ্যা খুজে পাই না। তবু চলমান বাস্তবতার নিখুঁত বুননে সময়কে ধরে রাখা রপ্ত করি আপন মনে। তাই প্রাত্যহিক জীবনের কর্মভাবনা প্রকাশ পায় ‘কাজের ভিতর। কাজের ভিতর দিয়ে মানুষ তার পরিচয় খুঁজে। ‘মানুষেই সর্বশেষ মানুষই পরমেশ্বরে রূপ নেয়’।
প্রতিদিন ভোরে ফজর নামাজের পরেই শুরু হয় কর্মময় জীবনের পথ চলা। পরিবারের সদস্যদের জন্য নাস্তা তৈরী করা, বাচ্চাদের মসজিদে পাঠানো, মসজিদ থেকে ফিরলে প্রাইভেট টিউটরের কাছে পাঠানো, টিউটরের কাছ থেকে ফিরলে স্কুলে পাঠানোর প্রস্তুতি শুরু হয়। সবার কাজ ঠিক মত করার পর আসে নিজের পালা। কর্মস্থলে যাবার প্রস্তুতি।কর্মস্থল থেকে ফিরে পরিবারের সদস্যদের জন্য রান্না করা, সন্তানদের ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করা, তারা ফিরে আসলে তাদের খাওয়া দাওয়ার পর বিশ্রামের ব্যবস্থা করা।সন্ধ্যার পর পড়তে বসানো আবার রাতের খানার প্রস্তুতি এভাবে চলে সময়ের বৃত্তে ঘুর্ণায়মান জীবনের প্রতিটি কর্মব্যস্ত জীবন। সারা দিনের কর্মক্লান্ত শরীর নিয়ে যখন রাতে বিছানায় যাই তখন রাতের বাকী সময়টুকু যেন আর কাটতে চায় না। নির্ঘুম রাত কাটে প্রবাসী স্বামীর ফোনের অপেক্ষায়। যখন কাঙ্খিত ফোন আসে তখন জীবনের সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। সবাই বলে অপেক্ষার প্রহর নাকি দীর্ঘ হয়, আমার মনে হয় অপেক্ষার প্রহর জীবনে কখনো শেষ হয় না। অপেক্ষাতেই নাকি প্রেমের সম্পর্ক বেশী গাঢ় হয়। সে প্রেম শাশ্বত, দেহজ কামনা বাসনার বাইরে, শুধু শারীরিক প্রেম নয়। যা ব্যক্তিমানুষের শারীরিক বার্ধক্যের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিমনে হাহাকার আর আত্মসাধনার জন্মই দেয়। নশ্বর বিশ্বচরাচরে শরীরের মত প্রেমেও ক্ষয় আছে এবং সে ক্ষয় কালক্রমে অনুতাপ ও পাপবোধের জন্ম দেয়। যেটা কারো কাম্য নয়। প্রতিটি অপেক্ষমান বিরহী আত্মা প্রেমকে দেখে নারীর সহমর্মিতা, সমবেদনা, পুরুষের আত্মনিবেদনের ভেতর দিয়ে।
আমিও সেটার বাইরের কেউ নই। বরং যাপিত জীবনের যে সুবর্ণ সঞ্চয়, সেখানে যে বাঁক ও তার ঢেউ তাকে আমার জীবনের এক ক্রান্তিলগ্নে এসে উপলব্ধি করতে অনুপ্রাণিত হই যে, সময় এবং যৌবন আসলে মানবজীবনের এক পরাক্রমী ক্ষয়িষ্ণু অধ্যায়ের নাম। যেখানে তার অযত্ন ও অবহেলা সেখানে তার রুদ্রমূর্তি। যেখানে তার সযত্ন আসন পাতা সেখানে সে প্রাণবন্ত ও সৌন্দর্যের স্মারক। আসলে কোন বস্তু মানুষের কাছাকাছি থাকলে তার প্রয়োজনটা বুঝা যায় না। সে যখন দুরে থাকে তখন তার প্রয়োজনটা অতি জরুরী হয়ে পড়ে।
তখন স্মৃতিভারাতুর আপন যৌবনের বৈরীরূপ এসে সময়ের স্রোতে সমাহিত হয়, তখন সময়ের বৈরিতায় নিজের উত্তরাধিকারের ভেতর আপন রক্ত ছলকে উঠে; অথচ তাকেই আপন যৌবন কালের সমতলে ও সময়ের আহ্বানে তার প্রাজ্ঞমনের সম্মতি মেলে না। কাটে সম্মতির অপেক্ষায় অযাচিত বৈরী সময়। সময়ের প্রয়োজনে ব্যক্তিমানুষের মস্তিষ্কে যৌনকামনার বিপুল আলোড়নে আভিজাত্য, ঐতিহ্য পর্যন্ত বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। মানুষের বিশ্বাসের জগতের এক বিরাট অঞ্চল জুড়ে কামনা ও লাম্পট্যকে প্রায় অভিন্নার্থে গ্রহণ করে। একার্থক বিষয় নিয়ে মানুষের মনোজগতে কোন প্রকার ভাবনার অবস্থান্তর ঘটে না। সময়ই নাকি সব নিয়ন্ত্রন করে। তাই মানবসমাজের মত সময়ের আবর্তে অনুভূতিকে সযত্নে লালন করছি এবং নিজের ভেতর তার পরিচর্যা করছি নিরন্তর। জানিনা কবে এই সময়ের দায়ভার থেকে মুক্তি পাব। সময় যেন আমার সমস্ত সত্তা জুড়ে সঞ্চরণশীল ও ক্রিয়াশীল সম্ভ্রান্ত রোমান্টিক মানস এবং আধুনিকতার প্রশ্নে সদা প্রচ্ছন্ন। তাই নিজের জীবনোপলব্ধির অভিজ্ঞান থেকেই অপেক্ষার সময়কে ধারণ করে চলছি কর্মসাধনার ভিতর দিয়ে।
বুদ্ধদেব বসুর ‘দ্রৌপদীর শাড়ি’ কাব্যে সময় ভাবনায় নারীর একটি চিরন্তন রূপকে কল্পনা করেছেন। তিনি নারীর স্বাধীন সত্তাকে দৃঢ়চিত্তে প্রতিস্থাপন করেছেন যাতে কোন অপশক্তি, দুঃশাসন নারীর সম্ভ্রম ছিনিয়ে নিতে না পারে সেই সত্যই তিনি বিশেষ চিত্রকল্পের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন। যেটাকে ধারন করেই কাটে আমার অপেক্ষার সময়। যেন এভাবেই বয়ে যাবে সামনের অনাগত সময়……
যেন ইরাজ আহমেদ এর কাব্য ভাবনার মতে …
এভাবেই তার জন্য অপেক্ষা করতে হয়।
গভীর আঁধারে, এভাবেই একদম একা।
আগুনের মতো একা,
নিঃসঙ্গ রাত্রিতে বিভ্রান্ত পাখির ডানার মতো একা।
চোয়ালে, কপালে হেঁটে যায় মাকড়সার সারি।
চমকে সরিয়ে দিতে গিয়ে দেখি আসলে সময়।
একেকটা দিন বাতাসের গায়ে দাগ কাটে,
একেকটা দিন ছাইয়ের মতো জমা হয়ে থাকে,
নখের আড়াল থেকে ঝুর ঝুর করে পড়ে কবরের মাটি।
হাতের মুঠোয় ধরা শুকনো গোলাপ।
দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে আসে চোখ,
পুরনো ঘড়িটা হাই তোলে,
পাগলের মতো দুটো হাত তুলে আড়মোড়া ভাঙ্গে।
একশ বছর ধরে গাঢ় ঘুম,
ঘুম শেষ হয় কবে?
সময় ফুরিয়ে গেলে
এভাবেই তার জন্য অপেক্ষা করতে হয় গভীর আঁধারে
এভাবেই একদম একা।
*******************************
সালমা রহমান
তাং ০৬/০৪/২০১২
নিজ শয়নকক্ষ, জয়পাড়া, দোহার-ঢাকা।
loading...
loading...
সম্মানিত সালমা রহমান এর কলাম বা লিখন পূর্বে পড়ার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। যথেষ্ঠ ভালো লিখতেন। এই লিখাটি পড়েও বলছি … অসাধারণ লিখেছেন। এখন আর তেমন ভাবে তাঁর লিখা চোখে পরে না। তাঁর অনন্য বৈশিষ্ট হচ্ছে লিখার অনবদ্যতা।
প্রদায়ক হিসেবে আপনাকে ধন্যবাদ মি. হামিদুর রহমান পলাশ। শুভ সকাল।
loading...
জীবন যেন একাকীত্বের সঙ্গী। ভাল লেখা।
loading...
সালমা রহমান বেশ লিখেন।
loading...