ভুলেও_ভুল_করি_না
স্থান, কাল, পাত্র বলে একটা কথা আছে। সবাই সব স্থানে সবসময় সবকিছু করতে পারে না। আমি এমনই বোকা যে, এই কথাটা বুঝতে আমার এক’শ বছর লাগলো !
আমার বউয়ের পক্ষের এক আত্মীয়ের কথা বলি। সম্পর্কে আমি তাঁর জামাই হলেও বেচারা উল্টো আমাকেই শ্বশুর বলে ডাকতেন। শত সুখের ভিড়েও তাঁর মনে দুঃখের সীমা ছিলো না। তাঁর কষ্টের কথা তাঁর মুখ থেকেই শুনুন ;
– শ্বশুর, বলদটারে নিয়ে বড় বিপদে আছি, বলেনতো কি করি?
আমি কিছুই বুঝতে না পেরে বললাম, কার কথা বলছেন মামা ?
তাঁর মুখের মানচিত্র কিছুটা উঁচুনিচু মালভূমির আকার ধারন করলো। বিষাদ না কান্না বুঝা গেলো না। মুখ দিয়ে কিছু অস্পষ্ট উচ্চারণ। আমি যা বুঝলাম, তার অর্থ এরকম – তাঁর ছোট ছেলে লালন সকালে বিকালে লাল, নীল, হলুদ আচরণ করছে। দিনে দু’চারটি নালিশ আসে। শুধু তাই নয়, লালন ব্যাক্তিক, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় কোন শৃঙ্খলাই মানছে না।
আমি বললাম, মামা কোন চিন্তা নেই, লালনকে লালন পালন করার জন্যে শীগগির একটা সুন্দরী মেয়ে দেখে বিয়ে দিয়ে দিন। আলু পটলের মতো সাইজ হয়ে যাবে।
তিনি দু’চোখ বের করে আমার দিকে তাকালেন। আমি ভস্মীভূত হয়ে গেলাম। আমি সাথে সাথেই আমার কথা উঠিয়ে নিয়ে বললাম, মামা আর একটা বুদ্ধি আছে, ওরে বিদেশে পাঠিয়ে দেন।
যেই কথা সেইকাজ। মাস দুইয়ের মধ্যে লালন চলে গেল লন্ডন ( ইংল্যান্ড )।
বছরখানেক পরের কথা। পুরান থানার সেই পুরোনো রেইন ট্রি গাছের নিচে মামার সাথে দেখা। ভয়ে ভয়ে মাথা নিচু করে মামাকে সালাম দিলাম। মামা হাসিমুখে এগিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি কিছু বলার আগেই মুখ খুললেন – শ্বশুর, তুমিতো আচ্ছা দার্শনিক হে।
আমি ভাবলাম, আশ্চর্য! আমি দর্শন শাস্ত্রে মাস্টার্স করেছি, এটা মামা কি করে জানলেন? যাক, মামার সাথে কিছুক্ষণ কথা হলো। যা জানা গেলো তার সারমর্ম এই – লালন বিদেশে গিয়ে আমূল বদলে গেছে। সে নিজে রান্না করছে, নিজে ড্রাইভ করে অফিস করছে, ওভার টাইম করছে, শৃঙ্খলায় এওয়ার্ড পেয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি।
সেদিন রাতে বাসায় ফিরে আমার ঘুম আসে না। কেমন করে লালন নামের অসভ্যটা এমনটা সভ্য হলো? বিলেতিরা কি এমন মন্ত্র জানে ?
আমার এক বিলেতফেরত বন্ধু বলেছিলো, সেখানে নাকি রাস্তায়, মাঠে, ঘাটে, হোটেলে সব জায়গায় গোপন চোখ পাতা আছে। এমন জাল পাতা আছে, সে নিজের অজান্তে কোন অন্যায় করলেও ধরা পরবে। আবাক কান্ড – পুলিশ ঘুষ নেয় না। ঘরের দরজা খোলা, চুরি হয় না। গাড়িতে কিছু ফেলে আসলে অবলীলায় ফেরত আসে।
আমার কাছে কথাগুলো স্বপ্নের মতো মনে হয়েছিলো। আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো – আমরা কেন আমাদের ছেলেমেয়েদের মডেল হতে পারছি না ? কিছু শেখাতে পারছি না ? নাকি আমাদের দেশের আলো, বাতাস, পানি দূষিত হয়ে গেছে ? এত সমস্ত ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না।
ভাগ্যক্রমে ঘুমের মধ্যে লালনের সাথে দেখা হয়ে গেলো। বললাম – বলোতো লালন, কেন আমরা দেশের বাইরে গিয়ে দ্রুত বদলে যাই, দেশে পারি না ?
লালন বিজ্ঞের মতো হেসে যা উত্তর দিলো তার সারাংশ নিম্নরূপ –
• ওরা কাজকে সম্মান করে ও ভালোবাসে।
• কাউকে কোন উপদেশ দেয়ার আগে নিজে তা অনুশীলন করে।
• সবাই সবাইকে সহযোগিতা করে।
• ওখানে সময়োপযোগী আইন আছে এবং আইনের প্রয়োগ আছে । যিনি আইন / নিয়ম মানবেন না, তার কপালে দুঃখ আছে।
লালন বললো, তাইতো আমরাও কাজ করি, ভুলেও ভুল করি না।
loading...
loading...
আপনার লিখনির ধ্যান জ্ঞান স্বতন্ত্র। এমন ধাঁচের লিখায় শিক্ষার উপকরণ বিদ্যমান।
loading...