টোটকার সাতসতেরো

নিজের বউ বাদে সব মেয়েদেরই পরমা সুন্দরী বলে মনে হয়। না কোনো মহাপুরুষের বিশ্ব বিখ্যাত কোনো বাণী নয়। সাত বাই সতেরোর লিচুবাগান বাইলেনের আমার মুখরা সহধর্মিণীর মুখনিসৃত মুখরবাণী। বাণের মতো সোজা গিয়ে বেঁধে একেবারে মনের দূর্বলতম জায়গায়। সত্যি কথা বলতে কি, চোখদুটো ট্যারা না হলেও সুন্দরীদের টেরিয়ে দেখার বেগুনচেরা দৃষ্টিটুকু এখনো ততটা দুর্বল হয়ে পড়েনি। আর পড়েনি বলেই তবু রক্ষে। না হলে বড্ড বেশী বৌ নেওটা হয়ে পড়ার ষোলোআনা চান্স ছিল। তাতে বৌয়ের পায়াই ভারী হতো, আমার পায়ে শেকল পড়তো। তখন খাঁচার পাখির মতো বিলাপ করতে হতো, শকতি নাহি (ফুলে ফুলে) উড়িবার। না তাই বলে অস্থানে কুস্থানে, উড়ে বেড়ানোর মতো বুকের পাটাও সাত বাই সতেরোর বাইলেনে দেখানো সম্ভব ছিল না। কিন্তু তাই বলে শুধুই স্ত্রীধনে চোখে সর্ষেফুল দেখতে কে চায় আর!

রমলার সাথে প্রথম আলাপ ওদের বাড়িতে বিয়ের পাত্রী দেখতে গিয়েই। মাসতুতো দাদার জন্যে মেয়ে দেখতে গিয়ে আমার সেই টেড়িয়ে দেখাই কাল হলো। এখন বুঝি দাদার কপালই ভালো ছিল। নয়তো কার বৌ কার ঘরে। খবরটা প্রথম বড়মাসির কাছ থেকেই জানা যায়, কনেপক্ষ পাত্রের মাসতুতো ভাইয়ের সাথেই ঘটকালীতে বেশী আগ্রহী। বলাই বাহুল্য বড়মাসি তাতে বিরাট কিছু আহ্লাদিত হননি সেসময়। নিজের বোনের উপর অভিমানও করতে পারেননি, আবার বোনের কাল্পনিক সৌভাগ্যের কথা মনে করে মনে মনে যে ঈর্ষান্বিত হননি, সেকথাও বলা যায় না জোর করে। যাই হোক সাত বাই সতেরোর বাইলেনের সানাইয়ের ভেঁপুর এই হলো পূর্ব কথা।

তখন বয়স ছিল স্বপ্নীল। বিয়ে করা বৌয়ের সাথে ঘর করার অভিজ্ঞতাও শূন্য। দাম্পত্যসুখের ভ্যালিডিটি যে থাকে ঘরণীর তূণে, সে তথ্যও অজানা। ফলে মধুর বসন্ত এসেছে মধুর মিলন ঘটাতে বলেই মনে হয়েছিল, যদিদং হৃদয়ং মম আউরাতে গিয়ে। পুরুষের পক্ষে পরিণয়ের সূত্র যে কলুর বলদের সমগোত্রীয়, সেকথা স্ত্রীর গোত্ত্রান্তরের সময় কজনেরই বা খেয়াল থাকে! তাই সাত বাই সতেরোর বাইলেনে সেদিন নিজেকে যে শাহজাহান গোত্রীয় মনে হচ্ছিল, তাতে কোনো ভুল নেই।

কিন্তু ভুল ভাঙ্গল অচিরেই। রমলার পায়ের মলের মধুর ধ্বনী যে পরাধীনতার হৃৎকম্প ধরিয়ে দেবে কে জানত! উঠতে রমলা বসতে রমলা। প্রথম প্রথম গর্বের ছাতি বেলুনমুখী হলেও, তা চুপসে যেতে বেশী দেরী হয়নি। ভাগ্গিস শুতেও রমলা ছিল, নয়তো ভারসাম্যের অভাবে স্বভাব খারাপ হলেই পুরুষেরই দোষ! তা এভাবেই শ্রীমতি ভয়ঙ্করীকে নিয়ে মোটামুটি একটা সহাবস্থনের রুটিন চলছিল! কিন্তু ঐ, স্বভাব যায় না মলে, সেই সুন্দরীরমণী দেখলেই দৃষ্টি টেড়িয়ে যায়। আর ওখানেই রমলার যত খবরদারি। কি করে বোঝাই তাকে, ও যে সুন্দর তাই চেয়ে দেখি রুমু, সেকি মোর অপরাধ! তোমাকেও তো একদিন দেখেছিলাম সোনা! সেদিন ছিল না মনে?

না বিষয়টা মেয়েদের কাছে ঠিক মনে রাখা না রাখার বিষয় নয়। ছাদনাতলায় একবার বাগে পেলেই, ঐ যে সাতপাকে বেঁধে ফেলল, আর নিস্তার নেই। তখন আর খেয়াল থাকবে না, প্রথম দেখার দিন থেকে প্রেমে পটানোর যাবতীয় মেশিনারীগুলি একদিন ঠিক কি কি ছিল, স্বামী নামক অধুনা গৃহপালিত নির্জীব জীবটির! বিজ্ঞাপনের চমকে ভুলে জাঁকজমক করে বিয়ে করাটাও যে পুরুষের পক্ষে মেয়েদের রূপের ছটায় চোখ ওল্টানোই, সে কথাই বা কে আর মনে রাখছে? একবার সাতপাকের পাকে পাকে আটকে ফেলতে পারলেই! অর্থাৎ কিনা সেই চান্স ইন আ লাইফটাইম অপুরচুনিটির পর বাড়ির বাইরে বেরুলেই একেবারে ব্রহ্মচর্য্য! মাতৃবৎ পরদারেষু। উফ এক বঙ্কিমী মোক্ষম দাওয়াইতেই বঙ্গীয় প্রেমিককূলের অন্তেষ্টী সারা!

ভুলটা হয়েছিল আমারই, নতুন কেনা মোবাইল হ্যান্ডসেটে শখ করে মৌয়ের ছবিটাকেই দুদিনের জন্যে স্ক্রীনসেভার করাই কাল হল আমার। অতএব দুই আর দুইয়ে চার করতে বঙ্গললনাদের দুমিনিটও লাগার কথা নয়। লাগেওনি। কিন্তু জোর লেগেছিল আমার। জোরসে ঝটকা ধীরেসে লাগা নয়, ঝটকা অ্যায়সা লাগল যে সহাবস্থানের রুটিনের যাবতীয় ফাঁকফোঁকরে নজরদারির ফেবিকল সেঁটে গেল একেবারে, লাইফসেন্টেন্সের মতো। এরপরেরর সব সেন্টেন্সেরই টেন্স একটাই! নঃ ভূত নঃ ভবিষ্যৎ।

তোমার মোবাইলে মৌটুসীর ছবি কেন, সে কথা আমি বুঝি না ভেবেছো? কচি খুকি পাওনি আমাকে। না কচি খুকি আর পাব কি করে? একে তো নাবালিকা বিয়ে করা আইনত অসম্ভব, আহা মনে মনে এখন খুব আফসোসস হয় ঠাকুর্দার বাবার কালে কেন জন্মাইনি? বালিকাবধুর যুগেই সত্যিকারের মধুর বসন্ত আসত মধুর মিলন ঘটাতে। কবি না দেখেই কি আর অমনি লিখেছিলেন! যাই হোক আমাদের মত বিংশশতকীদের তো সে গুড়ে বালি, তাই কচি খুকি আর পাবো কোথায় সোনা? তারপর তোমার জন্মসাল? সেতো দেব নঃ জনান্তি! এযুগে তো ছাদনাতলায় ধারিদেরই দাপাদাপি। না এসব অপ্রিয় সত্য আর কে কানে তুলতে যাচ্ছে! দাম্পত্যের বয়ঃবৃদ্ধির সাথে সাথে মনে মনে কথা বলায় পারদর্শী হয়ে ওঠার যে কি অ্যাডভান্টেজ সে কথা পীড়িত পতিকুলের প্রতিনিধি মাত্রেই জানেন, তাই নতুন করে আর বলার কিছু নেই।

কিন্তু আমার সেই স্বভাব যায় না মলে। তাই ১৪২০-র চতুর্থ মাসের বিংশতি দিবসে মৌকে মানে মৌটুসীকে প্র্রথম দেখার সেই ম্যাজিক্যাল মোমেন্টসে সেই যে দুই চোখ টেড়িয়ে গেল, সে গেল তো গেলই। আর সোজা হল না। সোজা হবে কি করে, তুমি তো নাম্বার ওয়ান ৪২০! রমলার মুখ নিসৃত বাণী তেড়ে আসে। আর তার তোড়? সে আটাত্তরের বন্যা দেখার অভিজ্ঞতা যাদের আছে তারাই বুঝবেন। একেবারে বাঘে গরুতে এক ঘাটের জল খাইয়ে ছাড়বে, আমি তো কোন ছাড়! না তাই বলে আমারো দুচোখ ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। মৌয়ের সাথে দেখা হবে, আর তার রূপে দৃষ্টি নোঙর ফেলবে না তাই আবার হয় না কি? আর হতে যাবেই বা কেন? আমি তো আর কুরুক্ষেত্রের পিতামহ ভীষ্ম নই রে বাবা। আর ভীষ্মের শরশয্যায় একবার দুই এক পিস মৌটুসীর মতো মেয়েকে এনে দিলে কি হতো কুরুক্ষেত্রের গতি, ব্যাসদেবের কলম সে কথা লিখে যাবার মতো কালি খুঁজে পায়নি নিশ্চয়, সে যুগে। সে না পাক, কিন্তু আমার সদ্য পাক ধরতে থাকা চুলেও যে মধুর বসন্ত আবার উঁকি দেবে না সে কথা হলফ করে বলতে পারি না, মৌটুসীকে দেখার পর।

মৌ, মৌটুসী-রমলারই জ্যাঠতুতো দিদি সুরধ্বনী-র খুড়তুতো ননদ অঙ্গীরা-র মাসতুতো ভাসুর রমাপদ-র পিসতুতো শালী মাধবীলতার একমাত্র কন্যা! রমলার মতে যথেষ্টই নিকট আত্মীয়তার সম্পর্ক! এটাই নাকি ওদের পারিবারিক ঐতিহ্য, আমাদের মতো বাবা মা আর এক আধটা ভাইবোনের ছোট পরিসরের পারিবারিক সংস্কৃতি না কি ওদের নয়! তো রমালার সেই পরম নিকট আত্মীয় মাধবীলতাদিই নাকি কিভাবে রমলার হদিশ বার করেছিলেন, সে কথা তিনিই বলতে পারবেন। মোদ্দা কথা বিয়ের এক যুগ পর এই প্রথম মৌটুসীরা কলকাতায় আসছে মৌকর্তার নতুন চাকুরীর সূত্রে। আজন্ম প্রবাসী এই দম্পতির জন্যে তাই একটা বাসযোগ্য মাথা গোঁজার ঠাঁই জোগার করে দেবার ভার পড়েছিল সাত বাই সতেরোর রমলাপতির ওপরেই। বলাই বাহুল্য আপন স্ত্রীরত্নের এমন নিকট আত্মীয়তার পারিবারিক ঐতিহ্যের মুন্ডুপাত করতে করতেই আচম্বিতে- মেঘ না চাইতেই জল! ১৪২০র চতুর্থ মাসের বিংশতিতম দিবসে মৌদর্শন!

আমি কবি নই। সাহিত্যিকও নই তাই প্রথম দেখার সেই অনুপম লগ্নের বর্ণনা দেওয়া সাত বাই সতেরোর কানাগলি থেকে সম্ভবই নয়। তাই সে পথও মারাবো না। শুধু বলব রমলার সেই সাত বাই সতেরোর বাইলেনের বিখ্যাত বাণী, নিজের বৌ বাদে সব মেয়েদেরই পরমা সুন্দরী বলে মনে হয়; হয়তো সব বৌ-রাই তাদের স্বামী সম্বন্ধে বলে থাকে। হয়তো ইহাই নারীধর্ম! তা সে রমলা যাই বলুক, নতুন কেনা মোবাইলে মৌয়ের ছবি টাঙানো রমালাপতির চরিত্রের দোষ না নান্দনিক সৌন্দর্যবোধের প্রকাশ সে বিচারের ভার অন্তর্যামীর হাতেই থাক, আপাতত গৃহযুদ্ধ মোকাবিলা করাই প্রধান সমস্যা- সাত বাই সতেরোর লিচুবাগান বাইলেনে!

রমলার কড়া শাসনে পঁচাত্তরের ইন্দিরা গান্ধীর মুখটা মনে পরে যেতেই পারে, সে যুগের সরকারী কর্মচারীদের স্মৃতিরোমন্থনে! অগত্যা গৃহ শান্তিস্বস্তয়নার্থে মোবাইল পরিষেবা বন্ধ! বন্ধ অন্তর্জালের মায়াবী জগতের অশরীরী চলাফেরা। পুরাকালের রাজাদের সভাকবির মতো তাই আমায় রমলাবন্দনা পরিষেবা চালু করতে হলো আবার নতুন করে। পীড়িত পতিকুলের প্রতিনিধিরা আমার এই টোটকাটি প্রয়োগ করে দেখতে পারেন, ফল হাতে হাতে না পেলেও ঠিক মতো ধৈর্য্য ধরে থাকতে পারলে বিফল হবেন না আদৌ, এ কথা হলপ করেই বলতে পারি। দাদ হাজা চুলকানির মতোই হয়তো একেবারে নিরাময় সম্ভব নয়, কিন্তু যখন তখন গৃহশান্তিস্বস্তয়নের ব্যাপারে এই টোটকা আপনাকে কখনোই ঠকাবে না! এটা প্রমানিত সত্য। চোখ বুঁজে ভরসা করতে পারেন। আর সুসময় এলে চোখ খুলে দেখতে পাবেন, বন্ধ ফাঁকফোঁকর গুলি আবার সদন্ত্যহাসিতে আপনাকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে হয়তো!

শ্রীশুভ্র

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৪ টি মন্তব্য (লেখকের ২টি) | ২ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ১৬-১০-২০১৭ | ৭:২৬ |

    লিখাটি পড়লাম। কী অসাধারণ ভাবেই না দাম্পত্যের গল্প উপহার দিয়েছেন !! মুগ্ধপাঠ। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • শ্রী শুভ্র : ১৭-১০-২০১৭ | ২১:১১ |

      অনেক ধন্যবাদ আপনাকেও।

      GD Star Rating
      loading...
  2. রিয়া রিয়া : ১৬-১০-২০১৭ | ১৩:০৮ |

    সত্যই। মুগ্ধ হবার মতো লেখা দাদা।

    GD Star Rating
    loading...
    • শ্রী শুভ্র : ১৭-১০-২০১৭ | ২১:১০ |

      ধন্যবাদ রিয়া। তুমি পড়েছো জেনে খুশি হলাম।

      GD Star Rating
      loading...